You are currently viewing ভগবান বিষ্ণু ও ভগবান শিবের মধ্যকার ৪ প্রলয়ঙ্করী যুদ্ধ || 4 Fights Between Vishnu and Shiva ||

ভগবান বিষ্ণু ও ভগবান শিবের মধ্যকার ৪ প্রলয়ঙ্করী যুদ্ধ || 4 Fights Between Vishnu and Shiva ||

বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের তিন অপরিহার্য স্তম্ভ হচ্ছেন ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর। সমগ্র সৃষ্টির সৃজনশীলতা, লালন-পালন ও সংহারের জন্য এই ত্রিদেবের কোন বিকল্প নেই। আদতে তাঁদেরকে আলাদা সত্ত্বা মনে হলেও গুঢ় অর্থে তারা নিরাকার পরম ব্রহ্মের সৃষ্টিকারী, পালনকারী ও ধ্বংসকারী শক্তির প্রকাশ। কিন্তু এক ও অভিন্ন সত্ত্বা হওয়ার সত্ত্বেও তাঁদের মধ্যে কি যুদ্ধ বা দ্বন্দ হওয়া সম্ভব? আজ্ঞে হ্যাঁ, বিভিন্ন পুরাণ থেকে জানা যায় ব্রহ্মার সাথে শিবের, ব্রহ্মার সাথে বিষ্ণুর, এবং বিষ্ণুর সাথে শিবের একাধিকবার সংঘটিত হয়েছে প্রলয়ংকরী যুদ্ধ অথবা দ্বন্দ্ব। তবে এসকল যুদ্ধ বা দন্দ্বের মধ্যে নিহিত রয়েছে মহাজাগতিক কল্যান সাধনের অভিপ্রায়। প্রিয় দর্শক, আজ আমরা জানাবো পালন কর্তা বিষ্ণু ও সংহার কর্তা শিবের মধ্যে সংঘটিত ৪টি প্রলয়ংকরী যুদ্ধের কাহিনী। জানবো কে কাকে কতবার পরাজিত করতে পেরেছিলেন। তবে শুরু করার আগে আপনাদের জানিয়ে রাখা দরকার, বিষ্ণু বা শিব কেউই কারও দ্বারা পরাজেয় নন। তারা স্বেচ্ছায় পরাজয় স্বীকার না করলে কেউ কাউকে পরাজিত করতে সক্ষম নন। তাই শুধুমাত্র নিয়তির বিধান মোতাবেক এবং মহাজাগতিক কল্যান সাধনের নিমিত্তেই তাঁদের মধ্যকার এই যুদ্ধ এবং জয় পরাজয়।

১. মহাভারতে শ্রীবিষ্ণু বনাম মহাদেব

আচ্ছা মহাভারতে কি কোথাও বিষ্ণু ও শিবের মধ্যকার কোন যুদ্ধের কথা শুনতে পাওয়া যায়? এই প্রশ্নের সাধারন উত্তর হচ্ছে “না”। তবে আপনারা নিশ্চই জানেন ভগবান বিষ্ণুর পূর্ণাবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জন্ম নিয়েছিলেন এই দ্বাপর যুগে। তাই ভগবান বিষ্ণু মহাভারতের যুগে সরাসরি প্রকট না হলেও তার অবতার সক্রিয়ভাবে পদচারনা করেছেন মহাভারতের প্রতিটি দৃশ্যে। নিজে অস্ত্র ধারণ না করেও কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের গতি-প্রকৃতি নিয়ন্ত্রন করেছিলেন তিনি। তিনি শুধুমাত্র অর্জুনের রথের সারথি হিসেবে যুদ্ধের ময়দানে উপস্থিত থেকেছিলেন বটে, তবে এ যুদ্ধের পরিণতি লিখিত হয়েছিল তার হাতেই।

আবার অন্যদিকে ভগবান শিবও সরাসরি মহাভারতের কোন কর্মযজ্ঞে অংশগ্রহণ করেননি। তবে আপনারা অনেকেই দুর্যোধনের মিত্র ও গুরু দ্রোণাচার্যের পুত্র অশ্বত্থামাকে খুব ভালোভাবেই চিনে থাকবেন। কৌরবদের পক্ষে যুদ্ধে অংশ নেওয়া এই মহাশক্তিশালী যোদ্ধা তুমুল ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিলেন পাণ্ডবদের বিপক্ষে। প্রায় ৩ অক্ষৌহিণী পাণ্ডব সেনা সংহার করে পাণ্ডবদের মহা সর্বনাশ ডেকে এনেছিলেন তিনি। বস্তুত কুরুক্ষেত্রের ময়দানে অশত্থামার মত নৃসংশ যোদ্ধা আর ২য় কেউই ছিলেন না। এবং কৌবর পক্ষের কোন রথী-মহারথীই পাণ্ডবদের এত বড় সর্বনাশ করতে পারেননি। এবার নিশ্চই মনে প্রশ্ন জাগে অশ্বত্থামা আসলে কে? আজ্ঞে হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, তিনি দেবাদিদেব মহাদেবের এক অবতার। অশ্বত্থামার পিতা দ্রোণাচার্য বহু বছর ধরে ভগবান শিবের কঠোর তপস্যা করেছিলেন শিবের মত পুত্র লাভ করার জন্য। আর তার তপস্যার প্রভাবেই জন্ম হয়েছিল অশ্বত্থামার। একারনেই অশ্বত্থামাকে ডাকা হত শিবাংশ বা রুদ্রাংশ নামে।

সুতারাং মহাভারতে ভগবান শ্রীবিষ্ণুর অবতার ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও ভগবান শিবের অবতার অশত্থামা মুখোমুখি হয়েছিলেন একে অপরের। এঁদের মধ্যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন আলোর দিশারী এবং অশ্বত্থামা ছিলেন প্রচণ্ড পাপিষ্ঠ, নীতি-নৈতিকতা ও বিবেক বর্জিত পাষণ্ড এক নরাধম। পাণ্ডবদের বংশ নাশ করার উদ্দেশ্যে অশ্বত্থামা যখন উত্তরার গর্ভে ব্রহ্মাস্ত্রের আঘাত হেনেছিলেন তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার মাথার মণিটি কেড়ে নিয়ে তাকে অমরত্ত্বের অভিশাপ দিয়েছিলেন। প্রিয় দর্শক, এখানে ভগবান শ্রীবিষ্ণু ও ভগবান শিব মুখোমুখি হয়েছিলেন একটি মহৎ কারনে। এবং এখানে জয় বা পরাজয় কোন মুখ্য বিষয় নয়। বস্তুত এঁদের মধ্যে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের দেখিয়েছেন আলোর পথ। অপরদিকে রুদ্রাংশ অশ্বত্থামা আমাদেরকে দেখিয়েছেন হিংসা, পাপ, লোভ ও কুসঙ্গের প্রভাবে মানুষের কি মারাত্মক রকমের পরণতি হতে পারে।

আরও পড়ুনঃ  মৃত্যুর পর ৪৭ দিন পর্যন্ত আত্মার সাথে কি কি ঘটে? গরুড় পুরাণ || Garuda Purana Story ||

২. ভগবান শিব ও বিষ্ণুর যুদ্ধ

আপনারা নিশ্চই দক্ষযজ্ঞের কাহিনী শুনে থাকবেন। পিতা দক্ষের আয়োজিত যজ্ঞে বিনা নিমন্ত্রনে হাজির হয়েছিলেন শিবজায়া দেবী সতী। কিন্তু সেই যজ্ঞভূমিতে পিতা দক্ষ কর্তৃক স্বামী মহাদেবের নিন্দা সহ্য করতে পারেননি তিনি। আর তাই প্রজ্জ্বলিত যজ্ঞাগ্নিতে  আত্মহুতি দিয়েছিলেন তিনি। দেবী সতীর সাথে এরকম আকস্মিক বিচ্ছেদে বিহ্বল হয়ে গিয়েছিলেন প্রলয়ের দেবতা মহাদেব। এসময় তার হৃদয়ের অসীম শূন্যতা থেকে সৃষ্টি হয় এক প্রগাঢ় বৈরাগ্যের। সৃষ্টির প্রতি সমস্ত দায়ীত্ব থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন তিনি। অর্থাৎ মহাপ্রলয়ের মহাদায়ীত্ব ত্যাগ করে মহাজাগতিক ধ্যানে লীন হয়ে গেলেন তিনি। আপনারা জানেন ত্রিদেবের কারও দায়ীত্ব কারও থেকে ছোট বা বড় নয়। তাঁদের প্রত্যেকের উপরে অর্পিত দায়ীত্ব সঠিকভাবে পালিত হলেই এ বিশ্বজগৎ সচল থাকে। এবং এঁদের মধ্যে কেউ তার দায়ীত্ব পালন করা বন্ধ করলেই সমগ্র বিশ্বসংসার ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। মহাদেব শিবের এহেন বৈরাগ্যও সমস্ত সৃষ্টিকে ভারসাম্যহীন করে ফেলল। দিনের পর দিন মহাদেবের অনুপস্থিতিতে সৃষ্টিতে মহাপ্রলয় নেমে আসার উপক্রম তৈরি হল। দুশ্চিন্তায় পড়লেন সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা এবং পালনকর্তা শ্রীবিষ্ণু। ঘটনাপ্রবাহে পাতাল লোক থেকে নাগরাজ বাসুকি ধরণীতে উঠে এলেন মহাদেবের সাথে সাক্ষাৎ এর উদ্দেশ্যে। তবে বাসুকি যেহেতু প্রজাপতি ব্রহ্মা কর্তৃক পাতালে নির্বাসিত হওয়ার অভিশাপ প্রাপ্ত হয়েছিলেন, সেহেতু বাসুকির কৈলাস তথা ধরণিতে উঠে আসার কোন অধিকার ছিল না। আর ঠিক এই সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন বিশ্বসংসারের প্রতিপালক ভগবান শ্রীবিষ্ণু। মহাদেবের মহাজাগতিক ধ্যান ভঙ্গ করে পুনরায় প্রলয়ের দায়ীত্ব গ্রহণ করানোর জন্য এক নিখুত পরিকল্পনা তিনি। তিনি তার বাহন গরুড় দেবকে প্রেরণ করলেন নাগরাজ বাসুকির সাথে যুদ্ধ করার জন্য। তুমুল শক্তিশালী গরুড় দেব ভগবান বিষ্ণুর আদেশ শোনামাত্রই যুদ্ধে লিপ্ত হলেন বাসুকির সাথে। এবং খুব সহজেই বাসুকিকে ভূপাতিত করে তাকে পরাজিত করলেন তিনি। শেষমেষ গরুড দেব যখন বাসুকিকে বধ করতে উদ্যত হলেন, তখন বাসুকি নিরূপায় হয়ে তার আরধ্য ভগবান শিবকে সাহায্যের জন্য স্মরণ করলেন। আপনারা জানেন বাসুকি ছিলেন ভগবান শিবের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভক্ত। তাই ভক্তের আকুতিতে ধ্যানভঙ্গ করতেই হল দেবাদিদেব মহাদেবকে। দীর্ঘদিনের ধ্যান ভঙ্গ করে ক্রুদ্ধ মহাদেব বাসুকিকে রক্ষা করতে উপস্থিত হলেন রণভূমিতে। তিনি গরুড় দেবকে আদেশ করলেন, হয় বাসুকির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করো, অথবা আমার সাথে যুদ্ধ করো। গরুড় দেব অতুল্য রকমের শক্তিশালী হলেও চরম ক্রুদ্ধ মহাদেবের সাথে যুদ্ধ করার মত ধৃষ্টতা তার ছিল না। বরং তিনি তার আরধ্য ভগবান বিষ্ণুর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলেন। ফলে গরুড়কে রক্ষা করতে এবার রণভূমিতে এলেন স্বয়ং নারায়ণ। অনিবার্য হয়ে পড়ল দুই পরাশক্তির যুদ্ধ। একদিকে মহাদেব তার ভক্ত বাসুকিকে রক্ষা করতে বদ্ধপরিকর অন্যদিকে নারায়ণ তার বাহনকে রক্ষা করার জন্য যুদ্ধংদেহী মূর্তিতে দাঁড়িয়ে আছেন মহাদেবের সামনে। এরপর প্রথমে বাগবিতণ্ডা এবং বাগবিতণ্ডা থেকে শুরু হল মহাযুদ্ধ। দুই অসীম শক্তিশালী দেবের যুদ্ধে প্রলয়ের দামামা বেজে উঠল সমস্ত সৃষ্টিতে। চারিদিকে ত্রাহি ত্রহি রবে প্রকম্পিত হল বিশ্বসংসার। যুদ্ধভূমিতে শ্রীনারায়ণ এবং মহাদেব শিব ভয়ংকর সব শক্তিশালী অস্ত্র দিয়ে আঘাত করতে থাকলেন একে অপরকে। এভাবে বহুকাল যুদ্ধ চলার পর একসময় ক্রুদ্ধ শিব তার ত্রিশুল দিয়ে প্রহার করে বসলেন শ্রীনারায়ণের বক্ষে। তবে এবার শ্রীনারায়ণ নিজ বক্ষে ত্রিশূলের প্রহারে ক্লিষ্ট হয়েও কোন প্রতিঘাত করলেন না। আর এই ঘটনায় চৈতন্য ফিরল মহাদেবের। তিনি অশ্রুসিক্ত নয়নে ভগবান বিষ্ণুর উদ্দেশ্যে বললেন, “হে নারায়ণ আমাকে ক্ষমা করুন। আপনি আমার ভক্ত, আবার আপনিই আমার আরধ্য। আপনার বক্ষের যেস্থানে আমি ত্রিশূলের প্রহার করেছি, ঠিক সেখানেই আমার আবাস।” ভগবান বিষ্ণু বুঝলেন তার পরিকল্পনা সফল হয়েছে। তিনি এবার মহাদেবকে বললেন, “হে মহাদেব, দেবী সতীর সাথে বিচ্ছেদের পর আপনি যখন সমস্ত দায়ীত্ব ত্যাগ করলেন, তখন সমস্ত সৃষ্টি ধীরে প্রলয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল, তাই আপনাকে ফিরিয়ে আনতেই আমার এই পরিকল্পনা।” এরপর মহাদেব ও মহাবিষ্ণুর আলিঙ্গনে ঘুচে গেল দ্বন্দ। আর এই মহৎ কর্মে সহযোগীতা করার জন্য মহাদেব বাসুকিকে আশির্বাদ স্বরূপ নিজের গলায় তুলে নিলেন এবং আশির্বাদ করলেন ভগবান বিষ্ণুর বাহন গরুড় দেবকেও।

আরও পড়ুনঃ  পঞ্চকেদার সৃষ্টি হওয়ার পেছনের পৌরাণিক কাহিনী || Mythology Behind the Creation of Panch Kedar ||

৩. ভগবান শিব বনাম ভগবান কৃষ্ণ

দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর বংশধর তথা ভক্ত প্রহ্লাদের পৌত্র বানাসুরের আয়োজনে এক বিভীষিকাময় যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও ভগবান শিবের মধ্যে। এই দৈত্যরাজ বালির পুত্র বানাসুর ছিলেন প্রবল প্রতাপশালী এবং তুমুল শক্তিশালী এক অসুর সম্রাট। তার নিজের অতুল্য শক্তি থাকার পরেও  তিনি আরও বেশী শক্তিশালী হওয়ার উচ্চাকাঙ্ক্ষা করতেন। আর তাই তিনি সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী ও অপরাজেয় হওয়ার জন্য শুরু করেন ভোলানাথ শিবের কঠোর তপস্যা। আপনারা জানেন তপস্বীর মনে যতই দূরভিসন্ধি থাকুক না কেন ভোলানাথ কখনোই তার ভক্তকে নিরাশ করেন না। বানাসুরকেও তিনি নিরাশ করেননি। তিনি তাকে সহস্র বাহু ও অপ্রতিরোধ্য যোদ্ধা হওয়ার বরদান করেছিলেন। তবে ধূর্ত বানাসুর ভগবান শিবের কাছে আরও একটি বর দাবী করে বসেন। আর সেটি হল, বানাসুর যদি কখনো বিপদের সম্মুখীন হন তাহলে ভগবান শিব যেন নিজে প্রকট হয়ে তাকে রক্ষা করেন। অগত্যা ভগবান শিব এই বরটিকেও মঞ্জুর করে অদৃশ্য হলেন বানাসুরের সম্মুখ থেকে। বাণাসুরেরও দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন রূপ নিল বাস্তবে। যার রক্ষক স্বয়ং ভগবান শিব তাকে পরাজিত বা বধ করে কার সাধ্য। ফলে বানাসুর হয়ে উঠলেন নিষ্ঠুর, অত্যাচারী এবং দাম্ভিক।

যাইহোক এই বানাসুরের কন্যা উষা স্বপ্নে এক সুদর্শন পুরুষকে দর্শন করেছিলেন। এবং সেই স্বপ্নে দেখা পুরুষের প্রতি প্রণয়াসক্ত হয়ে পড়েন তিনি। বাস্তবে উষার এই স্বপ্নপুরুষটি ছিলেন স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পৌত্র অনিরুদ্ধ। উষা অনিরুদ্ধের প্রেমে এতটা উতলা হয়ে পড়েছিলেন যে, তিনি তার সখী চিত্রলেখার মায়াবিদ্যার সাহায্যে অনিরুদ্ধকে হরণ করে তার বাসভবন শোনিতপুরে নিয়ে আসেন। আপনাদের জানিয়ে রাখা ভালো, উষার পিতা বানাসুর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে তার চরম শত্রু মনে করতেন। আর তাই ঘটনাক্রমে বানাসুর যখন অনিরুদ্ধের কথা জানতে পারেন, তখন তিনি অনিরুদ্ধকে বন্দী করে নিক্ষেপ করেন কারাগারে।

এদিকে দেবর্ষি নারদের মাধ্যমে অনিরুদ্ধের বন্দী হওয়ার সংবাদ পৌছে গেল যদুকুলে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তখন তার জ্যেষ্ঠ্য ভ্রাতা বলরাম, পুত্র প্রদ্যুম্ন, সাত্যকী এবং  বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে উপস্থিত হলেন শোনিতপুরের রণভূমিতে। তবে বানাসুর বিপুল শক্তির অধিকারি হওয়ার সত্ত্বেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামের সাথে নিজে যুদ্ধ করার নির্বুদ্ধিতা করলেন না। বরং তিনি আহবান করলেন তার রক্ষাকর্তা ভগবান শিবকে। আর বচনবদ্ধ শিবও বানাসুরের আহবানে সাড়া দিয়ে কার্ত্তিক, গণেশ, নন্দী, অসংখ্য গণ, এবং পিশাচ বাহিনী নিয়ে আবির্ভূত হলেন যুদ্ধের ময়দানে। শুরু হল ভগবান শ্রীবিষ্ণুর পূর্নাবতার ও ভগবান শংকরের মধ্যে এক বিভীষিকাময় যুদ্ধ। দুই পক্ষ থেকে পশুপাতাস্ত্র, পিণাক ধণুক, ত্রিশূল,  বৈষ্ণাবাস্ত্র, সুদর্শণ চক্র, লাঙ্গল প্রভৃতি ভয়ংকর অস্ত্রের প্রয়োগে রক্তের বন্যায় ভেসে গেল রণক্ষেত্র। তবে বহুকাল ধরে চলমান এই যুদ্ধে কোন পক্ষই অপর পক্ষকে পরাজিত করতে পারল না। এমনকি ভগবান শিব ও ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দুজনেই জানতেন তারা উভয়েই অপরাজেয়। তাই এভাবে যুদ্ধ চলমান থাকলে সৃষ্টির বিণাশ অবশ্যম্ভাবী। অবশেষে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ মনে মনে স্তুতি করলেন ভগবান শিবের। তিনি শিবের কাছে জানতে চাইলেন, কিভাবে এই যুদ্ধের পরিনতি দান করা যায়। ভগবান শিব তখন ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জৃম্ভনাস্ত্র প্রয়োগ করার পরামর্শ দেন। এই জৃম্ভনাস্ত্র যার উপরে প্রয়োগ করা হয় তিনি নিদ্রিত এবং নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। ফলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন রণভূমিতে জৃম্ভনাস্ত্র নিক্ষেপ করলেন তখন ভগবান শিব নিদ্রিত হয়ে পড়লেন। এবার ভগবান শিবের অনুপস্থিতিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার সুদর্শণ চক্র প্রয়োগ করে বানাসুরের দুইটি মাত্র বাহু অবশিষ্ট রেখে বাকীগুলোকে কর্তন করে দেন। তবে তিনি বানাসুরকে প্রাণে মারেননি, তার দর্প চূর্ণ করে প্রাণ দান করেছিলেন। আর এভাবেই শেষ হয় হরি ও হরের যুদ্ধ। এবং যুদ্ধ শেষে উষা এবং অনিরুদ্ধকেও উদ্ধার করেছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ।

আরও পড়ুনঃ  এই ১০ বিখ্যাত ব্যাক্তিকে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া হয় নি কেন?

৪. নৃসিংহ বনাম শরভ

ভগবান বিষ্ণুর চতুর্থ অবতার নৃসিংহ অবতারের কথা আপনাদের সকলেরই জানা। সত্যযুগে অত্যাচারী দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুকে বধ করতে এবং ভক্ত প্রহল্লাদকে রক্ষা করতে ভয়ংকর এই অবতারে আবির্ভূত হয়েছিলেন জগতের প্রতিপালক ভগবান শ্রীবিষ্ণু। তবে আপনারা অনেকেই হয়ত জানেন না বিভিন্ন পুরাণে ভগবান শিবের ১৯টি অবতারের উল্লেখ পাওয়া যায়। আর এই ১৯টি অবতারের মধ্যে ভয়ংকরতম এক অবতার হচ্ছেন শরভ অবতার বা শরভেরশ্বর অবতার। আমাদের বাংলায় শরভেশ্বরের কোন মূর্তিকল্প বা পূজো দেখতে না পাওয়া গেলেও দক্ষিণ ভারতে শরভেশ্বর পূজিত হন সাড়ম্বরে। যাইহোক ভগবান শিব ও ভগবান বিষ্ণুর যুদ্ধের চতুর্থ কাহিনীতে মুখোমুখী হয়েছিলেন ভগবান বিষ্ণুর নৃসিংহ অবতার এবং ভগবান শিবের শরভ অবতার।

দুর্দণ্ড প্রতাপশালী অসুর হিরণ্যকশিপুকে বধ করেও ক্রোধ শান্ত হচ্ছিল না ভগবান নৃসিংহদেবের। হিরণ্যকশিপুর রজঃগুণসম্পন্ন রক্ত পান করার ফলে নৃসিংহদেবের ক্রোধ আরও বৃদ্ধি পেতে শুরু করল। আর তাই অসুর বিণাশের পরেও তার ধ্বংসলীলা চালিয়ে যেতে লাগলেন নৃসিংহরূপী ভগবান বিষ্ণু। তাঁর এই উগ্র ধ্বংসলীলা পর্যবেক্ষণ করে আতঙ্কিত দেবতাগণ আশঙ্কা করলেন, এভাবে যদি নৃসিংহদেব তাঁর ধ্বংসলীলা চালিয়ে যেতে থাকেন তাহলে সৃষ্টিতে মহাপ্রলয় নেমে আসবে। তাই স্বর্গের দেবগণ এবার শরণাপন্ন হলেন দেবাদিদেব মহাদেবের। তারা মহাদেবকে অনুরোধ করলেন আসন্ন প্রলয় থেকে সৃষ্টিকে রক্ষা করার জন্য। দেবগণের অনুরোধে মহাদেবও উপলব্ধি করলেন নৃসিংহদেবের অপ্রতিরোধ্য ক্রোধ প্রলয়কাণ্ড ঘটাতে যাচ্ছে সমস্ত সৃষ্টির বুকে। তাই মহাদেব তারই এক উগ্র অনুচর বীরভদ্রকে প্রেরণ করলেন নৃসিংহদেবকে শান্ত করতে। তবে নৃসিংহদেবের তীব্র ক্রোধের সামনে সকল প্রচেষ্টা ব্যার্থ হল বীরভদ্রের। তিনি নৃসিংহদেবকে শান্ত করতে ব্যর্থ হয়ে মহাদেবের হস্তক্ষেপ প্রার্থণা করলেন।

ফলে দেবাদিদেব মহাদেব তাঁর ওমকার স্বরূপের সবচেয়ে ভয়ংকর রূপটি ধারন করলেন। এই রূপটিই শরভ অবতার বা শ্রী শরভেশ্বর নামে পরিচিত। তাঁর এই ভয়ংকর রূপের শক্তি তথা সঙ্গী হিসেবে ছিলেন মাতা আদিশক্তির দুইটি রূপ; মাতা প্রাত্যাঙ্গীরা এবং মাতা শুলিনী। মহাদেবের এই শরভ রূপ মানুষ, সিংহ এবং ঈগলের সমন্বয়ে গঠিত। এই রূপের ছিল সহস্র মস্তক, মাথায় জটা ও অর্ধচন্দ্র , সহস্র হস্ত এবং দুইটি বিশাল ডানা। শরভ অবতারে মহাদেব যখন নৃসিংহদেবের সামনে উপস্থিত হলেন, তখন সমস্ত বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড প্রস্তুতি নিচ্ছিল মহাদেব ও মহাবিষ্ণুর আরও একটি বিভীষিকাময়য় যুদ্ধ প্রত্যক্ষ করার জন্য।

তো শরভেশ্বর যখন নৃসিংহদেবকে যুদ্ধে আহবান করলেন, তখন নৃসিংহদেব প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হয়ে কান্ডাবেড়ুন্ডা”নামের এক বিকট রূপ ধারন করেন। শুরু হয় শরভ ও নৃসিংহদেবের মধ্যে প্রলয়ঙ্করী যুদ্ধ। তাঁদের দুজনেই গগন বিদারী গর্জনে আক্রমণ করতে লাগলেন একে অপরকে। আকাশ বাতাস প্রকম্পিত করে তাঁদের এই মহাযুদ্ধ চলল ১৮ দিন ব্যাপী। ইতিমধ্যে স্বর্গের দেবতারাও মহাদেব ও নারায়ণের এই যুদ্ধের ফল নিয়ে আতঙ্কিত ও শংকিত হয়ে পড়েছেন। অবশেষে এক পর্যায়ে শরভেশ্বরের প্রচণ্ড আঘাতে ভূপাতিত হয়ে আত্মসংবরণ করেন নৃসিংহদেব। চৈতন্য ফিরে পেয়ে তিনি শরভেশ্বরের স্তুতি করেন এবং আসন্ন প্রলয় থেকে সৃষ্টিকে রক্ষা করার জন্য ভগবান শিবের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন।

তবে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে শরভেশ্বর অবতার স্বীকৃত নয়। তাঁদের মতে নৃসিংহদেবের উগ্র ক্রোধ মাতা লক্ষ্মী ও ভক্ত প্রহ্লাদের স্তুতিতেই প্রশমিত হয়েছিল।

Rate this post

Leave a Reply