You are currently viewing রাত নামলেই ১১ শিব মন্দির থেকে ভেসে আসে নারী কণ্ঠের কান্না || 11 Shiva Temple, Abhaynagar, Jessore

রাত নামলেই ১১ শিব মন্দির থেকে ভেসে আসে নারী কণ্ঠের কান্না || 11 Shiva Temple, Abhaynagar, Jessore

দুঃখিনী রাজকন্যার নাম অভয়া। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের ফলে কপালে জুটেছিল অকাল বিধবার তকমা। তাই বাকী জীবন কাটাতে চেয়েছিলেন দেবাদিদেব মহাদেবের সেবা করে। দুর্ভাগা রাজকন্যার এই আকুতিতে পিতা রাজা নীলকণ্ঠ রায় নির্মান করে দিয়েছিলেন ১১টি শিবমন্দির। ৩০০ বছর আগের সেই অনিন্দ্যসুন্দর মন্দিরগুলো দর্শন করা ও এর অমূল্য ইতিহাস জানার জন্যই আমাদের আজকের আয়োজন। আজ সনাতন এক্সপ্রেসের দর্শকদের আমরা নিয়ে যেতে চাই বাংলাদেশের যশোর জেলার অভয়নগর উপজেলার বাঘুটিয়া গ্রামে। জনশ্রুতি বলছে আজও রাতের গভীরে সাদা শাড়ি পড়া অভয়াকে দেখা যায় এ মন্দির থেকে ও মন্দিরে শিবের জলাভিষেক করে বেড়াতে। কেউ কেউ আবার সেই দুঃখিনী রাজকন্যার চাপা কান্নার শব্দও ভেসে আসতে শুনেছেন মন্দিরের ভেতর থেকে। তাহলে চলুন দর্শক আমরাও ঘুরে আসি সেই ১১টি শিব মন্দিরের দেশ থেকে।

১১ শিব মন্দিরের ইতিহাসঃ

ইতিহাস বলছে মুঘলদের সাথে যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দী হন যশোহর রাজ্যের প্রতাপশালী রাজা মহারাজ প্রতাপাদিত্য । এর বহু বছর পর রাজা প্রতাপাদিত্যেরই বংশধর রাজা নীলকণ্ঠ রায় নতুন করে আধিপত্য বিস্তার করেন যশোহরের চাচড়া এলাকায়। এই নীলকণ্ঠ রায়ের ঘর আলো করে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এক ফুটফুটে কন্যাসন্তান। রাজকন্যার নাম রাখা হল অভয়া। এরপর কন্যা অভয়াকে নিয়ে রাজা নীলকণ্ঠ রায় চাচড়া থেকে সপরিবারে চলে এলেন ভৈরব নদীর পাড়ে। নির্মাণ করলেন নতুন রাজপ্রাসাদ। আর এখানেই বেড়ে উঠতে লাগলেন রাজকন্যা অভয়া।

প্রাপ্তবয়স্কা হলে অভয়ার বিয়ে হয় সে সময়ের অত্যন্ত প্রভাবশালী ‘নড়াইল জমিদার” বংশের নীলাম্বর রায়ের সাথে। কিন্তু অদৃষ্টের নির্মম পরিহাসে বিয়ের অল্প কিছুদিন পরেই দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েন নীলাম্বর রায়। অতঃপর কিছুদিন রোগভোগের পরে পরপাড়ে পাড়ি জমান এই নীলাম্বর রায়। এর ফলে অকালে বিধবা হয়ে যান রাজকন্যা অভয়া। ছোট বেলা থেকেই অভয়া দেবী ছিলেন ভোলানাথ শিবের পরম ভক্ত। তাই পিতার কাছে অনুরোধ করলেন, তিনি তার বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে চান ভোলানাথের আরাধনা করেই।

আরও পড়ুনঃ  দেবী দুর্গা গজ, ঘোটক, নৌকা ও দোলায় যাতায়াত করেন কেন?

১১ শিব মন্দির নির্মান

সময়টা ১৭৪৫ সাল। নীলকন্ঠ রায় মেয়ের ইচ্ছা শুনে ১টি/২টি নয় নির্মান করে দিলেন ১১টি শিব মন্দির। রাজবাড়ির সন্নিকটে ৬০ একর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত হল সেই মন্দির প্রাঙ্গন। আর মেয়ের নাম অনুসারে নগরের নাম হল অভয়ানগর, যা কালক্রমে পরিচয় পেয়েছে অভয়নগর নামে। সেই থেকে আজ ৩০০ বছর পরেও ভৈরব নদের তীরে এখনো দাঁড়িয়ে আছে সেই পবিত্র স্থাপনা। বলাই বাহুল্য, একই স্থানে এতগুলো শিব মন্দির এতদঞ্চল তথা সমগ্র বাংলাদেশে আর কোথাও দেখতে পাওয়া যায় না।

স্থানীয় জনশ্রুতি বলছে রাজকন্যা অভয়া সারাদিন সেখানেই শিবের ভক্তি করতেন। আর মাঝে মধ্যেই মনের কষ্টে ডুকরে কেঁদে উঠতেন তিনি। আর এভাবেই আস্তে আস্তে তার কান্নার শব্দ মিলিয়ে গেছে মহাকালের নিষ্ঠুর স্রোতে। কথিত আছে, আজো নাকি রাতের বেলায় কোনো নারীর চাপা কান্নার শব্দ শোনা যায় মন্দিরের ভেতর থেকে। এই ১১টি মন্দিরের মধ্যে সর্ব উত্তরের মন্দিরটি হল এখানকার মূল মন্দির। প্রধান মন্দিরের দুই পাশে পূর্ব ও পশ্চিমে ৪টি করে মোট ৮টি ও প্রবেশপথের দুই দিকে ২টিসহ মোট ১০টি অপ্রধান মন্দির রয়েছে। রাজা নীলকণ্ঠ রায় এই ১১টি মন্দিরে স্থাপন করেছিলেন ১১টি কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ। যার সবকটিই চুরি হয়ে গেছে কালক্রমে। বর্তমানে স্থানীয়দের প্রচেষ্টায় মূল মন্দিরে স্থাপন করা হয়েছে একটি শিবলিঙ্গ। বাকী ১০টি মন্দির আজও বিগ্রহশূন্য।

মন্দিরের বাইরে দক্ষিণ দিকে আছে একটি প্রধান প্রবেশপথ। প্রবেশপথ দিয়ে ঢুকতেই দেখা যায় প্রতিটি মন্দিরে প্রবেশের জন্য আছে খিলানাকৃতির প্রবেশপথ ও উপ-প্রবেশপথ। আরও রয়েছে, বাঁকানো ও কোণাকৃতির কার্নিশ। রয়েছে সুন্দর কিছু কারুকার্য। তার মধ্যে রয়েছে পদ্মসহ অনেক রকমের পোড়ামাটির চিত্র। মন্দিরের ছাঁদগুলো নির্মিত হয়েছে উলম্ব ধরনের ডোমের সমন্বয়ে। অর্থাৎ দুই স্তরে নির্মিত ছাদের ভেতরে গোলাকার এবং বাইরে চালা রীতিতে নির্মিত। সবগুলো মন্দিরেরই নির্মাণশৈলীতে দেখা মেলে উৎকর্ষতা এবং দক্ষতার ছাপ। শোনা যায় মন্দিরের চারপাশ একসময় বেষ্টিত ছিল সুউচ্চ প্রাচীর দ্বারা। তবে এখন সেগুলোর আর চিহ্নমাত্র নেই। আরও শোনা যায়, মন্দিরের উত্তর-পশ্চিম কোণে খনন করা হয়েছিল একটি বড় পুকুর। রাজা নীলকণ্ঠ রায় প্রতিটি মন্দিরের জন্য দান করেছিলেন দুইশো বিঘা নিষ্কর ভূমি। এই জমি থেকেই প্রাপ্ত আয়ে নির্বাহ করা হত মন্দিরের খরচ। তাছাড়া মন্দিরের ভোগ হওয়ার পরে ভক্তদের প্রসাদ বিলি করার পর পূজারী ব্রাহ্মণদের বাড়ি বাড়ি ভোগ পাঠানো হতো নীলকণ্ঠ রায়ের রাজত্বকালে।

আরও পড়ুনঃ  পূর্বজন্মে পরম বিষ্ণুভক্ত হয়েও কেন পরজন্মে রাবণ ও কুম্ভকর্ণ রূপে জন্মাতে হল?

কিন্তু কালক্রমে অভয়াদেবীর মৃত্যু, রাজপ্রথার অবসান ও রাজপরিবারের সদস্যদের দেশত্যাগের ফলে ম্লান হয়ে পরে ১১ শিব মন্দির। সাজানো গোছানো মন্দিরগুলো পরিনত হয় পরিত্যাক্ত ও গা ছমছমে ভূতের বাড়িতে। আর এই সুযোগ হাতছাড়া করেনি দখলদারেরাও। ফলে মূল মন্দিরগুচ্ছ ব্যাতীত আর সবকিছুই হারিয়ে যায় হরি লুটের বাতাসার মত।

১১ শিব মন্দির সংস্কার

তবে গনপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ২০১৪ সালে উদ্যোগ গ্রহণ করে মন্দিরগুলো সংস্কার করার। এর ফলে ধবংসের হাত থেকে আপাতত রেহাই পেল অভয়াদেবীর সেই ১১টি শিব মন্দির। বর্তমান যশোর শহর থেকে ৪৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই গুচ্ছ মন্দিরগুলোতে আজও প্রতি বছর চৈত্র সংক্রান্তিতে বসে মেলা। দূর দূরান্ত থেকে আসা হাজারো ভক্তবৃন্দের পদ চারনায় মুখরিত হয় অভয়দেবীর ১১ শিব মিন্দর প্রাঙ্গন। তারপর বছরের বাকী ৩৬৪ দিন আবারও একা নির্জনে পড়ে থাকে কয়েক শতাব্দীর পুরনো এই শিবালয়।

 

5/5 - (2 votes)

Leave a Reply