You are currently viewing অশ্বমেধ, গোমেধ ও নরমেধ যজ্ঞ কি? ভ্রান্ত ধারণার অবসান || Ashwamedha, Gomedha & Naramedha Yagna ||

অশ্বমেধ, গোমেধ ও নরমেধ যজ্ঞ কি? ভ্রান্ত ধারণার অবসান || Ashwamedha, Gomedha & Naramedha Yagna ||

নমস্কার প্রিয় বন্ধুরা। সনাতন এক্সপ্রেসের একটি বিশেষ আয়োজনে আপনাকে স্বাগতম। এটিকে বিশেষ বলার কারন হচ্ছে, অশ্বমেধ, গোমেধ ও নরমেধ যজ্ঞ সম্পর্কে যুগ যুগ ধরে চলে আসা মিথ্যাচার তথা ভ্রান্ত ধারনার অবসান ঘটতে চলেছে এই আলোচনার মাধ্যমে। জানতে চান কি সেই ভ্রান্ত ধারনা? অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পন্ন হলে নাকি যজ্ঞের অশ্বটি যজ্ঞকারী রাজার স্ত্রী তথা রাণীর সাথে অশ্লীল কর্মে লিপ্ত হত এবং এরপর সেই পশু বধ করে অগ্নিতে আহূতি দেওয়া হত। আবার গোমেধ যজ্ঞে নাকি গরুকে বলি দিয়ে গোমাংস পরিবেশন করা হত যজ্ঞে উপস্থিত ব্যাক্তিবর্গের মধ্যে। তাহলে নরমেধ যজ্ঞে নিশ্চই নরবলি বা নরমাংস খাওয়ার বিধান থাকা উচিত, তাই না?  আবার গোমেধ যজ্ঞের ধারণার উদ্ধৃতি দিয়ে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাও বলে থাকেন হিন্দুদের গোমেধ যজ্ঞে যে পরিমান গরু বলি দেওয়া হত, তা দেখে শংকিত ঋষিগণ গোহত্যা এবং গোমাংস ভক্ষন নিষিদ্ধ করে দেন। তাহলে এই জগাখিচুড়ি থেকে পরিত্রানের উপায় কি? যে সনাতন ধর্ম অনাদি কাল থেকে অহিংস রীতি অনুসরন করে আসছে, যে ধর্মে ব্যাভিচার বর্জনে এত নীতিকথা আদিষ্ট হয়েছে, যে ধর্মে যে কোন প্রকার মাংসাহারকে ব্যাপকভাবে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে, সেই ধর্মে এগুলো কিভাবে গ্রহণযোগ্য? তাহলে চলুন দেখি এই অপযুক্তিগুলো খণ্ডন করে শুদ্ধ জ্ঞান অর্জন করা যাক।

মেধ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে যাগ-যজ্ঞ। সনাতন শাস্ত্রে পাঁচ প্রকার যজ্ঞের নামকরণ করা হয়েছে যা পঞ্চমেধ যজ্ঞ নামেও পরিচিত। এগুলো হচ্ছে অশ্বমেধ, গোমেধ, পুরুষমেধ বা নরমেধ, অবিমেধ এবং অজমেধ। এর মধ্যে প্রথম তিনটি যজ্ঞ নিয়ে রয়েছে ব্যাপক ভ্রান্ত ধারনা। এই ভ্রান্ত ধারণার শুরু হয়েছে মূলত কিছু অমৌলিক গ্রন্থের উদ্ধৃতি দিয়ে। এবং সেই ভ্রান্ত ধারণার ভিত্তিকে শক্ত করেছে সায়ণ, মহীধর ও উব্বট কর্তৃক রচিত কিছু ভাষ্য বা অনুবাদ। এসকল ভ্রান্ত মতে যজ্ঞে গাভী, অশ্ব, পুরুষ, ছাগল ও ভেড়াকে হত্যা করে সম্পন্ন  হত যজ্ঞের কার্যবিধি। সে অর্থে অশ্ব বা ঘোড়া কেন্দ্রিক যে যজ্ঞ তাকে বলা হয় অশ্বমেধ যজ্ঞ, গাভী বা গরু কেন্দ্রিক যে যজ্ঞ তাকে বলা হয় গোমেধ যজ্ঞ এবং নর বা মানুষ কেন্দ্রিক যাগ-যজ্ঞকে বলা হয় নরমেধ যজ্ঞ। তবে মহর্ষি দয়ানন্দ সরস্বতী সর্বপ্রথম এই বিকৃত ও ভ্রান্ত ধারণাগুলোর যুক্তিখণ্ডন করেছিলেন যথাযথ শাস্ত্রীয় বচন দ্বারা। তাঁর ভাষ্যের আলোকেই সনাতন এক্সপ্রেসের দর্শকদের জন্য তুলে ধরা হল প্রকৃত সত্য।

আরও পড়ুনঃ  হনুমান চালিশা পাঠ করুন, আশ্চর্য শক্তিশালী মন্ত্রের ক্ষমতা দেখুন।
অশ্বমেধ যজ্ঞ
অশ্বমেধ যজ্ঞ

তো প্রথমেই জেনে নেওয়া যাক বৈদিক শাস্ত্র গ্রন্থের আলোকে যজ্ঞ কাকে বলে?

বৈদিক সংস্কৃতের ধাতুপাঠ অনুযায়ী যজ্ঞ শব্দের উৎপত্তি ‘যজ্’ ধাতু হতে, যার অর্থ- দেব পূজা, সংগতিকরণ বা ঐক্যবদ্ধ করা এবং দান করা। পবিত্র বেদের প্রথম মন্ডলের প্রথম সুক্তের চার নং মন্ত্রে যজ্ঞকে ‘অধ্বরং’ বলা হয়েছে।

মহর্ষি যাস্কাচার্য তাঁর অমরগ্রন্থ অর্থাৎ বৈদিক ব্যকরন গ্রন্থ নিরুক্তে বলেছেন,

“”অধ্বরাং ইতি যজ্ঞনাম।

ধ্বরাতিহিংসাকর্ম তত্‍প্রতিশেধহ।।””

অর্থাৎ, যজ্ঞের আরেক নাম অধ্বর। এবং যজ্ঞ হল সেই অনুষ্ঠান যা সম্পূর্ন সাত্ত্বিক এবং সেখানে সকল প্রকার ধ্বর বা হিংসাকর্ম তথা রক্তপাত,হিংসা ও বিদ্বেষ নিষিদ্ধ। সে অর্থে যজ্ঞে পশুবলির মত হিংসাকর্ম সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। তাছাড়া আমাদের চারটি বেদের অসংখ্য স্থানে যজ্ঞকে অধ্বর বা অহিংস বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

অথর্ববেদে বলা হচ্ছে,

রাজসূয়, বাজপেয়,অগ্নিষ্টোম, ও অশ্বমেধাদি সব যজ্ঞ অধ্বরঃ অর্থাৎ হিংসা রহিত যজ্ঞ। যাহা প্রাণীমাত্রকে বৃদ্ধি এবং সুখ শান্তি দাতা।

সুতারাং বেদের যজ্ঞকে পশুবলির অনুষ্ঠান হিসেবে যে মিথ্যা ধারণা প্রচলিত তা সম্পূর্ণরূপে ভুল এবং বেদ বিরুদ্ধ। এছাড়াও যজ্ঞকে কেন্দ্র করে যে অশ্লীলতার প্রচার করা হয় সেটিও ভিত্তিহীন। কারন সাত্ত্বিক কোন অনুষ্ঠানে অশ্লীলতা বা যৌনকর্মের কোন স্থান নেই।

এবার জেনে নেওয়া যাক অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পর্কে। এ যজ্ঞে রাজা তাঁর একটি শক্তিশালী ঘোড়াকে ছেড়ে দিতেন পৃথিবী পরিভ্রমণের জন্য। ঘোড়ার পিছনে থাকত অশ্বমেধ যজ্ঞকারী সেই রাজার বিশাল সেনাবাহিনী। ঘোড়াটি যে রাজ্যের উপর দিয়ে দৌড়ে যেত সেই রাজ্যের রাজা যদি ঘোড়াটিকে বাধা না দিতেন তাহলে অশ্বমেধ যজ্ঞকারী রাজা ঐ রাজ্যের অধিকার পেতেন। পক্ষান্তরে যদি কোন রাজা ঘোড়াটিকে আটক করতেন, তাহলে তাঁর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতেন ঘোড়ার পিছনে থাকা অশ্বমেধ যজ্ঞকারী রাজার সেনাবাহিনী। জেনে রাখা ভালো মাত্র গুটিকয়েক বৈদিক সম্রাট এই অশ্বমেধ যজ্ঞ করেছিলেন, তারা হচ্ছেন যুধিষ্ঠির, দশরথ, পরীক্ষিত ও জন্মেজয়।

আরও পড়ুনঃ  পিতৃপক্ষ ও দেবীপক্ষ কি? বিস্তারিত জানুন, সংশয় দূর করুন |

 

তবে অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে শতপথ ব্রাহ্মণ গ্রন্থটি পড়তে পারেন। মূলত যজুর্বেদের ব্যখ্যামূলক গ্রন্থই হচ্ছে এই শতপথ ব্রাহ্মণ। এই গ্রন্থ অনুসারে জানা যায়

“প্রজাপতির্বৈ জমদগ্নিঃ সো অশ্বমেধঃ।

ক্ষত্রং বাশ্বো বিডিতরে পশবঃ।

ক্ষত্রস্যৈতদ্রূপং য়দ্ধিরণ্যং।

জ্যোতির্বৈ হিরণ্যম্।”

অর্থাৎ, রাজ্যপলনের কর্মই অশ্বমেধ। রাজার নাম অশ্ব এবং প্রজার নাম অশ্ব ব্যতীত অপরাপর পশুর নাম। অশ্বমেধে রাজ্যের শোভা স্বরূপ ধন হয়ে থাকে এবং সেই জ্যোতির নাম হিরণ্য।

তাছাড়া শতপথ ব্রাহ্মণে বলা হয়েছে,

“রাষ্টং বৈ অশ্ব মেধঃ ।

অগ্ন হি গৌঃ ।

অগ্নির্বা অশ্বঃ আজ্যং মেধঃ”

অর্থাৎ, অশ্ব হল রাষ্ট্রের প্রতীকি নাম । এই রাষ্ট্রের মেধ তথা প্রগতি কামনায় রাজা যে যজ্ঞ করেন তাই অশ্বমেধ যজ্ঞ।

অশ্বমেধ যজ্ঞ
অশ্বমেধ যজ্ঞ

শতপথ ব্রাহ্মণে আরো বলা হয়েছে-

যা দ্বারা রাজ্যের প্রকাশ বা উন্নতি হয় তাই অশ্বমেধ। রাজ্যের উন্নতিবাচক কর্ম ধারণ করাই রাজ্যসভার কার্য। ঐ রাজ্যসভা নিজ পক্ষ থেকেই প্রজার প্রতি কর ধার্য করে থাকে। সেই রাজা দ্বারাই রাজ্য ও প্রজা দ্বারাই প্রজাদের বৃদ্ধি বা উন্নতি হয়ে থাকে।অর্থাৎ, অশ্বমেধ হচ্ছে সেই কর্ম যা দ্বারা দেশ ও জনগণের কল্যাণ হয়ে থাকে। এখানে অশ্লীলতা বা হিংসাকর্মের কোনো স্থান নেই। তাই এই মহৎ কর্মের বিকৃত ও অশ্লীল তাৎপর্য সর্বদাই বর্জনীয়।

 

এ তো গেল অশ্বমেধ যজ্ঞের কথা, তাহলে কি গোমেধ যজ্ঞে গাভী বলি বা মাংস ভক্ষণের বিধান ছিল? আসুন জেনে নেওয়া যাক আসল সত্য।

বৈদিক কোষ নিঘন্টুতে গাভীর নয় প্রকার নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলো হল, অঘ্না, উস্ত্রা, উস্ত্রিয়া, অহী, মহী, অদিতি, ইলা, জগতি এবং শকরী। গাভীর এই নবনামগুলোর মধ্যে অঘ্না এবং অদিতি নাম দুইটির উপর আলোকপাত করলেই গাভীর প্রতি বেদের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট হবে।

অঘ্না শব্দের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে যাস্কমুনি বলেছেন, “অঘ্না অহন্তব্যা ভবতি”

আরও পড়ুনঃ  চিত্রগুপ্তের জন্ম কিভাবে হয়েছিল? তিনি কিভাবে যমরাজের সহকারী হয়েছিলেন? Story of Chitragupta.

অর্থাৎ, গাভীর নাম অঘ্না এইজন্য যে, তাহা “অহন্তব্যা” অর্থাৎ হত্যা করার যোগ্য নয়।

মহাভারতের শান্তিপর্বে অঘ্না শব্দের অর্থ সমন্ধে বলা হয়েছে,

“বেদ বা শ্রুতিতে গাভীকে অঘ্না তথা অবধ্য বলা হয়েছে। যিনি গাভী কে এবং ষাড়কে বধ করেন তিনি মহা পাপ করেন।

সুতারাং অঘ্না বা গাভী হচ্ছে এমন একটি প্রাণী যাকে কোনভাবেই বধ করা যাবে না। ”

এবার আসুন অদিতি শব্দটির দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক, অদিতি শব্দের নির্বচনে নিঘন্টুর টীকায় শ্রী দেবরাজ যজ্বা লিখেছেন, “ন দ্যতি, অখন্ডীয়া বা”।

অর্থাৎ, গাভীর নাম অদিতি এইজন্য হয়েছে যে, গাভী অখন্ডনীয়, অর্থাৎ তাহার অঙ্গ কে খন্ড বা টুকরো করা উচিৎ নয়।

সুতারাং, গাভীর এর দুই নামের উপর বিচার করার পর স্পষ্টভাবে বলা যায় যে, যজ্ঞে বা সাধারনভাবে গাভী বা ষাড়কে হত্যা করা বৈদিক ভাবের সর্বদা বিপরীত।

এতক্ষন তো গেল গাভী হত্যা না করার কথা। তাহলে গোমেধ যজ্ঞে আসলে হয়টা কি?

আমরা আগেই বলেছি গো শব্দটির নয়টি অর্থের কথা বলা হয়েছে বৈদিক কোষ নিঘন্টুতে। এবার সেই নয়টি অর্থ থেকে মহী ও জগতি শব্দ দুটির দিকে একটু নজর দেওয়া যাক। মহী শব্দের অর্থ হচ্ছে পৃথিবী এবং জগতি শব্দের অর্থ হচ্ছে জগৎপতি বা সর্বশক্তিমান। তাই মহী তথা পৃথিবী ও পরিবেশের নির্মলতা কামনায় জগতি বা সর্বশক্তিমানের উদ্দেশ্যে যে যজ্ঞ বা উপাসনা তাই গোমেধ যজ্ঞ।

গোমেধ যজ্ঞ
গোমেধ যজ্ঞ

এবার আসি নরমেধ যজ্ঞে। যারা অশ্বমেধকে অশ্ববলি এবং গোমেধকে গোবলি বলে থাকেন, তারা নরমেধকে কি বলবেন? নরবলি? কই তারা তো নরমেধকে নরবলি যজ্ঞ বলেন না। তাহলে নরমেধ যজ্ঞ আসলে কি?

মূলত মানুষের মৃত্যুর পর তার আত্মার সদগতি কামনায় যে অগ্নিদাহাদি ভিত্তিক অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া যজ্ঞ করা হয় সেটিই নরমেধ যজ্ঞ।

সুতারাং, সনাতন বেদাদি শাস্ত্রে পশুর প্রতি সকল প্রকার হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে এবং তা করলে কর্তা অবশ্যই পাপী বলে গণ্য হবেন।

5/5 - (1 vote)

Leave a Reply