মহারাজ যুধিষ্ঠিরকে কমলা বা পরমা একাদশী মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছিলেন স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। একদা শ্রীকৃষ্ণের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় আর্যাবর্তের চক্রবর্তী সম্রাট ও পাণ্ডুপুত্র যুধিষ্ঠির শ্রীকৃষ্ণের কাছে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, হে মধুসূদন! পুরষোত্তম মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথি মাহাত্ম্য, ব্রতকথা, আচার ও নিয়ম কানুন আপনার কাছ থেকে আগেই জেনেছি। এবার কৃপা করে অধিমাস, মলমাস বা পুরুষোত্তম মাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশীর নাম, একাদশীর মাহাত্ম্য, পালনীয় বিধি ও এর ফলাফল সম্পর্কে বিশদ্ভাবে আমাকে বলুন।
পরমা একাদশী পালনের নিয়ম
উত্তরে শ্রীকৃষ্ণ সন্তুষ্ট চিত্তে যুধিষ্ঠিরের উদ্দেশ্যে বললেন “হে কৌন্তেয়, কমলা বা পরমা একাদশীতে পালনীয় বিধি পদ্মিনী একাদশী তিথিতে পালনীয় বিধির মত অভিন্ন। অন্যান্য একাদশী তিথির মতই পূর্দবের শমীর দিন থেকেই ব্রত কার্যের সূচনা হয়। এবং দশমীর দিন থেকেই কাঁসার পাত্রে ভোজন, মসুর, ছোলা, শাক এবং অপরের অন্ন ও আমিষ বর্জন করতে হয়। পরের দিন প্রাতঃকৃত্যের পর সুগন্ধী ধূপ, দীপ, চন্দনাদি দিয়ে ভগবানের পূজা করতে হয়। রাত্রিতে জাগ্রত থেকে ভগবানের নাম, গুণ কীর্তন করতে হয়। এবং পদ্মিনী একাদশীর মতই এই কমলা বা পরমা একাদশী ব্রত সুখদাত্রী, মুক্তি দানকারী, আনন্দ প্রদানকারী, পবিত্র এবং পাপবিনাশিনী। এসকল কারনে এই একাদশীর নাম পরমা।”
পরমা একাদশী মাহাত্ম্য
পরমা একাদশী পালনের বিধি ও নিয়ম কানুন বর্ণনা করার পর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবার পরমা একাদশী মাহাত্ম্য বর্ণনা শুরু করলেন। তিনি যুধিষ্ঠিরকে বললেন, “হে মহারাজ যুধিষ্ঠির, পরমা একাদশী কেন একটি অবশ্যই পালনীয় এবং এ একাদশীর প্রভাবে কি ধরনের ফল পাওয়া যায় সেই বিষয়ে একটি কাহিনী এখন আমি আপনাদেরকে বর্ণনা করব। একদা আমি যখন কাম্পিল্য নগরে ভ্রমণ করছিলাম, তখন সেখানকার কিছু সাধু-সন্যাসী ও মুনিঋষিদের সান্নিধ্য লাভ করার সুযোগ হয়েছিল আমার। এবং পরমা একাদশী মাহাত্ম্য বা ব্রতকথার এই কাহিনী আমি তাঁদের শ্রীমুখ থেকেই শ্রবণ করেছিলাম।
পুরাকালে কাম্পিল্য নগরে সুমেধা নামে এক হতদরিদ্র ব্রহ্মণ বাস করতেন। তাঁর স্ত্রীর নাম ছিল পবিত্রা। দেবী পবিত্রা ছিলেন অত্যন্ত সাধ্বী ও পতিব্রতা। কিন্তু পূর্বে কৃত কিছু কর্মফলের কারনে সুমেধা নামের এই বাহ্মণ ধনহীন হয়ে পড়েন। তাঁর অবস্থা এতটা শোচনীয় ছিল যে গৃহীদের কাছে ভিক্ষা চেয়েও তাঁর কপালে কিছুই জুটত না। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর পতিব্রতা স্ত্রী নিষ্ঠা সহকারে পতি সেবা করতেন। তিনি এতটাই ত্যাগী ছিলেন যে গৃহে অতিথি আসলে তাঁদের সেবা করার পরে প্রয়োজন পড়লে তিনি নিজে অনাহারে থাকতেন। দেবী পবিত্রা কখনোই তাঁর স্বামীকে কখনও বলতেন না যে তাঁদের গৃহে অন্ন বা ভোজ্য কিছু নেই। কিন্তু দিনের পর দিন অনাহার ও অর্ধাহারে থাকার পর ক্রমে ক্রমে শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটতে থাকল এই পতিব্রতা নারীর।
আর তাই পত্নীর শারিরীক দূরাবস্থার কথা চিন্তা করে ব্রাহ্মণ সুমেধা নিজের ভাগ্যকে দোষারোপ করতেন। একদিন ব্রাহ্মণ তাঁর পত্নীকে বললেন, “হে কান্তে! তুমি আমাকে নিজ মুখে না বললেও আমি তোমার কষ্ট বুঝি। তোমার জীর্ণ শরীর এই অর্ধাহার-অনাহারের বোঝা বইতে পারছে না। কিন্তু বলো এখন আমি কি করব? শত চেষ্টা করেও আমি ধনবান মানুষদের কাছেও ভিক্ষা চেয়ে পাই না। ক্রোশের পর ক্রোশ হেটে গিয়েও ভিক্ষা সংগ্রহে আমি প্রতিনিয়ত ব্যার্থ হই। এখন আমার ইচ্ছে, ধন সংগ্রহের জন্য আমি দূরদেশে কোথাও যেতে চাই। সেখান থেকে ধনলাভ করতে পারলে তোমার এই কষ্ট আর আমাকে দেখতে হবে না। তুমি আমাকে দূরদেশে ভিক্ষা সংগ্রহে যাওয়ার অনুমতি দাও।”
ব্রাহ্মণপত্নী তখন ক্ষীণ হেসে স্বামীকে বললেন, “হে বিদ্বান! এজগতে প্রত্যেক মানুষ তার পূর্বসঞ্চিত ফল ভোগ করে। তাই পূর্বজন্মের কোন সঞ্চিত ফল না থাকলে স্বর্ণপর্বতে গেলেও কিছু পাওয়া যাবে না। হে স্বামী, পূর্বজন্মে আমি অথবা আপনি কেউই হয়ত আমাদের ধনসম্পদ ইত্যাদি কোন কিছুই সৎপাত্রে দান করিনি। সেকারনেই আজ আমাদের এই দূর্দশা। তাই আমাদের ভাগ্যে যা আছে তা এখানে থেকেই লাভ হবে। তাছাড়া আপনাকে ছাড়া আমি এক মুহূর্তও থাকতে পারব না। কেননা আমার মত পতীহীনাকে দুর্ভাগা বলে সবাই তখন নিন্দা করবে। অতএব এখানে যা ধন লাভ হয় তা দিয়ে আমাদের দুজনের দিনযাপন করাই শ্রেয়। ব্রাহ্মণ সুমেধা তাঁর বিচক্ষণ পত্নীর কথা শুনে তাঁর অভিপ্রায় বদল করলেন। ভাবলেন তাঁর স্ত্রী শুধু সাধ্বী এবং পতিব্রতাই নন, বরং বিচক্ষণ ও জ্ঞানীও বটে। তাই স্ত্রীর পরামর্শে কাম্পিল্য নগরেই অতি কষ্টে দিনাতিপাত করতে লাগলেন এই দম্পতি।
পরমা একাদশী পালনের ফলাফল
একদিন ভগবানের আয়োজনে মুনিশ্রেষ্ঠ কৌণ্ডিন্য পদার্পণ করলেন কাম্পিল্য নগরের সুমেধার পর্ণকুটিরে। এমন বরেণ্য ঋষির দর্শন পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হলেন ব্রাহ্মণ সুমেধা। তিনি সস্ত্রীক মুনিকে ষষ্টাঙ্গে প্রণাম করে, এবং কৌণ্ডিণ্য মুনির পদধৌত করে তাঁকে আপ্যায়ন করলেন। এরপর সুন্দর আসনে বসিয়ে দিয়ে তাঁর পূজা করলেন এবং পদসেবা করলেন। তাঁদের কুটিরে সঞ্চিত সামান্য কিছু ভোজন এনে ঐ দম্পতি আনন্দ সহকারে মুনিকে ভোজন করালেন। তাঁদের আয়োজন অতি সামান্য হলেও তাতে ভক্তি, আন্তরিকতা ও সেবার কোন ত্রুটি ছিল না। তাই মহামুনি কৌণ্ডিণ্য তাঁদের আপ্যায়নে অত্যন্ত প্রীত হলেন।
ঋষির ভোজন সমাপন হওয়ার পরে ব্রাহ্মণপত্নী ঋষি কৌণ্ডিণ্যকে জিজ্ঞাসা করলেন, হে মুনিবর! আমরা অতিশয় দরিদ্র। বহু ক্রোশ পথ হেটেও ভিক্ষা জোটে না আমাদের কপালে। তাই দয়া করে আমাদের এই সামান্য আয়োজনে আপনি পরিতৃপ্ত হন। ব্রাহ্মণ পত্নীর ভক্তিতে আবারও প্রসন্ন হয়ে স্মিত হেসে বরাভয় প্রদর্শন করলেন মহামুনি কৌণ্ডিণ্য। এরপর ব্রাহ্মণ পত্নী আবারও জিজ্ঞাসা করলেন, “হে মুনিবর, আমার স্বামী আমাকে এখানে রেখে ভিক্ষা সংগ্রহের জন্য দূর দেশে যেতে চান। কিন্তু আমি তাঁকে যেতে নিষেধ করেছি। আমার বিশ্বাস ছিল আপনার মত কেউ একজন আমাদেরকে উদ্ধার করার জন্য এখানে পদার্পণ করবেন। হে জ্ঞানী, এখন আমাদের ভাগ্যবশে এখানে আপনার শুভাগমন হয়েছে। আপনিই আমাদেরকে বলে দিন কিভাবে দরিদ্রতা নাশ হয়? বিনা দানে কিভাবে ধন, বিদ্যা, স্ত্রী লাভ হয়? দরিদ্রতা বিনষ্ট হয় এমন কোন ব্রত বা তপস্যার কথা আপনি কৃপা করে আমাদের বলুন।
ব্রাহ্মণ পত্নীর কথা শুনে মুনিবর বললেন, “হে পুত্রী! তোমার বিচক্ষণতা, জ্ঞান, ও ভক্তিতে আমি অতিশয় সন্তুষ্ট হয়েছি। তাই আমিও তোমাদের এই দারিদ্রতা বিমোচনের উপায় বলে যাচ্ছি। পুরুষোত্তম মাসের কৃষ্ণপক্ষের একাদশী তিথির নাম পরমা একাদশী। এই একাদশী সর্বশ্রেষ্ঠা এবং শ্রীভগবানের অতিব প্রিয়তমা। এই পরমা একাদশী ব্রত পালনে মানুষ অন্ন, ধনসম্পদ আদি সবই লাভ করে থাকে। এই ব্রত সর্বপ্রথম পালন করেছিলেন ধনপতি কুবের। রাজা হরিশচন্দ্রও এই ব্রত পালনে স্ত্রী-পুত্র ও রাজ্য ফিরে পেয়েছিলেন। হে বিশালাক্ষী! এই জন্য তোমরাও এই ব্রত পালন কর।” এই বলে ব্রাহ্মণের পর্ণকুটির ত্যাগ করলেন মহামুনি কৌণ্ডিণ্য।
এরপর কৌণ্ডিণ্য মুনির নির্দেশ মোতাবেক ব্রাহ্মণ সুমেধা সস্ত্রীক বিধিমতো পুরুষোত্তম মাসের কল্যানদায়িনী পরমা একাদশী ব্রত পালন করলেন। ব্রত সমাপনের পর আচমকা রাজভবন থেকে এক রাজকুমার তাঁদের ছোট্ট কুটিরে প্রবেশ করলেন। এবং ব্রহ্মার প্রেরণায় এই রাজকুমার বহু ধনসম্পদ, নতুন গৃহ ও গাভী দান করলেন সুমেধা ও স্ত্রীকে। এইভাবে পরমা ব্রতের প্রভাবে ব্রহ্মণ-দম্পতির সকল দুঃখের অবসান হল। অপরপক্ষে ব্রাহ্মণের প্রতি এই দানের ফলে মৃত্যুর পর সেই রাজকুমারও বিষ্ণুলোক প্রাপ্ত হয়েছিলেন।”
শ্রীকৃষ্ণ বলে চললেন, হে পাণ্ডব, যে মনুষ্য এই একাদশী ব্রত পালন না করেন তিনি চুরাশি লক্ষ যোনিতে ভ্রমণ করেও কখনও সুখী হন না। বহু পুণ্য কর্মের ফলে দুর্লভ মানব-জন্ম লাভ হয়। তাই মানব-জীবনে এই একাদশী ব্রত পালন করা অবশ্য কর্তব্য।” স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শ্রীমুখ নিঃসৃত এই পরমা একাদশী মাহাত্ম্য শ্রবণ করে মহারাজ যুধিষ্ঠির তাঁর আত্মীয়বর্গের সঙ্গে এই ব্রত পালন করেছিলেন।
আরও পড়ুনঃ
- পদ্মিনী একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য
- প্রবোধিনী বা উত্থান একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য
- রমা একাদশীর ব্রত মাহাত্ম্য
- পাশাঙ্কুশা বা পাপাঙ্কুশা একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য
- ইন্দিরা একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য
- পদ্মা বা প্বার্শ বা প্বার্শপরিবর্তনী বা জয়ন্তী একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য
- অজা বা অন্নদা একাদশীর ব্রত মাহাত্ম্য [রাজা হরিশ্চন্দ্রের কাহিনী ]
- শ্রাবণ পুত্রদা বা পবিত্রা বা পবিত্রারোপণ বা পবিত্রারোপণী একাদশী ব্রতের মাহাত্ম্য
- কামিকা একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য
- শয়ন বা শ্রী শ্রী হরিশয়নী একাদশীর মাহাত্ম্য
- যোগিনী একাদশীর মাহাত্ম্য
- ভীমসেনী বা পাণ্ডবা নির্জলা একাদশীর মাহাত্ম্য
- অপরা একাদশীর মাহাত্ম্য
- মোহিনী একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য || Mohini Ekadashi Mahatmya ||
- বরুথিনী একাদশীর মাহাত্ম্য
- কামদা একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য
- পাপমোচনী একাদশীর ব্রত মাহাত্ম্য
- আমলকী বা আমলকীব্রত একাদশীর ব্রত মাহাত্ম্য
- বিজয়া একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য
- ভৈমী বা জয়া একাদশী কি? ভৈমী একাদশীর মাহাত্ম্য
- ষটতিলা একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য
- পৌষ পুত্রদা একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য
- সফলা একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য
- মোক্ষদা একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য
- উৎপন্না একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য
- একাদশীর উপবাস-দিন নির্ণয়-বিভ্রান্তি ও সমাধান
- একাদশী কী? কিভাবে একাদশী আবির্ভাব হলো, একাদশী পালনের নিয়মাবলী, একাদশী মাহাত্ম্য