You are currently viewing গাভীকে মাতা বলা হয় কেন? গোমাতা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা কি? Why Cows are Called Gowmata?

গাভীকে মাতা বলা হয় কেন? গোমাতা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা কি? Why Cows are Called Gowmata?

আচ্ছা আপনি মানুষ হলে গাভী কিভাবে আপনার মা হয়? গাভী যদি মা হয় তাহলে ষাড় কি আপনার পিতা? আপনার নিজের পিতা-মাতা থাকতে গাভীকে মা বলার কি দরকার? আপনারা তো গরু ছাড়া অন্যান্য প্রাণীর মাংস ভক্ষণ করেন, তাহলে গোমাংস খেলে আপনাদের সমস্যা কোথায়? কি? প্রশ্নগুলো অনেক চেনা মনে হচ্ছে না? একদম তাই। সনাতন হিন্দু ধর্মের অনুসারীগণ তাদের ব্যক্তিগত জীবনে বা অন্তর্জালের দুনিয়ায় বহুবার এই প্রশ্নগুলোর সম্মুখীন হয়ে থাকেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমাদের শাস্ত্রপাঠের অভ্যাস না থাকায় এ প্রশ্নগুলোর কোন সদুত্তর না দিতে পেরে মুখ লুকিয়ে প্রশ্নগুলো এড়িয়ে যেতে হয় আমাদেরকে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? আমাদের শাস্ত্রগ্রন্থে যথেষ্ঠ পরিষ্কারভাবে এসকল বিষয়ের ব্যখ্যা থাকার পরেও আর কতদিন আমরা শাস্ত্রবিমুখ হয়ে অন্যের কটূক্তি মেনে নেব?  আসুন, গাভী তথা গোমাতা সম্পর্কে আমাদের বিভিন্ন ধর্ম শাস্ত্রের ব্যাখ্যা জেনে নেওয়া যাক। সেইসাথে এটি ব্যাপকভাবে শেয়ার করে আপনার সনাতনী বন্ধুদেরকেও জানিয়ে দিন যাতে তারাও ভবিষ্যতে এ ধরণের প্রশ্নে বিব্রতবোধ না করে সঠিক উত্তরটি দিতে পারে।

সনাতন ধর্মের বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্রে ৭জন মাতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এরা হচ্ছেন, বেদমাতা, ধরণী মাতা, ব্রাহ্মণ মাতা, গুরুমাতা, গোমাতা, রাজমাতা এবং গর্ভধারিনী মাতা। এদের মধ্যে ৬ জনকে মাতা বলায় কোন সমস্যা না থাকলেও গোমাতাকে নিয়ে রয়েছে ঘোরতর আপত্তি। কিন্তু কারণ কি? গাভী পশুকুলভুক্ত বলে? জন্মের পর আমরা আমাদের মাতৃদুগ্ধ পান করে বেঁচে থাকি। কিন্তু যে সকল সন্তান জন্মের পরেই মাতৃহারা হয়, কিংবা কোন কারনে মাতৃদুগ্ধ থেকে বঞ্চিত হয় তাদের জন্য বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হয় গোদুগ্ধ। শুধু কি তাই? মানব শিশুর পাশাপাশি আমরা সকলেই সারাজীবন গোমাতা থেকে সংগৃহীত দুগ্ধ পান করি। অপরিমেয় পুষ্টিগুণসম্পন্ন এই তরল বস্তুটির পাশাপাশি আমাদের জন্মে, বিবাহে বা আদ্যশ্রাদ্ধে গোময় ও গোমুত্রের ব্যাবহার বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তাছাড়া গোদুগ্ধজাত ছানা, সন্দেশ, মিষ্টান্নসহ অসংখ্য উপাদেয় খাদ্যের উৎসও হচ্ছে গাভী। তাই গাভীকে শুধুমাত্র পশু হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। ঠিক যেমন একজন শিশু তার মায়ের স্তন্যদুগ্ধ পান করার পাশাপাশি যদি অন্য কারো স্তন্যদুগ্ধ পান করে তাহলে তাকে দুধমাতা বলা হয়, ঠিক তেমনি গাভীর দুধ ও দুধ থেকে উৎপন্ন নানাবিধ খাদ্যদ্রব্য ভক্ষণ করে মানবকুল জীবন ধারন করে। এবার বলুন যে প্রানী আমাদের জীবন ধারনের জন্য এত উপাদেয় খাদ্যের যোগান দেয় তাকে মাতা বললে ক্ষতিটা কোথায়?

আরও পড়ুনঃ  রাত নামলেই ১১ শিব মন্দির থেকে ভেসে আসে নারী কণ্ঠের কান্না || 11 Shiva Temple, Abhaynagar, Jessore

প্রাচীন ভারতে গোপালন ছিল সবচেয়ে সম্মানজনক পেশাগুলোর মধ্যে একটি। আর তাইতো অনাদির আদি গোবিন্দ জন্ম নিয়েছিলেন এই গোকুলেই। এই গোকুলের গোপালক হিসেবেই নিজেকে সকলের সামনে তুলে ধরেছিলেন তিনি। কিন্তু কেন বলুন তো? এত প্রানী থাকতে তিনি গরুকেই কেন এমন প্রাধান্য দিয়েছিলেন?

আবার দেবাদিদেব মহাদেবের কথাই ভাবুন। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের সংহারকর্তার অতি আদরের বাহনটিও একটি বৃষ বা ষাড়। তাছাড়া তিনি নিজেও একবার বৃষভ অবতার ধারণ করে সৃষ্টিকে রক্ষা করেছিলেন। নবরাত্রিতে পূজিতা দেবীদের মধ্যে প্রথমেই যে দেবী পূজিতা হন তিনি হচ্ছে শৈলপুত্রী। এই শৈলপুত্রীর বাহনও হচ্ছে একটি ষাড়। আমাদের প্রাচীন মুনি ঋষিদের আশ্রমেও অতি যত্নে গাভী পালন ও তাদের রক্ষা করা হত।

আসলে এগুলো হচ্ছে গাভী সম্পর্কে ঈশ্বর কর্তৃক মানুষকে প্রদত্ত্ব একটি সুক্ষ্ম ইঙ্গিত। আর সেই ঈঙ্গিতের মর্মার্থ হচ্ছে  পৃথিবীতে যখন কেউ গাভীদের শ্রদ্ধা এবং পূজা করার শিক্ষাপ্রাপ্ত হন তখন তিনি প্রকৃতপক্ষে সভ্য হন। তাছাড়া সনাতন সমাজে গোদানের দৃষ্টান্ত ও মহিমাও একেবারে কম নয়। শত ভরি স্বর্ণ দান করলে যে ফল হয় একটি মাত্র গাভী দানে সেই ফল প্রাপ্ত করার সম্ভব। বলা হয় ব্রাহ্মণ দেবতাকে শ্বেত গাভী দান করলে মানুষ ঐশ্বর্যশালী হয়। এরকম হাজারো গোদান বা গাভীদানের মহিমা বর্ণিত হয়েছে আমাদের পৌরাণিক শাস্ত্রগ্রন্থগুলিতে।

যাইহোক, এবার আসুন আমাদের মহাভারত, গীতা, চৈতন্য চরিতামৃত, পুরাণ ও বেদাদি শাস্ত্রে গাভী সম্পর্কে কি বলা হচ্ছে।

মহাভারতে বলা হয়েছে “গাবো বিশ্বস্য মাতরঃ” অর্থাৎ গাভী এই বিশ্বের মাতাস্বরূপা।।

ঋকবেদে বলা হচ্ছে, এই গাভী রুদ্রগণের মাতা, বসুগণের কন্যা, আদিত্যগণের ভগিনী এবং অমৃতস্বরূপ দুগ্ধের আবাসস্থান। তাই আমি জ্ঞানবান মনুষ্যের নিকট বলছি যে—নিরপরাধ এবং অখন্ডনীয়া গো-দেবীকে বধ করো না।।

শুক্ল যজুর্বেদে বলা হচ্ছে, গরু অখন্ডনীয়া এবং বিভিন্ন উপায়ে মহিমান্বিত, তাকে হিংসা করো না।।

আরও পড়ুনঃ  চিত্রগুপ্তের জন্ম কিভাবে হয়েছিল? তিনি কিভাবে যমরাজের সহকারী হয়েছিলেন? Story of Chitragupta.

শুক্ল যজুর্বেদে আরো বলা হয়েছে, হে জ্ঞানবান পরমাত্মা! এই গাভী সহস্র উপকারক্ষম, শতধারাযুক্ত চমৎকার দুগ্ধের উৎসস্থল এবং সারা বিশ্বে বহু মানুষের দ্বারা বহুভাবে পালনীয়া। সকল মানুষদের জন্য ঘৃত তথা দুগ্ধ দোহনশালিনী, অখন্ডনীয়া এবং পরম ব্যোমে অবস্থিত গাভীকে হিংসা করো না।।

অথর্ববেদে বলা হচ্ছে, যদি আমাদের গরু, অশ্ব, এবং পুরুষ অর্থাৎ মনুষ্যকে হিংসা করো বা হত্যা করো তবে তোমাকে সীসা দ্বারা বিদ্ধ করিব যাহাতে আমাদের মধ্যে বীরদের বিনাশক কেহ না থাকে।।

অথর্ববেদের এই মন্ত্র দ্বারা বোঝানো হয়েছে যে, কেউ যদি নিরপরাধ কাউকে অন্যায়ভাবে হত্যা করে তবে তাকে কঠোর থেকে কঠোরতর শাস্তি দেওয়া উচিত। তাকে কখনই ক্ষমা করা উচিত নয়।

অথর্ববেদে আরো বলা হচ্ছে, হে ধেনুসকল! তোমরা এই গোশালায় নির্ভয়ে থাকো, একসঙ্গে মিলিয়া বিচরণ করো, গোময় উৎপন্ন করো এবং অমৃতরূপ মধুর রসযুক্ত তথা দুগ্ধ ধারণকারিণী ধেনু সকল নীরোগ হইয়া আমাদের নিকট এসো।।

মহাভারতে বলা হচ্ছে, যে মানুষ শাস্ত্রীয় নিষেধ অগ্রাহ্য করিয়া মাংস বিক্রয়ের জন্য গোবধ করে কিংবা গো-মাংস ভক্ষণ করে অথবা যাহারা মাংসার্থী হইয়া গোবধের জন্য গোঘাতককে বা গোবধীকে অনুমতি দেয়, তাহাদের মধ্যে ঘাতক, খাদক ও অনুমতিদাতা সেই গরুর গায়ে যতগুলি লোম থাকে, তত বৎসর নরকে নিমগ্ন থাকে।।

চৈতন্য চরিতামৃতে মহাপ্রভু বলেছেন,

প্রভু কহে,— গোদুগ্ধ খাও, গাভী তোমার মাতা।

বৃষ অন্ন উপজায়, তাতে তেঁহো পিতা।।

গো অঙ্গে যত লোম তত সহস্র বৎসর।

গোবধী রৌরব মধ্যে পঁচে নিরন্তর।।

অর্থাৎ, আপনি গরুর দুধ খান; সেই সূত্রে গাভী হচ্ছে আপনার মাতা। আর বৃষ অন্ন উৎপাদন করে, যা খেয়ে আপনি জীবন ধারণ করেন; সেই সূত্রে সে আপনার পিতা।।

এবং যে ব্যক্তি গো হত্যা করবে, সেই গরুর শরীরে যত লোম আছে তত হাজার বৎসর গোহত্যাকারীকে রৌরব নামক নরকে যন্ত্রণার সাথে পঁচতে হবে।

ভবিষ্য পুরাণে বলা হয়েছে, গাভীকে প্রণাম ও প্রদক্ষিণ করলে সপ্তদ্বীপ বিশিষ্ট পৃথিবী প্রদক্ষিণের ফল হয়। পদ্ম পুরাণ বলছে, যে প্রতিদিন গাভীকে এক মুষ্টি ঘাস দেয় তার সমস্ত পাপ নাশ হয়।

আরও পড়ুনঃ  কার ভুলে, কেন ও কিভাবে আবির্ভাব হল দশ মহাবিদ্যার? | মা কালীর ভয়ঙ্করতম দশটি রূপ | Das Mahavisya Story

গীতার দশম অধ্যায়ের ২৮ নং শ্লোকে শ্রীভগবান বলেছেন, ধেনুদের মধ্যে আমি কাম ধেনু। এবং সকল সকল গাভীই কামধেনুর পার্থিব রূপ। অর্থাৎ গাভী মাত্রই শ্রীকৃষ্ণের আরেক রূপ। তাইতো বেদে বলা হয়েছে “সর্বে দেবাঃ স্থিতা দেহে সর্ব দেবময়ী হি গৌঃ” অর্থাৎ, গাভীর দেহে সমস্ত দেবদেবীদের বাস হওয়াতে গাভী সর্ব দেবময়ী।

সনাতন শাস্ত্রে আরো বলা হয়েছে যে ব্যক্তি গাভীর সেবা করে তার গৃহে লক্ষ্মীদেবী চিরকাল অবস্থান করেন।

তাহলে দর্শক, আপনারা ইতিমধ্যেই বুঝতে পারছেন সনাতন ধর্মে গাভী এবং বৃষ কি গুরুত্বপূর্ণ মহিমা বহন করে। আর ঠিক এই কারনে আমাদের সনাতন হিন্দু ধর্মের অনুসারীগন, গাভীকে মাতা সম্বোধন করেন, গোহত্যা করেন না, গোমাংস ভক্ষণ করেন না এবং সর্বোপরী গোকুলকে রক্ষা করে থাকেন।

যদি প্রশ্ন করেন সনাতন হিন্দুদের অনেকেই অন্যান্য প্রাণীর মাংস ভক্ষণ করেন। সেটি কি শাস্ত্র সম্মত? আজ্ঞে না। সনাতন ধর্ম কোভাবেই অন্যায়ভাবে হিংসা করাকে সমর্থন করে না। কারন অহিংসা পরম ধর্ম। তাই কোন প্রাণীর প্রতি হিংসা করে তাকে বধ করা বা মাংস ভক্ষন করার অনুমতি আমাদের শাস্ত্র দেয় না। তবে শাস্ত্রে যেহেতু শুধুমাত্র গরুকে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে তাই গরু ছাড়া অন্যান্য প্রাণির মাংস অনেকেই গ্রহন করে থাকেন। তবে সেসকল খাবার তামসিক এবং শস্ত্র কর্তৃক অননুমোদিত। তাই যে প্রানির গোদুগ্ধ আমাদের পরম উপাদেয় খাদ্য, যে প্রানীর বিষ্ঠা ধরিত্রী মাতার উর্বরতা বৃদ্ধি করে পৃথিবীর সৃজনশীলতা রক্ষা করে আমরাও সেই প্রাণীকে নিঃসঙ্কোচে মাতা সম্বোধন করি এবং তাদেরকে রক্ষা করি।

পরিশেষে গোমাতার প্রণাম মন্ত্র দিয়ে শেষ করতে চাইঃ

 ওঁ যয়া সর্ববিদং ব্যাপ্তং জগৎ স্থাবর জঙ্গম।

তাং ধেনুং শিরসা বন্দে ভূতভব্যস্য মাতরম্॥

অর্থাৎ, যিনি সমস্ত চরাচর জগৎকে ব্যাপ্ত করে রেখেছেন, সেই ভূত ও ভবিষ্যতের জননী গোমাতাকে আমি নত মস্তকে প্রণাম করি।

5/5 - (1 vote)

Leave a Reply