You are currently viewing পদ্মা বা প্বার্শ বা প্বার্শপরিবর্তনী বা জয়ন্তী একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য

পদ্মা বা প্বার্শ বা প্বার্শপরিবর্তনী বা জয়ন্তী একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য

বাংলা ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথির নাম পদ্মা বা পার্শ্ব একাদশী। অনেকে এই একাদশীকে প্বার্শ পরিবর্তনী বা পরিবর্তনী একাদশী নামেও ডেকে থাকেন। আপনারা অনেকেই জানেন, আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষ একাদশী তিথিতে শ্রীভগবান বিষ্ণু ক্ষীর সাগরে শ্বেতদ্বীপে অনন্ত শয্যায় বা যোগনিদ্রায় শয়ন করে নিদ্রিত হন। তাই আষাঢ় শুক্লপক্ষীয় একাদশীটি শয়ন একাদশী নামে খ্যাত। এরপর  ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষে একাদশী তিথিতে অনন্তশয্যায় শায়িত ভগবান শ্রীহরি প্বার্শ পরিবর্তন করেন। এসময় তিনি বাম অঙ্গ পরিবর্তন করে দক্ষিণ অঙ্গে শয়ন করেন, তাই এই একাদশীকে প্বার্শ একাদশী বা পরিবর্তিনী একাদশী বা পদ্মা একাদশীও বলা হয়। এবং সর্বশেষ, কার্তিক মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী  তিথিতে ভগবান বিষ্ণু যোগনিদ্রা থেকে জাগরিত হন। তাই সেই একাদশীর নাম হলো উণ্থান একাদশী। বিষ্ণুর এই শয়ন, পার্শ্ব পরিবর্তন ও উত্থান উপলক্ষে যথাক্রমে আষাঢ়, ভাদ্র ও কার্তিক মাসের শুক্লা একাদশী বিশেষ শুভপ্রদ গণ্য করা হয়। ছরের এই চার মাস ব্যাপী পালিত হয় চাতুর্মাস্য ব্রত। প্রাকৃতিক কারণে এসময় মানুষের দেহ ও মনে রজঃ ও তম গুণের প্রভাব অধিক দেখা যায়, অঘটন বেশী ঘটে। তাই কায়মনোবাক্যে সংযত থাকা বাঞ্ছনীয়। কোনও কোনও বিষয়ে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়।
পার্শ্ব একাদশী
অনন্ত শয্যায় শায়িত শ্রীবিষ্ণু

চাতুর্মাস্য ব্রত পালনের নিয়মঃ

চতুর্মাসেষু কর্তব্যং কৃষ্ণভক্তি বিবৃদ্ধয়ে ॥
পুরাণে বলা হয়েছে,

যো বিনা নিয়মং মর্ত্যো
ব্রতং বা জপ্যমেব বা।
চাতুর্মাস্য নয়েন্ মূর্খো
জীবন্নপি মৃতো হি সঃ ॥

যে ব্যক্তি নিয়ম, ব্রত বা জপ ব্যতীত চাতুর্মাস্য যাপন করে, সেই ব্যক্তি অজ্ঞ ও জীবন্মৃত।
শ্রীব্রহ্মা নারদমুনিকে বলছেন, হে নারদ, চাতুর্মাস্য ব্রত ভক্তি সহকারে পালন করলে মানুষ পরমাগতি লাভ করার সুযোগ পাবে।
ব্রত নিয়মগুলি হলো :-

  • বেশী বেশী করে হরিনাম জপ করতে হবে। যারা হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করেন না, তাঁরা শুরু করে দেবেন। যারা নিয়মিত মন্ত্র জপ করেন, তাঁরা জপসংখ্যা বৃদ্ধি করবেন। কলিবদ্ধ জীবের সদ্গতি লাভের একমাত্র উপায় হরিনাম। আমাদের মনকে সুরক্ষা দান করে মন্ত্র হরিনাম।
  • প্রতিদিন গীতা-ভাগবত শ্রবণ বা পাঠ করতে হবে। ভগবানের কথা, ভক্তের কথা আলোচনাই আমাদের অসার হৃদয়ে আশা ও আনন্দ সঞ্চার করে থাকে। যারা ভগবৎ কথায় সময় দিতে পারে না, তারা আজেবাজে কথায় সময় পেয়ে বসে।
  • তর্ক, গালগল্প এড়িয়ে চলতে হবে। কলিযুগের মানুষ আমরা তর্ক করতে, ঝগড়া বাধাতে, গালগল্পে খুবই উন্মুখ হয়ে থাকি। টিভি দেখা, নভেল পড়াও এর অন্তর্ভুক্ত। এসব অসৎসঙ্গ দোষ ছাড়া অন্য কিছু নয়।
  • প্রত্যূষে স্নান সারতে হবে। ভক্তগণ তো ভোর চারটায় স্নান সেরে মঙ্গল আরতিতে যোগ দেন। যত্ন নেন কোনও দিন যেন ফাঁকি না যায়। মঙ্গলময় শ্রীহরির কৃপাকটাক্ষ লাভের উপযুক্ত ব্রাহ্মমুহূর্তে শুচিশুদ্ধ হয়ে জেগে থাকা বাঞ্ছনীয়।
  • শ্রাবণে শাক, ভাদ্রে দই, আশ্বিনে দুধ এবং কার্তিকে মাষকলাই ডাল খাওয়া চলবে না। এই সময়ে এই দ্রব্যগুলি রোগ সৃষ্টি করে। মন বিক্ষিপ্ত করে। স্কন্দ পুরাণে বলা হয়েছে-

শ্রাবণে বর্জয়েৎ শাকং
দধি ভাদ্রপদে তথা।
দুগ্ধম্ আশ্বযুজে মাসি
কার্তিকে চামিষং ত্যজেৎ ॥
বিশেষতঃ, কার্তিক মাসে বেগুন, বরবটি, শিম আহার নিষিদ্ধ।

  • শ্রীহরি অর্চন কিংবা শ্রীহরিভক্তিমূলক অন্য কোনও সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতে হবে। সবসময় জানতে হবে অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা। আচারে হোক, প্রচারে হোক যেকোনও সেবায় সবসময় সংযুক্ত থাকতে হবে, তাহলেই আমরা ভালো থাকবো।
আরও পড়ুনঃ  কামদা একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য

আরও পড়ুনঃ একাদশী কী? কিভাবে একাদশী আবির্ভাব হলো, একাদশী পালনের নিয়মাবলী, একাদশী মাহাত্ম্য

এই চাতুর্মাস্য ব্রতের ব্রতকারীরা কেউ শয়ন একাদশী থেকে উত্থান একাদশী পর্যন্ত, কেউ আষাঢ় মাসের গুরু পূর্ণিমা থেকে কার্তিক মাসের হৈমন্তী রাস পূর্ণিমা পর্যন্ত, আবার কেউ কর্কট সংক্রান্তি থেকে মকর সংক্রান্তি পর্যন্ত- এইভাবে পালন করে থাকেন। মোটামুটি যে দিন শুরু করবেন তার চার মাস পরে সমাপন করবেন।এই ব্রত ফলে মন সুন্দর হয়, শরীর ও প্রাণ সুন্দর হয়। বলা হয়, চার মাস বিষ্ণু শায়িত থাকেন। মানুষ এই ব্রত করলে বিষ্ণুর সুখনিদ্রা হয়। বিষ্ণুর পাদপদ্ম সেবায় রতা লক্ষ্মীদেবী তখন ব্রতকারীদের প্রতি প্রসন্না হন। তখন লক্ষ্মীর তুষ্ট দৃষ্টিপাতের ফলে ব্রতকারী লক্ষ্মীমন্ত হয়। নিয়ম শিষ্টাচার হীন হলে বিষ্ণুর নিদ্রা বিঘ্নিত হয়। বিষ্ণুর পাদপদ্ম সেবায় রতা লক্ষ্মীদেবী তখন অনুভব করেন যে, লোকেরা ব্রতহীন ও উচ্ছৃঙ্খল হওয়ার ফলে প্রভুর নিদ্রা বিঘ্নিত হচ্ছে। তখন লক্ষ্মীদেবী ব্রতহীনদের প্রতি রুষ্টা হন। তাঁর রুষ্ট দৃষ্টিপাতের ফলে লোকে লক্ষ্মীছাড়া হয়। তখন জীবনে নানা রকমের দুর্বিপাক লেগে থাকে।

এবং চ কুর্বতো মাসাং
শ্চতুরো যান্তি বৈ সুখম্।
অন্যথা প্রভবেদ্ দুঃখম্
অনাবৃষ্টিশ্চ জায়তে ॥

“এভাবে চার মাস ব্রত পালন করলে সুখে যাপন হবে। নতুবা দুঃখের প্রভাব বৃদ্ধি হবে, অনাবৃষ্টি ও অন্যান্য দুর্বিপাক লেগে থাকবে।”
সার্বিক ব্রতনিয়ম থাকা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত কিছু কিছু ব্রতসংকল্প করে থাকেন কোনও কোনও ব্রতকারী। সেই আচরণগুলিও শাস্ত্রসম্মত। যেমন-

১) সারাদিনে একবার মাত্র হবিষ্যান্ন গ্রহণ করা,

২) বিছানা না পাতিয়ে মাটিতে ঘুমানো,

৩) থালা-বাটি ব্যবহার না করে কলাপাতা বা পদ্মপাতা ব্যবহার করা,

৪) শরীরে তেল না মাখা,

৫) নখ, চুল না কাটা,

৬) মৌন থাকা।

বিভিন্ন প্রকার ব্রত আচরণেও ভিন্ন ভিন্ন পুরস্কার বিহিত রয়েছে। কেউ কেউ লবণ খাবে না, কেউ কেউ মিষ্টি জিনিস খাবে না, কেউ কেউ দুধজাতীয় কোনও খাবার গ্রহণ করবে না। কেউ কেউ মাটিতে মুখ দিয়ে খাবার গ্রহণ করেন। আমাদের দেশে অনেকেই আমিষপ্রিয় ও নেশাপ্রিয় মানুষ রয়েছেন। সেক্ষেত্রে বলা হয়েছে, যদি কেউ চাতুর্মাস্যে মদ ও মাছ-মাংস বর্জন করতে পারে, তবে সে এক সুন্দর যোগী হতে পারবে, ওজস্বী ব্যক্তিত্ব হতে পারবে।পরিশেষে, উল্লেখ্য এই যে, শ্রীহরির প্রতি একটু একটু ভক্তি অনুশীলন, বার ব্রত পালন, আমাদের জীবনকে পবিত্র ও মহান করে তোলে।

আরও পড়ুনঃ  মোক্ষদা একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য
পার্শ্ব একাদশী
পার্শ্ব একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য

পদ্মা/পরিবর্তনী/পার্শ্ব একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য

ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে ভাদ্রমাসের শুক্লপক্ষের পদ্মা/পরিবর্তনী/পার্শ্ব একাদশী মহাত্ম্য যুধিষ্ঠির-শ্রীকৃষ্ণ সংবাদে বর্ণনা করা হয়েছে। পাণ্ডবশ্রেষ্ঠ মহারাজ যুধিষ্ঠির ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করলেন-হে মাধব! ভাদ্র মাসের শুক্লপক্ষের একাদশীর নাম কি? এই ব্রত পালনের বিধি কি এবং ব্রত পালনেই বা কি পুণ্য লাভ হয়? অনুগ্রহ করে আমাকে সবিস্তারে বর্ণনা করে কৃতার্থ করবেন। উত্তরে ভগবান  শ্রীকৃষ্ণ বললেন- হে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির, মহাপুণ্যপ্রদা, মুক্তিদায়িনী এবং সমস্ত পাপহারিনী এই একাদশী বাজপেয় যজ্ঞ থেকেও বেশি ফল দান করে। যে ব্যক্তি এই তিথিতে ভক্তি সহকারে ভগবান শ্রীবামনদেবের পূজা করেন, তিনি ত্রিলোকে পূজিত হন। পদ্মফুলে পদ্মলোচন শ্রীবিষ্ণুর অর্চনকারী বিষ্ণুলোক প্রাপ্ত হন। শায়িত ভগবান এই তিথিতে পার্শ্ব পরিবর্তন করেন। তাই এর পার্শ্ব একাদশী বা পরিবর্তিনী একাদশী।
যুধিষ্ঠির মহারাজ বললেন- হে জনার্দন! আপনার এসকল কথা শুনেও আমার সন্দেহ পূর্ণরূপে দুর হয়নি। হে দেব! আপনি কিভাবে শয়ন করেন, কিভাবেই বা পার্শ্ব পরিবর্তন করেন, আর চার্তুমাস্য ব্রত পালনকারীর কি কর্তব্য এবং আপনার শয়নকালে লোকের কি করণীয়? এসব বিষয়ে বিস্তারিতভাবে আমাকে বলুন। আর কেনই বা দৈত্যরাজ বলিকে বেঁধে রাথা হয়েছিল, তা বর্ণনা করে আমার সকল সন্দেহ দূর করুন।
শ্রীকৃষ্ণ বললেন- হে রাজন! দৈত্যকুলে আবির্ভূত প্রহ্লাদ মহারাজের পৌত্র ‘বলি’ আমার অতি প্রিয় ভক্ত ছিল। সে আমার সন্তুষ্টি বিধানের জন্য গো-ব্রাহ্মণ পূজা ও যজ্ঞাদি ব্রত সম্পাদন করত। কিন্তু ইন্দ্রের প্রতি বিদ্বেষবশত সকল দেবলোক সে জয় করে নেয়। তখন দেবতাগণসহ ইন্দ্র আমার শরণাপন্ন হয়েছিল। তাদের প্রার্থনায় আমি বাহ্মণবালক বেশে বামনরূপে বলি মহারাজের যজ্ঞস্থলে উপস্থিত হলাম। তার কাছে আমি ত্রিপাদভূমিমাত্র প্রার্থনা করেছিলাম। সেই তুচ্ছবস্তু থেকে আরও শ্রেষ্ঠ কিছু সে আমাকে দিতে চাইলেও আমি কেবল ত্রিপাদ ভূমি প্রহণেই স্থির থাকলাম। দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য আমাকে ভগবানরূপে জানতে পেরে বলিমহারাজকে ঐ দান দিতে নিষেধ করল। কিন্তু সত্যাশ্রয়ী বলি গুরুর নির্দেশ অমান্য করে আমাকে দান দিতে সংকল্প করল। তখন আমি এক পদে নীচের সপ্তলোক, আরেক পদে উপরের সপ্তভুবন অধিকার করে নিলাম। পুনরায় তৃতীয় পদের স্থান চাইলে সে তার মাথা পেতে দিল। আমি তার মস্তকে তৃতীয় পদ স্থাপন করলাম। তার আচরণে সন্তুষ্ট হয়ে আমি সর্বদা তার কাছে বাস করার প্রতিশ্রুতি দিলাম।

আরও পড়ুন একাদশীর উপবাস-দিন নির্ণয়-বিভ্রান্তি ও সমাধান

ভাদ্র শুক্লপক্ষীয়া একাদশীতে ভগবান শ্রীবামনদেবের এক মূর্তি বলি মহারাজের আশ্রমে স্থাপিত হয়। দ্বিতীয় মূর্তি ক্ষীর সাগরে অনন্তদেবের কোলে শয়ন একাদশী থেকে উত্থান একাদশী পর্যন্ত চারমাস শয়ন অবস্থায় থাকেন। এই চারমাস যে ব্যক্তি নির্দিষ্ট নিয়ম, ব্রত বা জপ তপ ব্যতীত দিনযাপন করে, সেই মহামূর্খ জীবিত থাকলেও তাকে মৃত বলে জানবে। শ্রাবণ মাসে শাক, ভাদ্র মাসে দই, আশ্বিনে দুধ, কার্তিক মাসে মাসকলাই বর্জন করে এই চারমাস শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা করতে হয়। প্রতিটি একাদশী ব্রত যথাযথ পালন করতে হয়। শায়িত ভগবান পার্শ্ব পরিবর্তন করেন বলে এই একাদশী মহাপূণ্য ও সকল অভীষ্ট প্রদাতা। এই পদ্মা বা পার্শ্ব একাদশী ব্রত পালনে এক সহস্র অশ্বমেধ যজ্ঞের ফল পাওয়া যায়।
  • হিন্দু বা সনাতন ধর্মীয় সকল প্রকার তথ্য, আচার-নিয়ম, সংস্কৃতি, আখ্যান ও উপাখ্যান জানতে আমাদেরকে ইউটিউবে বা ফেসবুকে ফলো করতে পারেন।

5/5 - (1 vote)

This Post Has One Comment

Leave a Reply