You are currently viewing পদ্মিনী একাদশী মাহাত্ম্য || পুরুষোত্তম মাস, অধিমাস বা মলমাসের শুক্লপক্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রত ||

পদ্মিনী একাদশী মাহাত্ম্য || পুরুষোত্তম মাস, অধিমাস বা মলমাসের শুক্লপক্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ ব্রত ||

পদ্মিনী একাদশী মাহাত্ম্য বর্ণনা করেছিলেন স্বয়ং পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। মূলত স্মার্তগণ পুরুষোত্তম মাস বা অধিমাসকে মলমাস নামে আখ্যায়িত করে মাসে সমস্ত শুভকার্য পরিত্যাগ করে থাকেন। কিন্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই মাসকে পারমার্থিক মঙ্গলের জন্য অন্য সকল মাস থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে নির্ণয় করেছেন। এবং ভগবানের নিজের নামানুসারে এই মাসের নামকরা হয়েছে পুরুষোত্তম মাস। একদা পাণ্ডুপুত্র মহারাজ যুধিষ্ঠির এক একান্ত আলোচনায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কাছে বিনীতভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, “হে জনার্দন! আমি বহুধর্ম ও ব্রতের কথা শুনেছি। এবার আপনি দয়া করে পুরুষোত্তম মাসের সর্বপাপবিনাশিনী ও পুণ্যদায়িনী শুক্লপক্ষীয়া পদ্মিনী একাদশীর মাহাত্ম্য কথা আমার কাছে বর্ণনা করুন, যা শ্রবণ করলেন পরমপদ প্রাপ্ত হওয়া যায়।”

পদ্মিনী একাদশী পালনের নিয়ম

যুধিষ্ঠিরের জ্ঞানতৃষ্ণা ও সমর্পণে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বঙ্কিম ঠোঁটে ফুটে উঠল প্রসন্নতার হাসি। তিনি যুধিষ্ঠিরকে সহাস্য বদনে বললেন, “হে চক্রবর্তী সম্রাট যুধিষ্ঠির, পদ্মিনী একাদশী তিথিতে অন্যান্য একাদশী তিথির মতই পূর্দবের শমীর দিন থেকেই ব্রত কার্যের সূচনা হয়। এবং দশমীর দিন থেকেই কাঁসার পাত্রে ভোজন, মসুর, ছোলা, শাক এবং অপরের অন্ন ও আমিষ বর্জন করতে হয়। পরের দিন প্রাতঃকৃত্যের পর সুগন্ধী ধূপ, দীপ, চন্দনাদি দিয়ে ভগবানের পূজা করতে হয়। রাত্রিতে জাগ্রত থেকে ভগবানের নাম, গুণ কীর্তন করতে হয়।”

এ পর্যন্ত বলে একটু থামলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তিনি দেখতে পেলেন মহারাজ যধিষ্ঠিরের চোখে মুখে তখনও অতৃপ্তির ছাপ। অর্থাৎ, তিনি আরও বিশদভাবে ভগবানের কাছ থেকে পদ্মিনী একাদশী মাহাত্ম্য শ্রবণ করতে চান। অন্তর্যামী ভগবান বুঝতে পারলেন ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের এই গোপন অভিপ্রায়। তাই এবার তিনি বলে উঠলেন, “হে ধর্মপুত্র, এখন এই ব্রতের একটি ইতিহাস আপনার মনোরঞ্জনের জন্য এবার বর্ণনা করছি। বহু পূর্বে ঋষি পুলস্ত্য মহা বিষ্ণুভক্ত দেবর্ষি নারদকে এই ইতিহাস বর্ণনা করছিলেন।

পদ্মিনী একাদশী মাহাত্ম্য
পদ্মিনী একাদশী মাহাত্ম্য

পদ্মিনী একাদশী মাহাত্ম্য

একসময় আপনাদের এই কুরু-পাণ্ডব বংশের রাজা এবং আপনাদেরই পূর্বপুরুষ ছিলেন রাজ কার্তবীর্য। তিনি ছিলেন অতুলনীয় রকমের বলশালী। একদা এই রাজা কার্তবীর্যমহা ধুরন্ধর ও মহাবলি রাক্ষস লঙ্কাপতি রাবণকে পরাজিত করে তাঁর কারাগারে বন্দী করে রাখেন। লঙ্কাধীশ রাবণ ছিলেন মহামুনি পুলস্ত্য এর পৌত্র। তাই স্বর্গে মহর্ষি পুলস্ত্য তার নাতি রাবণের পরাজয়ের সংবাদ পেয়ে ত্বরিত মাহিষ্মতী নগরে এলেন। সেই উদীয়মান সূর্যের ন্যায় ঋষিকে দেখে কার্তবীর্যার্জুন তাঁকে সাদর অভ্যর্থনা জানালেন। এবং মহর্ষির আগমনের কারণ জানতে চাইলেন। ঋষি কার্তবীর্যার্জুনের কাছে রাবণের মুক্তি প্রার্থনা করলেন।

আরও পড়ুনঃ  উৎপন্না একাদশী ব্রত মাহাত্ম্য

প্রচণ্ড বলশালী ক্ষত্রিয় রাজা কার্তবীর্য মুনি ঋষিদেরকে খুবই সম্মান করতেন। তাই মুনির আজ্ঞায় রাজা রাবণকে মুক্ত করে দেন তিনি।এবং রাবণকে অনেক উপহার প্রদান করে তাঁর সঙ্গে মিত্রতায় আবদ্ধ হলেন। এই আশ্চর্যজনক কথা শুনে দেবর্ষি নারদ পুলস্ত্য মুনিকে জিজ্ঞাসা করেন, “হে মুনিবর! ইন্দ্রসহ সকল দেবতা যেখানে রাবণের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন সেখানে কিভাবে সামান্য ক্ষত্রিয় রাজা কার্তবীর্য রাবণকে পরাজিত করলেন? কৃপা করে তা আমাকে বলুন। মহামুনি পুলস্ত্য তখন দেবর্ষি নারদের কাছে কার্তবীর্য জন্ম রহস্য বর্ণনা করেন।

বহুকাল আগের কথা। তখন চলছে ত্রেতাযুগ। সেকালে হৈহয় বংশে ক্নৃতবীর্য নামে এক মহাপরাক্রমশালী রাজা ছিলেন। চাকচিক্যময় নগরী মহিস্মতীপুরে ছিল তাঁর রাজধানী। রাজা কৃতবীর্যের ছিল এক হাজার পত্নী। কিন্তু কোন রানীর গর্ভেই রাজ্যসভার গ্রহণের মতো কোন পুত্র সন্তান জন্ম গ্রহণ করে নি। এমনকি দেবতাদের আরাধনাতেও  বংশপ্রদীপের দেখা পেলেন না তিনি। অবশেষে সাধু সন্যাসীদের আজ্ঞানুসারে বিভিন্ন ব্রত পালন করা শুরু করলেন রাজা ক্নৃতবীর্য। তথাপিও রাজা ছিলেন অপুত্রক। তাই একদা নিজের মন্ত্রীর ওপর রাজ্যভার অর্পণ করে কঠোর তপস্যায় অরণ্যে গমন করবেন বলে স্থির করলেন রাজা ক্নৃতবীর্য। কৃতবীর্যের এক হাজার রানীর মধ্যে মহারাজ হরিশচন্দ্রের কন্যা পদ্মিনী ছিলেন অত্যন্ত পতিব্রতা। স্বামীর মনের অবস্থা বুঝতে পেরে এই মহিয়সী নারীও স্বামীর সাথে তপস্যার জন্য মন্দার পর্বতে গমন করলেন। মান্দার পর্বতের চূড়ায় বসে রাজা কৃতবীর্য ও রানী পদ্মিনী দশ হাজার বছর ধরে কঠোর তপস্যা করলেন। কিন্তু তবুও কার্তবীর্য পুত্রসুখ বঞ্চিতই রইলেন।

হতাশায় নিমজ্জিত স্বামী কৃতবীর্যের দিকে তাকিয়ে মর্মাহত হলেন রানী পদ্মিনীও। এবার এই মহাসাধ্বী রমনী অনুসূয়াকে জিজ্ঞাসা করলেন, “হে সাধ্বী! একটি পুত্র সন্তান লাভের আশায় আমি ও আমার স্বামী দশ হাজার বছর তপস্যা করেও বিফল হয়েছি। আমার স্বামীর এই মলিন মুখমণ্ডল আমাকে এখন প্রতিনিয়ত পীড়া প্রদান করছে। দয়া করে আমাকে এমন কোন ব্রতের কথা বলুনন যে ব্রত পালনে ভগবান প্রসন্ন হন এবং অতিশ্রেষ্ঠ পুত্র লাভ হয়, এমন কোন উপায় বিধান করুন।” পদ্মিনীর প্রার্থনায় প্রসন্ন হলেন অনুসূয়া। তিনি বললেন, “হে রানীশ্রেষ্ঠ, প্রতি বত্রিশ মাস পর পর এক অধিমাস বা পুরুষোত্তম মাস আসে। এই মাসের শুক্লপক্ষে আসে পদ্মিনী ও কৃষ্ণপক্ষে আসে পরমা নামে দুই একাদশী। এই ব্রত পালন করলে পুত্রদাতা ভগবান শীঘ্রই প্রসন্ন হন। অতএব আপনি নিষ্ঠার সাথে এই ব্রত পালন করুন। নিশ্চই শ্রীভগবান আপনাদের উপর প্রীত হয়ে পুত্রসন্তান উপহার দেবেন।”

আরও পড়ুনঃ  একাদশী কী? কিভাবে একাদশী আবির্ভাব হলো, একাদশী পালনের নিয়মাবলী, একাদশী মাহাত্ম্য

অনুসূয়ার নির্দেশে পদ্মিনী পরম শ্রদ্ধা সহকারে ও সঠিক নিয়মে এই পদ্মিনী একাদশী ব্রত পালন করলেন। ব্রত শেষে পদ্মিনী দেখতে পেলেন স্বয়ং ভগবান বিষ্ণূ ভগবান গরুড় বাহনে আরোহন করে পদ্মিনীর সম্মুখে উপস্থিত হয়েছেন। এ দৃশ্য দেখে আনন্দে আপ্লুত হলেন পদ্মিনী। এরপর ষষ্টাঙ্গে প্রণাম করলেন শ্রীভগবানকে। ভগবান বললেন, “হে ভদ্রে! তোমার অতুলনীয় নিষ্ঠা ও পদ্মিনী একাদশী ব্রত পালনে আমি অতিশয় প্রসন্ন হয়েছি। পুরুষোত্তম মাসের সমান কোন মাস আমার প্রিয় নয়। এই মাসের একাদশী আমার পরম প্রিয়। তুমি সেই ব্রত যথাযথ পালন করেছ। তাই আমি তোমার ইচ্ছানুরূপ বর প্রদান করব। বল কি তোমার প্রার্থনা?”

ভগবানের স্তব করে রাণী পদ্মিনী বললেন, “হে পরমেশ্বর, আমি চাই আমার এই বর আমার স্বামীর প্রাপ্য হোক। আপনি অনুগ্রহ করে আমার স্বামীকে এই বরদান করুন। ভগবান বিষ্ণু পদ্মিনীর পতিভক্তি দেখে আরও একবার সন্তুষ্ট হলেন। এরপর তিনি  রাজার কাছে এসে বললেন, “হে রাজেন্দ্র! আপনার মহীয়সী স্ত্রী তাঁর ব্রতের ফল আপনাকে অর্পণ করেছেন। এবার আপনি আপনার অভিলাষিত বর প্রার্থনা করুন।”  মহানন্দে রাজা কৃতবীর্য বললেন, “হে জগৎপতি, মধুসুদন, আমি বহুকাল যাবত পুত্রসন্তান লাভ থেকে বঞ্চিত। আমি আমার বংশ ও রাজ্য সংরক্ষণ করার জন্য দেবতা, মানুষ, নাগ, দৈত্য, রাক্ষস আদি কেউ তাকে পরাজিত করতে পারবে না, এমন পুত্র আমি প্রার্থনা করি।”  রাজার প্রার্থনা অনুসারে ভগবান তাঁকে বরদান করে বললেন, “তথাস্তু”। এরপর ভগবান অন্তর্হিত হলেন। রাজা কৃতবীর্য পত্নীসহ নগরে ফিরে এলেন। যথাসময়ে রাণী পদ্মিনীর গর্ভে মহাবলশালী এক পুত্রের জন্ম হয়। মহারাজ কৃতবীর্য তাঁর বহু অভিলাষিত পুত্রের নাম রাখেন কার্তবীর্য বা কার্তবীর্যার্জুন। ত্রিলোকে তার সমান কোন বীর ছিল না। তাই দশানন রাবণ যুদ্ধে তার কাছে পরাজিত হয়।”

পদ্মিনী একাদশী পালনের ফল

এসকল ঘটনা বর্ণনা করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন, হে কুন্তী নন্দন, এই পদ্মিনী একাদশী ব্রত যিনি নিয়ম মাফিক ও নিষ্ঠার সাথে পালন করবেন, তিনি ভগবান শ্রীহরির শ্রীপাদপদ্মে অহৈতুকী ভক্তি লাভ করবেন। তাছাড়া যিনি এই  পদ্মিনী একাদশী মাহাত্ম্য পাঠ ও শ্রবণ করেন তিনি বহু পুণ্য লাভ করেন।” এরপর শ্রীকৃষ্ণের উপদেশে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির সপরিবারে এই একাদশী ব্রত পালন করেন।

আরও পড়ুনঃ  অজা বা অন্নদা একাদশীর ব্রত মাহাত্ম্য [রাজা হরিশ্চন্দ্রের কাহিনী ]

আরও পড়ুনঃ

5/5 - (1 vote)

Leave a Reply