You are currently viewing স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝখানে আজও উল্টো হয়ে ঝুলে আছেন অভিশপ্ত ত্রিশঙ্কু || Story of Cursed Trishanku ||

স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝখানে আজও উল্টো হয়ে ঝুলে আছেন অভিশপ্ত ত্রিশঙ্কু || Story of Cursed Trishanku ||

“ত্রিশঙ্কু অবস্থা” নামক বাংলা প্রবচনটি হয়ত অনেকেই শুনে থাকবেন। সাধারনত উভয় সংকট বোঝাতে এই প্রবচনটি ব্যাবহার করা হলেও এর বেশীরভাগ ব্যাবহার লক্ষ করা যায় রাজনীতিতে বা রাজনৈতিক বক্তৃতায়। তবে আপনারা অনেকেই হয়ত জানেন না রাজা ত্রিশঙ্কু ছিলেন ইক্ষাকু বংশীয় রাজা ত্রয়ারুণের পুত্র এবং রাজা হরিশচন্দ্রের পিতা। এবং সে হিসেবে তিনি ছিলেন ভগবান শ্রীরামচন্দ্রেরও পূর্বপুরুষ। ঘটনাচক্রে স্বর্গে আরোহণকালে স্বর্গে স্থান না পেয়ে স্বর্গ ও মর্ত্ত্যের মাঝখানে আজও ঝুলন্ত অবস্থায় আছেন তিনি। তিনি না পেরেছিলেন স্বর্গে পৌছাতে, না পেরেছিলেন মর্ত্ত্যে ফিরে আসতে। তাই তাঁর এই পরিস্থিতির মত উভয় সংকটকে বাংলা বাগধারায় স্থান দেওয়া হয়েছে ত্রিশঙ্কু অবস্থা নামে।  বাল্মিকী রামায়ণের বাল কাণ্ডে বর্ণিত মহারাজ ত্রিশঙ্কুর সেই কাহিনীটি আজ উপস্থাপন করা হল সনাতন এক্সপ্রেসের দর্শকদের জন্য।

বাল্মিকী রামায়ণের কাহিনী জানার আগে আমরা জেনে নিতে চাই রাজা ত্রিশঙ্কু সম্পর্কে পুরাণ কি বলছে। তো পুরাণ মতে রাজা ত্রিশঙ্কুর পূর্বনাম ছিল সত্যব্রত। তিনি ছিলেন ইক্ষাকু বংশীয় রাজা ত্রয়ারুণের অধার্মিক, পাপী এবং লম্পট রাজপুত্র। একদা তিনি এক ব্রাহ্মণ কন্যাকে তাঁর বিবাহের আসর থেকে অপহরণ করেছিলেন বিধায় তাঁর পিতা ক্ষিপ্ত হয়ে তাকে নির্বাসিত করেছিলেন। এরপর একদিন শিকারে গিয়ে সত্যব্রত কোন পশু শিকার না করতে পেরে বশিষ্ঠের প্রয় গাভী নন্দিনীকে হত্যা করে তাঁর মাংস ভক্ষণ করেছিলেন। ঋষি বশিষ্ঠ যখন এই ঘটনা জানতে পারেন তখন তিনি সত্যব্রতকে চণ্ডাল হয়ে যাওয়ার অভিশাপ দিয়েছিলেন। তাছাড়া সত্যব্রতের কৃত তিনটি পাপ তথা পিতাকে ক্রোধান্বিত করা, পরস্ত্রীকে অপহরণ ও গোমাংস ভক্ষণের কারনে তাকে ত্রিশঙ্কু নামে অভিহিত করেন।

এবার আসি বাল্মিকী রামায়ণের বাল কাণ্ডে। ইক্ষাকুবংশীয় রাজা ত্রিশঙ্কু তাঁর নিজের শরীরকে খুবই ভালোবাসতেন। তাই তিনি চেয়েছিলেন তাঁর এই পার্থিব শরীর নিয়েই স্বর্গে যেতে।  তাঁর মনে হল সশরীরে স্বর্গে যেতে হলে সবার আগে যাগ যজ্ঞ করে তাঁর সমস্ত পাপ বিনাশ করবেন এবং এরপর ব্রহ্মতেজ সম্পন্ন কোন মুনির তেজে তিনি স্বর্গারোহণ করবেন। এই কামনা নিয়ে তিনি উপস্থিত হলেন কুলগুরু বশিষ্ঠের কাছে। গুরুর কাছে আবেদন জানালেন, তাকে সশরীরে স্বর্গে যাওয়ার ব্যাবস্থা করার জন্য। ত্রিশঙ্কুর এই আবদার শুনে বিষ্মিত হলেন বশিষ্ঠ। তিনি বললেন, “হে বৎস, এই পঞ্চভূতে গড়া দেহ নিয়ে স্বর্গে আরোহণ করে প্রকৃতি-বিরুদ্ধ। আমি তোমার এই কাজে কোনভাবেই সাহায্য করতে পারব না।” বশিষ্ঠের মুখে নেতিবাচক উত্তর শুনে মর্মাহত হলেন রাজা ত্রিশঙ্কু। অনেক অনুনয়-বিনয় করেও তিনি বশিষ্ঠকে সশরীরের স্বর্গে যাওয়ার যজ্ঞ আয়োজন করতে রাজি করাতে পারলেন না।

আরও পড়ুনঃ  দ্রৌপদী ও পঞ্চপাণ্ডবের ফুলশয্যা ও দাম্পত্য জীবন কেমন ছিল? Family Life of Draupadi and Pandavas

তবে হাল ছাড়লেন না ত্রিশঙ্কু। বশিষ্ঠের আশ্রম থেকে বিফল মনোরথ হয়ে তিনি সন্ধান করতে লাগলেন ব্রহ্মতেজ সম্পন্ন ঋষিদের। একদিন জঙ্গলে পরিভ্রমণ করার সময় তিনি দেখতে পেলেন জঙ্গলের মধ্যে কিছু ঋষিগণ যাগ-যজ্ঞাদিতে ব্যাস্ত সময় পার করছেন। রাজা ত্রিশঙ্কু ভাবলেন এই ঋষিদের কেউ হয়ত আমাকে সশরীরের স্বর্গারোহন করতে সাহায্য করতে পারবেন। তাই তিনি তাদের সান্নিধ্যে গিয়ে তাদেরকে প্রণাম করলেন এবং তাদের কাছে নিজের মনোবাঞ্ছা প্রকাশ করলেন। সব শুনে ঋষিগণ অট্টহাস্য করে বললেন, “ হে মূর্খ ত্রিশঙ্কু, আমরা সবাই ঋষি বশিষ্ঠেরই সন্তান। আমাদের পিতা যে কার্য প্রত্যাখ্যান করেছেন সেই কার্যে তুমি কখনোই আমাদের সাহায্য পাবে না। ” এসময় ত্রিশঙ্কু কিছুটা ক্রুদ্ধ হয়ে ঋষিদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেন এবং তাদের বিরুদ্ধে অপমানজনক কথাবার্তা বলতে শুরু করলেন। রাজা ত্রিশঙ্কুর মুখে পিতা বশিষ্ঠ ও তাঁর ঋষিপুত্রদের ভর্ৎসনা শুনে কুপিত হলেন ঋষিগণ। তাঁরা ত্রিশঙ্কুকে অভিশাপ দিলেন, “গুরুর অবাধ্য হওয়ার জন্য ও গুরু নিন্দা করার জন্য রাজা ত্রিশঙ্কু তুমি চণ্ডালে পরিণত হও।” ফলে রাজা ত্রিশঙ্কুর রাজ বেশ উবে গিয়ে তৎক্ষণাৎ তিনি চণ্ডালে পরিণত হলেন। চণ্ডাল বেশে তাঁর শরীর হল মলিন ও জীর্ণ,  শরীরে দেখা গেল অপরিষ্কার বস্ত্র, মাথায় খর্ব কেশ, গলায় শ্মশানমালা এবং অঙ্গে লৌহের আভরণ। রাজা ত্রিশঙ্কুর এই অবস্থা দেখে তাঁর আত্মীয় পরিজন এবং মন্ত্রীগণও তাকে পরিত্যাগ করে চলে গেলেন। তবে অপমানিত, একাকীত্ব ও চণ্ডালত্ত্ব পাপ্তির পরেও নিজের উদ্দেশ্য সাধনে পিছপা হলেন না তিনি। এবার তিনি দক্ষিণে যাত্রা শুরু করলেন কোন একজন ব্রহ্মতেজ সম্পন্ন ঋষির অনুসন্ধানে।

এভাবে কিছুকাল পথ চলার পর তিনি দেখা পেলেন ঋষি বিশ্বামিত্রের। তখন বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্রের মধ্যে চলছিল তুমুল বিরোধ। ত্রিশঙ্কুর কথায় যখন তিনি বশিষ্ঠ ও তাঁর পুত্রদের কথা জানতে পারলেন, তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন রাজা ত্রিশঙ্কুকে স্বর্গারোহণে সাহায্য করার জন্য।

আরও পড়ুনঃ  কালীপূজায় পাঠাবলি / পশুবলি কতটা যৌক্তিক?

নির্ধারিত দিনে শুরু হল যজ্ঞ। যজ্ঞে আহবান করা হল চতুর্দিকের ঋষি ও ঋত্ত্বিকদের। কিন্তু বশিষ্ঠ, তাঁর শতপুত্র ও মহোদয় নামক একজন ঋষি বিশ্বামিত্রের এই যজ্ঞকে চণ্ডালের যজ্ঞ নামে অভিহিত করে তাতে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানালেন। ফলে ঋষি বিশ্বামিত্র এই ঋষিদের উপর কুপিত হয়ে তাদেরকে নানাবিধ অভিশাপ দিলেন এবং এরপর প্রধান যাজক রূপে শুরু করলেন রাজা ত্রিশঙ্কুকে সশরীরে স্বর্গে পাঠানোর যজ্ঞ। কিন্তু মুশকিল হল কোন দেবতাই বিশ্বামিত্রের এই যজ্ঞের যজ্ঞভাগ বা আহুতি গ্রহণ করতে এলেন না। কারন তাঁরাও চান না প্রকৃতির নিয়ম ভঙ্গ করে কোন নশ্বর দেহকে স্বর্গে স্থান দিতে। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষার পর কোন দেবতার উপস্থিতি না দেখে ঋষি বিশ্বামিত্রও বুঝতে পারলেন দেবতাদের উদ্দেশ্য। তাই এবার তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি তাঁর নিজের তপোবল দিয়ে ত্রিশঙ্কুকে স্বর্গে উত্তোলন করে তাঁর প্রতিজ্ঞা রক্ষা করবেন।

এ পর্যায়ে বিশ্বামিত্র তাঁর তপঃপ্রভাবে ত্রিশঙ্কুকে উত্তোলন করে স্বর্গের দিকে নিক্ষেপ করলেন। কিন্তু ত্রিশঙ্কু স্বর্গদ্বারে পৌছানোমাত্র দেবরাজ ইন্দ্র ত্রিশঙ্কুকে স্বর্গে প্রবেশে বাধা দিলেন। তিনি বললেন, “হে ত্রিশঙ্কু, তুমি স্বর্গভোগের অধিকারী নও। গুরুশাপে আক্রান্ত কোন চণ্ডালকে আমরা স্বর্গে স্থান দিতে পারি না। তুমি পুনরায় মর্ত্ত্যে পতিত হও।” এই বলে ইন্দ্রদেব ত্রিশঙ্কুকে আবার পৃথিবী অভিমূখে নিক্ষেপ করলেন। ফলে মাথা নিচের দিকে দিয়ে ভূমিতে পতিত হতে শুরু করলেন ত্রিশঙ্কু। ত্রাহি ত্রাহি রবে ত্রিশঙ্কু যখন নিচে পতিত হচ্ছিলেন তখন তাকে স্বর্গ ও মর্ত্ত্যের মাঝখানে আটকালেন বিশ্বামিত্র। এরপর সেখানেই নিজের তপোবল দিয়ে নতুন একটি স্বর্গ, সপ্তর্ষিমণ্ডল ও অন্যান্য নক্ষত্র সৃষ্টি করলেন। এরপর তিনি উদ্যোগ নিলেন নতুন ইন্দ্র সৃষ্টি করার অথবা ত্রিশঙ্কুকেই ইন্দ্রপদে অধিষ্ঠিত করার জন্য। এ ঘটনায় ভীত হলেন দেবগণ। তাঁরা বিশ্বামিত্রের কাছে এসে এই অনাসৃষ্টি থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করলেন। বিশ্বামিত্র বললেন, “আমি ত্রিশঙ্কুকে কথা দিয়েছি আমি তাকে সশরীরে স্বর্গে প্রেরণ করব। সুতারাং আমার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার উপায় নেই।” উত্তরে দেবতারা বললেন, “হে ঋষিবর, তবে তাই হোক, ত্রিশঙ্কু তাঁর নিজের স্বর্গেই অবস্থান করুক। কিন্তু নতুন কোন ইন্দ্র সৃষ্টি করে বা ত্রিশঙ্কুকে ইন্দ্রের সমান শক্তিশালী করে দেবতাদেরকে বিপদগ্রস্থ করবেন না।” দেবতাদের অনুনয় মেনে নিলেন বিশ্বামিত্র। সেখান থেকে রাজা ত্রিশঙ্কু তাঁর নিজের স্বর্গে অবস্থান করলেন বৈকি তবে তাঁর মাথা ঝুলে রইল নিচের দিকে।

আরও পড়ুনঃ  অশ্বমেধ, গোমেধ ও নরমেধ যজ্ঞ কি? ভ্রান্ত ধারণার অবসান || Ashwamedha, Gomedha & Naramedha Yagna ||

অবশ্য অন্য একটি কাহিনী থেকে জানা যায়, বিশ্বামিত্র যখন তাঁর তৈরি স্বর্গে নতুন ইন্দ্র সৃষ্টি করতে মনস্থির করলেন, তখন দেবরাজ ইন্দ্র স্তুতি করে বিশ্বামিত্রকে শান্ত করেছিলেন এবং সোনার বিমানে চড়িয়ে ত্রিশঙ্কুকে প্রকৃত স্বর্গে নিয়ে গিয়েছিলেন।

 

5/5 - (1 vote)

Leave a Reply