You are currently viewing হিন্দুরা কেন শবদাহ করে ? এটা কতটা অমানবিক?

হিন্দুরা কেন শবদাহ করে ? এটা কতটা অমানবিক?

পৃথিবীর সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম সত্যটি হল মৃত্যু। জাগতিক কামনা , বাসনা, সংসার ও ভোগ বিলাস সব কিছুই শেষ হয় মৃত্যুর মধ্য দিয়ে।

গীতায় ভগবান বলছেন  “জাতস্য হি ধ্রুবর্মৃত্যো ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ”
অর্থাৎ, যে জন্মেছে তার মৃত্যু নিশ্চিত, যে মরেছে তার জন্মও নিশ্চিত।

যেহেতু মৃত্যুই মানুষের জীবনের সর্বশেষ ঘটনা তাই মৃত ব্যাক্তির সৎকার পরম যত্নের সাথে করা হয় পৃথিবীর প্রত্যেক দেশে ও ধর্মে। কিন্তু ভিন্নতা থাকে এসকল সৎকার পদ্ধতিতে। কেউ বা সমাধিস্ত হন, কেউ সলিল সমাধি প্রাপ্ত হন আবার কেউ আগুনে পুড়ে ছাই। তবে আপনি যদি হিন্দু হন তাহলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রশ্ন ওঠে শবদাহ পদ্ধতিকে নিয়ে। হিন্দুরা কেন আগুনে মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলে? এটা কি অমানবিক নয়? ইত্যাদি ইত্যাদি। যথারীতি আপনি আমি চুপ হয়ে যাই আমাদের অজ্ঞতার কারনে। কিন্তু আর অজ্ঞতা নয়। আমরাও জানতে চাই, আগুনে পোড়ালে মৃতদেহ কি সত্যিই যন্ত্রনা অনুভব করে? এটা কতটা অমানবিক? এর থেকে ভাল কোন সৎকার পদ্ধতি আছে কি? পৃথিবীতে প্রচলিত সৎকার পদ্ধতিগুলোর মধ্যে যুক্তিবাদী দৃষ্টিকোণ থেকে কোনটি সবচেয়ে ভালো? দর্শক, আশা করছি, ধর্মীয়, আর্থ সামাজিক ও যৌক্তিক জ্ঞানের স্বার্থে সম্পুর্ণ ভিডিওটি মনোযোগ সহকারে দেখবেন।

প্রথমেই একটা গুরুত্বপুর্ণ তথ্য দিয়ে শুরু করতে চাই। আর তা হল পৃথিবীতে শতকরা কত ভাগ মানুষ শবদাহ করে? আপনি হয়ত বলবেন শুধুমাত্র হিন্দু আর বৌদ্ধ ধর্মেই শবদাহ করা হয়। কিন্তু আসলে কি তাই? চলুন দেখা যাক পরিসংখ্যান কি বলে। উইকিপিডিয়া সহ আরো বেশ কিছু পরিসংখ্যান প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মতে পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মৃত মানুষকে আগ্নিতে দাহ করা হয়। কি চমকে গেলেন? তাহলে গুগলে গিয়ে creamation rate লিখে সার্চ করে দেখতে পারেন। এবার বলুন, পৃথিবীর অর্ধেক মানুষ যে মৃতদেহ সৎকার পদ্ধতি অনুসরন করে তারা কি এটাকে অমানবিক বা যন্ত্রনাদায়ক মনে করেন না?

আসলে বিষয়টার সাথে অমানবিক বা যন্ত্রনাদায়ক কোন শব্দটির সাথেই মেলানো উচিত হবে না। একটু ভাবুন একজন মানুষের মৃত্যুর পর তার শরীরে কি ঘটে? যদি আপনি মৃতদেহটি সৎকার না করে ফেলে রাখেন, দেখবেন তাতে পচন ধরেছে এছাড়াও কীটের আক্রমন ও দুর্গন্ধ তো আছেই। তো মৃত্যুর পর যদি মানুষের শরীরে ব্যাথা বা যন্ত্রনার অনুভুতি থাকত তাহলে কি এসকল, পচন বা কীটের আক্রমনে তা চিৎকার করত না? কিন্তু বাস্তবে তা ঘটে না। তাহলে এটি কিভাবে যন্ত্রনাদায়ক বা অমানবিক হয়?

আরও পড়ুনঃ  গণেশের ১২ টি অবতারের পৌরাণিক কাহিনী || Mythological Story of 12 Incarnations of Lord Ganesha

তো প্রথমেই আসি হিন্দু শাস্ত্রমতে শবদাহ বা মৃতদেহকে আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয় কেন? শবদাহকে আমরা কথ্য ভাষায় ‘লাশ পোড়ানো’ বা মড়া পোড়ানো বলে থাকি, কিন্তু শাস্ত্রীয় ভাষায় এর নাম ‘অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া’। এখানে অন্ত অর্থে অন্তিম বা শেষ এবং ইষ্টি অর্থে যজ্ঞ। অন্ত্যেষ্টি হলো জীবনের শেষ যজ্ঞ।

আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষদের বৈদিক সমাজ তথা সমগ্র সনাতন সমাজ হচ্ছে যজ্ঞপ্রধান। জীবনের শুরু তথা ‘গর্ভাধান’ থেকে জীবনের শেষ তথা ‘দেহত্যাগ’ সবই পালন করতে হয় ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে যজ্ঞ করে। খেয়াল করে দেখবেন যে কোন যজ্ঞে অগ্নি প্রজ্জ্বলন ও সেই জ্বলন্ত অগ্নিতে ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন বস্তু অর্ঘ্য হিসেবে ঈশ্বরকে প্রদান করতে হয়। অনুরুপভাবে অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া যজ্ঞে, ইশ্বর কর্তৃক প্রদত্ব নশ্বর দেহখানি জীবনান্তে ইশ্বরকেই অর্ঘ্য প্রদান করা হয়।

 

কিন্তু দেহকে পুড়িয়ে ফেললে তার সারা জীবনের কৃতকর্মের ফলাফল কিভাবে ভোগ করবে? এমন প্রশ্ন আসতেই পারে। আপনিই বলুন, একটি অসাড়, প্রানহীন মৃতদেহ কিভাবে তার ভালো মন্দের ফল বা যন্ত্রনা ভোগ করতে পারে? আজ্ঞে হ্যাঁ, এটার প্রশ্নই ওঠে না। আমাদের দেহটি শুধুমাত্র আমাদের একটি আবরন মাত্র। যা আমাদের আত্মাকে জাগতিকভাবে একটি শারিরীক রুপদান করে থাকে।  ঠিক যেমন আমরা পুরাতন কাপড় ত্যাগ করে নতুন কাপড় পরিধান করি, তেমনি আমাদের আত্মা সাময়িক প্রয়োজনে দেহ ধারন করে এবং প্রয়োজন শেষে সেই দেহ ত্যেগ করে অন্য দেহ ধারন করে থাকে। প্রশ্ন হল, কোন ব্যাক্তি তার ভালো কাজের পুরষ্কার  বা খারাপ কাজের শাস্তি কিভাবে ভোগ করবে? আমাদের আত্মা অবিনশ্বর, তার কোন মৃত্যু নেই। তাই আত্মা সুক্ষ্ম দেহ ধারন করেই তার প্রাপ্য ফল ভোগ করে থাকে।

 

আমরা অনেক সময় মজার ছলে বলে থাকি অমুক ব্যাক্তি মরে ভুত হয়ে গ্যাছে। কথাটি রসাত্মক হলেও, এটি আসলে পঞ্চভূত শব্দটি থেকেই এসেছে। সনাতন শাস্ত্র মতে পঞ্চভূতেই সব কিছুর সৃষ্টি ও পঞ্চভূতেই সবকিছুকেই লীন হতে হবে। এটাই জগতের নিয়ম।

আরও পড়ুনঃ  মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণের ৪টি ভয়ানক ছলনা || 4 Double-Dealings of Krishna In Mahabharat ||

হিন্দু শাস্ত্রমতে এ বিশ্ব সংসার ও এর প্রতিটি উপাদান পঞ্চভূতে গঠিত হয়েছে। এগুলো হল ক্ষিতি অর্থাৎ মাটি, অপ অর্থাৎ জল, তেজ অর্থাৎ অগ্নি, মরুৎ অর্থাৎ বাতাস, এবং ব্যোম অর্থাৎ আকাশ বা মহাশূন্য, সেই হিসেবে আমাদের এই ক্ষুদ্র দেহখানিও এই পঞ্চভূতেই সৃষ্ট। একারনে দেহাবসানের পর আমাদের প্রাণহীন দেহকে এই পঞ্চভূতেই সমর্পন করা হয়। খেয়াল করে দেখবেন, আমাদের মৃতদেহের একটি অংশ ছাই রূপে ক্ষিতি বা মৃতিকাতে মিশ্রিত হয়। অস্থিরুপে একটি অংশ অপ বা জলের সাথে, পোড়ানোর সময় তেজ বা আগুনের সাথে, ধোঁয়ারূপে মরুৎ বা বাতাসের সাথে এবং ব্যাপক অর্থে ব্যোম বা মহাশূন্যের সাথে মিশে যায়।

 

অনেকে বলবেন, তাহলে পৃথিবীর যে অর্ধেক মৃত মানুষকে সমাধিস্থ করা হয় তাদের ব্যাপারে কি? এটা কি সনাতনে নিষিদ্ধ? তাদের দেহ কি পঞ্চভূতে লীন হয় না?

হিন্দু শাস্ত্রে সমাধিস্থ করা নিষিদ্ধ নয়। স্মৃতিশাস্ত্রে স্পষ্টভাবেই এটা অনুমোদিত। বরং হিন্দুদের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মাঝে এখনও এটা প্রচলিত আছে। যেমন- নাথ বা যোগী সম্প্রদায় এবং সন্ন্যাসীদেরকে সমাধি দেয়া হয়। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে অপমৃত্যু হলে বা অপরিনত বয়সে কেউ মৃত্যুবরন করলেও তাকে সমাধিস্থ করা হয়। এ ক্ষেত্রেও সমাধিস্থ দেহ ধীরে ধীরে এবং পরোক্ষভাবেই পঞ্চভূতেই লীন হয়। তবে এই প্রক্রিয়ায় ধাপে ধাপে পোকামাকড়ের আক্রমন ও খাবার হয়ে এবং পচন প্রক্রিয়ায় তা সম্পন্ন হয়।

 

এবার একটু তুলনামুলক আলোচনা করা যাক। একজন মানুষকে যখন সমাধিস্থ করা হয় তার জন্য প্রায় সাড়ে তিন হাত থেকে চার হাত পরিমান জায়গা বরাদ্দ রাখা হয়। সনাতন ধর্মের বৈদিক ঋষিরা ত্রিকালদর্শী হওয়ায় তারা আগে থেকেই জানতেন পৃথিবীতে এক সময় জনসংখ্যা বিষ্ফোরনের ফলে মানুষের বসবাসের জায়গার অভাব দেখা দেবে। যা আমরা ইতিমধ্যেই উপলব্ধি করতে পারছি। সামাজিক ভাবে দেখলে অনুমান করা যায় যদি একটা মৃত ব্যক্তি সাড়ে তিন হাত জায়গা স্থায়ীভাবে বরাদ্দ করা হয় তাহলে কোটি কোটি মৃত ব্যক্তির জন্য প্রতি বছর ধরে এত জায়গার সংকুলান কিভাবে হবে?

আরও পড়ুনঃ  পরশুরামঃ মহাকাব্যের এক অমর চরিত্র || Life History of Parshurama

 

খেয়াল করে দেখবেন, যখন কোন মারাত্মক ভাইরাস বা জীবানুর আক্রমনে কোন ব্যাক্তি বা পশুপাখি মারা যায় তখন ডাক্তাররা সে প্রানীকে মাটিতে পুতে না ফেলে আগুনে পুড়িয়ে ফেলতে বলে থাকেন। এছাড়াও যে কোন খাবার o সবজি একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সিদ্ধ করে খেতে পরামর্শ দেওয়া হয়। কারন আগ্নি এমন এক শক্তিশালী উপাদান যা যে কোন কিছুকেই ধবংস করে দিতে পারে। তো এদিক দিয়ে দেখা যায়, মৃত ব্যাক্তিকে সমাধিস্থ করলে সেই ব্যাক্তি যদি মারাত্মক কোন সংক্রামক ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে থাকেন তাহলে তা পরিবেশের অন্য উপাদানের মাধ্যমে পুনরায় আমাদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। অন্যদিকে আগুনে পুড়িয়ে দিলে আক্রান্ত ব্যাক্তির মধ্যে বসবাসকারী সকল অনুজীব বা ভাইরাস ভস্মীভূত হয়ে যায়।

 

তবে কি শবদাহ করলে তার কোন নেতিবাচক প্রভাব নেই? অবশ্যই আছে। শব পোড়ানোর সময় সৃষ্ট অগ্নিকুন্ডের মাধ্যমে, কার্বন ডাই অক্সাইড উতপন্ন হয় যা আমাদের পরিবেশ ও ওজন স্তরের জন্য হুমকিস্বরূপ। কিন্তু শবদাহের মাধ্যমে সৃষ্ট কার্বন ডাই অক্সাইড কলকারখানা ও গাড়ির জ্বালানী থেকে নির্গত কার্বন ডাই অক্সাইড এর তুলনায় যতসামান্য মাত্র।

এবার সৎকার পদ্ধতি নির্বাচনের দায়িত্ব আপনার কাঁধে। ধর্মীয় ও তথ্যনির্ভর এই তুলনামুলক আলোচনায় আপনি নিষচই বুঝতে পারছেন, কোন পুদ্ধতি মৃতদেহ সতকারের জন্য উত্তম। তবে সব কথার শেষ কথা মৃত্যু আত্মীয় স্বজনদের জন্য পার্থিব শোক হলেও আত্মার কোন শোক নয়। কারন এটি তার জীর্ণ শীর্ন দেহকে পরিত্যাগ করে নতুন দেহকে ধারন করার একটা উৎসব মাত্র।

5/5 - (1 vote)

Leave a Reply