You are currently viewing শক্তিপীঠ যশোরেশ্বরী মন্দির কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? ৫১ সতীপীঠ || Jessoreshwari Kali Temple

শক্তিপীঠ যশোরেশ্বরী মন্দির কেন এত গুরুত্বপূর্ণ? ৫১ সতীপীঠ || Jessoreshwari Kali Temple

‘যশোরে পানিপদ্ম দেবতা যশোরেশ্বরী,

চণ্ডশ্চ ভৈরব যত্র তত্র সিদ্ধ ন সংশয়।’

তন্ত্র চুড়ামনিতে ঠিক এভাবেই বর্ণিত হয়েছে যশোরেশ্বরী কালী মাতার বর্ণনা। অর্থাৎ যশোরে পতিত হয়েছে দেবী সতীর পাণিপদ্ম বা করকমল। দেবীর নাম যশোরেশ্বরী, ভৈরব হলেন চণ্ড। এই সতীপীঠে কায়মনোবাক্যে পুজো করলে ভক্তের মনোবাসনা নিশ্চিতভাবে পূর্ণ হয়।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা থেকে প্রায় ৩২৫ কিলোমিটার দক্ষিন পশ্চিমে সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামে অবস্থিত সুপ্রাচীন এই শক্তিপীঠ। সম্প্রতি এই মন্দিরটি দর্শনে গিয়েছিলেন ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী  শ্রী নরেন্দ্র মোদি। এর ফলে নতুন করে আলোচনায় এসেছে পৌরাণিক এই মন্দিরের অজানা সব ইতিহাস। যারা এই মন্দির সম্পর্কে জানতেন না বা গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেননি, তারাও গুরুত্বসহকারে আগ্রহী হয়েছেন জাগ্রত এই কালী মন্দির সম্পর্কে। আজ আমরাও সনাতন এক্সপ্রেসের দর্শকদেরকে নিয়ে যেতে চাই যশোরেশ্বরী মায়ের পদপাদ্মে। জানতে চাই এই পীঠের পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং গায়ে কাঁটা দেওয়া সব কিংবদন্তী। তো চলুন দর্শক ঘুরে আসি যশোহর রাজ্যের ঈশ্বরী, যশোরেশ্বরী মায়ের বাড়ীর আঙিনা থেকে, হয়তোবা, তার দর্শন ও দুর্লভ আশির্বাদে কেটে যেতে পারে আমাদের জীবনের সমস্ত বাধা বিপত্তি।

সত্য যুগে, নিজের পিতা দক্ষের যজ্ঞে উপস্থিত হয়ে নিজ স্বামী দেবাদিদেব মহাদেবের অপমান সহ্য করতে পারেননি দেবী সতী। দক্ষযজ্ঞের সেই জলন্ত অগ্নিকুন্ডে আত্মহূতি দেন তিনি। এ সংবাদ পেয়ে ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে সেই যজ্ঞের বিনাশ করেন দেবাদিদেব মহাদেব।  এরপর শোকার্ত মহাদেব সতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে শুরু করলেন প্রলয় নৃত্য। ত্রাহি ত্রাহি রব উঠল সমস্ত বিশ্ব ব্রহ্মান্ড থেকে। এভাবে সমগ্র সৃষ্টি যখন রসাতলে যাওয়ার উপক্রম হল তখন শ্রী নারায়ন তার সুদর্শন চক্র দ্বারা মাতা সতীর দেহ ৫১ টি খন্ডে ছেদন করে দেন। সেই ৫১ টি ছিন্ন খন্ড পতিত হয়েছিল ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে। এই ৫১টি খন্ডের একটি তথা সতীর করকমল বা পাণিপদ্ম পতিত হয়েছিল সুন্দরবনের কোল ঘেষা ইশ্বরীপুর গ্রামে।

আরও পড়ুনঃ  জীবিত শিবলিঙ্গ ! রহস্যজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে প্রতিবছর || Matangashwar Living Shivlinga

উপমহাদেশের ধর্ম, সংস্কৃতি ও ভাস্কর্যের অসাধারন নিদর্শন এই মন্দির ও কালী মুর্তি। এই মুর্তি দক্ষিন বাংলার স্থানীয় চন্ড জাতির ভাস্কর্য শিল্পের অনুপম নির্মান। মন্দিরে অধিষ্ঠাত্রী কষ্ঠিপাথরের নির্মিত ভয়ংকর করালবদনা ও একই সাথে মনোহরা কালী মুর্তি। মন্দির-বেদির ওপর প্রতিষ্ঠিত মাতৃমূর্তির শুধু মুখমণ্ডলই দৃষ্টিগোচর হয়। শ্রীযশোরেশ্বরীর কণ্ঠের নিচে তার শ্রীহস্ত ও শ্রীচরণ কিছুই নজরে পড়ে না। মূর্তির অবয়ব পুরোটাই আবৃত মখমলে । মায়ের মাথার ওপর টকটকে লাল রঙের চাঁদোয়া ও সোনার মুকুট। কণ্ঠে রক্তজবার মালা ও নানা অলংকার।  লোলজিহ্বা দেবীর ভীষণা মূর্তি। মালদার জাগ্রত জহুরা কালীমাতার মুখমণ্ডলের সঙ্গে কিছুটা সাদৃশ্য রয়েছে যশোরেশ্বরীর। যশোরেশ্বরী মাতা ভীষণদর্শন হলেও মায়ের শ্রীবদনে কী অপূর্ব দেবীভাব। তার সেই উগ্রমুর্তির পিছনেই যেন লুকিয়ে আছে সন্তানবাৎসলা এক অপরূপ মাতৃমুর্তি। দুষ্টের জন্য তিনি সংহারকারিনী আর ভক্তের জন্য তিনি সর্বমঙ্গলময়ী রক্ষাকারিণী। ভক্তের পরম আশ্রয়ের শেষ কথা যেন তিনিই। এই কালী মন্দির ও মুর্তি পশ্চিম বাহিনী।

মায়ের পুজোয় সমবেত ভক্তগণ নিবেদন করেন ফুল, ফল ও নানাধরনের মিষ্টি। মাতৃমূর্তির সামনে সুন্দর করে কাঁসার থালা ও মাটির পাত্রে থরে থরে সাজানো হয় নৈবেদ্য । শ্রীযশোরেশ্বরীর পুজো তন্ত্রমতেও করা হয়ে থাকে। এছাড়াও প্রতিবছর মন্দিরে শ্যামাপুজোয় হয় ধুমধাম করে মায়ের অর্চনা হয় এই মন্দিরে। হাজার হাজার ভক্ত ও পুর্ণার্থীর আগমনে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে এই মহাতীর্থের মহিমা। এসময় মন্দিরে হাজার হাজার ভক্ত মায়ের কাছে সন্তানসুলভ আবদারে পুজো দেন, মানত করেন ও মায়ের মহিমা শ্রবণ করেন। এখানকার হোমযজ্ঞও হয় দেখার মত। মাকে নানা অলংকারে সাজানো হয়। মন্দিরের সামনে তিনদিন মেলা বসে। আর এসব উতসবের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে মাতা যশোরেশ্বরী নানান অলংকারে বিভূষিতা হয়ে ভক্তদেরকে আশির্বাদ করেন। এই মন্দিরের বারান্দায় সনাতন হিন্দু ভক্তদের পাশাপাশি দেখা মেলে ভিন্ন ধর্ম ও মতের মানুষের। কারন তিনি যে বিশ্বজননী, জাতি ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই যে তার সন্তান।  তারা ও মাকে ভীষণ মান্যি করে। মানত করতে আসে। মানত পূরণ হলে এক জোড়া পায়রা মন্দিরের বারান্দা থেকে উড়িয়ে দেয়া হয়। ।

আরও পড়ুনঃ  ব্রহ্মা, বিষ্ণুকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র শিবের মত বর কেন চায় মেয়েরা?

কবিরামের দিগ্বিজয় প্রকাশ গ্রন্থ থেকে জানা যায় প্রাচীন কালে অনড়ি নামে একজন ব্রাহ্মন এই স্থানে ঘন জঙ্গলে মাতা সতীর অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন। মায়ের ইচ্ছাতেই তিনিই এখানে শতদ্বার যুক্ত মন্দির নির্মান করে দেন। এর বহুকাল পর মন্দিরটি যখন ভগ্নপ্রায়, তখন ধেনুকর্ণ নামের একজন স্থানীয় ক্ষত্রিয় নৃপতি এই ভগ্ন মন্দির সংস্কার করেন। পরে রাজা লক্ষ্মণ সেন এই মন্দির পুনরায় সংস্কার ও চন্ড ভৈরবের ত্রিকোন মন্দির নির্মান করে দেন।

তবে সবচেয়ে আকর্ষনীয় ব্যাপারটি হল যশোরেশ্বরী দেবীর নামকরন। জানা যায় – মহারাজ প্রতাপাদিত্যের পিতা বিক্রমাদিত্য ও তার এক সহযোগি বসন্ত রায় গৌড়ের এক চরম অরাজকতার সময় সুলতানের অপরিমিত ধনরত্ন নৌকা বোঝাই করে গোপনে এই এলাকায় প্রেরণ করেন। গৌড়ের ধনরত্ন বোঝাই অসংখ্য নৌকা এখানে পৌঁছানোর পর ধীরে ধীরে বন জঙ্গলে আবৃত্ত এলাকাটির খ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। প্রতিষ্ঠিত হলো একটি সমৃদ্ধ রাজ্য। প্রবাদ আছে, গৌড়ের যশ হরণ করে এই এলাকার শ্রীবৃদ্ধি হওয়ায় নবপ্রতিষ্ঠিত রাজ্যের নামকরণ হল যশোহর।

১৫৮৭ সালে প্রতাপাদিত্য ঈশ্বরীপুরের কাছে তার নতুন রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেন। জনশ্রুতি বলছে রাজা প্রতাপাদিত্য যমুনা ও ইছামতি নদীর সঙ্গমস্থলে নতুন রাজধানী শহর নির্মান করার সময় দূর থেকে ধুম উদ্গীরন দেখে এই মন্দির খুঁজে পান। অন্য একটি মত বলছে মহারাজা প্রতাপাদিত্যের সেনাপতি এখানকার জঙ্গল থেকে একটি আলৌকিক আলোর রেখা বের হয়ে মানুষের হাতুর তালুর আকারের একটি পাথরখণ্ডের উপর পড়তে দেখেন। এরপর তারা এই পীঠস্থান খুঁজে পান।

তবে দেবী যেভাবেই প্রতাপাদিত্যের কাছে ধরা দেন না কেন, এটি ছিল রাজা প্রতাপাদিত্যের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। তিনি যশোরেশ্বরী দেবীকে ভাগ্যদেবতা মেনে চক মেলানো মন্দির নির্মান করে দেন। তিনি তার নতুন রাজধানী শহর গড়ে নাম রাখেন যশোরেশ্বরী পুরী। সেই থেকে এই গ্রামের নাম হয় যশোরেশ্বরীপুর যা বর্তমানে ইশ্বরীপুর। রাজা প্রতাপাদিত্যের সময়কাল থেকে তার মন্ত্রগুরু ও দেওয়ান চট্টপাধ্যায় অধিকারিক পরিবার পুরুষাক্রমে এই মন্দিরের সেবক।

আরও পড়ুনঃ  উগ্রশীলা তারাপীঠের ইতিহাস ও বামাক্ষ্যাপা ||

মূল মন্দির সংলগ্ন স্থানে নাটমন্দির নামে একটি বৃহ মঞ্চমণ্ডপ নির্মাণ করা হয়েছিল যেখান হতে দেবীর মুখমণ্ডল দেখা যায়। এটি লক্ষ্মণ সেন বা মহারাজা প্রতাপাদিত্য কর্তৃক ত্রয়োদশ শতাব্দীতে নির্মাণ করা হয়েছিল । ১৯৭১ সালের পর এটি ভেঙে পড়ে। সেই সুদৃশ্য, লম্বা-চওড়া বিরাট নাটমন্দিরের আজ কিছুমাত্র অবশিষ্ট নেই। এখন শুধুমাত্র স্তম্ভগুলি দেখা যায়। দু-একটা স্তম্ভ কয়েকশো বছরের নীরব সাক্ষী হয়ে ইটের পাঁজর বের করে দাঁড়িয়ে আছে কোনরকমে। একদা মন্দিরের চারদিকে সুউচ্চ প্রাচীরও ছিল। কিন্তু মূল মন্দিরটি বাদে আর সবকিছুই আজ কালের গর্ভে বিলীন। মন্দিরের নহবতখানাটিও এখন ভগ্নস্তূপ। বর্তমানে এই মন্দিরটি বাংলাদেশ সরকারে প্রত্নতত্ব বিভাগের সংরক্ষনের দায়িত্বে রয়েছে।

5/5 - (1 vote)

Leave a Reply