আমাদের ইতিহাস নির্ভর গ্রন্থ রামায়ণের মূল উপজীব্য বিষয় হচ্ছে রাম-রাবণের যুদ্ধ। মাতা সীতাকে হরণ করার কারনে রাম ও রাবণের মধ্যে সংঘঠিত হয়েছিল এক মহাযুদ্ধ। সে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন রাবণের মত অমরত্বের বরপ্রাপ্ত মহাশক্তিশালী রাক্ষস এবং তার পুত্র, ভ্রাতা ও অগণিত রাক্ষস সেনারা যারা ছিলেন যুদ্ধবিদ্যা ও মায়াবিদ্যায় অপরাজেয়। অন্যদিকে শ্রীরামের পক্ষে ছিলেন তার কিছু মিত্র এবং যুদ্ধে অনভিজ্ঞ কিছু সাধারণ বানর সেনা।
প্রশ্ন হচ্ছে, রামায়ণের এই যুদ্ধে অংশ নেওয়া সেরা ১০ জন যোদ্ধা কারা? প্রিয় দর্শক, আপনারা ইতিমধ্যেই জানেন রামায়ণের কেন্দ্রীয় চরিত্র শ্রীরামচন্দ্র ছিলেন স্বয়ং ভগবান শ্রীবিষ্ণুর অবতার। সুতারাং তার চেয়ে বড় বা শক্তিশালী যোদ্ধা এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে কেউ নেই। তাই শ্রীরামচন্দ্রকে এই তালিকার বাইরে রেখে আজ আমরা জানার চেষ্টা করব রামায়ণের সেরা ১০ জন যোদ্ধার র্যাংকিং।
১০. অতিকায়
পূর্বজন্মের মধু-কৈটভ পরজন্মে রাবণের ঔরসে ও ধান্যমালিনীর গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন অতিকায় ও ত্রিশিরা নামে। অতিকায় ছিলেন রাবণের মত বলশালী, শ্রুতিধর, মায়াবিদ্যাবিশারদ এবং অস্ত্রচালনায় অত্যন্ত পারদর্শী। মূলত তার বিশালাকার শরীরের জন্যই তার নাম হয়েছিল অতিকায়।
ব্রহ্মার বরে রাক্ষস অতিকায় হয়ে উঠেছিলেন দেবতা কিংবা অসুরের অবধ্য। ব্রহ্মার কাছ থেকে তিনি বর হিসেবে পেয়ছিলেন দিব্য ব্রহ্ম কবচ ও সূর্যের মতো দিপ্তমান রথ। আর এসব শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দেব-দানবদের বহু বীর যোদ্ধাকে পরাজিত ও বধ করেছিলেন তিনি। যুদ্ধক্ষেত্রে শরজাল দিয়ে তিনি পরাজিত করেছিলেন দেবরাজ ইন্দ্রকে। এমনকি বরুন দেবের পাশকেও প্রতিহত করেছিলেন তিনি। মেঘনাদের মত তিনিও অন্তরীক্ষে বিচরন করে নিজের মায়াবিদ্যা দ্বারা শত্রুকে নাজেহাল করে দিতে পারতেন।
কুম্ভকর্ণের মৃত্যুর পর যখন অতিকায় রণভূমিতে প্রবেশ করেছিলেন, তখন তার পর্বতের ন্যায় শরীর, কালমেঘের ন্যায় শব্দায়মান তার গর্জন, এবং সহস্র অশ্বসম্বলিত ও অগণিত অস্ত্ররাজি শোভিত রথ দেখে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন স্বয়ং শ্রীরামচন্দ্রও।
রামায়ণের যুদ্ধে তিনি তুমুল ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করেছিলেন বানর যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে। বহু বানর সেনা নিধন করে তিনি যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন লক্ষ্মণের সাথে। কিন্তু লক্ষ্মণের মত মহাবীর যোদ্ধাও কোনভাবে পরাজিত করতে পারছিলেন না বিশালদেহধারী এই রাক্ষসকে। অবশেষে অতিকায়কে বধ করার জন্য লক্ষ্মণকে ব্রহ্মাস্ত্র প্রয়োগ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন পবনদেব। এবং লক্ষ্মণের ছোঁড়া সেই ব্রহ্মাস্ত্রের আঘাতেই বধিত হয়েছিলেন এই মহাবলি রাক্ষস।
০৯. অঙ্গদ
কিষ্কিন্ধ্যার রাজা বালির মহাবলি পুত্র ছিলেন অঙ্গদ। শ্রীরামচন্দ্র ও সুগ্রীব কর্তৃক নিজের পিতাকে বধিত হতে দেখেও ন্যায়পরায়ণ অঙ্গদ শ্রীরামচন্দ্রের পক্ষাবলম্বন করে রাবণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। সমগ্র বানর সেনার মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয় শক্তিশালী যোদ্ধা। শ্রীরামচন্দ্র রাবণকে শেষবারের মত আত্মসমর্পণ করার সুযোগদান করতে অঙ্গদকে পাঠিয়েছিলেন রাবণের দরবারে। সেখানে সমস্ত রাক্ষস বাহিনীকে চ্যালেঞ্জ করে অঙ্গদ বলেছিলেন তার একটি পা সামান্য পরিমান সরিয়ে দেখাতে। আর তা করতে না পারলে মাতা সীতাকে সসম্মানে শ্রীরামচন্দ্রের কাছে ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু স্বয়ং রাবণ ও তাঁর বীরপুত্র মেঘনাদও তাঁর পা চুল পরিমান নড়াতে পারেননি।
মেঘনাদের সাথে যুদ্ধের সময় অঙ্গদ মেঘনাদের রথের উপরে চড়ে ঘোড়াসহ রথটিকে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন এবং মেঘনাদকে পরাজিত করেছিলেন। এ যুদ্ধে তাঁর হাতেই বধিত হয়েছিলেন রাবণের মহাশক্তিশালী পুত্র নারান্তক এবং বজ্রদংশত্র ও মহাপার্শ্বের মত বিকট শক্তিশালী সব রাক্ষসেরা। ৮৭ দিন ধরে চলা রামায়ণের যুদ্ধে অঙ্গদ প্রমাণ করেছিলেন তাঁর অসীম বীরত্ব, অতুলনীয় সাহস, তীক্ষ্ণ যুদ্ধকৌশল, এবং শ্রীরামচন্দ্রের প্রতি অটুট ভক্তি।
০৮. সুগ্রীব
রামায়ণের যে চরিত্রটির সাথে মিত্রতা স্থাপন করে শ্রীরামচন্দ্র বানর সেনার সাহায্য পেয়েছিলেন তিনি হচ্ছেন সুগ্রীব। স্বয়ং সূর্যদেবের সন্তান সুগ্রীব ছিলেন অপরিমিত শক্তি, অসীম ধৈর্য ও ন্যায়ের প্রতিবিম্ব। পাহাড়সম পাথর উত্তোলন ও নিক্ষেপ করা কিংবা বৃহৎ কোন বৃক্ষকে উৎপাটন করার মত জাদুকরী ক্ষমতা ছিল মহাবলি সুগ্রীবের মধ্যে। বলা হয়, মল্লযুদ্ধে রাবণকে পরাজিত করার মত ক্ষমতাও ছিল সুগ্রীবের। তবে শারীরিক শক্তির বাইরেও একজন বুদ্ধিমান ও দক্ষ সংগঠক হিসেবেও তাঁর জুড়ি মেলা ভার। রামায়ণের যুদ্ধে তাঁর প্রবল প্রহারে বধিত হয়েছিলেন অগণিত রাক্ষস সেনা। তবে কুম্ভকর্ণের পুত্র কুম্ভ, বিশালাকার রাক্ষস মহোদর এবং বিরূপাক্ষের মত বিপুল শক্তিশালী রাক্ষস যোদ্ধাদেরকে বধ করে নিজের প্রবল শক্তির পরিচয় দিয়েছিলেন সুগ্রীব।
০৭. জাম্ববান
রামায়ণের আরেক কিংবদন্তীতুল্য যোদ্ধা ছিলেন জাম্ববান। ভালুকদের রাজা জাম্ববানের জীবন শুরু হয়েছিল ভগবান বিষ্ণু কর্তৃক কূর্ম অবতার ধারন করার সময় এবং সর্বশেষ শ্রীকৃষ্ণের যুগেও তাঁর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। ভাবছেন একজন ভালুক রাজা আর কত শক্তিশালী হতে পারে? জাম্ববান ছিলেন এমন এক বিশালদেহী ভালুক যিনি উচ্চতায় ছিলেন বিশাল, শক্তিতে ছিলেন বিস্ফোরক, আর গতিতে ছিলেন বায়ুর সমান। রামসেতু নির্মাণ করার সময় বিশাল বিশাল পাথর তিনি নিজেই বহন করেছিলেন অনায়াসে। শারীরিক শক্তির বাইরে জাম্ববান ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী, বুদ্ধিমান ও দূরদর্শী। হনুমানকে তাঁর বিস্মৃত শক্তির সন্ধান দেওয়া, মাতা সীতাকে খুঁজতে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে শ্রীহনুমানকে প্রেরণ করা, যুদ্ধক্ষেত্রে বানর সেনাদের মনোবল বৃদ্ধি করা এবং লক্ষ্মণের জীবন বাঁচাতে সঞ্জীবনী বুটি আনতে শ্রীহনুমানকে প্রেরণ করা এসবকিছুর মূলে ছিলেন ভালুকরাজ জাম্ববান।
রামায়ণের যুদ্ধভূমিতেও জাম্ববান ছিলেন অপ্রতিরোধ্য। রাক্ষসদের বিশাল বিশাল যুদ্ধরথকে একাই উলটে দিয়েছিলেন তিনি। দলে দলে রাক্ষস সেনাদেরকে সংহার করে যুদ্ধভূমি প্রকম্পিত করেছিলেন তিনি। সমগ্র রাক্ষসবাহিনীর কাছে জাম্ববান ছিলেন এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। এমনকি মহাভারতের যুগে এসেও, জাম্ববানের কাছ থেকে স্যমন্তক রত্ন উদ্ধার করার জন্য, স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে ২৮ দিন যাবত যুদ্ধ করতে হয়েছিল জাম্ববানের সাথে। সুতারাং এ ঘটনার দ্বারা সহজেই অনুমান করা যায় যে, জাম্ববান কি বিপুল পরিমান শক্তি ধারণ করতেন।
০৬. কুম্ভকর্ণ
রামায়ণের যুদ্ধের এক যুদ্ধদানবের নাম কুম্ভকর্ণ। সম্পর্কে তিনি লঙ্কাধীশ রাবণের ভ্রাতা। তবে শক্তি-সামর্থ্য বা সাহসে তিনি রাবণের থেকে কোন অংশে কম ছিলেন না। ব্রহ্মার কাছে ইন্দ্রাসন চাওয়ার পরিবর্তে ভুল করে নিদ্রাসন চেয়ে বসায়, প্রতি অর্ধ-বছরে একদিন জেগে থাকতে পারতেন তিনি। তিনি এতটাই শক্তিশালী ছিলেন যে, তাঁর শরীরের উচ্চতা ছিল পাহাড় সমান। তাঁর বিস্তৃত বাহু দ্বারা তিনি নিমেষেই উপড়ে ফেলতে পারতেন বড় বড় পর্বত। বৃহৎ কাণ্ডের বৃক্ষরাজিকে উৎপাটন করতে পারতেন তৃণের মত তাচ্ছিল্যের সাথে। একদল দিকগজের পক্ষেও কুম্ভকর্ণকে ঠেলে এক চুল পরিমান সরানো সম্ভব ছিল না। তবে কুম্ভকর্ণ নামের এই দানবীয় রাক্ষস রাবণের তুলনায় কিছুটা হলেও ছিলেন ন্যায়বোধের অধিকারী। তবে ভ্রাতা রাবণের আদেশে নিজের ন্যায়বোধকে সরিয়ে রেখে তিনি অবতীর্ণ হয়েছিলেন রামায়ণের যুদ্ধে।
কুম্ভকর্ণ যেদিন যুদ্ধভূমিতে প্রবেশ করেছিলেন, সেদিন আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করে বানর সেনাদের কর্ণকুহরে প্রবেশ করেছিল এক অতিদানবীয় গর্জন। তাঁর এক একটি পদার্পণ ছিল এক একটি বিশালাকার বজ্রপাতের সমান। তিনি কখনো পদপিষ্ট করে, কখনো ভক্ষন করে বা কখনো পদাঘাত করে বধ করেছিলেন বিপুল সংখ্যক বানর সেনা। তিনি পরাজিত করেছিলেন সুগ্রীব ও অঙ্গদের মত মহাবলী যোদ্ধাদেরকে এবং তাঁর প্রবল প্রহারে আহত হয়েছিলেন নল, নীল, হনুমানসহ শ্রীরামচন্দ্রের বহু বীর যোদ্ধা।
যুদ্ধক্ষেত্রে তাকে পরাজিত ও বধ করতেও বিপুল সংগ্রাম করতে হয়েছিল ভগবান শ্রীরামচন্দ্রকে। শ্রীরামের নিক্ষেপিত সাধারণ তীর তাঁর সামান্যতম ক্ষতি সাধন করতে পারেনি। তাকে পরাজিত করতে শ্রীরামচন্দ্র একে একে রুদ্রাস্ত্র ও ব্যাভস্ত্র প্রয়োগ করলেও সেগুলো কুম্ভকর্ণকে বধ করতে ব্যার্থ হয়। এরপর শ্রীরামচন্দ্র যখন অর্ধ-চন্দ্রাস্ত্র প্রয়োগ করে কুম্ভকর্ণের পা কেটে দেন তখনও কুম্ভকর্ণ তাঁর গদা নিয়ে ছুটে আসছিলেন শ্রীরামচন্দ্রকে বধ করার উদ্দেশ্যে। তবে সর্বশেষ ঐন্দ্রাস্ত্র প্রয়োগ করে কুম্ভকর্ণের শিরোচ্ছেদ করে দিয়েছিলেন শ্রীরামচন্দ্র।
০৫. লক্ষ্মণ
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যখন শ্রীরামচন্দ্র রূপে অবতার ধারণ করেছিলেন, তখন তাঁর শয্যা অনন্ত নাগ অবতার ধারণ করেছিলেন লক্ষ্মণ রূপে। লক্ষ্মণের জীবনের মূল উদ্দেশ্য শ্রীরামচন্দ্রের সেবা করা হলেও তাঁর তেজ, পরাক্রম, নির্ভিকতা ও ভক্তি আলাদা করে আলোচনার দাবী রাখে। তো শেষনাগের অবতার হওয়ার কারনে লক্ষ্মণ ছিলেন সর্পের মত তেজবান, তীব্র ক্রোধসম্পন্ন এবং প্রলয়ংকরী শক্তির ধারক। ধণুর্বিদ্যা ও গদাযুদ্ধ এই দুই দক্ষতায়ই লক্ষণ ছিলেন অতুলনীয়। সমগ্র রামায়ণে কোথাও দেখা যায় না যে, তাঁর ধণুর্বাণ লক্ষ্যচ্যুত হয়েছে বা তাঁর গদার প্রহার নিষ্ফল হয়েছে। আর তাই রণদক্ষতায় শ্রীলক্ষ্মণকে রাখা হয়েছে পঞ্চম স্থানে। শিশুকাল থেকেই শ্রীরামচন্দ্রের সাথে যৌথভাবে তিনি বধ করেছেন অগণিত রাক্ষস, অসুর, দানব কিংবা দৈত্যদেরকে।
তবে রামায়ণের যুদ্ধই ছিল শ্রীলক্ষ্মণের বীরত্ব প্রদর্শনের শ্রেষ্ঠ মঞ্চ। তাঁর হাড় হিম করা চাহনিতেই ত্রাহি ত্রাহি রব উঠেছিলে রাবণের রাক্ষস বাহিনীর মধ্যে। তাঁর নিক্ষেপিত সুতীক্ষ্ণ বাণের আঘাতে বধিত হয়েছিল তাবড় তাবড় রাক্ষস রথী মহারথীরা। তিনি যখন তীব্র ক্ষিপ্রতায় গদাযুদ্ধে লিপ্ত হয়েছিলেন, তখন যেন ভূকম্পণ অনুভূত হয়েছিল যুদ্ধের ময়দানে। তাই সমগ্র রাক্ষস বাহিনীর কাছে লক্ষণ ছিলেন এক মূর্তিমান আতঙ্ক। আত্মরক্ষার কৌশলেও তিনি ছিলেন প্রায় রাম ও হনুমানের সমতুল্য। একমাত্র নাগপাশ ছাড়া তাকে লক্ষ্য করে নিক্ষেপিত সকল প্রকার দিব্যাস্ত্র ব্যার্থ করে দিয়েছিলেন তিনি। এবং তাঁর সবচেয়ে বড় বীরত্ব হচ্ছে অতিমহারথী মেঘনাদকে বধ করা। যে মেঘনাদের অস্ত্রভাণ্ডারে ছিল প্রায় সকল প্রকার দিব্যাস্ত্র, যার আয়ত্বে ছিল সহস্রাধিক মায়াবিদ্যা, যার ক্ষমতা ছিল মেঘের আড়ালে লুকিয়ে যুদ্ধ করা, সেই মেঘনাদকে নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে পরাজিত ও বধ করেছিলেন শ্রীলক্ষণ।
০৪. বালি
রামায়ণের যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করেও রামায়ণ যুগের একজন অন্যতম শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন কিষ্কিন্ধ্যার বানর রাজা বালি। স্বর্গের রাজা দেবরাজ ইন্দ্রের সন্তান হওয়ার সুবাদে তিনি জন্মগতভাবেই ছিলেন বিপুল শক্তি ও পরাক্রমের অধিকারী। বলা হয় তাঁর শরীরে বিদ্যমান ছিল ৭০০০০ হাতির সমান বল। পিতা ইন্দ্রের কাছ থেকে তিনি এমন একটি দিব্য মালা উপহার হিসেবে প্রাপ্ত হয়েছিলেন যা যা তাকে যুদ্ধক্ষেত্রে পুনরায় শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করত এবং যেকোন মারাত্মক পরিস্থিতিতে নিশ্বাস-প্রশ্বাস চলমান রাখত। তবে এর বাইরে যে শক্তিটি তাকে অপরাজেয় করে তুলেছিল সেটি হচ্ছে ব্রহ্মার দেওয়া বরদান। ভগবান ব্রহ্মা তাঁর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বর দিয়েছিলেন যে, বালি যখন কোন শত্রুর সাথে যুদ্ধ করবেন তখন তাঁর শত্রুর অর্ধেক শক্তি তিনি তাঁর নিজের মধ্যে টেনে নিতে পারবেন। ফলে তাঁর সামনে যতবড় শক্তিশালী শত্রুই আসুক না কেন, শত্রুর অর্ধেক শক্তি নিজের মধ্যে টেনে নেওয়ার ফলে তাঁর যুদ্ধবিজয় অবশ্যম্ভাবী হয়ে পড়ত। একারনে তিনি তাঁর ভ্রাতা সূর্যপুত্র সুগ্রীবকে তিনি সহজেই পরাজিত করতে পেরেছিলেন। এছাড়াও দুন্ধুবী ও মায়াবী নামক দুই মহাশক্তিশালী অসুর পিতা-পুত্রকেও বধ করেছিলেন তিনি। এমনকি যে রাবণকে বধ করতে শ্রীরামচন্দ্রের এত আয়োজন, সেই রাবণকে নিজের লেজে পেঁচিয়ে বগলের নিচে চেপে রেখেছিলেন তিনি।
বলাই বাহুল্য, এই বালিকে বধ করার জন্য স্বয়ং শ্রীবিষ্ণুর অবতার শ্রীরামচন্দ্রকে ছলনার আশ্রয় নিতে হয়েছিল। সুতারাং বালি যে কি বিপুল পরিমান শক্তির অধিকারী ছিলেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
৩.রাবণ
রামায়ণের প্রধান খল চরিত্র রাবণ সম্পর্কে নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। তাঁর পিতা ব্রাহ্মণ ও মাতা রাক্ষসী হওয়ার কারণে মাতার রাক্ষস গুণ প্রাপ্ত হয়েছিলেন তিনি। জন্মগতভাবে তিনি ছিলেন প্রবল যুদ্ধবাজ, নারীলোভী, পরশ্রীকাতর, মায়াবিদ্যায় পারদর্শী এবং বিপুল শক্তির অধিকারী। এগারো হাজার বছর ধরে তিনি তপস্যা করে সন্তুষ্ট করেছিলেন প্রজাপতি ব্রহ্মাকে। বর পেয়েছিলেন, কোন দেবতা, দানব, অসুর, কিন্নর, গন্ধর্ব, বা যক্ষ তাকে বধ করতে বা পরাজিত করতে পারবেন না। তাছাড়া ভগবান শিবের সর্বাপেক্ষা বড় ভক্ত হওয়ার কারনে তাঁর শক্তির মাত্রা উন্নীত হয়েছিল এক অনন্য মাত্রায়। তিনি তাঁর বৈমাত্রেয় ভ্রাতা কুবেরকে পরাজিত করে হাসিল করেছিলেন তাঁর পুষ্পক বিমানটি। একদা তিনি শিব-পার্বতীর বাসস্থল কৈলাশ পর্বতকেও উত্তোলন করে ফেলেছিলেন। তাঁর বিপুল পরাক্রমে দেবরাজ ইন্দ্র, যমরাজ, বরুণদেবসহ প্রায় ৩০ জন দেবতা তাঁর কাছে পরাজিত হয়েছিলেন। তাঁর পুত্র মেঘনাদের জন্মের সময় তিনি নবগ্রহকে যুদ্ধে পরাজিত ও বন্দী করেছিলেন। এসময় তিনি শনিদেবকে পরাজিত করে তাকে মারাত্মকভাবে আহতও করেছিলেন। এগুলো ছাড়াও তিনি বিভিন্ন সময় কারনে-অকারনে রথী মহারথী রাজাদের সাথে যুদ্ধ করে তাদেরকে বধ করেছিলেন।
রামায়ণের যুদ্ধে রাবণ যখন তাঁর উড়ন্ত রথে আরোহন করে সগর্জনে যুদ্ধভূমিতে প্রবেশ করেছিলেন, তখন সমস্ত বানর সেনা কেঁপে উঠেছিল অজানা আশঙ্কায়। তাঁর এক একটি অগ্নিবাণে ছারখার হয়ে গিয়েছিল অগণিত বানর সেনা। তিনি পরাজিত করেছিলেন লক্ষ্মণ, সুগ্রীব, অঙ্গদ এবং হনুমানসহ অসংখ্য রথী মহারথীদেরকে। এমনকি শ্রীরামচন্দ্রের পক্ষেও তাকে পরাজিত করা বেশ কষ্টসাধ্য ছিল। রাবণের নিক্ষেপিত ভয়ংকর সব মারণাস্ত্রকে প্রতিরোধ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন স্বয়ং ভগবান শ্রীরামচন্দ্রও। অবশেষে রাবণকে বধ করার অন্য কোন উপায় না দেখে শ্রীরামচন্দ্র তাঁর উপরে নিক্ষেপ করেছিলেন মহা বিধ্বংসী ব্রহ্মাস্ত্র। আর এই ব্রহ্মাস্ত্রের আঘাতেই বধিত হয়েছিলেন মহাশক্তিশালী রাবণ।
২.মেঘনাদ (ইন্দ্রজিৎ)
রাবণের পুত্র মেঘনাদ রাবণের মতই ছিলেন মহাপরাক্রমশালী। ত্রিদেব ব্যাতীত অন্য সকল দেবতা, মানব, দানব, যক্ষ, রাক্ষস, অসুর ও অন্যান্য সৃষ্টির মধ্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ছিলেন তিনি। সনাতন ধর্মীয় পৌরাণিক ইতিহাসে তিনি এযাবতকালের একমাত্র অতিমহারথী হিসেবে পরিগণিত হন। এবং বীরত্বের শ্রেণীবিভাগে শুধুমাত্র মহামহারথীগণ তথা ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর ছাড়া অন্য সকলের চেয়ে তিনি শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা। তাঁর জন্মের সময় রাবণ নবগ্রহকে বন্দী করে রেখেছিলেন বিধায় কোন গ্রহের কুপ্রভাব তাঁর উপরে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। বাল্যকাল থেকেই পিতার আদেশে শক্তি অর্জনে ব্রতী হন মেঘনাদ। গুরু শুক্রাচার্যের দিকনির্দেশনায় তিনি মহামায়ার আরাধনা করে লাভ করেন অতুল্য মায়াবল, দুঃসাধ্য মহেশ্বর যজ্ঞ সম্পাদন করে পশুপতির কাছ থেকে লাভ করেন বিভিন্ন বর ও মায়াবিদ্যা। অন্যদিকে, তিনি অগ্নিষ্টোম, অশ্বমেধ, রাজসূয়, গোমেধ, বৈষ্ণব প্রভৃতি সপ্তযজ্ঞ সম্পন্ন করেন এবং কামচারী আকাশগামী স্যন্দন, তামসী মায়া, অক্ষয় তূণীর, শক্তিশেল ও শত্রুনাশক বহুবিধ অস্ত্রসস্ত্র লাভ করেন। ফলে বাল্যকাল থেকেই মেঘনাদ হয়ে ওঠেন দুর্ধর্ষ এক যোদ্ধা। তাছাড়া তিনি ব্রহ্মার কাছ থেকে বর প্রাপ্ত হয়েছিলেন যে, যে ব্যক্তি ১৪ বছর নিদ্রা এবং নারীসঙ্গ থেকে বিরত থাকতে পারবেন তিনিই একমাত্র মেঘনাদকে বধ করতে সামর্থ্য হবেন। তিনি আরও বরপ্রাপ্ত হয়েছিলেন যে, যুদ্ধে যাওয়ার আগে নিকুম্ভিলার যজ্ঞাগারে মাতা প্রত্যাঙ্গীরার পূজা করলে তিনি এক দিব্য রথ প্রাপ্ত হবেন। এবং সেই রথে আরোহণ করে যুদ্ধে গেলে কেউই তাকে পরাজিত করতে পারবে না। সুতারাং বলা যায় শক্তি সামর্থ্য ও বরে মেঘনাদ ছিলেন অপরাজেয় এবং অবধ্য।
তাই তাঁর বিপুল শক্তি, অভেদ্য মায়াজাল ও অপ্রতিরোধ্য অস্ত্রসস্ত্র সহযোগে তিনি একের পর এক জয় করেন বড় বড় যুদ্ধ। তিনি যুদ্ধে পরাজিত করেছিলেন শেষনাগ, ইন্দ্রপুত্র জয়ন্ত ও দেবরাজ ইন্দ্রকেও। আর দেবরাজ ইন্দ্রকে পরাজিত করে বন্দী করার জন্য তাঁর নাম হয়েছিল ইন্দ্রজিৎ। তিনি মেঘের আড়ালে লুকিয়ে যুদ্ধ করে শত্রুকে বিভ্রান্ত ও পরাজিত করতে পারতেন বলেই তাঁর নাম হয়েছিল মেঘনাদ।
রামায়ণের যুদ্ধে তিনি বানর সেনাদের বিপক্ষে এমন তীব্র প্রহার শুরু করেছিলেন যে, বিপুল পরিমান বানর সেনা তিনি মূহুর্তেই সংহার করে দিয়েছিলেন। রাম-লক্ষ্মণের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রথম দিনেই তিনি রাম লক্ষণকে নাগ পাশ দ্বারা বিদ্ধ করে সেদিনকার যুদ্ধে বিজয় লাভ করেছিলেন। পরবর্তী দিনে তিনি লক্ষ্মণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে তাকে শক্তিশেল দ্বারা প্রহার করে মূর্ছিত করে দেন। এবং তাঁর পরবর্তী দিনে মেঘনাদ তাঁর চূড়ান্ত মায়াবিদ্যা প্রয়োগ করে মায়া সীতা সৃষ্টি করেন, এবং সকলের সামনে তাকে বধও করেন। এর ফলে মনোবল ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল রাম-লক্ষ্মনসহ সমস্ত বানর সেনাদের। কিন্তু পরবর্তীতে মেঘনাদ নিকুম্ভিলা যজ্ঞাগারে প্রবেশ করলে বিভীষণের পরামর্শে লক্ষ্মণ সেখানে উপস্থিত হন এবং অঞ্জলিকাস্ত্র প্রয়োগ করে তাকে বধ করেন।
১.হনুমান
রামায়ণের চরিত্রগুলোর মধ্যে শক্তি-সামর্থ্য ও রণদক্ষতায় শ্রীহনুমানকে রাখা হয়েছে সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধা হিসেবে। এবং তাকে শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা বলার কারন হয়ত আপনারা ইতিমধ্যেই অনুমান করতে পেরেছেন। শ্রীহনুমানের জন্ম হয়েছিল বানর রাজ কেশরীর ঔরসে এবং মাতা অঞ্জনীর গর্ভে। তবে পবনদেবের আশির্বাদে তাঁর জন্ম হওয়ার কারনে তিনি পবনপুত্র হনুমান নামেই ত্রিভূবনে পরিচিত। পুরাণ মতে, শ্রীহনুমান স্বয়ং ভগবান শিবের অবতার বা মতান্তরে শিবাংশ। সুতারাং জন্মগতভাবেই তিনি যে বিপুল শক্তির অধিকারী ছিলেন তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
তবে এর বাইরেও শ্রীহনুমান বিভিন্ন দেবতাদের কাছ থেকে লাভ করেছিলেন শক্তিশালী বর ও আশির্বাদ।
- ইন্দ্রদেব তাকে বর দিয়েছিলেন যে, তাঁর বজ্রাস্ত্র শ্রীহনুমানের কোন ক্ষতি করতে পারবে না।
- বিশ্বকর্মা তাকে বর দিয়েছিলেন যে, তাঁর নির্মিত অস্ত্রশস্ত্রে হনুমানের কোন ক্ষতি হবে না।
- ছেলেবেলায় যে সূর্যদেবকে ফল ভেবে হনুমান ভক্ষণ করতে গিয়েছিলেন, সেই সূর্যদেবকেই পরবর্তীতে গুরু হিসেবে প্রাপ্ত হয়েছিলেন হনুমান। শিক্ষা গ্রহণ শেষে গুরু সূর্যদেব তাঁর শিষ্যকে এই বর দিয়েছিলেন যে, হনুমান হবেন অসীম জ্ঞান ও বাগ্মীতার অধিকারী। একারণে শ্রীহনুমান সমস্ত বেদ, উপনিষদ, এবং ধর্মীয় শিক্ষা নিজের অন্তরে ধারণ করতে পেরেছিলেন খুব সহজেই।
- কুবেরদেব তাকে বর দিয়েছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে সর্বদা বিজয়ী হওয়ার।
- তাঁর পিতা পবনদেব তাকে দিয়েছিলেন অপরিমেয় শক্তি, তুখোড় গতি এবং ক্লান্তিহীনতার বর।
- অগ্নিদেব তাকে বর দিয়েছিলেন অগ্নি বা অগ্নি দ্বারা নির্মিত কোন অস্ত্র শ্রীহনুমানের উপরে কোন প্রকার প্রভাব ফেলতে পারবে না। একারনে লংকায় যখন তাঁর লেজে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়, তখন তিনি নিজে আহত হননি বরং সম্পূর্ণ লঙ্কাকে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন।
- বরুণদেব তাকে বর দিয়েছিলেন যে, জল কখনো শ্রী হনুমানের বাঁধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। একারনে বিশাল সমুদ্রের উপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় বা প্রকাণ্ড জলদানবদের সাথে যুদ্ধেও শ্রীহনুমানকে কোন প্রকার ক্লেশ পেতে হয় নি।
- এবং শ্রীরামচন্দ্র ও মাতা সীতা তাকে দিয়েছিলেন অমরত্বের বর। তবে এত সব বর, আশির্বাদ ও অস্ত্রশস্ত্র থাকার সত্বেও শ্রীহনুমানের সবচেয়ে বড় অস্ত্র ছিল রাম ভক্তি। এবং তা দিয়ে তিনি বার বার অসাধ্য সাধন করে দেখিয়েছেন।
তিনি যখন মাতা সীতাকে খুঁজতে লঙ্কায় গিয়েছিলেন, তখন তিনি একাই আশি হাজার কিংকর রাক্ষসদেরকে বধ করেছিলেন, এবং সেখানেই তিনি রাবণের পুত্র অক্ষয়কেও বধ করেছিলেন।
শ্রীহনুমান যখন রামায়ণের যুদ্ধে প্রবেশ করেছিলেন তখন তাঁর তীব্র গর্জন ব্রজ্রপাতের মত আঘাত করেছিল রাক্ষস বাহিনীর সৈন্যদের কর্ণকুহরে। তিনি কখনো গদাঘাতে, কখনো মুষ্টিঘাতে এবং কখনো দিব্যাস্ত্র প্রয়োগ করে বধ করেছিলেন অগণিত রাক্ষস সেনাদেরকে। তবে সাধারন রাক্ষস সেনাদেরকে সংহার করার পাশাপাশি তিনি রাবণের দুই মহাশক্তিশালী পুত্র দেবান্তক ও ত্রিশিরা, কুম্ভকর্ণের পুত্র নিকুম্ভ, প্রহস্তের সাত পুত্র, ধুম্রাক্ষ, অকম্পন, কালনেমি, অহিরাবণ প্রভৃতি তাবড় তাবড় রথী মহারথীদেরকে বধ করে শ্রীরামচন্দ্রের যুদ্ধবিজয় সুনিশ্চিত করেছিলেন। তাছাড়া শক্তিসেল বিদ্ধ লক্ষ্মণের প্রাণ বাঁচাতে সুবিশাল গন্ধমাদন পর্বত তিনি কাঁধে তুলে এনেছিলেন অনায়াসে।
প্রিয় দর্শক, এই ছিল আমাদের বিচারে রামায়ণের ১০ জন যোদ্ধার র্যাংকিং। আপনার দৃষ্টিতে রামায়ণের সেরা যোদ্ধারা কারা তা কমেন্ট করে জানাতে ভুলবেন না। এবং আপনি যদি একজন রামভক্ত হয়ে থাকেন তাহলে কমেন্টে একবার জয় শ্রীরাম লিখে যাবেন।