সনাতন ধর্মীয় পৌরাণিক কাহিনীগুলোতে বর্ণিত হয়েছে বিপুল শক্তিধর ও ভয়ংকর সব অসুর, দানব ও রাক্ষসের কাহিনী। তাদের অত্যাচার ও উৎপাতে ত্রিলোক যখন ত্রাহি ত্রাহি বর তুলত তখন দেবগন তাঁদেরকে বধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠিত করতেন ত্রিলোকে। কিন্তু কখনো কখনো শুধুমাত্র শক্তির জোরে তাঁদেরকে পরাজিত করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি, প্রয়োজন হয়েছে মগজাস্ত্র তথা বুদ্ধির। আজ আমরা ঠিক তেমনই এক অসুরের কাহিনী জানতে চলেছি যার ভয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন স্বয়ং দেবাদিদেব মহাদেব। কিন্তু যার ভয়ে স্বয়ং ভগবান পালিয়ে যান, তাঁর হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় কি? কে সেই মাস্টারমাইন্ড যার মাস্টারপ্লানে কুপোপাত হয়েছিল এই অসুর?
ভস্মাসুর, দেবাদিদেব মহাদেব ও মোহিনীরূপী শ্রীবিষ্ণুর এই কাহিনী বর্ণিত হয়েছে একাধিক পুরাণে। সেখানে কাহিনী, চরিত্র বা উপস্থাপন কৌশলে মৃদু ভিন্নতা থাকলে মূল কাহিনী এবং নৈতিক শিক্ষার বিষয়টি প্রায় অভিন্ন। আসুন তাহলে মূল কাহিনীতে প্রবেশ করা যাক। কাহিনীর শুরু দেবাদিদেব মহাদেবকে দিয়ে। আপনারা সকলেই জানেন মহাদেব আত্মধ্যানে লীন থাকেন। কৈলাশ পর্বতে গৃহী জীবন যাপনের পাশাপাশি ছাইভস্ম মেখে শ্মশানচারী সন্যাসীর জীবনও যাপন করে থাকেন তিনি। একদা তিনি কোন এক নির্জন প্রান্তরে বসে ধ্যানের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এসময় তিনি তাঁর পাশে থাকা ভস্মের পাত্র থেকে কিছুটা ভস্ম নিজের গায়ে মাখলেন। দেবাদিদেব তাঁর নিজের শরীরে যে ভস্ম মাখেন তা মূলত শ্মশান ভস্ম। কিন্তু সেদিন ভস্ম মাখার সময় তিনি দেখতে পেলেন ভস্মের মধ্যে মানুষের কিছু চুল মিশ্রিত হয়ে আছে। নিজের ব্যাবহার্য বিভূতিতে মানুষের চুল দেখে চরম বিরক্ত হলেন তিনি। তাঁর সেই বিরক্তি মুহূর্তে রূপ নিল ক্রোধের। ক্রুদ্ধ হয়ে তিনি তাঁর ভস্মের পাত্রটিকে ছুড়ে মারলেন মাটিতে। মহাদেবের ক্রোধ যেনতেন কিছু নয়। দুর্বাসার মত রাগী ঋষির জন্মও হয়েছিল তাঁর ক্রোধ থেকেই। তাই এবাররও তাঁর ক্রোধ বৃথা গেল না। বিভূতির পাত্রটি ছুড়ে মারার পরেই সেই ভস্ম ও শিবের ক্রোধের সমন্বয়ে সৃষ্টি হল এক অসুর। যেহেতু ভস্ম থেকে এই অসুরের জন্ম তাই তাঁর নাম হল ভস্মাসুর বা ভস্মাসুরা। এরপর এই ভস্মাসুর শিবের সামনে এসে প্রণাম করে বললেন, “আদেশ করুন প্রভু।”
ভস্মের পাত্র বিনষ্ট হওয়ায় মহাদেবের তখন শ্মশান ভস্মের প্রয়োজন ছিল। তাই তিনি ভস্মাসুরকে আদেশ করলেন, “হে ভস্মাসুর, আজ থেকে তুমি আমার জন্য শ্মশান থেকে ভস্ম আনবে। এটাই তোমার একমাত্র কাজ।” ভস্মাসুর অত্যন্ত খুশিমনে চলে গেলেন শিবের জন্য ভস্ম আনতে। এভাবে কেটে গেল বহুকাল। এর মধ্যে অজস্রবার শ্মশান থেকে ভস্ম এনে দেবাদিবকে দিয়েছেন ভস্মাসুর, কোনদিন এর কোন ব্যাতিক্রম হয়নি। ভস্মাসুরের এই সমর্পণ ও ত্যাগ দেখে তাঁর প্রতিও বিশেষভাবে প্রীত ছিলেন মহাদেব।
কিন্তু একদিন ভস্মাসুর ফিরে এলেন একেবারে খালি হাতে। এ দৃশ্য দেখে একটু আশ্চর্য হলেন শিব। ভস্মাসুরকে জিজ্ঞাসা করলেন, “কি ব্যাপার ভস্মাসুর, আজ ভস্ম আনোনি কেন?” মহাদেবের প্রশ্ন শুনে তাঁর পদতলে লুটিয়ে পড়লেন ভস্মাসুর। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “হে প্রভু, আমাকে ক্ষমা করবেন। আজ আমি কোন শ্মশানে ভস্মের খোজ পাই নি। এতকাল ধরে আমি কোনদিন আপনার আদেশ লঙ্ঘন করি নি। কিন্তু আজ আমি নিরুপায়। শ্মশানে কোন মৃতদেহ না এলে আমি ভস্ম কোথা থেকে পাবো? তবে আপনার আদেশ পালন করতে না পারার জন্য আপনি যদি আমাকে কোন দণ্ড দেন তাহলে আমি তা মাথা পেতে নেব।”
মহাদেব বললেন, “না হে ভস্মাসুর, শ্মাশানে ভস্ম না পেলে তো তোমার কিছু করার নেই। এখানে তো তোমার কোন দোষও নেই যে, আমি তোমাকে দণ্ড দেব।” ভস্মাসুর বললেন, “তাহলে হে প্রভু, আমাকে এই বর দিন যে, আমি যদি কারও মাথায় হাত রাখি তাহলে সে ভস্মে পরিণত হবে। যেদিন আমি কোথাও ভস্মের সন্ধান পাবো না, সেদিন আমি এভাবেই আপনার জন্য ভস্ম আনব। এতে আপনার ভস্মেরও অভাব থাকবে না আর আমাকে দেওয়া আপনার আদেশ ও লঙ্ঘন হবে না।”
ভস্মাসুরের চাওয়া বর নিয়ে কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন শিব। তারপর ভাবলেন তাঁর প্রতি অটুট শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থাকেই হয়ত ভস্মাসুর এই বর চাইছে। তাছড়া ভস্মাসুরের দীর্ঘদিনের কর্মনিষ্ঠা দেখেও তাঁর প্রতি বিশেষভাবে সন্তুষ্ট ছিলেন মহাদেব। তাই তিনি ভস্মাসুরের চাওয়া বর প্রদান করে তাঁর উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন “তথাস্তু। এখন থেকে তুমি যার মাথায়ই হাত রাখবে তাঁর শরীর ভস্মে পরিণত হবে।”
শিবের কাছ থেকে বর লাভ করে যারপরনাই সন্তুষ্ট হলেন ভস্মাসুর। কিন্তু এর পরক্ষণেই এক দুষ্টবুদ্ধি খেলে গেল তাঁর মাথায়। ভস্মাসুর শিবের দেওয়া বর তাঁর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করার জন্য এগিয়ে এলেন শিবের দিকে। তারপর তাঁর হাত রাখার চেষ্টা করলেন তারই প্রভু মহাদেবের মাথায়। ভস্মাসুরের এই দুর্বুদ্ধি দেখে হতবুদ্ধি হয়ে গেলেন মহাদেবও। তাঁর দেওয়া বর ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা তাঁর নেই। অন্যদিকে ভস্মাসুর যদি কোনভাবে তাঁর মাথায় হাত রাখতে পারেন তাহলে তিনিই নিজেও ভস্ম হয়ে যাবেন। অগত্যা উপায় না দেখে সেখান থেকে চম্পট দিয়ে পালিয়ে বাঁচলেন শিব। ভস্মাসুরও ছুটল তাঁর পিছুই পিছু। নিজের বরে বলীয়ান অসুরের হাত থেকে বাঁচতে ছদ্মবেশ ধারণ করে পালিয়ে বেড়াতে লাগলেন মহাদেব। আর মহাদেবের খোঁজে ভস্মাসুরও যাকে পেল তাঁর মাথায় হাত রেখে ভস্ম করে দিতে লাগল। এই ঘটনায় দেবকুল, ঋষিকুল এবং মানবকুল এক চরম উৎকণ্ঠায় দিনাতিপাত করতে লাগল।
অবশেষে একদিন দেবাদিদেব মহাদেব পৌছে গেলেন ভগবান শ্রীবিষ্ণুর বৈকুণ্ঠ ধামে। কারন তিনি জানতেন এই সমগ্র সংসারের সবচেয়ে বড় মাস্টারমাইন্ড হচ্ছেন বিষ্ণু। শুধুমাত্র তাঁর মাস্টারপ্লান দিয়েই ভস্মাসুরকে পরাজিত করা সম্ভব। দেবাদিদেব মহাদেবের কাছে ভস্মাসুরের সমস্ত বৃত্তান্ত শুনে অভয় দিলেন ভগবান বিষ্ণু। এরপর তিনি মায়াবলে ধারণ করলেন মোহিনী রূপ। এই সেই মোহিনী রূপ যার আবেদনে ভুলিয়ে অসুরদেরকে তিনি অমৃত পান করা থেকে বিরত রেখেছিলেন। বৈষ্ণব সমাজে মোহিনী একাদশী নামে যে একাদশীটি পালন করা হয় তার নামকরণও হয়েছে শ্রী বিষ্ণুর এই মোহিনী অবতারের নামেই।
যাইহোক, শ্রীবিষ্ণু মোহিনী রূপ ধারণ করে এসে দাঁড়ালেন ভস্মাসুরের সামনে। অপ্সরাদের চেয়ে সুন্দর শারীরিক গঠন শৈলী, উজ্বল গাত্রবর্ণ এবং সর্বাঙ্গসুন্দরী মোহিনীকে দেখে সব কিছুই বিস্মৃত হয়ে গেল ভস্মাসুরের। মোহিনীর কমনীয় আবেদনে দুই চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল তাঁর। তাই আর দেরী না করে ভস্মাসুর মোহিনীকে প্রেম নিবেদন করে বিবাহের প্রস্তাব দিলেন। ভস্মাসুরের প্রেম নিবেদন করা দেখে মোহিনীর ঠোটে যে হাসি ফুটে উঠল তা দেখে আরও একবার সম্মোহিত হয়ে গেলেন ভস্মাসুর। কার মাথায় হাত রাখলে কি হবে এসব বিষয়ে বেমালুম ভুলে গেলেন তিনি। মোহিনী এবার ভস্মাসুরকে শর্ত দিলেন যে যদি ভস্মাসুর মোহিনীকে নৃত্যকলায় হারাতে পারেন তাহলে তিনি তাঁকে বিবাহ করবেন। অসুর ভাবলেন এ আর এমন কি? তাই তিনি রাজি হয়ে গেলেন মোহিনীর সাথে নৃত্যকলা প্রতিযোগিতার জন্য।
শুরু হল নৃত্য প্রতিযোগিতা। মোহিনী যেভাবেই নৃত্য করেন, ভস্মাসুর সেভাবেই অনুকরণ করে নৃত্য করতে লাগলেন তালে তালে। এভাবে কেটে গেল বেশ কিছু সময়। আর আড়াল থেকে এই ঘটনা পর্যপবেক্ষন করছিলেন দেবাদিদেব মহাদেব। এরপর এক পর্যায়ে মোহিনী তাঁর নিজের মাথায় নিজের হাত রেখে বিশেষ ভঙ্গিতে নৃত্য করতে লাগলেন। আর যেহেতু ভস্মাসুর মোহিনীর নাচের মুদ্রা অনুসরণ করছিলেন, তাই তিনিও তাঁর নিজের মাথায় হাত রেখে নৃত্য করার জন্য যেইনা তাঁর নিজের মাথায় হাত দিলেন, ওমনি তাঁর নিজের শরীরই ভস্মে পরিণত হল। সমগ্র সংসার মুক্তি পেল ভস্মাসুর নামক অসুরের সৃষ্ট আতঙ্ক থেকে।
প্রিয় দর্শক, পুরাণের কাহিনীগুলো রচনা করার মূল উদ্দেশ্য ছিল, কাহিনীর আড়ালে আমাদেরকে কিছু নৈতিক শিক্ষা প্রদান করা। ভস্মাসুরের এই কাহিনীও তাঁর ব্যাতিক্রম কিছু নয়। এই কাহিনী দ্বারা আমাদেরকে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে যে ক্ষমতা কখনো ভুল ব্যক্তির হাতে অর্পণ করা উচিত নয়। তাহলে সেই ভুলের মাশুল আমাদের নিজেদেরকেই দিতে হয়। এবং এই ভুল শুধরানোর জন্য বিপুল পরিমান সংগ্রামেরও প্রয়োজন হয়।