You are currently viewing মহাভারতের যুদ্ধের সেরা ১০ জন যোদ্ধা কারা? এবং এদের মধ্যেই বা কে শ্রেষ্ঠ?

মহাভারতের যুদ্ধের সেরা ১০ জন যোদ্ধা কারা? এবং এদের মধ্যেই বা কে শ্রেষ্ঠ?

আপনি কি জানেন মহাভারতের যুদ্ধ কাদের মধ্যে সংঘটিত হয়েছিল? অনেকেই বলবেন কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে। কিন্তু আসল ব্যাপার হচ্ছে, মহাভারতের যুদ্ধের দুই পক্ষের একটি পক্ষে ছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং অপর পক্ষে ছিলেন মামা শকুনি। বাকি সবাই তো তাঁদের খেলার পুতুল মাত্র। আচ্ছা, মহাভারতের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা কে, এটা নিশ্চই আপনাদের অজানা নয়। হ্যাঁ, তিনি স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, অনাদির আদি গোবিন্দ সর্বকারন কারনম। তাঁর সামান্য চোখের ঈশারায় কুরুক্ষেত্র তো সামান্য ব্যাপার, সম্পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডে প্রলয় নেমে আসতে বাধ্য। তাই আমাদের আজকের আয়োজন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ব্যাতীত কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ১০ জন সেরা যোদ্ধাকে নিয়ে। আর এ তালিকায় রয়েছেন মহামহিম ভীষ্ম ,কর্ণ ,অর্জুন, গুরু দ্রোণ ,ভীম, অশ্বত্থামা, ঘটৎকচ, দুর্যোধনসহ কুরু ও পাণ্ডবপক্ষের সব রথী মহারথী যোদ্ধারা। তো চলুন দর্শক জেনে নেওয়া যাক, বাহুবল, ধনুর্বিদ্যা, দিব্য অস্ত্র, যুদ্ধের দক্ষতা, সততা ও নীতি, এবং প্রজ্ঞার বিচারে সেই ১০ জন সেরা যোদ্ধা কারা এবং এদের মধ্যেই বা কে শ্রেষ্ঠ। এবং আপনার বিচারে মহাভারতের সেরা ১০ জন যোদ্ধা কারা তা অবশ্যই কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না।

১০. দুর্যোধন

মানব জাতির ইতিহাসের বৃহত্তম যুদ্ধের কারন ছিলেন আসুরিক প্রবৃত্তি সম্পন্ন যোদ্ধা দুর্যোধন। পিতা ধৃতরাষ্ট্র ও মাতা গান্ধারীর জ্যেষ্ঠ্য পুত্র দুর্যোধন কপট কৌশল প্রয়োগ ও যুদ্ধবিদ্যা দুইদিকেই ছিলেন নিপুন। কূট কৌশলে পাণ্ডবদেরকে ভূমিচ্যূত করা, পাশা খেলায় হারিয়ে বনবাসে পাঠানো, দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ ইত্যাদি কাজ থেকে শুরু করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকেও গ্রেপ্তার করার পরিকল্পনা করেছিলেন কূটবুদ্ধিসম্পন্ন দুর্যোধন। তবে কূটনীতির পাশাপাশি রণনীতি ও রণদক্ষতায়ও দুর্যোধনের জুড়ি মেলা ভার ছিল। দুর্যোধন শব্দের অর্থ ‘যার সাথে যুদ্ধ করা দুষ্কর’। ধনুর্বিদ্যা, দিব্যাস্ত্র প্রয়োগে সক্ষমতা, সততা, নীতি এবং প্রজ্ঞার দিক দিয়ে বিচার করলে দুর্যোধনের যোগ্যতার দৌড় খুব বেশীদুর নয়। কিন্তু বাহুবল ও গদাযুদ্ধে দুর্যোধন ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। গদাযুদ্ধে তাঁর সমান বীর যোদ্ধা আর কেউই ছিল না কুরুক্ষেত্রের ময়দানে। পাণ্ডবদেরকে ১২ বছরের বনবাস ও ১ বছরের অজ্ঞাতবাসে পাঠিয়ে এই ১৩ বছর বলরামের কাছে গদাযুদ্ধ শিক্ষা করেন দুর্যোধন। আর এ কারনে তিনি ভীমের চেয়ে অধিকতর দক্ষ ও ক্ষিপ্রতা সম্পন্ন গদাযোদ্ধা ছিলেন। বলা হয় তাঁর গদা ছিল অর্জুনের গাণ্ডীবের মতই শক্তিশালী। মহাভারতের যুদ্ধের ১৮তম দিনে ভীমসেন যখন কিছুতেই দুর্যোধনকে গদাযুদ্ধে পরাজিত করতে পারছিলেন না এবং উল্টো নিজেই দুর্যোধনের হাতে পরাস্ত হওয়ার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বুঝতে পেরেছিলেন গত ১৩ বছরে দাদা বলরামের কাছ থেকে গদাযুদ্ধ শিক্ষা করে গদাচালনার যোগ্যতায় ভীমকে বহু আগেই ছাড়িয়ে গেছেন দুর্যোধন। আর তাই কোন বৈধ উপায়ে ভীম কর্তৃক দুর্যোধনকে পরাজিত করা অসম্ভব। কিন্তু পাপীর বিনাশ করার জন্য কূট কৌশল প্রয়োগে কোন পাপ নেই। তাই শ্রীকৃষ্ণের ইঙ্গিতে দুর্যোধনের জঙ্ঘায় আঘাত করে তাঁকে ভূপাতিত ও নিহত করেন ভীম।

দুর্যোধন
দুর্যোধন

০৯. সাত্যকি

মহাভারতের মহাবীর যোদ্ধাদের অনেকের বীরত্বের কথা চাপা পড়ে গিয়েছে অন্যান্য যোদ্ধাদের পরাক্রমের আড়ালে। যদুবংশীয় মহাপরাক্রমশালী যোদ্ধা সাত্যকি বা যুযুধান ছিলেন ঠিক তেমনই এক যোদ্ধা। অর্জুন ও অভিমন্যুর পরে সাত্যকিই ছিলেন পাণ্ডবপক্ষের সবচেয়ে সামর্থ্যবান ধণুর্ধর। প্রথম জীবনে তিনি দ্রোনাচার্যের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করেছিলেন বটে, তবে ইন্দ্রপ্রস্থ স্থাপিত হওয়ার পরে আর্যাবর্তের অন্যান্য রাজকুমারদের সাথে তিনিও অর্জুনের কাছ থেকে অস্ত্রশিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। মূলত অর্জুনের কাছ থেকেই তিনি ধণুর্বিদ্যার উচ্চতর কৌশলগুলো তথা বিভিন্ন দিব্যাস্ত্র প্রয়োগের কৌশল রপ্ত করেছিলেন। তাই অর্জুনের প্রিয় শিষ্য এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পরম ভক্ত হওয়ার সুবাদে তিনি বলরামের মতকে উপেক্ষা করে পাণ্ডব পক্ষে যোগদান করেছিলেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে পাণ্ডবদের জয়ের জন্য এক বিরাট অবদান রেখেছিলেন সাত্যকি। তিনি দুই দুইবার মহামহিম ভীষ্মকে যুদ্ধের ময়দানে পিছু হঠতে বাধ্য করেছিলেন এবং ১০ হাজার রথী যোদ্ধাকে সাত্যকী একাই বধ করেছিলেন। অশ্বত্থমার সাথে যুদ্ধে তিনি এতটাই ভয়ংকর প্রহার করেছিলেন যে অশত্থামার মত মহা বীরও কিছুক্ষণের জন্য নিজের বিচার বুদ্ধি হারিয়ে ফেলেছিলেন। পুত্র অশ্বত্থামাকে বিহ্বল অবস্থায় দেখে গুরু দ্রোণ ছুটে গিয়েছিলেন তাঁকে রক্ষা করার জন্য। এসময় সাত্যকী গুরু দ্রোণাচার্যকেও আহত করে দিয়েছিলেন। তাছাড়া কৃপাচার্য ও কৃতবর্মাসহ বহু রথী মহারথীকে পরাস্ত ও বধ করেছিলেন সাত্যকি। যুদ্ধের ময়দানে দুর্যোধন, দুঃশাসন, শকুনি, চিত্রসেন আর দুর্মুখকেও তিনি একাই পরাজিত করেছিলেন। এছাড়াও দুর্যোধন ও দুঃশাসনের নেতৃত্বে পরিচালিত একটি প্রকাণ্ড সামরিক আক্রমণ তিনি একাই প্রতিহত করে দিয়েছিলেন। দ্রোণাচার্যের ভীষন আক্রমন থেকে পাণ্ডবদের শ্যালক ও সেনাপতি ধৃষ্টদ্যুম্নকেও প্রাণে রক্ষা করেছিলেন তিনি। সেসময় তিনি দ্রোণের উপর প্রবল শরবর্ষণ করে তাঁকে রক্তস্নাত করে দিয়েছিলেন।

সাত্যকি
সাত্যকি

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ১৪তম দিনে অর্জুন যখন সূর্যাস্তের আগেই জয়দ্রথকে বধ করার প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, তখন অর্জুন সাত্যকীকে দায়ীত্ব দিয়েছিলেন মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে রক্ষা করার জন্য। সাত্যকী কতটা যোগ্য ছিলেন তা তাঁর প্রতি অর্জুনের দায়ীত্ব অর্পণ দেখেই বোঝা যায়। তিনি দ্রোণাচার্য কর্তৃক যুধিষ্ঠিরকে বন্দী করার পরিকল্পনা ব্যার্থ করে দিয়েছিলেন। এমনকি তিনি দ্রোণাচার্যের প্রয়োগকৃত শক্তিশালী সব দিব্যাস্ত্রকেও প্রতিহত করে দিয়েছিলেন। ভগদত্তের সাথে যুদ্ধে তিনি তাঁকে প্রবলভাবে আঘাত করেছিলেন এবং ভগদত্তের প্রয়োগকৃত প্রত্যেকটি দিব্যাস্ত্র প্রতিহত করেছিলেন। সেসময় দূর্যধনের ভ্রাতারা এসে সাত্যকীর হাত থেকে ভগদত্তকে রক্ষা করেন। প্রবল পরাক্রমশালী এই যোদ্ধা কর্ণের পুত্র বৃষসেনকে পরাজিত করেছিলেন এবং ভীমের প্রতিজ্ঞা যাতে ভঙ্গ না হয় তাই দুঃশাসনকে পরাস্ত করেও তাঁকে প্রাণদান করেছিলেন। যুদ্ধ শেষে পাণ্ডবপক্ষের জীবিত ব্যাক্তিদের মধ্যে তিনিও ছিলেন একজন। এবং কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ৩৬ বছর পরে যদুবংশ নির্বংশ হওয়ার সময় তিনিও প্রাণত্যাগ করেন।

০৮. ঘটৎকচ

ভীমসেন ও তাঁর রাক্ষসী স্ত্রী হিড়ীম্বার পুত্র ছিলেন ঘটৎকচ। তাই স্বাভাবিকভাবে নিজের পৃতব্য তথা পাণ্ডবদের পক্ষে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন তিনি। শক্তির দিক দিয়ে বিবেচনা করলে তিনি তাঁর পিতা ভীমের প্রায় সমকক্ষই ছিলেন বলা চলে। রাক্ষস হওয়ার সুবাদে তিনি ছিলেন মায়াবিদ্যায় পারদর্শী এবং পরিস্থিতি অনুসারে তিনি নিজের শরীরকে অতিকায়, ক্ষুদ্রকায় বা অদৃশ্য করে ফেলতে পারতেন। প্রয়োজন অনুসারে তিনি শূন্যে উড়ন্ত অবস্থায়ও যুদ্ধ করতে পারতেন। তাছাড়া পাহাড় কিংবা মেঘের আড়াল থেকে ধণুর্বাণ ও রাক্ষস সেনাদের নিক্ষেপ করেও তিনি তাঁর মায়াবিদ্যার চূড়ান্ত রূপ প্রয়োগ প্রদর্শন করেছিলেন। এসকল কারনে ঘটৎকচ ছিলেন পাণ্ডবপক্ষের একজন মহারথ যিনি কৌরবদের বিপক্ষে বিপুল ধ্বংসযজ্ঞ পরিচালনা করেছিলেন। তাঁর আক্রমণ এতটাই ভয়ংকর ও বিধ্বংসী ছিল যে ঘটৎকচের ভয়ে কৌরব শিবিরে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছিল।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ৮ম দিনে রাক্ষস অলম্বুষ কর্তৃক অর্জুনপুত্র ইরাবনের মৃত্যু হলে ক্ষোভে ফুসে ওঠেন ঘতৎকচ। সেদিন তাঁর তীব্র গর্জনে বারংবার কেপে উঠেছিল কুরুক্ষেত্রের মাটি। ঘটৎকচ দ্বারা সৃষ্ট এই বিভীষিকা দেখে আতঙ্ককে পালাতে শুরু করেছিলেন কৌরবপক্ষের যোদ্ধারা। সেসময় দুর্যোধন ঘটৎকচকে বাঁধা দিতে এগিয়ে এলে তিনি তাঁকে পরাজিত করেন। পরবর্তীতে দুর্যোধনকে সাহায্য করতে গুরু দ্রোণ এগিয়ে আসলে তিনিও ঘটৎকচের কাছে পরাজিত হন। এসময় ভগদত্ত এসে ঘটৎকচের সাথে কৌরব বাহিনীর যুদ্ধে সমতা আনেন। যদিও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ৪র্থ দিনে ঘটৎকচের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন ভগদত্ত।

ঘটৎকচ
ঘটৎকচ

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ১৪তম দিনটি ছিল ঘটৎকচের বীরত্বপূর্ণ দিন এবং এই দিনেই তিনি বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছিলেন। এদিন অশ্বত্থামার সাথে তুমুল যুদ্ধে রত হন ঘটৎকচ। যুদ্ধের এক পর্যায়ে অশ্বত্থামার কাছে পরাজিত হন ঘটৎকচ, এসময় ধৃষ্টদ্যুম্ন এসে তাঁকে রক্ষা করেন। পরবর্তীতে শ্রীকৃষ্ণ ঘটৎকচকে পাঠিয়েছিলেন কর্ণকে আক্রমণ করার জন্য। কিন্তু এসময় তাঁর পথরোধ করে রাক্ষস অলম্বুষ। ঘটৎকচ ও অলম্বুষের মধ্যে দীর্ঘ অস্ত্র যুদ্ধের পর শুরু হয় মল্ল যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ঘটৎকচ মহাশক্তিশালী অলম্বুষকে বধ করেন এবং তাঁর ছিন্ন মস্তক দুর্যোধনের রথে ছুড়ে দিয়েছিলেন।

আরও পড়ুনঃ  রামায়ণের শহরগুলো / স্থানসমূহ এখন কোথায়? Present Locations of Cities Mentioned in Ramayana

এরপর পরই ঘটৎকচ কর্ণকে আক্রমণ করেন। তিনি কর্ণের উপরে এত প্রচণ্ড প্রহার করেছিলেন যে, মহাভারতের এই অন্যতম শ্রেষ্ঠ যোদ্ধাও দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলেন। ঘটৎকচকে বধ করতে প্রাণপন চেষ্টা করেছিলেন কর্ণও। কিন্তু তাঁর সকল অস্ত্র নিষ্প্রভ হয়ে গিয়েছিল ঘটৎকচের সামনে। অবশেষে ঘটৎকচের হাত থেকে নিজের প্রাণ বাচানোর আর একটি মাত্র উপায় বাকী ছিল কর্ণের হাতে। আর তা হল ইন্দ্রদেবের কাছ থেকে প্রাপ্ত বাসবী শক্তি অস্ত্র। এই অব্যর্থ অস্ত্রটি কর্ণ বাঁচিয়ে রেখেছিলেন অর্জুনকে বধ করার জন্য। কিন্তু কোন উপায় না দেখে সেই বাসবী শক্তি অস্ত্র দিয়েই তিনি বধ করেছিলেন ঘটৎকচকে। বাসবী শক্তি বিদ্ধ হয়ে ভূপাতিত হওয়ার সময় ঘটৎকচের শরীরের নিচে পিষ্ঠ হয়ে প্রায় এক অক্ষৌহিণী কৌরব সেনা নিহত হয়েছিলেন।

০৭. ভীম

পবনদেবের আশির্বাদে কুন্তী ও পাণ্ডু যে মহাবলশালী পুত্র লাভ করেছিলেন তিনিই হলেন দ্বিতীয় পাণ্ডব ভীম। দশ হাজার হাতির শক্তিসম্পন্ন এই যোদ্ধা একাই ধৃতরাষ্ট্রের এক শত পুত্রকে বধ করেছিলেন। বলা হয় ভীমের সমান বলশালী ব্যাক্তি পৃথিবীতে আর মাত্র চারজন ছিলেন। তাঁরা হচ্ছেন দুর্যোধন, বকাসুর, কীচক, এবং জরাসন্ধ। এবং কাকতালীয় হলেও সত্য যে বাকী চারজনকেই বধ করেছিলেন ভীম। অর্জুন, কর্ণ বা অশ্বত্থামার মত ভীমের কাছে কোন ঐশ্বরিক শক্তিসম্পন্ন দিব্যাস্ত্র ছিল না। কিন্তু শুধুমাত্র নিজের বাহুবল দিয়েই মহাভারতের অন্যতম সেরা যোদ্ধা হিসেবে নিজেকে প্রমান করেছিলন ভীমসেন। ১৮ দিনের কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে প্রায় প্রতিদিনই ভীম তাঁর অসীম বীরত্ব প্রদর্শন করেছিলেন। ভীমসেনকে গদাধারী ও মল্লযোদ্ধা হিসেবে দেখা গেলেও তীরন্দাজীতেও তাঁর দক্ষতা ছিল অসামান্য। যুদ্ধের ময়দানে গুরু দ্রোণ, পিতামহ ভীষ্ম, কর্ণ, শল্য, কৃতবর্মা এবং দুর্যোধনের মত অতিরথী – মহারথীদেরকেও পরাজিত করেছিলেন ভীম।

ভীম এবং দুর্যোধন দু’জনেই অত্যন্ত উগ্র মস্তিষ্কের হওয়ায় দ্রোণাচার্য তাঁদের ওপর পুরোপুরি আস্থা রাখতে পারেননি। এজন্য এই দু’জন অত্যন্ত শক্তিশালী যোদ্ধা হওয়া সত্ত্বেও তিনি এঁদের হাতে ব্রহ্মাস্ত্র বা ঐন্দ্রাস্ত্রের মতো কোনো ধ্বংসাত্মক দিব্যাস্ত্র তুলে দেননি। দিব্যাস্ত্র বলতে ভীমের কাছে ছিল পিতা পবনদেবের দেওয়া বায়বীয় ধনুক ও মায়াসুরের দেওয়া গদা। এবং এগুলো দিয়েই কৌরবপক্ষের চুড়ান্ত সর্বনাশ করে দিয়েছিলেন তিনি। এবার ভেবে দেখুন ভীমের কাছে যদি দিব্যাস্ত্রের জ্ঞান থাকত তাহলে হয়ত পাণ্ডবপক্ষে অন্য কোন যোদ্ধার যুদ্ধ করার প্রয়োজনই পড়ত না। যাইহোক, ১৮ দিন ব্যাপী প্রচণ্ড ক্ষিপ্রতার সাথে অগণিত শত্রুকে সংহার করেছিলেন ভীম। এবং ১৮তম দিনে দুর্যোধনকে বধের মাধ্যমে তিনিই ইতি টেনে দিয়েছিলেন  মহাভারতের যুদ্ধের।

ভীম
ভীম

০৬. অভিমন্যু

শ্রীকৃষ্ণ তাঁর প্রিয় ভগিনী সুভদ্রাকে বিবাহ দিয়েছিলেন তারই মিত্র অর্জুনের সাথে। এবং অর্জুন ও সুভদ্রার ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন কুরুক্ষেত্রের আরও এক মহারথী, অভিমন্যু। মাত্র ১৬ বছর বয়সের এই বিষ্ময় বালক কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যে বিপুল পরাক্রম, সাহসিকতা এবং যোগ্যতার প্রদর্শন করেছিলেন তা বেশীরভাগ রথী মহারথীরাও দেখাতে পারেনি। এমনকি এই বালকের বীরত্ত্বের কাছে কর্ণ, দ্রোণ, এবং ভীষ্মের সামর্থ্যও নিষ্প্রভ হয়ে যায়। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ১৩তম দিন পর্যন্ত বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে অগণিত শত্রুকে বধ করেছিলেন বালক অভিমন্যু। তাছাড়া তাঁর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন  দ্রোণ, শল্য, কর্ণ, কৃপাচার্য, অশ্বত্থামা, দুর্যোধন, অলম্বুষ, বিকর্ণ ও চিত্রসেনের মত বাঘা বাঘা কৌরব যোদ্ধারা। তাঁর হাতেই বধিত হয়েছিলেন দুর্যোধনের পুত্র, শল্যের পুত্র ও ভ্রাতা এবং কৃতবর্মার পুত্র প্রমূখ বীর যোদ্ধা গণ।

যুদ্ধের ১৩ তম দিনটি ছিল অভিমন্যুর দিন। এদিনেই তিনি প্রদর্শন করেছিলেন পিতার মত বিক্রম, লাভ করেছিলেন শাশ্বত মর্যাদা এবং মহাসম্মানের মৃত্যু। সেদিন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অর্জুনের অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে দ্রোণাচার্য রচনা করেছিলেন এক ভয়ংকর ও শক্তিশালী ব্যূহ, চক্রব্যূহ। পাণ্ডব সেনাদের মধ্যে একমাত্র মহাবীর অর্জুনই এই ব্যূহ ভেদ করার ক্ষমতা রাখতেন। তবে অর্জুনের প্রিয় পুত্র অভিমন্যু মাতৃগর্ভে থাকাবস্থায় চক্রব্যূহে প্রবেশ করার বিদ্যা রপ্ত করেছিলেন। তবে তিনি জানতেন না কিভাবে এই ব্যূহ থেকে বের হয়ে আসতে হয়। তবুও নিজের আসন্ন মৃত্যু জেনেও বালক অভিমন্যু ঢুকে পড়েছিলেন চক্রব্যূহে। সেদিন ক্ষাত্রতেজের চূড়ান্ত উদাহরণ প্রদর্শন করেছিলেন অভিমন্যু। তাঁর বিক্রমে কৌরবপক্ষের বহু যোদ্ধা বধিত হলেন এবং অগণিত যোদ্ধারা পালিয়ে বাচলেন। এমনকি সেদিন কর্ণ, দ্রোণ, এবং দুর্যোধনও অভিমন্যুর পরাক্রমে ভীত হয়ে পড়েন। অভিমন্যুর প্রবল শরবর্ষণে প্রলয়ের দামামা বেজে উঠল কুরুক্ষেত্রের ময়দানে। তখন কৌরব পক্ষ আর কোন উপায় না পেয়ে সপ্তরথী একসাথে আক্রমণ করেছিলেন অভিমন্যুর উপর। এই সপ্তরথী ছিলেন  দ্রোণাচার্য, কৃপাচার্য, কর্ণ, শকুনি, দুর্যোধন, দুঃশাসন, এবং অশ্বত্থামা। এবং এদের সম্মিলিত আক্রমণে বীরগতি প্রাপ্ত হন অর্জুনের বীরপুত্র অভিমন্যু। মাত্র ১৬ বছরের এক বালককে হত্যা করতে যখন সপ্তরথীর প্রয়োজন পড়ে তখন কাররোরই আর বুঝতে বাকি থাকে না যে, অভিমন্যু কত বড় মাপের যোদ্ধা ছিলেন।

অভিমন্যু
অভিমন্যু

০৫. ভগদত্ত

মহাভারতের যুদ্ধের এক অশ্রুত মহাবীর ছিলেন ভগদত্ত। সেযুগে ভগদত্ত ছিলেন প্রাগজ্যোতিষপুরের রাজা, নরকাসুরের পুত্র এবং সম্পর্কে দূর্যোধনের শ্বশুর। যোদ্ধাদের মর্যাদাক্রম অনুসারে তিনি ছিলেন মহারথী শ্রেণির যোদ্ধা। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক তাঁর পিতা নরকাসুর নিহত হওয়ার ফলে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তিনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিপক্ষে তথা কৌরব পক্ষে যুদ্ধ করেছিলেন। ভগদত্তের বিশেষত্ত্ব ছিল তিনি রণহস্তীর পীঠে চড়ে নিপুনভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করতে পারতেন। এবং কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ময়দানেও হাতীর পিঠে চড়ে পণ্ডবদের বিরুদ্ধে অপরিমিত ত্রাসের সঞ্চার করেছিলেন তিনি। যুদ্ধক্ষেত্রে তিনি যে রণহস্তীটি ব্যাবহার করেছিলেন তাঁর নাম সুপ্রতীক। এই সুপ্রতীক ছিল অষ্ট দিগগজের মধ্যে অন্যতম। তাছাড়া সুপ্রতীকের শরীর ছিল পর্বতের মত বিশাল এবং তাঁর সারা শরীর ছিল স্বর্ণের বর্ম দ্বারা আচ্ছাদিত। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ময়দানে সুপ্রতীক যে স্থান দিয়ে গমন করত সেখানকার সবকিছুকেই পিষ্ট করে দিত সে। ভগদত্ত এই সুপ্রতীকের সাহায্যে পাণ্ডবদের অগণিত যোদ্ধাকে বিনাশ করে দিয়েছিলেন। তাছাড়া সুপ্রতীককে ডিঙিয়ে তাঁর পীঠের উপরে বসে থাকা ভগদত্তকে স্পর্শ করাও এক প্রকার অসম্ভব কার্য ছিল পাণ্ডবদের পক্ষে।

মহাভারতের যুদ্ধের ৮ম দিনে ঘটৎকচ যখন তাঁর ভ্রমাত্মক মায়া দ্বারা কৌরব সেনাদের মধ্যে ত্রাস সৃষ্টি করছিলেন, তখন ভীষ্মের নির্দেশে ভগদত্ত এগিয়ে এলেন ঘটৎকচকে রুখে দিতে। ভগদত্তকে দেখে অভিমন্যুও এগিয়ে এসেছিলেন তাঁর সাথে যুদ্ধ করতে। ঘটৎকচ ও অভিমন্যুর নিক্ষেপিত লক্ষ লক্ষ বাণ কে লক্ষ্যচ্যুত করে দিয়েছিল ভ্রাম্যমান পর্বতের মত হস্তি সুপ্রতীক।  সেদিন ভগদত্ত একাই পরাজিত করেছিলেন ঘটৎকচ ও অভিমন্যুর মত দুই প্রধান পাণ্ডব যোদ্ধাকে।

ভগদত্ত
ভগদত্ত

যুদ্ধের ১২ তম দিনে ভীম ও ভগদত্তের মধ্যে শুরু হয় যুদ্ধ। কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে ভীমের রথ ছিন্ন ভিন্ন করে রথের সারথী ও অশ্বগুলোকেও বধ করে সুপ্রতীক। সুপ্রতীকের শরীর বেয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করলে সুপ্রতীক ভীমকে আছাড় দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয় এবং পদপিষ্ট করতে থাকে। সেদিন মারাত্মকভাবে আহত হলেও প্রাণে বেচে গিয়েছিলেন ভীম। তবে এটি ছিল কুরুক্ষেত্রের ময়দানে ভীমের সবচেয়ে ঝুকিপূর্ণ পরাজয়।

সেদিনই ভগদত্ত আবার মুখোমুখি হন পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ অর্জুনের। অর্জুনের ভাণ্ডার যেমন দিব্যাস্ত্র এবং ঐশী অস্ত্রে পূর্ণ ছিল, অসুরপুত্র ভগদত্তের অস্ত্র ভাণ্ডারেও কম কিছু ছিল না। তবে অর্জুনের সাথে যুদ্ধে আস্তে আস্তে পরাজয়ের দিকে যেতে থাকেন ভগদত্ত। এরপর একসময় আর উপায় না দেখে তিনি অর্জুনের উপর অপ্রতিরোধ্য বৈষ্ণবাস্ত্র নিক্ষেপ করেছিলেন । এই অস্ত্রের বিশেষত্ব হলো এর আঘাত কেবল ভগবান বিষ্ণুই সহ্য করতে পারেন, আর কেউ নন। তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বৈষ্ণাবাস্ত্রকে নিজ বক্ষে ধারণ করে অর্জুণের প্রাণ রক্ষা করেন। এর প্রতিবাদে অর্জুন তাঁর এক বাণে ভগদত্তকে বিদ্ধ করে হস্তী থেকে মাটিতে ফেলে দেন এবং আরে বাণে সুপ্রতীকের প্রাণ নাশ করেন।

আরও পড়ুনঃ  কে এই আদ্যাশক্তি মহামায়া? কীভাবে তার শত সহস্র রূপে প্রকাশ? Who is Adyashakti Mahamaya?

০৪. দ্রোণাচার্য

মহাভারতের প্রায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গুরু দ্রোণাচার্যের উপস্থিতি ছিল অত্যন্ত গুরুত্ত্বপূর্ণ। ঋষি ভরদ্বাজের পুত্র তথা ব্রাহ্মণ হয়েও তিনি হাতে তুলে নিয়েছিলেন অস্ত্র। ভগবান পরশুরামের কাছ থেকে অস্ত্রশিক্ষা করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন আর্যাবর্তের অপ্রতিদ্বন্দ্বী আচার্য। কুরু এবং পাণ্ডব উভয় পক্ষেরই অস্ত্র শিক্ষার দায়িত্ব ছিল তারই ওপরে। তিনি নিজ হাতে যেমন অর্জুনকে ধণুর্বিদ্যায় প্রশিক্ষিত করেছেন, তেমনি ভীম ও দুর্যোধনকে শিখিয়েছেন মল্লযুদ্ধ ও গদাযুদ্ধ। মহাভারতের যুগের সামরিক কলাকৌশল, ব্যূহ রচনা, ভয়ংকর সব দিব্যাস্ত্রের জ্ঞান ও প্রয়োগ ইত্যাদিতে নিপুন ছিলেন দ্রোণাচার্য। তাঁর একমাত্র দুর্বলতা তথা পুত্র অশ্বত্থামার কারণেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে তিনি বেছে নিয়েছিলেন পাপের পক্ষ। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ভীষ্মের শরশয্যার পর ১১তম দিন থেকে ১৫তম দিন পর্যন্ত তিনিই ছিলেন কৌরব পক্ষের সেনাপতি। প্রাথমিকভাবে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল পাণ্ডবদেরকে বধ না করে বন্দী করার মাধ্যমে যুদ্ধের সমাপ্তি টেনে দেওয়া। কিন্তু দুর্যোধনের ভর্ৎসনার কারনে তিনি রণাঙ্গনে এক দুর্ধর্ষ ও রক্তলোলুপ যোদ্ধার মত যুদ্ধ শুরু করেন। তাঁর দুর্দণ্ড প্রতাপে পাণ্ডবপক্ষের রথী মহারথীদেরও ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা সৃষ্টি হতে থাকে। ভীম, অভিমন্যু, ঘটৎকচ, ধৃষ্টদ্যুম্ন এবং সাত্যকীসহ অসংখ্য পাণ্ডব বীরদেরকে পরাজিত করেছিলেন তিনি। যুদ্ধের ময়দানে নানা রকমের অভিনব ব্যূহ রচনা করে পাণ্ডবদের বিপক্ষে বিপুল বিধ্বংস রচনা করেন। এমনকি এক পর্যায়ে সাধারন সেনাদের উপরে ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করে বিপুল বিপর্যয় সৃষ্টি করেছিলেন তিনি। যুদ্ধের ১৪তম দিনে তিনি তাঁর মহাশত্রু পাঞ্চালরাজ দ্রুপদ ও বিরাট রাজাকে বধ করেন এবং সব মিলিয়ে তিনি প্রায় ২ অক্ষৌহিণী পাণ্ডব সেনা নাশ করেছিলেন।

দ্রোণাচার্য
দ্রোণাচার্য

অপ্রতিরোধ্য দ্রোণাচার্যকে দেখে পাণ্ডব শিবিরকে গ্রাস করল এক অজানা আশঙ্কা। কারণ পাণ্ডবগণ ইতিমধ্যেই বুঝে গিয়েছিলেন যে যুদ্ধের ময়দানে দ্রোণাচার্যকে বধ করা অসম্ভব। এবং দ্রোণের নেতৃত্বে আর এক দিন যুদ্ধ চললেই পাণ্ডবগণ সুনিশ্চিত পরাজয়ের দিকে এগিয়ে যাবেন। তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবার এগিয়ে এলেন কাণ্ডারীর ভূমিকায়। তাঁর পরামর্শে অশ্বত্থামা নামের একটি হাতিকে বধ করে পাণ্ডবগণ প্রচার করেন গুরু দ্রোণের পুত্র অশ্বত্থামা নিহত হয়েছেন। স্বয়ং যুধিষ্ঠিরের মুখে একথা শুনে ভেঙে পড়লেন দ্রোণাচার্য। তিনি অস্ত্র ত্যাগ করে যুদ্ধের ময়দানেই অশ্বত্থামার চিন্তায় ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়েন। এসময় রাজা দ্রুপদের পুত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন দ্রোণাচার্যের শিরোচ্ছেদ করে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেন।আসলে দ্রোণাচার্য এত বড় মাপের যোদ্ধা ছিলেন যে তাঁকে বধ করতে অনৈতিক পন্থা অবলম্বন করতে হয়েছিল পাণ্ডবদের। আর এর থেকেই বোঝা যায়, দ্রোণাচার্য যোদ্ধা হিসেবে কতটা পরাক্রমশালী ছিলেন।

০৩. ভীষ্ম

হস্তিনাপুরের রাজা শান্তনুর ঔরসে এবং দেবী গঙ্গার গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন অষ্টবসুর অষ্টম বসু প্রভাষ বা দ্যু। এবং এজন্মে তিনি নাম ধারণ করেছিলেন দেবব্রত। সত্যবতীর সাথে পিতা শান্তনুর বিবাদ ভঞ্জন করার জন্য তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, তিনি কখনো বিবাহ করবেন না এবং সারাজীবন হস্তিনাপুরের সিংহাসনের অনুগত হয়ে থাকবেন। ভীষ্মের এই ভীষণ প্রতিজ্ঞার কারণে পিতা শান্তনু তাঁর নাম দিয়েছিলেন ভীষ্ম এবং তাঁকে ইচ্ছামৃত্যুর বরদান দিয়েছিলেন। এবং এই একই কারণে রাজা ধৃতরাষ্ট্রের পুত্ররা দুরাচারী ও পাপীষ্ঠ হওয়ার সত্তেও তাঁকে কৌরবপক্ষেই যুদ্ধ করতে হয়েছিল। বলা হয় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পরে ভীষ্মই ছিলেন একমাত্র ব্যক্তি যিনি নানা গুণে গুণান্বিত ছিলেন। রাজনীতি, রণনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, আয়ুর্বেদ, বেদ, বেদাঙ্গ, অস্ত্রবিদ্যা, যুদ্ধবিদ্যা, এবং পারমার্থিক জ্ঞানে ভীষ্মের জুড়ি মেলা ভার। তাছাড়া গুরু পরশুরাম, ইন্দ্রদেব ও সুর্যদেবের কাছ থেকে প্রাপ্ত দিব্যাস্ত্রের কারণে তিনি ছিলেন মহাভারতের এক অজেয় বীর। তিনি এত বড় মহারথী ছিলেন যে তাঁর গুরুদেব ভগবান পরশুরাম পর্যন্ত তাঁকে পরাজিত করতে পারেননি। তাছাড়া পিতার আশির্বাদে ইচ্ছামৃত্যুর বর প্রাপ্ত হওয়ার কারণে কোন মহারথী বা অতিরথী যোদ্ধার পক্ষেও তাঁকে বধ করাও সম্ভব ছিল না। এই ভীষ্মই যখন কৌরবদের সেনাপতিরূপে কুরুক্ষেত্রের ময়দানে উপস্থিত হলেন তখন কৌরব বাহিনীর জয় ছিল এক প্রকার নিশ্চিত। তবে গুরু দ্রোণাচার্যের মত পিতামহ ভীষ্মও স্নেহপরবশ হয়ে পাণ্ডবদেরকে বধ করতে চাননি। তিনি চেয়েছিলেন পাণ্ডবদের বন্দী করে যুদ্ধের ইতি টানতে। কিন্তু ধূর্ত দূর্যোধন যুদ্ধের ময়দানে তাঁর সামর্থ্যকে অপমান করায় এবং পাণ্ডবদের প্রতি তাঁর স্নেহকে ভর্ৎসনা করায় এক অন্য ভীষ্মে পরিণত হয়েছিলেন তিনি।

ভীষ্ম
ভীষ্ম

কুরুক্ষেত্রের ময়দানে তাঁর অপ্রতিরোধ্য প্রহার ও প্রচণ্ড ক্ষিপ্রতায় নাজেহাল হয়ে পড়েছিল পাণ্ডব পক্ষ। তাঁর বিধ্বংসী প্রহারে প্রতিদিন দশ হাজার সাধারন সেনা ও এক হাজার রথী বধিত হত। পাণ্ডবপক্ষের বড় বড় বীর যোদ্ধারা তথা অভিমন্যু, ভীম, সাত্যকী এবং যুধিষ্ঠিরও পরাজিত হয়েছিলেন তাঁর কাছে। তিনি এতটাই আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কাউকে বধ না করার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করে তাঁকে দুই দুইবার বধ করতে উদ্যত হয়েছিলেন।

কিন্তু ভীষ্মের এই গণসংহার চলতে থাকলে অচিরেই পাণ্ডবদের কপালে জুটবে নির্মম মৃত্যু অথবা সারা জীবনের বন্দীদশা। অথচ ভীষ্ম কারো হাতে বধ্য নন। সুতারাং, স্বাভাবিকভাবে যুদ্ধ করে তাঁকে পরাজিত বা বধ করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবার কুরুক্ষেত্রকে ভীষ্মমুক্ত করতে প্রচেষ্ট হলেন। আর তাই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ১০ম দিনে ভীষ্মের সামনে হাজির করা হল শিখন্ডীকে। কাশিরাজের তিন কন্যা অম্বা, অম্বিকা ও অম্বালিকাকে অপহরণ করার জেরে অম্বা বর প্রাপ্ত হয়েছিলেন পরের জন্মে শিখন্ডীরূপে তিনি ভীষ্মের মৃত্যুর কারণ হবেন। এবং ভীষ্মও সংকল্প করেছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে অম্বা তথা শিখণ্ডীকে দেখামাত্রই তিনি অস্ত্র ত্যাগ করবেন। সুতারাং কুরুক্ষেত্রের ময়দানে শিখণ্ডীকে যখন ভীষ্মের সামনে উপস্থিত করা হল, তখন ভীষ্ম স্বেচ্ছায় অস্ত্র ত্যাগ করলেন এবং পাণ্ডুপুত্র অর্জুন একের পর এক বাণ বর্ষণ করে ঝাঁঝরা করে দিলেন পিতামহের শরীর। তবে ইচ্ছামৃত্যুর বরপ্রাপ্ত হওয়ার কারণে তিনি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আরও ৪০ দিন পরে স্বেচ্ছায় দেহত্যাগ করেন। সুতারাং বুঝতেই পারছেন, ভীষ্মকে শিখন্ডীর মাধ্যমে অস্ত্রহীন না করা হলে কেউই তাঁকে পরাজিত বা বধ করতে পারতেন না। ফলে পাণ্ডবদের কুরুক্ষেত্র জয় কোনভাবেই সম্বব হত না।

২.১ অশ্বত্থামা

দ্রোণাচার্যের তপস্যার প্রভাবে কৃপীর গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন রুদ্রের  আংশিক অবতার বা রুদ্রাংশ অশ্বত্থামা। জন্মগতভাবে তিনি তাঁর মাথায় লাভ করেছিলেন এক অমূল্য রত্ন। এই রত্নের প্রভাবেই ক্ষুধা, তৃষ্ণা, ক্লান্তি বা যন্ত্রনার প্রভাব থেকে মুক্ত ছিলেন তিনি। জন্মের পরে তিনি অশ্বের মত শব্দ করে ক্রদন করেছিলেন বলে তাঁর নাম হয়েছিল অশ্বত্থামা। মূলত এই অশ্বত্থামার সাথে পাপীষ্ঠ দুর্যোধনের মিত্রতার কারনে এবং পুত্রের প্রতি অন্ধ স্নেহের বশবর্তী হয়ে কৌরব পক্ষে যুদ্ধ করতে হয়েছিল দ্রোণাচার্যকে।

কুরুক্ষেত্রের ময়দানে অশত্থামার মত নৃসংশ যোদ্ধা আর ২য় কেউই ছিলেন না। রুদ্রাংশ হওয়ার কারনে যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর ক্রোধ, ক্ষিপ্রতা এবং পরাক্রম ছিল কিছুটা রুদ্রের মতই। অর্জুন ও কর্ণের মত তাঁর অস্ত্রভাণ্ডারও ছিল দিব্য ও ঐশী অস্ত্রে পরিপূর্ণ। তাঁর পিতা দ্রোণাচার্য তাঁকে নারায়ণাস্ত্র, ব্রহ্মশির, ব্রহ্মাস্ত্রসহ মহাবিনাশী সব দিব্যাস্ত্রের জ্ঞান প্রদান করতে একটুও কার্পণ্য করেননি। আর এ সকল কারণে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অশ্বত্থামাকে থামানোর মত শক্তি শুধুমাত্র শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুন ব্যাতীত আর কারো ছিল না। তিনি যুধিষ্ঠির, ভীম, সাত্যকী, ঘটৎকচ, এবং ধৃষ্টধ্যুম্নকে একাধিকবার পরাজিত করেছিলেন যুদ্ধের ময়দানে। তাছাড়া অর্জুনের হাত থেকে অন্তত তিনবার তিনি কর্ণকে রক্ষা করেছিলেন। ঘটৎকচের সাথে যুদ্ধের সময় তিনি ঘটৎকচের পুত্রকে বধ করেন এবং প্রায় ১ লক্ষ পাণ্ডব সেনা বধ করেন। সেদিনই রাতে ঘটৎকচের প্রায় ১ অক্ষৌহিণী রাক্ষস সেনাকে নিধন করেছিলেন তিনি।

আরও পড়ুনঃ  ঋষ্যশৃঙ্গঃ মাথায় শিং ওয়ালা এক মুনির কাহিনী || Life History of Rishyashringa Muni ||
অশ্বত্থামা
অশ্বত্থামা

পিতা দ্রোণের মৃত্যুর পর অশ্বত্থামা অবতীর্ণ হন সর্বগ্রাসী মহাপাতকের ভূমিকায়। ১৫ তম দিনে চরম ক্রুদ্ধ অশ্বত্থামা নারায়ণাস্ত্রকে আহবান করে পাণ্ডব সেনাবাহিনীর উপর নিক্ষেপ করেছিলেন। যার ফলে অগণিত পাণ্ডব সেনা বীরগতি প্রাপ্ত হয়েছিলেন। একই দিনে, তিনি অগ্নিযাত্রার ডাক দিয়েছিলেন এবং পাণ্ডবদের ১ অক্ষোহিনী সৈন্য বধ করেছিলেন। অশ্বত্থামাই ছিলেন কৌরব পক্ষের সবচেয়ে বিধ্বংসী যোদ্ধা যিনি পাণ্ডবদের ২ অক্ষোহিনী সৈন্যকে এক রাত ও দিনে হত্যা করেছিলেন। এবং সর্বসাকুল্যে তিনি অন্তত ৩ অক্ষৌহিণী পাণ্ডব সেনা একাই নিধন করেছিলেন। কৌবর পক্ষের কোন রথী-মহারথীই পাণ্ডবদের এত বড় সর্বনাশ করতে পারেননি। যুদ্ধের ১৮ তম দিবাগত রাতে দূর্যোধনকে মৃত্যুশয্যায় রেখে তিনি প্রবেশ করেছিলেন পাণ্ডব শিবিরে। এরপর ক্রোধ ও প্রতিশোধের নেশায় উপ পাণ্ডবগণ, ধৃষ্টদ্যুম্ন ও শিখণ্ডী সহ কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী প্রত্যেক যোদ্ধাকে অন্যায়ভাবে বধ করেছিলেন তিনি। তাছড়া পাণ্ডবদেরকে নির্বংশ করতে অর্জুনের পুত্রবধু উত্তরার গর্ভে ব্রহ্মাস্ত্রের আঘাত হেনেছিলেন অশ্বত্থামা। অশ্বত্থামা বীর যোদ্ধা ছিলেন এবং কুরুক্ষেত্রের ময়দানে তাঁকে কেউ বধ করতে পারেননি বটে, তবে তাঁর ঘৃণ্য কর্মে হতভম্ব হয় গিয়েছিলেন স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তাই তিনি অশ্বত্থামার মাথার মণিটি ছিনিয়ে নিয়ে অমরত্বের অভিশাপ দিয়েছিলেন তাঁকে।

২. অঙ্গরাজ কর্ণ

সুর্যদেবের আশির্বাদে কুমারী কুন্তী যে পুত্রসন্তান লাভ করেছিলেন তাঁর নাম কর্ণ। তবে লোকলজ্জার ভয়ে তিনি কর্ণকে পরিত্যাগ করেছিলেন এবং সুতপুত্র হিসেবেই বেড়ে উঠেছিলেন কর্ণ। কর্ণের বীরত্ব ও পরাক্রম সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। সূর্যদেবের আশির্বাদে জন্মগতভাবে কর্ণ এক অভেদ্য কবচ প্রাপ্ত করেছিলেন যা শরীরে থাকা অবস্থায় কেউই তাঁকে বধ করতে সক্ষম ছিলেন না। ভগবান পরশুরামের কাছ থেকে অস্ত্রশিক্ষা করে তিনি হয়ে উঠেছিলেন এক অজেয় মহাবীর। ভার্গবাস্ত্র, নাগাস্ত্র, ব্রহ্মাস্ত্র, ব্রহ্মশিরাস্ত্র এবং বাসবি শক্তি অস্ত্র সহ অজস্র রকমের দিব্যাস্ত্রের অধিকারী ছিলেন মহাবীর কর্ণ। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ছাড়াও জরাসন্ধকে মল্লযুদ্ধে পরাজিত করা, দিক্বিজয় করা প্রভৃতি ঘটনা কর্ণের সামর্থ্যের পরিচয় দেয় খুব ভালোভাবে। তবে সুতপুত্র হিসেবে বেড়ে ওঠা একজন মানুষের পক্ষে এই বিপুল যোগ্যতা অর্জন করা একেবারেই সহজসাধ্য ছিল না। দিনের পর দিন সংগ্রাম ও বঞ্চনার পথ পাড়ি দিয়ে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন দিক্বিজয়ী বীর অঙ্গরাজ কর্ণ হিসেবে।

যেহেতু পিতামহ ভীষ্ম কর্ণের আসল পরিচয় জানতেন তাই তিনি কর্ণকে তাঁর জীবদ্দশায় আপন ভ্রাতাদের বিরুদ্ধে দাড় করাতে চাননি। তাই ১০ম দিনে ভীষ্মের শরশয্যার পরেই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে প্রবেশাধিকার পেয়েছিলেন কর্ণ। আর এরপর থেকেই কর্ণের বিক্রম শুরু হয় কুরুক্ষেত্রে। অর্জুন ব্যাতীত তিনি বাকী চার পাণ্ডবের প্রত্যেককেই পরাজিত করেছিলেন এবং তাঁদেরকে বধ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি অর্জুন ব্যাতীত বাকী পাণ্ডবদের বধ করবেন না বলে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তা রক্ষার্থেই তিনি তাঁদেরকে প্রাণদান করেছিলেন। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ১৪ তম রাতে তিনি বাসবী শক্তি প্রয়োগ করে মহাবলশালী ঘটৎকচকে বধ করেছিলেন যা ছিল কৌরব পক্ষের জন্য এক বিরাট স্বস্তির কারণ। এছাড়াও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কর্ণ কর্তৃক পরিচালিত তাণ্ডবে নিহত হন প্রায় ২ অক্ষৌহিণী পাণ্ডব সেনা। উল্লেখ্য পিতামহ ভীষ্ম ও গুরু দ্রোণাচার্যও পাণ্ডবদের বিপক্ষে এৎ বিধ্বংসী প্রহার করতে পারেননি।

অঙ্গরাজ কর্ণ
অঙ্গরাজ কর্ণ

কুরুক্ষেত্রের ময়দানে কর্ণের মৃত্যুও ছিল একেবারে অদ্ভূত। তবে তাঁর মৃত্যুর কারণ তাঁর যোগ্যতা হীনতা নয়, তাঁর দানশীলতা এবং পরশুরাম কর্তৃক প্রদত্ব অভিশাপ। অর্জুনের হাতে কর্ণকে বধ করানোর উদ্দেশ্যে দেবরাজ ইন্দ্র কর্ণের কাছ থেকে তাঁর কবচ ও কুণ্ডল ভিক্ষা করে নিয়েছিলেন যা কর্ণকে দূর্বল করে তুলেছিল। এই কবচ কর্ণের শরীরে থাকলে অর্জুনের তীর কোনভাবেই তাঁর বক্ষকে বিদ্ধ করতে পারত না। এবং কর্ণের মৃত্যুর ২য় কারণ ছিল তারই গুরুদেব পরশুরামের দেওয়া অভিশাপ। নিজের পরিচয় গোপন রেখে পরশুরামের কাছে অস্ত্রশিক্ষা করেছিলেন বলে তিনি কর্ণকে অভিশাপ দিয়েছিলেন প্রয়োজনের সময় কর্ণ দিব্যাস্ত্রের জ্ঞান ভুলে যাবেন। আর ঠিক এই কারণেই অর্জুনের সাথে যুদ্ধের সময় যখন দুর্ভাগ্যবশত কর্ণের রথের চাকা মাটিতে আটকে যায়, তখন কোন দিব্যাস্ত্রের জ্ঞান তিনি স্মরণ করতে পারেননি। এবং এত বড় বীর যোদ্ধার মৃত্যু হয়েছিল নিরস্ত্র অবস্থায়।

০১. অর্জুন

আজ্ঞে হ্যাঁ, পাণ্ডুপুত্র অর্জুনকেই রাখা হয়েছে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধাদের মধ্যে ১ম স্থানে। এর কারন আপনারা ইতিমধ্যেই অবগত। তবুও অর্জুন সম্পর্কিত কিছু বিষয় এখানে আপনাদের জন্য উপস্থাপন করা হল। আপনারা অনেকেই হয়ত জানেন না ভগবান বিষ্ণু নর ও নারায়ণ নামে দুই অংশে যে অবতার ধারণ করেছিলেন, সেই নরই হচ্ছেন মহাভারতের অর্জুন এবং নারায়ন হচ্ছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। দেবরাজ ইন্দ্রের সন্তান হওয়ায় জন্মগতভাবে তিনি ছিলেন দেবরাজের মতি তেজস্বী, বুদ্ধিমান, শক্তিশালী এবং পরাক্রমী। তিনি দ্রোণাচার্যের কাছে থেকে অস্ত্রবিদ্যায় প্রশিক্ষিত হয়েছিলেন বটে তবে তাঁর অস্ত্রভাণ্ডারে মহাভারতের সকল যোদ্ধার চেয়ে বেশী পরিমানে বিধ্বংসী অস্ত্র ছিল। তবে তিনি এই অস্ত্রগুলোর মধ্যে অনেকগুলোই কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে ব্যাবহার করেননি।

মহাভারতের যুদ্ধের আগেই অর্জুন তাঁর শক্তি ও সামর্থ্যের পরিচয় দিয়েছেন বহুবার। দ্রৌপদীর স্বয়ংবরে তিনি যে ধনুকটি দিয়ে লক্ষ্যভেদ করেছিলেন, স্বয়ংবরে উপস্থিত অনেক রথী-মহারথীরা সেটিকে উত্তোলন করতেই পারেননি। বনবাসে থাকাকালীন অর্জুন ও কীরাতরূপী শিবের মধ্যকার যুদ্ধে, স্বয়ং ভগবান শিব তাঁকে পরাস্ত করতে পারেননি। অর্জুন রসাতলে বসবাসকারী নিবাতকবচগণকে বধ করেছিলেন যা দেবতাদের পক্ষেও ছিল অসম্ভব। উল্লেখ্য এই নিবাতকবচগণকে স্বয়ং রাবণ বধ করতে না পেরে তাঁদের সাথে সন্ধি করেছিলেন। তাছাড়া খাণ্ডব দহনের সময় তিনি দেবরাজ ইন্দ্র ও অন্যান্য দেবতাদেরকেও পরাজিত করেছিলেন। তবে শুধুমাত্র ধণুর্বিদ্যাই নয় বাহুবলের দিক দিয়েও অর্জুন ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী। আর একারনে জরাসন্ধের সাথে মল্লযুদ্ধের সময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভীমের পাশাপাশি অর্জুনকেও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন।

অর্জুন
অর্জুন

মহাভারতের যুদ্ধে অর্জুন ছিলেন সর্বোচ্চ সংখ্যক কৌরব সৈন্যের নিধনকারী। বলতে গেলে অর্জুন একাই অধিকাংশ কৌরব সেনাদের বধ করেছিলেন। ভাগদত্ত, শ্রুতায়ু, জয়দ্রথ, কর্ণ, সুসর্মাকে বধ করার পাশাপাশি তিনি ভীষ্ম, দ্রোণ, দুর্যোধনসহ অসংখ্য কৌরব বীরদেরকে পরাজিত করেছিলেন। বলাই বাহুল্য, অভমন্যুর মৃত্যুর পরের দিন তিনি একাই কৌরবদের ৭ অক্ষৌহিণী সেনা বিনাশ করে দিয়েছিলেন। আর এভাবে একটানা ১৮ দিন গাণ্ডীব নামের অত্যন্ত ভারী এক ধনুক নিয়ে যুদ্ধ করে জয়লাভ করেছিলেন। তবে তাঁর এসকল জয়ে পরোক্ষ ও অদৃশ্যভাবে শক্তি যুগিয়েছিলেন পার্থসারথি শ্রীকৃষ্ণ।

আপনারা অনেকেই প্রশ্ন করতে পারেন, অর্জুন ও কর্ণ দুজনেই প্রায় সমান যোগ্যতাসম্পন্ন যোদ্ধা। কিন্তু কর্ণকে প্রথম স্থানে না রেখে অর্জুনকে কেন প্রথম স্থানে রাখা হল। আজ্ঞে হ্যাঁ, কর্ণ এবং অর্জুনের যোগ্যতা ও বীরত্বের বিচার করা আসলেই কোন সহজসাধ্য কাজ নয়। তবে সার্বিক বিবেচনায় অর্জুনকে প্রথম স্থানে রাখার কারন ২টি। ১ম কারন, কর্ণ ছিলেন অধর্মের পক্ষে এবং অর্জুন ছিলেন ধর্মের পক্ষের যোদ্ধা। এবং ২য় কারণ হচ্ছে ইতিহাস সব সময় বিজয়ীর হাতেই লেখা হয়। আর মহাভারতের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস আর কি হতে পারে।

5/5 - (2 votes)

Leave a Reply