You are currently viewing অজা বা অন্নদা একাদশীর ব্রত মাহাত্ম্য [রাজা হরিশ্চন্দ্রের কাহিনী ]

অজা বা অন্নদা একাদশীর ব্রত মাহাত্ম্য [রাজা হরিশ্চন্দ্রের কাহিনী ]

একাদশী মাত্রই পরম পবিত্র এক ব্রত, সকল ব্রতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ব্রত। একইভাবে অজা একাদশী বা অন্নদা একাদশী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি একাদশী তিথি। যারা এই তিথি পালন করবেন বা করেন, তাদের জন্য এই ব্রতের মাহাত্ম্য শ্রবণ করা অত্যন্ত জরুরীও বটে। কারন একাদশী মানে শুধুমাত্র উপবাস নয়, বরং একাদশীর মাহাত্ম্য এবং সংশ্লিষ্ট তিথির মাহাত্ম্য বর্ণনা করা ও শ্রবণ করাও একান্ত জরুরী। তাই আসুন এই অজা বা অন্নদা একাদশী তিথির মাহাত্ম্য জেনে নেওয়া যাক।

অজা বা অন্নদা একাদশীর ব্রত মাহাত্ম্য

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে ভাদ্রবর্তী কৃষ্ণপক্ষীয়া তথা ভাদ্রমাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশী তিথিকে বলা হয় অজা বা অন্নদা একাদশী। এখানে এই একাদশী ব্রতের মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে।  পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ সম্রাট যুধিষ্ঠির বললেন- “হে  শ্রীকৃষ্ণ, ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশীর নাম কি, এই একাদশী ব্রতের মাহাত্ম্য কি এবং এর কি ফল তা শুনতে আমি অত্যন্ত আগ্রহী। অনুগ্রহ করে আমাকে এই জ্ঞান প্রদানে বাধিত করবেন।” শ্রীকৃষ্ণ বললেন- “হে রাজন, হে পান্ডবশ্রেষ্ঠ, আমি সবিস্তারে ভাদ্রবর্তী কৃষ্ণপক্ষীয়া একাদশীর কথা বর্ণনা করছি। আপনি একাগ্রচিত্তে শ্রবণ করুন। ”

“ভাদ্রের কৃষ্ণপক্ষীয়া একাদশীকে বলা হয় ‘অন্নদা’ বা ‘অজা’। এই তিথি সর্বপাপবিনাশিনী। যিনি শ্রীহরির অর্চনে এই ব্রত পালন করেন, তিনি সর্বপাপ মুক্ত হন। এমনকি এই ব্রতের নাম শ্রবণেই রাশি রাশি পাপ বিদূরিত হয়ে যায় (হরিবোল)। এই ব্রত প্রসঙ্গে একটি পৌরাণিক ইতিহাস রয়েছে। আপনার জ্ঞানপিপাসা নিবারণের জন্য আমি সেই পৌরাণিক কাহিনীটি বর্ণনা করছি। এই ইতিহাস শ্রবণ করলে আপনি অজা বা অন্নদা একাদশীর গুরুত্ব ও মাহাত্ম্য আরও গভীরভাবে বুঝতে পারবেন”

অতি প্রাচীনকালে কৌশল রাজ্যে (অযোধ্যায়) রাজা হরিশচন্দ্র নামে এক নিষ্ঠাপরায়ণ, সত্যবাদী, চক্রবর্তী রাজা ছিলেন।  তিনি ছিলেন যেমন দাতা, তেমনি ধার্মিক এবং সত্যবাদী ছিলেন৷ তাঁর কাছে কন কিছু চেয়ে কেউ খালি হাতে ফিরতেন না৷ শীঘ্রই তাঁর এমন দানের সখ্যাতি স্বর্গে, মর্ত্যে ও পাতালে ছড়িয়ে পড়ল৷ একদিন দেবরাজ ইন্দ্রের সভায়, বশিষ্ঠ মুনি রাজা হরিশ্চন্দ্রের দানশীলতার কথা বর্ণনা করছিলেন। এসময় ঋষি বিশ্বামিত্র রাজা হরিশ্চন্দ্রের দানের সুখ্যাতি শুনলেন৷ ঋষি বিশ্বামিত্রের  ইচ্ছা হল, তিনি রাজা হরিশ্চন্দ্রের দানশীলতার পরীক্ষা নেবেন। তাই পরীক্ষা নেওয়ার জন্য উপযুক্ত সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন তিনি।

আরও পড়ুনঃ  উৎপন্না একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য

 

রাজা হরিশ্চন্দ্রের কাহিনীঃ

কিছুদিন পর স্বর্গের পাঁচজন অপ্সরা কোন একটি ভুল করার জন্য দেবরাজ ইন্দ্র কর্তৃক অভিশাপগ্রস্থ হন। ইন্দ্রের অভিশাপ ছিল যে, ওই পাচজন অপ্সরাকে মানবী হয়ে জন্মগ্রহন করে ঋষি  বিশ্বামিত্রের তপোবনে কিছুকাল বাস করতে হবে৷ ফলে যা হওয়ার তাই হল, অপ্সরাগণ মানবীরূপে ঋষি বিশ্বামিত্রের আশ্রমে রয়ে গেলেন পরিচারিকা হিসেবে। একদিন তারা বিশ্বামিত্রের তপোবনে পুষ্প চয়ন করতে গিয়ে অসাবধানতাবসত একটি পুষ্পবৃক্ষের শাখা ভেঙে ফেললেন৷ এই কাজের শাস্তিস্বরূপ ঋষি বিশ্বামিত্র তাদেরকে গাছের শাখায় বেঁধে রাখলেন৷ এদিকে দৈবক্রমে কৌশল রাজ্যে রাজা হরিশ্চন্দ্র সেই বনে মৃগয়া করতে আসেন৷ এসময় সেই তপোবনে গাছের ডালে বাঁধা বালিকারূপী অপ্সরাদের করুণ কান্নার আওয়াজ শুনে রাজা তাদের বন্খুধন মুক্লেত করে দিলেনন৷ অপ্সরারাও মুক্ত হয়ে যারপরনাই খুশি হয়ে স্বর্গে গমন করলেন৷ পরদিন প্রাতকালে ঋষি বিশ্বামিত্র পুষ্প চয়ন করতে এসে গাছের শাখায় বাঁধা অপ্সরাদের দেখতে পেলেন না৷ তিনি ধ্যানবলে জানতে পারলেন যে, কৌশলরাজ হরিশ্চন্দ্র তাদের বন্ধন মুক্ত করে দিয়েছেন৷ রেগে আগুন হলেন ঋশি বিশ্বামিত্র, এরপর রাজা হরিশ্চন্দ্রের রাজ্য তথা  অযোধ্যায় চললেন তিনি৷

আরও পড়ুনঃ একাদশী কী? কিভাবে একাদশী আবির্ভাব হলো, একাদশী পালনের নিয়মাবলী, একাদশী মাহাত্ম্য

রাজা হরিশ্চন্দ্র ঋশি বিশ্বামিত্রকে পরম শ্রদ্ধায় বসিয়ে করজোড়ে বললেন, ‘হে রাজর্ষি, এই দাসের প্রতি আপনার কী আদেশ?’ ঋষি বিশ্বামিত্র রাগে তখন কাঁপছেন। বললেন— ‘ হে রাজা! আমি আমার তপোবনে যে বালিকাদের বেঁধে রেখেছিলাম, তুমি কোন স্পর্ধায় তাদেরকে মুক্ত করে দিলে?’ রাজা হরিশ্চন্দ্র সভয়ে উত্তর দিলেন— ‘হে ভগবান, আমি না জেনে এই অন্যায় করে ফেলেছি, আপনি করুণা করে আমাকে ক্ষমা করুন৷ তার বিনিময়ে আপনি যা চান আমি তাই দিতে প্রস্তুত আছি৷’  ঋষিবিশ্বামিত্র বললেন, ‘বটে! খুব দানের বড়াই হয়েছে তোমার, হে রাজা! বেশ তো, আমাকে তোমার সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর তথা রাজ্যটা দান কর দেখি!’

হরিশ্চন্দ্র ঋষির এই আদেশ মেনে নিলেন৷ তিনি তাঁর সমস্ত স্থাবর-অস্থাবর ঋষি  বিশ্বামিত্রকে দান করলেন৷ তখন বিশ্বামিত্র মুনি দানের দক্ষিণা চাইলেন রাজার কাছে৷ রাজা তার ভান্ডাররক্ষীকে সাত কোটি সোনার মোহর দক্ষিণা হিসেবে দিতে আদেশ করলেন৷  এবার বাদ সাধলেন ঋষি বিশ্বামিত্র, বললেন, ‘হে রাজা! তুমি তো ধার্মিক! এখন কার রাজকোষ থেকে অর্থ নিয়ে আমাকে দান করছ তুমি? ভুলে যেও না, তুমি তোমার সমস্ত সবকিছুই আমাকে দান হিসেবে প্রদান করেছ! এখন এ সমস্ত রাজ্য, সমগ্র রাজপুরী, সম্পূর্ণ রাজভাণ্ডার, দামী রাজভূষণ, রানীর বহুমুল্য অলঙ্কার— সবই আমার৷ এতে আর তোমার কোনও অধিকার নেই৷ তাই অন্য কোথাও থেকে আমার দক্ষিণার ব্যাবস্থা কর৷ এবং এই মুহুর্তে তুমি তোমার রাণী শৈব্যা ও তোমার পুত্র রোহিতাশ্বকে নিয়ে আমার অধিকারকৃত এই রাজ্য থেকে প্রস্থান করো৷’

আরও পড়ুনঃ  একাদশী তালিকা ২০২৪ (১৪৩০-১৪৩১) | ব্রত উপবাস ও পারণের সময়সূচী | Ekadashi List 2024 | [বাংলাদেশ ও ভারত]
অন্নদা একাদশীর ব্রত মাহাত্ম্য
রাজা হরিশ্চন্দ্র, রাণী শৈব্যা ও রাজকুমার রোহিতাশ্ব

রাজা হরিশ্চন্দ্র এবার নিজের ভুল বুঝতে পারলেন এবং যারপরনাই লজ্জিত হলেন৷ তিনি বিশ্বামিত্র মুনির কাছ থেকে সাত দিন অতিরিক্ত সময় চেয়ে নিলেন এবং রাজপাট ছেড়ে রাণী ও পুত্রের সঙ্গে কাশী চলে গেলেন৷ সেখানে রানি শৈব্যাকে দাসী হিসেবে ও রোহিতাশ্বকে কাঠুরিয়া হিসেবে এক ব্রাহ্মণের কাছে বিক্রয় করলেন৷ এরপর তিনি নিজেকে এক শ্মশান-চণ্ডালের দাস হিসেবে বিক্রয় করে দিলেন। এর থেকে যে অর্থের আগমন হল তা দিয়ে তিনি ঋশি বিশ্বামিত্রের দক্ষিণার অর্থ যোগাড় করলেন।

একদিন যিনি ছিলেন রাজচক্রবর্তী, যে রাজার সুখের জন্য শত সহস্র দাসদাসী ব্যস্ত দিন কাটাতো, তিনি এখন একজন সামান্য শ্মশান-চণ্ডালের দাস৷ শ্মশানে তিনি ডোমের কাজ করেন ও শূকর প্রতিপালন করেন৷ অন্যদিকে  শত শত দাসী যে রাজরাণী শৈব্যার সেবা করত, তিনি আজ দরিদ্র ব্রাহ্মণের কেনা দাসী৷ আর রাজকুমার রোহিতাশ্ব? তিনি ব্রাহ্মণের পুজোর জন্য পুষ্প চয়ন করেন এবং কাঠ কাটেন ৷

কিন্তু হায়! এর চেয়েও নিষ্ঠুর পরিস্থিতি এগিয়ে এল রাজা হরিশ্চন্দ্রের পরিবারের উপর। একদিন  ব্রাহ্মণের পুষ্প কাননে পুষ্প চয়ন করার সময় রাজকুমার রোহিতাশ্বকে এক কালসর্প দংশন করল৷  রাজকুমার ঢলে পড়ল মৃত্যুর হিমশীতল কোলে৷ রাবী শৈব্যাও তার জগৎ অন্ধকার দেখলেন৷ যে পুত্রের মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি ও রাজা হরিশ্চন্দ্র সমস্ত দুঃখকষ্ট সহ্য করে ছিলেন, সেই স্নেহের পুত্রটিও আজ চলে গেল না ফেরার দেশে৷  রাণী পুত্রশোকে বিলাপ করে কাঁদতে লাগলেন৷ কিন্তু মৃত পুত্রের সৎকারও তো করতে হবে। কিন্তু সেখানে নেই তার কোন আত্মীয়-স্বজন, কে করবে দুঃখিনী মায়ের দুলালের শেষকৃত্য?  তাই নিজের নিজের নাড়ি ছেড়া ধন কোলে নিয়ে চললেন শ্মশানঘাটে৷

আরও পড়ুনঃ একাদশীর উপবাস-দিন নির্ণয়-বিভ্রান্তি ও সমাধান

এদিকে প্রকৃতি সেদিন যুদ্ধাংদেহী ভঙ্গিতে সেজেছে। চারিদিকে ঘোর অন্ধকার ও ভয়ানক দুর্যোগ৷ ঘাটের কড়ি আদায় করার জন্য রাজা হরিশ্চন্দ্র শ্মশানে দাঁড়িয়ে তার দায়ীত্ব পালন করছিলেন৷ এসময় রাণী শৈব্যা তার মৃত-পুত্র নিয়ে ঠিক সেই শ্মশানেই উপস্থিত হলেন৷ তাদেরকে চিনতে না পেরে রাজা হরিশ্চন্দ্র বললেন, যদি তিনি ঘাটের কড়ি না পান তাহলে তিনি শবদাহ করতে পারবেন না৷  রাণী শৈব্যা আর কী বা করবেন?  তিনি নিজেও অপরের কেনা দাসী, ঘাটের কড়ি পাবেন কোথায়? মনের দুঃখে তিনি সেই শ্মশানে বসে রাজা হরিশ্চন্দ্রের নাম ধরে অঝোরে কাঁদতে লাগলেন৷ এমন সময় দৈব ইঙ্গিতে একবার বিদ্যুৎ চমকাল৷ সেই বিদ্যুতের আলোতে রাজা হরিশ্চন্দ্র তার রাণী শৈব্যা ও তারই মৃতপুত্র রোহিতাশ্বকে চিনতে পেরে ডুকরে কেঁদে উঠলেন৷ রাণী শৈব্যাও ডোমের পোষাকে দায়ীত্বরত রাজা হরিশ্চন্দ্রকে চিনতে পেরে তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়লেন৷  তারপর দুজনে মিলে এভাবে অনেকক্ষণ কাঁদলেন তারা৷ পরে পুত্রের জন্য চিতা প্রস্তুত করে নিজেরাও ওই চিতায় আত্মহুতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন ৷

আরও পড়ুনঃ  একাদশীর উপবাস-দিন নির্ণয়-বিভ্রান্তি ও সমাধান

এমন সময়ে স্বয়ং ঋষি বিশ্বামিত্র প্রকট হয়ে বললেন, ‘হে রাজন! ধর্ম ও সত্যের প্রতি আপনার এই অনুরাগে শুধু আমিই না স্বয়ং দেবতারাও তুষ্ট হয়েছেন৷ আপনি প্রকৃতই ধার্মিক, দানবীর ও সত্যবাদী৷ এই দেখুন, আপনার পুত্র বেঁচে উঠেছে৷’ এই বলে রাজকুমার রোহিতাশ্বের গায়ে হাত বোলাতে তিনি বেঁচে উঠলেন৷ ঋষি বিশ্বামিত্র বলে চললেন, ‘হে রাজন! ভাদ্র মাসে কৃষ্ণপক্ষের একাদশী অন্নদা বা অজা নামে জগতে প্রসিদ্ধ। আপনি এই ব্রত পালন করুন। এই ব্রতপ্রভাবে আপনার সমস্ত পাপের, দুঃখের বিনাশ হবে। আপনার ভাগ্যবশত আগামী সাত দিন পরেই এই তিথির আবির্ভাব হবে। ঐ দিন উপবাস থেকে রাত্রি জাগরণ করবেন। এইভাবে ব্রত উদযাপনে আপনার সমস্ত পাপক্ষয় হবে এবং আপনার হারানো সুদিন ফিরে আসবে।

ঋষিবরের উপদেশ মতো তিনি শ্রদ্ধা সহকারে সেই ব্রত পালন করলেন। তার ফলে তাঁর সমস্ত পাপ দূর হল।  আকাশ থেকে দেবগণ দুন্দুভিবাদ্য ও পুষ্পবর্ষণ করতে লাগলেন। এরপর কিছুদিন নিষ্কণ্টক রাজ্যসুখ ভোগ করে অবশেষে আত্মীয়-স্বজন ও নগরবাসী সহ স্বর্গে গমন করলেন তিনি। যে মানুষ নিষ্ঠা সহকারে এই ব্রত পালন করেন, তিনি শ্রীহরি চরণে ভক্তি লাভ করে অবশেষে দিব্যধামে গমন করেন। অন্নদা একাদশীর ব্রত মাহাত্ম্য পাঠ ও শ্রবণে অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল লাভ হয়।

  • হিন্দু বা সনাতন ধর্মীয় সকল প্রকার তথ্য, আচার-নিয়ম, সংস্কৃতি, আখ্যান ও উপাখ্যান জানতে আমাদেরকে ইউটিউবে বা ফেসবুকে ফলো করতে পারেন।

5/5 - (1 vote)

This Post Has 2 Comments

  1. Pingback: অন্নদাএকাদশী 2021 - KRISHNA

Leave a Reply