পাণ্ডবা নির্জলা একাদশীর মাহাত্ম্য বৈষ্ণব সমাজে কাছে সর্বাধিক। বছরের ১২টি একাদশীর মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একাদশীর নাম হচ্ছে নির্জলা একাদশী। এই একাদশী তিথিটি পাণ্ডব, পাণ্ডবা, নির্জলা, নিজ্জলা, ভীমসেন বা ভীমসেনী একাদশী নামেও পরিচিত আমাদের বৈষ্ণব সমাজে। পাণ্ডুপুত্র ভীম এই একাদশী তিথি থেকে একাদশী পালন করেছিলেন বিধায় এই একাদশীটি জগতে ভীমসেনী বা পাণ্ডবা নির্জলা একাদশী নামে কীর্ত্তিত। আজ সনাতন এক্সপ্রেসের পাঠকদের জন্য রইল এই মহাপূন্যফলদাতা একাদশী তিথির মাহাত্ম্য, মহিমা এবং এ সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য।
পাণ্ডবা নির্জলা একাদশীর মাহাত্ম্য
বাংলা বছরের ২য় মাস তথা জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিকে নির্জলা বা পাণ্ডবা একাদশী নামে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। পাণ্ডবা নির্জলা একাদশীর মাহাত্ম্য ও মহিমা বর্ণিত হয়েছে ব্রহ্মবৈবর্তপুরাণে শ্রীভীমসেন-ব্যাসসংবাদে। আসুন আমরাও এই একাদশী ব্রতের মহিমা মনোযোগ সহকারে পঠন ও শ্রবণ করি।
শ্রীব্যাসদেবের মুখে পাণ্ডবা নির্জলা একাদশীর মাহাত্ম্য
মহারাজ যুধিষ্ঠির বললেন- হে জনার্দন! আমি অপরা একাদশীর সমস্ত মাহাত্ম্য শ্রবণ করলাম এখন জ্যৈষ্ঠ শুক্লপক্ষের একাদশীর নাম ও মাহাত্ম্য কৃপাপূর্বক আমার কাছে বর্ণনা করুন। শ্রীকৃষ্ণ বললেন, এই একাদশীর কথা মহর্ষি ব্যাসদেব বর্ণনা করবেন। কেননা তিনি সর্বশাস্ত্রের অর্থ ও তত্ত্ব পূর্ণরূপে জানেন। রাজা যুধিষ্ঠির ব্যাসদেবকে বললেন- হে মহর্ষি দ্বৈপায়ন! আমি মানুষের লৌকিক ধর্ম এবং জ্ঞানকান্ডের বিষয়ে অনেক শ্রবণ করেছি। আপনি যথাযথভাবে ভক্তিবিষয়িনী কিছু ধর্মকথা এখন আমায় বর্ণনা করুন।
শ্রীব্যাসদেব বললেন, “হে মহারাজ! তুমি যেসব ধর্মকথা শুনেছ এই কলিযুগের মানুষের পক্ষে সে সমস্ত পালন করা অত্যন্ত কঠিন। যা সুখে, সামান্য খরচে, অল্প কষ্টে সম্পাদন করা যায় অথচ মহাফল প্রদান করে এবং সমস্ত শাস্ত্রের সারস্বরূপ সেই ধর্মই কলিযুগে মানুষের পক্ষে করা শ্রেয়। সেই ধর্মকথাই এখন আপনার কাছে বলছি।
পাণ্ডবা নির্জলা একাদশী পালনের নিয়ম
উভয় পক্ষের একাদশী দিনে ভোজন না করে উপবাস ব্রত করবে। দ্বাদশী দিনে স্নান করে শুচিশুদ্ধ হয়ে নিত্যকৃত সমাপনের পর শ্রীকৃষ্ণের অর্চন করবে। এরপর ব্রাহ্মণদেরকে প্রসাদ ভোজন করাবে। অশৌচাদিতেও এই ব্রত কখনও ত্যাগ করবে না। যে সকল ব্যক্তি স্বর্গে যেতে চায়, তাদের সারা জীবন এই ব্রত পালন করা উচিত। পাপকর্মে রত ও ধর্মহীন ব্যক্তিরাও যদি এই একাদশী দিনে ভোজন না করে, তবে তারা যমযাতনা থেকে রক্ষা পায়।”
আরও পড়ুনঃ ভীষ্মপঞ্চক ব্রত কী, কখন ও কীভাবে করবেন?
পাণ্ডবা নির্জলা একাদশীর মাহাত্ম্য শ্রবণ করে ভীমসেনের প্রতিক্রিয়া
শ্রীব্যাসদেবের এসব কথা শুনে গদাধর ভীমসেন অশ্বত্থ পাতার মতো কাঁপতে কাঁপতে বলতে লাগলেন, “হে মহাবুদ্ধি পিতামহ! মাতা কুন্তী, দ্রৌপদী, ভ্রাতা যুধিষ্ঠির, অর্জুন, নকুল ও সহদেব এরা কেউই একাদশীর দিনে ভোজন করে না। আমাকেও অন্ন গ্রহণ করতে নিষেধ করে। কিন্তু দঃসহ ক্ষুধাযন্ত্রণার জন্য আমি উপবাস করতে পারি না।”
ভীমসেনের এরকম কথায় ব্যাসদেব বলতে লাগলেন, “যদি স্বর্গাদি দিব্যধাম লাভে তোমার একান্ত ইচ্ছা থাকে, তবে উভয় পক্ষের একাদশীতে ভোজন করবে না।” তদুত্তরে ভীমসেন বললেন, “আমার নিবেদন এই যে, উপবাস তো দুরের কথা, দিনে একবার ভোজন করে থাকাও আমার পক্ষে অসম্ভব। কারণ আমার উদরে ‘বৃক’ নামে অগ্নি রয়েছে। ভোজন না করলে কিছুতেই সে শান্ত হয় না। তাই প্রতিটি একাদশী পালনে আমি একেবারেই অপারগ। হে মহর্ষি! বছরে একটি মাত্র একাদশী পালন করে যাতে আমি দিব্যধাম লাভ করতে পারি এরকম কোন একাদশীর কথা আমাকে নিশ্চয় করে বলুন।” তখন ব্যাসদেব বললেন, “জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষের একাদশী তিথিতে জলপান পর্যন্ত না করে সম্পূর্ণ উপবাস থাকবে। তবে আচমনে দোষ হবে না। ঐদিন অন্নাদি গ্রহণ করলে ব্রত ভঙ্গ হয়।”
আরও পড়ুনঃ একাদশী কী? কিভাবে একাদশী আবির্ভাব হলো, একাদশী পালনের নিয়মাবলী, একাদশী মাহাত্ম্য
পাণ্ডবা নির্জলা একাদশী পালনের ফল
শ্রীব্যাসদেব বলে চললেন, “একাদশীর দিন সূর্যোদয় থেকে দ্বাদশীর দিন সূর্যাস্ত পর্যন্ত জলপান বর্জন করলে অনায়াসে বারোটি একাদশীর ফল লাভ হয়। বছরের অন্যান্য একাদশী পালনে অজান্তে যদি কখনও ব্রতভঙ্গ হয়ে যায়, তা হলে এই একটি মাত্র একাদশী পালনে সেই সব দোষ দূর হয়। দ্বাদশী দিনে বাহ্মমুহূর্তে স্নানাদিকার্য সমাপ্ত করে শ্রীহরির পূজা করবে। সদাচারী ব্রাহ্মণদের বস্ত্রাদি দানসহ ভোজন করিয়ে আত্মীয়স্বজন সঙ্গে নিজে ভোজন করবে। এরূপ একাদশী ব্রত পালনে যে প্রকার পূণ্য সঞ্চিত হয়, এখন তা শ্রবণ কর। সারা বছরের সমস্ত একাদশীর ফলই এই একটি মাত্র ব্রত উপবাসে লাভ করা যায়। শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্মধারী ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাকে বলেছেন, “বৈদিক ও লৌকিক সমস্ত ধর্ম পরিত্যাগ করে যারা একমাত্র আমার শরণাপন্ন হয়ে এই নির্জলা একাদশী ব্রত পালন করে তারা সর্বপাপ মুক্ত হয়। বিশেষত কলিযুগে ধন-সম্পদ দানের মাধ্যমে সদগতি বা স্মার্ত সংস্কারের মাধ্যমেও যথার্থ কল্যাণ লাভ হয় না। কলিযুগে দ্রব্যশুদ্ধি নেই। কলিতে শাস্ত্রোক্ত সংস্কার বিশুদ্ধ হয় না। তাই বৈদিক ধর্ম কখনও সুসম্পন্ন হতে পারে না।”
হে ভীমসেন! তোমাকে বহূ কথা বলার আর প্রয়োজন কি? তুমি উভয় পক্ষের একাদশীতে ভোজন করবে না। যদি তাতে অসমর্থ হও তবে জ্যৈষ্ঠ মাসের শুক্লপক্ষের একাদশীতে অবশ্যই নির্জলা উপবাস করবে। এই একাদশী ব্রত ধনধান্য ও পুন্যদায়িনী। যমদূতগণ এই ব্রত পালনকারীকে মৃত্যুর পরও স্পর্শ করতে পারে না। পক্ষান্তরে বিষ্ণুদুতগণ তাঁকে বিষ্ণুলোকে নিয় যান। শ্রীভীসেন ঐদিন থেকে নির্জলা একাদশী পালন করতে থাকায় এই একাদশী ‘পান্ডবা নির্জলা বা ভীমসেনী একাদশী’ নামে প্রসিদ্ধ হয়েছে। এই নির্জলা একাদশীতৈ পবিত্র তীর্থে স্নান, দান, জপ, কীর্তন ইত্যাদি যা কিছু মানুষ করে তা অক্ষয় হয়ে যায়। যে ব্যক্তি ভক্তিসহকারে এই একাদশী মহাত্ম্য পাঠ বা শ্রবণ করেন তিনি বৈকুণ্ঠধাম প্রাপ্ত হন।”
আরও পড়ুনঃ একাদশীর উপবাস-দিন নির্ণয়-বিভ্রান্তি ও সমাধান
প্রিয় কৃষ্ণভক্তগন, একাদশী সমগ্র মর্ত্যবাসীর জন্য ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অসীম আশির্বাদ, করুণা ও প্রেমের প্রতীক। তাই আসুন, আমরা সকলেই পারতপক্ষে একাদশী পালন করি এবং আমাদের বন্ধুবান্ধব, পরিবার-পরিজন এবং পরিচিতদেরকেও এই মহাফলদানকারী তিথি উদযাপনে উৎসাহিত করি। হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।