সুরাসুর তথা দেবতা ও অসুর সবাই প্রজাপতি ব্রহ্মার রচনা। তবুও এই দুটি পক্ষ সনাতন ধর্মের দুই মেরুর দুটি পক্ষকে নির্দেশ করে। এর মধ্যে দেবতারা হলেন সৃষ্টির বিকাশ সাধনকারী এবং অপরদিকে অসুরগন হচ্ছেন সৃষ্টির বিনাশকারী। তাই অসুর বলতেই আমাদের মনে উঁকি দেয় বিকটদর্শন, নিষ্ঠুর, রক্তলোলুপ ও পাপাশ্রয়ী কিছু অবয়ব। কিন্তু সব অসুরই কি সমান? আজ্ঞে না। আজ আপনাদেরকে এমন এক অসুরের কথা বলতে এসেছি যিনি ছিলেন পরম বৈষ্ণব, যিনি সহস্র বছর তপস্যা করে তার শরীরকে অত্যন্ত শুদ্ধ করে তুলেছিলেন, যার মহান আত্মত্যাগের ফলে সৃষ্টি হয়েছিল গয়াক্ষেত্র এবং তার পরহিতব্রতের কারনেই গয়াতে পিন্ডদান করলে পিন্ডদানকারীসহ তার পুর্বোক্ত সাত পুরুষের মুক্তি ঘটে। প্রিয় দর্শক, বলছি গয়াসুরের কথা। অসুরকুলে জন্মগ্রহন করেও যে শ্রীবিষ্ণুর পদপাদ্ম লাভ করা যায় তার জ্বলজ্যান্ত প্রমান হচ্ছেন গয়াসুর। তো চলুন দর্শক, আর দেরী না করে জেনে নেওয়া যাক গয়াসুরের কাহিনি।
সনাতন ধর্মের পবিত্র তীর্থস্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম গয়া । সনাতন ধর্মাবলম্বীরা তাদের পিতৃ-মাতৃ ঋণের শোধার্থে তথা পিতৃপুরুষের পরলোকগত আত্মার শান্তি কামনার জন্য পিন্ডদান করতে গয়াতে যান। এছাড়াও গয়া মানে চিরকাঙ্খিত চিরবিস্ময় ‘শ্রীবিষ্ণুপাদপদ্ম’। এজন্য গয়াকে বিষ্ণুক্ষেত্রও বলা হয়ে থাকে। সুপ্রাচীন গ্রন্থ রামায়ণ ও মহাভারতেও গয়ার উল্লেখ পাওয়া যায়। রামায়ণে বর্ণিত হয়েছে রাম, সীতা ও লক্ষ্মণ গয়ায় পদার্পন করেছিলেন রাজা দশরথের পিণ্ডদান করার উদ্দেশ্যে। অন্যদিকে মহাভারতে গয়াকে উল্লেখ করা হয়েছে ‘গয়াপুরী’ নামে।
এই গয়াপুরী যার নামে আজও বিখ্যাত, তিনি হলেন গয়াসুর। বায়ুপুরানের গয়া মাহাত্ম্য পাঠ করলেই জানা যায় এই অসুরের মহান আত্মত্যাগের কাহিনি। অসুরকুলের মধ্যে গয়া ছিল মহাবলি ও মহাপরাক্রমশালী। তার শরীর দৈর্ঘ ছিল ১২৫ যোজন স্থুলতা ছিল ৬০ যোজন । তবে তার শরীর যতই বিশাল হোক না কেন, আচরনে তিনি ছিলেন পরম বৈষ্ণব। ভগবান বিষ্ণুর একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন এই গয়াসুর। একটি মত বলছে পিতা ত্রিপুরাসুর এবং মাতা প্রভাবতীর পুত্র ছিলেন গয়া। অন্যমতে গয়া ছিলেন স্বয়ং ব্রহ্মার সৃষ্টি, অর্থাৎ তার কোন জাগতিক পিতা মাতা নেই। এবং এই কারনে তার মধ্যে কোন আসুরিক প্রবৃত্তিও ছিল না।
এই গয়াসুরের মনে সর্বদাই একটা কথা তাড়া করে বেড়াত যে, যদিও তার প্রবৃত্তি অসুরদের মত নয়, কিন্তু শুধুমাত্র অসুরকুলে জন্ম নেওয়ার জন্য তিনি হয়ত স্বর্গলাভ করতে পারবেন না, এবং কেউ তাকে সম্মানের চোখে দেখবে না। তাই মুক্তি লাভের জন্য তিনি কোলাহল পর্বতের চূড়ায় বসে শুরু করলেন ভগবান শ্রীবিষ্ণুর কঠোর তপস্যা। কেটে গেল শত সহস্র বছর, তবুও তপস্যা করেই চললেন গয়াসুর। গয়াসুরের এমন কঠোর তপস্যা দেখে শংকিত হলেন দেবতারা, কারন গয়াসুর যদি দুর্লভ কিছু চেয়ে বসেন বিষ্ণুর কাছে? যুগ যুগ ধরে অসুররা তো ঠিক এই কাজটিই করে এসেছেন। প্রথমে তারা ত্রিদেবের যে কোন একজনকে সন্তুষ্ট করে বর লাভ করেছেন আর বর প্রাপ্তির পরেই শুরু হয়েছে তাদের তান্ডব, স্বর্গলোক থেকে বিতাড়িত হয়েছেন দেবতারা। এরপর মহাসংগ্রাম করে পরাজিত করতে হয়েছে সেই অসুরকে। সুতারাং দেবতাদের এই শংকা মোটেও অমূলক নয়। তাই তারা প্রথমেই গেলেন প্রজাপতি ব্রহ্মার কাছে, খুলে বললেন গয়াসুরের কঠোর তপস্যার কথা, অনুরোধ করলেন কিছু একটা করতে। দেবতাদের শংকাকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে ব্রহ্মা চললেন বিষ্ণুর কাছে। বিষ্ণুও শুনলেন দেবতাদের শংকার কথা। তারপর সবাই মিলে উপস্থিত হলেন কোলাহল পর্বতে, গয়াসুরের তপস্যা স্থলে। শ্রীবিষ্ণু গয়াসুরকে তার তপস্যা ভঙ্গ করে বর চাইতে বললেন। গয়াসুর বললেন, “হে প্রভু, আমি আপনার কাছে স্বর্গ, রাজ্য, ঐশ্বর্য বা অমরত্ব চাই না। আপনি যদি সত্যিই আমাকে বর প্রদান করতে চান তাহলে আমাকে এই বর প্রদান করুন যে আমার শরীর যেন যে কোন ব্রাহ্মন, তীর্থশীলা, দেবতা, মন্ত্র, যোগী, সন্যাসী, ধর্মী, কর্মী, জ্ঞাতি প্রভৃতি সকল পবিত্র পদার্থ থেকেও যেন পবিত্র হয়।” গয়াসুরের প্রার্থনা শুনে অত্যান্ত প্রীত হলেন ভগবান বিষ্ণু। তিনি খুশিমনে গয়াসুরকে তার অভীষ্ট বর প্রদান করে বৈকুন্ঠে গমন করলেন। অন্যদিকে দেবতারাও শংকামুক্ত হলেন। তারাও গয়াসুরের এমন বর প্রার্থনায় ধন্য ধন্য করতে লাগলেন।
তবে সমস্যা শুরু হল একটু অন্যরকমভাবে। গয়াসুর ছিলেন যেমন ধার্মিক তেমন পরোপকারী। বিষ্ণুর বরে যখন তার শরীর ভীষন শুদ্ধ হল তখন তিনি বেরিয়ে পড়লেন নগর ভ্রমণে। তার শরীরের দর্শন-স্পর্শনে তার চারপাশের সমস্ত প্রানিকুল পবিত্র হয়ে বৈকুন্ঠে গমন করতে থাকল। এভাবে একে একে শুন্য হতে লাগল, শহর,নগর,লোকালয়। শত সহস্র পাপ করেও বৈকুন্ঠবাসী হতে শুরু করলেন সবাই। এ দৃশ্য দেখে আবারও চিন্তায় পড়লেন দেবতারা। তবে সবার চেয়ে বেশি চিন্তিত হলেন যমরাজ। কারন গয়াসুরের শরীরের কল্যানে একটি প্রাণীও আর যমের বাড়ির ছায়া মাড়ায় না। এখন উপায়? সৃষ্টির অমোঘ নিয়ম তো এভাবে লঙ্ঘিত হতে পারে না। পাপ পুণ্যের ফল তো সবারই ভোগ করা উচিত। উপায়ান্তর না দেখে যমরাজ শরানাপন্ন হলেন ব্রহ্মার। তিনি ব্রহ্মাকে বললেন, “ গয়াসুরকে এখনই থামাতে না পারলে বিধির লিখনে পরিবর্তন হয়ে যাবে। প্রত্যেকের তার কর্ম অনুযায়ী ফল ভোগ করার প্রথা সমাপ্ত হয়ে যাবে। পাপীরাও স্বর্গের অপার সুখ ভোগ করতে শুরু করবেন।” ব্রহ্মা যমরাজের বক্তব্যের যথার্থতা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলেন।
এরপর ব্রহ্মা আবারও দেবতাগনকে নিয়ে উপস্থিত হলেন শ্রীবিষ্ণুর নিকট। ভগবান বিষ্ণু এই সংকট থেকে পরিত্রান পাওয়ার জন্য ব্রহ্মাকে একটি যজ্ঞের আয়োজন করতে বললেন। তবে এই যজ্ঞের জন্য প্রয়োজন একটি পবিত্র দেহ। যেহেতু নারায়নের বরে গয়াসুরের দেহ ছিল সবচেয়ে পবিত্র তাই পবিত্র দেহ খুঁজে পেতে কোন কষ্ট হয়নি দেবতাদের। এরপর ব্রহ্মা গয়াসুরের কাছে গিয়ে তার দেহটি জগতের কল্যাণে চাইলেন। গয়াসুরও সানন্দে জগতের কল্যাণে তার দেহ দান করলেন। শুরু হল যজ্ঞানুষ্ঠান। গয়াসুর যোগ বলে তার দেহ বিস্তার করলেন। কোলাহল পর্বতে মাথা, বাজপুরে নাভিদেশ, আর শ্রীক্ষেত্রে রাখলেন চরন। বলা হয় ব্রহ্মা তাঁর নাভিতে যজ্ঞ সম্পাদন করেছিলেন। যজ্ঞের শুরুতে ব্রহ্মার আদেশে ধর্মশীলা এনে রাখা হয় গয়াসুরের শরীরের উপর। এরপর সকল দেবতা সেই ধর্মশীলায় আরোহন করেন গয়াসুরকে পিষ্ট করে তার থেকে পরিত্রান পাওয়ার জন্য। কিন্ত তাতে কোন কাজ হল হল না। গয়াসুরের পবিত্র দেহ ঠিক আগের মতই সচল রইল। সংবাদ পৌছালো শ্রীবিষ্ণুর কাছে। তিনি গদাধররূপে হাজির হলেন গয়াসুরের সম্মুখে। এরপর প্রথমে গয়াসুরের দেহে গদাঘাত করলেন এবং পরে সকল দেবতাদেরকে নিয়ে গয়াসুরের শরীরের উপর স্থাপিত সেই ধর্মশীলায় আরোহন করলেন। কিন্তু ফলাফল সেই শুন্য। গয়াসুর নির্বিকারভাবে তাকিয়ে দেখছিলেন দেবতাদের এসব কর্মকান্ড। তারপর একসময় বলে উঠলেন, “হে দেবগণ, আমি আমার নিষ্পাপ দেহ ব্রহ্মার যজ্ঞে দান করার পরেও আমার প্রতি এত নির্যাতন কেন? শ্রীহরি একটিবার আদেশ করলেই তো আমি নিশ্চল হয়ে যেতাম। আপনারা আমাকে বঞ্চিত করে এতবড় যজ্ঞানুষ্ঠান কেন করলেন?”
যে দেবতাগন গয়াসুরকে পিষ্ট করতে এতসব আয়োজন করেছেন তাদের প্রতি গয়াসুরের এমন বিনয়বাক্য দেখে করুণায় গলে গেলেন দেবতারা। তারা গয়াসুরের এমন মহানুভবতায় তাকে আবারও বর চাইতে বললেন। গয়াসুর চাইলেন, “যতদিন চন্দ্র সূর্য থাকবে ততদিন এই শীলায় বিষ্ণুসহ সকল দেবগন অধিষ্ঠান করবেন। এই স্থান আমার নামানুসারে একটি পুন্যক্ষেত্র মহাতীর্থে পরিনত হবে। এখানে আমার শরীর যে পাঁচ ক্রোশ জায়গা জুড়ে স্থিত হয়েছে তা গয়াক্ষেত্র নামে এবং আমার মস্তক যে এক ক্রোশ জায়গা জুড়ে স্থিত হয়েছে তা গয়াশির নামে পরিচিত হবে। এই তীর্থ ক্ষেত্র সকল প্রকার তীর্থের থেকে শ্রেষ্ঠ হিসেবে পরিগনিত হবে। এছাড়াও এই তীর্থে শ্রাদ্ধ ও পিন্ডদান করলে শ্রাদ্ধকারী ও তার সাত পূর্বপুরুষ ব্রহ্মলোকে গমন করবে ” গয়াসুর নিজের মৃত্যুর বিনিময়েও পরের এমন উপকারের কথা ভাবতে পারেন দেখে বিষ্মিত দেবতাগন তাকে আশির্বাদ করলেন এবং তার চাওয়া বর অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হওয়ার বর প্রদান করলেন। এরপর গয়াসুরের শরীর নিশ্চল হয়ে লীন হয়ে রইল বর্তমান গয়া নামক স্থানে।
সেখানে ভগবানের আশীর্বাদে সেখানে সকল জীবের উদ্ধারের পথ প্রশস্ত হল। এখানে মৃতের উদ্দেশ্য পিণ্ডদান করলে তাঁর মুক্তিলাভ হয়। এরপর থেকে গয়াতে পিন্ডদান করার রীতি ছড়িয়ে পড়ে সারা ভারতবর্ষে। এছাড়াও গয়াসুরের স্মৃতিহেতু এখানেই রইল বিষ্ণুর পদচিহ্ন অঙ্কিত ধর্মশীলা। ফল্গু নদীর কাছেই সেই বিষ্ণুপাদপদ্মকে ঘিরে গড়ে উঠেছে বিখ্যাত বিষ্ণুপদ মন্দির। অভূতপূর্ব সেই পাদপদ্ম। সেখানে সকলেরই মস্তক ছোঁয়ানোর অধিকার আছে। কেউ সেখানে সহস্র তুলসী অর্পণ করছেন আবার কেউবা ব্রাহ্মণদ্বারা শ্রীবিষ্ণুর সহস্রনাম পাঠ করিয়ে সঙ্কল্পপূর্বক তুলসীদান করছেন। অমোঘ আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু পরমধাম এই বিষ্ণুপাদপদ্ম। যুগে যুগে কালে কালে কত মানুষের উদ্ধারস্থল এই বিষ্ণুপাদপদ্ম। এখানে প্রতিদিন রাতে করা হয় বিষ্ণুপদ শৃঙ্গার। উল্লেখ্য বর্তমান এই মন্দিরটি নির্মাণ করিয়ে দেন রাণী অহল্যাবাঈ হোলকার।
যারা গয়াধামে যাবেন বলে মনস্থির করেছেন তাদের জেনে রাখা ভালো, এখানেই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আপন স্বরূপদর্শন হয় বা অষ্টসাত্ত্বিক লক্ষণ প্রথম প্রকাশিত হয়। এখানেই তাঁর গুরুদেব শ্রীঈশ্বরপুরীর সাথে প্রথম সাক্ষাত হয়। এবং সেখানেই তাঁর দীক্ষালাভ হয়। আবার এখানেই শ্রীরামকৃষ্ণদেবের পিতা ক্ষুদিরাম চট্টোপাধ্যায় পিতৃপিণ্ডদান করতে গেলে গদাধর স্বপ্নে তাঁর পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করার কথা জানান। তাই সুযোগ হলে অবশ্যই গয়াতীর্থ পরিদর্শন এবং পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে পিণ্ডদান করার অনুরোধ রইল আপনাদের প্রতি।