You are currently viewing রহস্যময় কংকালীতলা শক্তিপীঠের পৌরাণিক কাহিনী || Kankali Kali Temple Mystery || ৫১ শক্তিপীঠ ||

রহস্যময় কংকালীতলা শক্তিপীঠের পৌরাণিক কাহিনী || Kankali Kali Temple Mystery || ৫১ শক্তিপীঠ ||

কংকালীতলা শক্তিপীঠ। বিষ্ময়কর এ মন্দির ঘিরে রয়েছে ইতিহাস ও পুরাণের নানা আশ্চর্যজনক কাহিনী। রয়েছে নানা রকমের জনশ্রুতি, রহস্য ও অভিজ্ঞতা। ৫১টি শক্তিপীঠের মধ্যে অন্তিম পীঠস্থান এই কংকালী মাতার মন্দিরে রয়েছে দেবী সতীর পৌরাণিক কঙ্কাল, রয়েছে বনস্পতির ছায়াঘেরা সুনিবিবিড় প্রাকৃতিক দৃশ্য, জঙ্গলের গা ছম ছমে পরিবেশ, বাউল সাধকদের গান ও বাদ্যযন্ত্রের ছন্দ এবং মন্দিরে রাত্রি যাপনে নিষেধাজ্ঞা। প্রিয় দর্শক, আজ আপনাদেরকে নিয়ে যেতে চাই বীরভূম জেলার গুপ্ত তন্ত্রসাধনার এক মহাপীঠ কংকালীতলা সতীপীঠে। জানাতে চাই এই কংকালী মাতা রহস্য, কংকালীর কংকাল এখানে পতিত হওয়ার কাহিনী, এ মন্দিরে রাত্রিযাপনের অভিজ্ঞতা, এবং কেন এই শক্তিপীঠকে অন্তিম পীঠ বা শেষ শক্তিপীঠ বলা হয় সেই কাহিনী। আশা করি এ আয়োজনে আমাদের সাথে শেষ পর্যন্ত থাকবেন, এবং এরকম রহস্যময় তথ্য উপস্থাপনে আমাদেরকে উৎসাহিত করার জন্য কমেন্টে একবার জয় মা কালী লিখে যাবেন।

পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার বোলপুর শহর থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরে কোপাই নদীর অববাহিকায় এবং ছায়া সুনিবিড় প্রকৃতির মধ্যে অবস্থান করছে মহাশক্তিপীঠ কংকালীতলা মায়ের মন্দির। মাতা সর্বমঙ্গলা এখানে পরিচিত কংকালী মাতা, দেবগর্ভা বা রত্নাগর্ভি নামে। পীঠ নির্ণয়তন্ত্র থেকে জানা যায় এ স্থানে পতিত হয়েছিল দেবী সতীর কংকাল বা অস্থি যার ফলে এখানে দেবী পরিচিতি পেয়েছেন কংকালী নামে। তবে ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল কাব্যগ্রন্থ অনুসারে জানা যায় এখানে দেবী সতীর কাঁখাল অথবা কোমরের অংশ বা কটিদেশ পতিত হয়েছিল বলেই মাতা এখানে কংকালী নামেই পরিচিত। তাছাড়া কংকালী মায়ের এই মন্দিরটি মূল সতীপীঠ নাকি উপপীঠ তা নিয়েও বিশেষজ্ঞদের মধ্যে রয়েছে মতনৈক্য।
কংকালীতলা মন্দিরের মূল ফটক দিয়ে প্রবেশ করেই চোখে পড়ে লম্বা ছাউনি বিশিষ্ঠ মায়ের মন্দিরের গর্ভগৃহ। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে মায়ের পুজোয় অংশগ্রহণ করার জন্যই গর্ভগৃহের সামনে এই লম্বা ছাউনি। তবে এই মন্দিরের গর্ভগৃহে নেই কোন দেবী মূর্তি। একটি বেদীর উপরে শ্মশানকালীর চিত্রপটে পূজিত হন মাতা কংকালী। বেদীর সামনে একটি দেবীঘট স্থাপন করে সেটিকে দেবী দেবগর্ভা কল্পনা করে চলছে পূজা-অর্চনা। শোনা যায় এই মন্দিরে মূর্তি বা প্রতিমা স্থাপন করা নিষিদ্ধ। দেবীমাতা নিজেই চান না এখানে তাঁর কোন স্থায়ী প্রতিকৃতি নির্মিত হোক। তাই যতবারই এখানে মূর্তি নির্মান করার চেষ্টা করা হয়েছে ততবারই ঘটেছে অঘটন। তাই শান্তিনিকেতনের এক বিখ্যাত চিত্রশিল্পী মুকুল দের আঁকা এই চিত্রপটখানিই এ গর্ভগৃহের একমাত্র মাতৃচিহ্ন। তবে শোনা যায় এখানে যে বেদীর উপরে মাতৃবন্দনা হয় তাঁর নিচে নাকি পোঁতা রয়েছে ১০৮টি নরমুণ্ড।

আরও পড়ুনঃ  রাম কেন অবতার, শ্রীকৃষ্ণ কেন ভগবান? Why Rama is Avatar and Shri Krishna is God Himself?

মন্দিরের বাইরে চোখে পড়ে একটি শতবর্ষী বটবৃক্ষ। মানুষের কাছে এ বৃক্ষের নাম মনোষ্কামনা বৃক্ষ। তাইতো বহু দূর্দশাগ্রস্থ মানুষ মায়ের কাছে বিপদমুক্তির মানত রেখে গেছেন এই মনোষ্কামনা বৃক্ষের গায়ে। তাঁদের মনোকামনা পূর্ণ হলে এখানকার ভোগমন্দিরে অর্থায়ণ করে আগত পূণ্যার্থীদেরকে প্রসাদ খাইয়ে যান তাঁরা।
মন্দিরের একাংশে দেখা যায় একটি প্রাচীন ঘট ও তাঁর উপরে আরও একটি শ্মশান কালীকার চিত্রপট। গর্ভগৃহের মত এখানেও নিত্যপূজা সম্পাদন করে থাকেন মন্দিরের পুরোহিত ও সেবায়েতগন।
এবার আসি এই মন্দিরের সবচেয়ে রহস্যময় স্থানটিতে। ছবিতে যে জলাশয় বা কুণ্ডটি দেখতে পাচ্ছেন এটিই মুলত মাতা দেবগর্ভার আসল চিহ্ন। আজ থেকে কয়েকশো বছর পূর্বে এখানে এই কুণ্ডটি ছাড়া কোন মন্দিরের অস্ত্বিত্ত ছিল না। প্রচলিত জনশ্রুতি অনুসারে কয়েকশো বছর আগে একজন সাধু এই পীঠের অস্তিত্ব অনুভব করেছিলেন। পরবর্তীকালে আরও একজন ভক্তকে স্বপ্নাদেশ দিয়ে মাতা কংকালী বলেছিলেন, তাঁর শরীরের কংকাল বা অস্থি এই কুণ্ডে প্রস্তরীভূত হয়ে নিমজ্জিত অবস্থায় আছে। অর্থাৎ দেবীর কিছু দেহাংশ এই জলাশয়ের নিচে পাথর খণ্ডের আকারে ডুবন্ত অবস্থায় আছে। তাই সেই সাধক মায়ের পুজো করার আজ্ঞা পান। সেখান থেকেই এই কুণ্ডের পাশের বেদীতে পূজিতা হতেন দেবী। পরবর্তীকালে কুণ্ডের পাশে নির্মিত হয় দেবী কংকালীর এই মন্দির।
এই রহস্যময় কুণ্ড সম্পর্কে স্থানীয়ভাবে প্রচলিত রয়েছে বহু কিংবদন্তি। বলা হয় তীব্র দাবদাহে যদি সমগ্র বীরভূমের জলও শুকিয়ে যায়, তবুও এই কুণ্ডের জল কখনো শুকায় না। স্থানীয় বিশ্বাস এই কুণ্ডের পশ্চিম পাশে দুটি গুপ্ত সুড়ঙ্গের মাধ্যমে মণিকর্ণিকা ঘাটের সাথে যুক্ত হয়ে আছে এই দেবীকুণ্ড। তাইতো কোন মৌসুমেই এই জল শুকিয়ে যায় না। তাছাড়া দেবীকুণ্ডের এই জলে নামাও নিষিদ্ধ ভক্ত ও পূণ্যার্থীদের জন্য। বলা হয় এই বিধির অমান্য করলে ঘোর বিপদ অবসম্ভাবী। তবে সাধারন পূণ্যার্থীরা এই মন্দির দর্শনে গিয়ে কুণ্ডের জলে ফুল অর্পণ করেন ও এর পবিত্র জল মাথায় ছিটিয়ে মাতার কৃপা প্রার্থনা করেন। তাছাড়া এই কুণ্ডের জল পান করে দুরারোগ্য ব্যাধি থেকেও মুক্তি পেয়েছেন অনেকেই। বলা হয় এই কুণ্ডে নিমজ্জিত দেবীর দেহাংশ বা পাথর খণ্ডগুলি কুড়ি বছর অন্তর কুণ্ড থেকে তোলা হয়। এরপর পূজা শেষে সেগুলিকে পুনরায় কুন্ডের জলে ডুবিয়ে দেওয়া হয়।

আরও পড়ুনঃ  শিব রাবণকে লাথি মেরে কৈলাস পর্বত থেকে ফেলে দিয়েছিলেন কেন? Why Shiva Kicked Ravana Off Kailash Parvat

এছাড়াও এমন্দিরে রাত্রিযাপন করাকে কেন্দ্র করেও রয়েছে নানা রকমের জনশ্রুতি। বলা হয় এখানে রাত্রি যাপন অসম্ভব। সারাদিনের কোলাহলপূর্ণ কংকালী মাতা মন্দিরের চেহারা পালটে যায় অন্ধকার নামার সাথে সাথেই। চারিদিকে সুনসান নিরবতা নেমে আসে সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে। তাই এখানে যারা রাত্রি যাপন করার চেষ্টা করেছেন তাঁরা অনেকেই সম্মুখীন হয়েছেন নানা রকমের অতিপ্রাকৃত ঘটনা এবং দুর্ঘটনার। অনেকে বলে থাকেন মাতা কংকালী রাতে কুণ্ডের চারপাশে ঘুরে বেড়ান কুমারী বেশে। তাই মন্দিরের পক্ষ থেকেও এই মন্দিরে রাত্রিযাপনকে নিষেধ ও নিরুৎসাহিত করা হয়ে থাকে।
এবার আসি এই কুণ্ডের পৌরাণিক ইতিহাসে। আপনারা অনেকেই জানেন পিতা দক্ষের আয়োজিত যজ্ঞে বিনা নিমন্ত্রনে হাজির হয়েছিলেন দক্ষকন্যা ও শিবজায়া সতী। কিন্তু সেই যজ্ঞে পিতা কর্তৃক নিজ স্বামী শিবের নিন্দা সহ্য করতে পেরে সেই যজ্ঞাগ্নিতেই আত্মহূতি দিয়েছিলেন দেবী সতী। এ সংবাদ পেয়ে ক্রুদ্ধ মহাদেব দক্ষযজ্ঞে হাজির হয়ে সেই যজ্ঞ ধ্বংস করেন এবং সতীর নিথর দেহ কাঁধে নিয়ে তাণ্ডব নৃত্য করতে থাকেন। এ দৃশ্য দেখে শ্রীনারায়ণ তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে সতীর দেহ ৫১টি খণ্ডে খণ্ডিত করে দেন। আর সেগুলো প্রস্তরীভূত হয়ে পতিত হয় বিভিন্ন পবিত্র স্থানে। সেই সকল স্থান পরিণত হয় এক একটি শক্তিপীঠে। কিন্তু সতীর শরীরের একটি খণ্ড তখনও শিব তাঁর হাত দিয়ে ধরে রেখে কাঁধে বহন করে চলেছিলেন। সেই খণ্ডটি ছিল দেবীর কাঁখাল বা কটিদেশ। এরপর নারায়ণের প্রভাবে শিবের যখন চৈতন্য ফেরে তখন তিনি এই খণ্ডটি নিজে থেকে এই স্থানে অবতরণ করিয়েছিলেন। কিন্তু দেবী বসুমতি এই খণ্ডের ভার বহন করতে ব্যার্থ হয়েছিলেন বিধায় এখানে এই বিরাট কুণ্ডের সৃষ্টি হয়। একারনে এই পীঠস্থানকে দেবীর অন্তিম পীঠ বা সর্বশেষ শক্তিপীঠ নামেও আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। তাছাড়া ভোলানাথ শিবের চৈতন্যোদয়ের পরে এই পীঠস্থানের সৃষ্টি হয়েছিল বিধায় একে চৈতন্য পীঠ নামেও ডেকে থাকেন অনেকে।

আরও পড়ুনঃ  কে কে অভিশাপ দিয়েছিল রাবণকে? || অভিশপ্ত রাবণ ||

আপনারা জানেন সুদর্শণ চক্রের আঘাতে দেবী সতীর শরীর যখন প্রস্তরীভূত হয়ে মর্ত্যের বিভিন্ন স্থানে পতিত হয়, তখন মহাদেব সেগুলোকে রক্ষা করার জন্য প্রত্যেকটি সতীপীঠের পাশে আবির্ভূত হয়েছিলেন ভৈবর রূপে। মূলত শক্তিপীঠগুলোকে পাহারা দেওয়ার উদ্দেশ্যেই তৈরি হয়েছিল এই ভৈরব পীঠগুলো। তাই দেবী কংকালী, দেবগর্ভা বা দেবী রত্নাগর্ভির এই মন্দিরের অদূরেই সুশীতল বটবৃক্ষের তলায় দাঁড়িয়ে আছে রুরু ভৈরবের মন্দির। শক্তিপীঠের মত এই ভৈরবপীঠ অতটা জাঁকজমক না হলেও এখানেও রয়েছে নিত্যপূজার ব্যাবস্থা।
কংকালীতলা ও রুরু ভৈরবের প্বার্শবর্তী কাঞ্চিশ্বর শিবরমন্দিরের কথাটিও না বললে নয়। রাজা প্রথম মহীপালের সমসাময়িক কাঞ্চিরাজ রাজেন্দ্রচোল ছিলেন বীরভূমের এই অঞ্চলের রাজা। শিবভক্ত এই রাজা কোপাই নদীর তীরবর্তী ও কংকালী মাতার মন্দিরের প্বার্শবর্তী এই স্থানে স্থাপন করেছিলেন একটি শিবমন্দির। রাজা কাঞ্চিরাজের নামানুসারেই এই শিবলিঙ্গকে বলা হয় কাঞ্চিশ্বর শিবলিঙ্গ। এবং এর পাশেই রয়েছে পাশে রয়েছে মহাশ্মশান ও পঞ্চবটিবন।
দেবী সতীর দেহাংশের স্মৃতিবিজড়িত এই মহাপীঠে সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেছেন বহু সাধক। তাই জাগ্রত এই মন্দিরে ভক্ত ও পূণ্যার্থীদের ভিড় লেগেই থাকে সার্বক্ষণিকভাবে। তবে প্রতিবছর চৈত্র সংক্রান্তিতে এখানে নামে মানুষের ঢল। ৩ দিন ব্যাপী চলমান এ অনুষ্ঠানে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় কংকালী মায়ের মন্দির চত্বর। তাছাড়া অমাবস্যা, পূর্ণিমাতেও এমন্দিরে প্রচুর মানুষ ভিড় করেন মাতা দেবগর্ভার কৃপালাভের আশায়। তাই সুযোগ হলে কলকাতার অদূরের এই পূণ্যভূমি দর্শন করে আসতে ভুলবেন না।

5/5 - (1 vote)

Leave a Reply