মনু মৎসরূপী ভগবানকে জিজ্ঞেস করলেন- হে ভগবান। ঋষিগণের নাম, গোত্র, বংশ-বিবরণ ও প্রবরসমূহের সাম্য-অসাম্য ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত জানতে ইচ্ছা করি।
মনুর সেই প্রশ্নের উত্তরে ভগবান মৎসরূপে পরপর কয়েকটি অধ্যায়ে ভৃগু, অঙ্গিরা, অত্রি, বিশ্বামিত্র, কশ্যপ, বশিষ্ঠ, পরাশর ও অগস্ত্যের গোত্র ও বংশের বর্ণনা করেন। এ দীর্ঘ আলোচনা স্বল্প পরিসরে করা সম্ভব নয়। মৎস্যপুরাণের এ বর্ণনা হতে কীভাবে ব্রহ্মার সৃষ্ট ঋষিগণ হতে পরবর্তীকালে গোত্রের মাধ্যমে বৈদিক সংস্কৃতির ধারা প্রবাহিত হয়ে আসছে তার বর্ণনা পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে এই শাখা বহু বিস্তার লাভ করে। সপ্তর্ষি হতে সৃষ্ট গোত্রের ধারা পরবর্তীকালে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে বহুধারায় বিভক্ত হয়।
পূর্বের আলোচনা অনুসারে দেখা যায়, গোত্রপ্রবর্তক ঋষিগণ ব্রাহ্মণ ছিলেন। তবে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্র- এ চারটি বর্ণ ভীভাবে বিভাজিত হলো? সেক্ষেত্রে দেখা যায় জন্মসূত্রে সকলেই ব্রাহ্মণ। কিন্তু ভগবদ্গীতার সিদ্ধান্ত অনুসারে বর্ণ বিন্যাস জন্মসূত্রে নয়, বরং গুণ অনুসারে নির্ণীত হয়। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভগবদ্গীতায় (৪/১৩) বলেন-
“প্রকৃতির তিনটি গুণ ও কর্ম অনুসারে আমি মানবসমাজে চারটি বর্ণবিভাগ সৃষ্টি করেছি। আমি এই প্রথম স্রষ্টা হলেও আমাকে অকর্তা এবং অব্যয় বলে জানবে।” উপরের শ্লোক অনুসারে বর্ণবিভাগ যে জন্মানুসারে নয়, বরং কর্মানুসারে তা শতভাগ নিশ্চিত। তাই একই গোত্রে কর্ম ও গুণানুসারে চারটি বর্ণ থাকতে দেখা যায়। কেউ যদি শাস্ত্র অধ্যয়ন তথা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে পারদর্শী হন এবং সেভাবে জীবিকা অবলম্বন করে তবে সে ব্রাহ্মণ, পরিচালনায় দক্ষ হলে ক্ষত্রিয়, ব্যবসা বাণিজ্যে জীবিকা নির্বাহ করলে বৈশ্য এ সকল পেশার লোকদের সেবাকারীর কোনো বৃত্তি হলে সে শূদ্র বলে গণ্য হবে।
প্রায়ই শোনা যায়, একই গোত্রে বা একই বংশে কি বিবাহ করা যায়? এক্ষেত্রে শাস্ত্রে কী বলা হয়েছে? মনুসংহিতায় এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-
অর্থাৎ, যে নারী মাতার সপিন্ডা না হয়, অর্থাৎ সপ্তপুরুষ পর্যন্ত মাতামহাদি বংশজাত না হয় ও মাতামহের চতুর্দশ পুরুষ পর্যন্ত সগোত্রা না হয় এবং পিতার সগোত্রা বা সপিন্ডা না হয়, অর্থাৎ পিতৃস্বসাদিব সন্তান সম্ভব সম্বন্ধ না হয় এমন স্ত্রী-ই দ্বিজাতিদের (ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য) বিবাহের যোগ্য বলে জানবে। (মনুসংহিতা ৩/৫-৬) বৈদিক শাস্ত্রের এই সিদ্ধান্ত আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণও স্বীকার করছেন-
তাঁদের মতে, নিকটাত্মীয়ের মধ্যে বিবাহ বিজ্ঞানসম্মত নয়। এধরনের সম্পর্কের ফলে যে সন্তান হয়, তার মধ্যে জন্মগত ত্রুটি দেখা দেওয়ার ঝুঁকি প্রবল। দ্য ল্যানসেট সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধে বিজ্ঞানীরা এ তথ্য জানিয়েছেন। যুক্তরাজ্যের ব্র্যাডফোর্ড শহরে বসবাসকারী পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক গবেষণা চালিয়ে দেখা যায়, নিকটাত্মীয়ের মধ্যে বিবাহের মাধ্যমে জন্মগ্রহণকারী সন্তানের জিনগত অস্বভাবিকতার হার সাধারণ শিশুদের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি। এসব অস্বাভাবিকতার মধ্যে নবজাতকের অতিরিক্ত আঙ্গুল গজানোর মতো সমস্যা থেকে শুরু করে হৃৎপিন্ডে ছিদ্র বা মস্তিষ্কের গঠনপ্রক্রিয়ার ক্রুটি দেখা দিতে পারে। গবেষণায় নেতৃত্ব দেন ফিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এয়ারমন শেরিডান। ২০০৭ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণকারী সাড়ে ১৩ হাজার শিশুকে ওই গবেষণার আওতায় আনা হয়।ব্র্যাডফোর্ড শহরে দক্ষিণ এশীয় অভিবাসীদের বড় একটি অংশ বসবাস করে। সেখানে পাকিস্তানি বংশোদ্ভুত জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৩৭ শতাংশই রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়দের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়দের মধ্যে বিবাহের প্রচলন রয়েছে। সারা বিশ্বে ১০০ কোটির বেশি মানুষ এ রকম সংস্কৃতি ধারণ করে।
লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকগণ যেন এই বৈদিক সত্যকেই নতুন করে উদঘাটন করে ঘোষণা দিলেন ল্যানসেট সাময়িকীতে।
তবে, মনু ও শতরূপা কি ভ্রাতা ও ভগিনীর ন্যায় ছিলো না?
উত্তর হচ্ছে না, কেননা, মন ও শতরূপা এ জগতের সাধারণ মানুষের ন্যায় যোনিগতভাবে জন্মলাভ করেননি। তারা পতি-পত্নীরূপেই ব্রহ্মা থেকে সৃষ্টি হয়েছিল। আবার, মনু ও শতরূপা থেকে যদি মানবজাতির বিকাশ হয়, তবে তাদের থেকে যাদের সৃষ্টি হয়েছে, তাদের দ্বারা কি ভ্রাতা ভগিনীর সম্পর্কের মাধ্যমে সৃষ্টি বিস্তার হয়নি? এক্ষেত্রেও এ ধরনের কোনো সম্পর্ক হয়নি। কারণ, পূর্বেই বর্ণনা করা হয়েছে, মনুর তিন কন্যাকে যথাক্রমে রুচি, কর্দম ও দক্ষের সাথে বিবাহ দেয়া হয়। তাই সেখানেও এ প্রশ্ন ওঠার কোনো সুযোগ নেই।
বৈষ্ণবগণ কেন অচ্যুতগোত্রীয়?
সপ্তর্ষি থেকে গোত্র প্রবর্তিত হলেও পরবর্তীকালে গোত্র ও প্রবরের মাধ্যমে বহু মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিগণের মাধ্যমে বহু গোত্র প্রবর্তিত হয়। গোত্রের সংখ্যা নিরূপণ করতে গিয়ে বৌধায়ন নিজেই বলেছেন-
গোত্রানাং তু সহস্রাণি প্রযুতান্যর্ব্বুদানিচ।
উনপঞ্চাশদষৈাং প্রবরাঋষিদর্শনাৎ।।
উপর্যুক্ত শ্লোক অনুসারে, সহস্র গোত্রের কথা বলা হয়েছে। এখানে সহস্রশীর্ষা পুরুষের মতো সহস্র বলতে অসংখ্য বোঝানো হয়েছে। তাই মুখ্য কতিপয় গোত্র চিহ্নিত করা গেলেও গোত্র সর্বমোট কয়টি তা নিরূপণ করা যায় না। কারণ, পূর্বেই বলা হয়েছে- মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিগণ হতেই গোত্র প্রবর্তিত হতো।
এবার আসা যাক, বৈষ্ণবদের গোত্র প্রসঙ্গে। জন্মগতভাবে ভিন্নগোত্রীয় বলে সম্বোধন করা হয়েছে। কেননা, বৈষ্ণবগণ বংশগতভাবে কোনো গোত্রের উত্তরসূরী হলেও বৈষ্ণবগণকে শাস্ত্রে অচ্যুতগোত্রীয় বলে সম্বোধন করা হয়েছে। কেননা, বৈষ্ণবগণ বংশগতভাবে কোনো গোত্রের উত্তরসূরী হলেও তারা এখন সরাসরি অচ্যুত ভগবানের সাথে যুক্ত। অমল পুরাণ শ্রীমদ্ভাগবতে (৪/২১/১২) ভগবদ্ভক্ত তথা বৈষ্ণবণকে অচ্যুতগোত্র বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে-
সর্বত্রাস্থলিতাদেশঃ সপ্তীদ্বীপৈকদগুধৃক।
অন্যত্র ব্রাক্ষণকুলাদন্যত্র অচ্যুতগোত্রতঃ
অর্থাৎ, “মহারাজ পৃথু ছিলেন সপ্তদীপ সমন্বিত পৃথিবীর একচ্ছত্র সম্রাট। তাঁর অপ্রতিহত আদেশ সাধু, ব্রহ্মণ ও অচ্যুত গোত্রীয় বৈষ্ণব ব্যতীত অন্য কেউ লঙ্ঘন করতে পারত না।” এই শ্লোকের টীকায় শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুর লিখেছেন- “অচ্যুত গোত্রতঃ’- অচ্যুত অর্থাৎ, শ্রীভগবানই গোত্র বলিতে প্রবর্তকতুল্য যাঁদের, সেই বৈষ্ণবগণ ব্যতীত, তা বলায় শ্রীবৈষ্ণবগণের বর্ণ ও আশ্রম ধর্মের অভাবই ব্যক্ত করা হলো।”
উক্ত শ্লোকের তাৎপর্যে শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ লিখেছেন- “জড়-জাগতিক উপাধি জাতি, বর্ণ, ধর্ম, রাষ্ট্র ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে পার্থক্য সৃষ্টি করে। বিভিন্ন গোত্র জড় দেহের পরিপ্রেক্ষিতে পার্থক্য সৃষ্টি করে, কিন্তু কেউ যখন কৃষ্ণভক্ত হন, তিনি তখন অচ্যুত গোত্রধারী হন বা পরমেশ্বর ভগবানের বংশধর হন এবং তার ফলে তিনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদির সমস্ত বিবেচনার অতীত হন।
প্রেমবিবর্তে জগদানন্দ পন্ডিত অচ্যুত গোত্র প্রসঙ্গে বলেন-
শ্রী অচ্যুতগোত্র বলি’ বৈষ্ণব-নির্দেশ।
ইহার তাৎপর্য কিবা, ইথে কি বিশেষ”।।৪৫।।
স্বরূপ বলে, “গৃহী, ত্যাগী উভয়ে সর্বথা।
এই গোত্রে অধিকার নাহিক অন্যথা।।৪৬।।
শ্রীঅচ্যুতগোত্রে থাকে শুদ্ধভক্ত যত।
স্বধর্মনিষ্ঠায় কভু নাহি হয় রত।।৪৭।।
সংসারের গোত্র ত্যজি’ কৃষ্ণগোত্র ভজে।
সেই নিত্যগোত্র তার যেই বৈসে ব্রজে।।৪৮।।
মধ্যমাধিকারী আর উত্তমাধিকারী।
সকলে অচ্যুতগোত্র দেখহ বিচারি””।।৪৯।।
শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুর তাঁর পদে নিম্নোক্তভাবে বৈষ্ণবগণকে অচ্যুতগোত্র বলে অভিব্যক্ত করেছেন-
মুনি দ্বিজ শূদ্র ভেদ নাহিক বৈষ্ণবে।
বৈষ্ণবগণের বাহা কৃষ্ণ গোত্র লভে।।
পিতৃগোত্রেন যা কন্যা স্বামীগোত্রেন গোত্রিতা।
তথা কৃষ্ণ ভক্ত মাত্রেণ অচ্যুত গোত্র ভবেৎ নৃণাং।।
বিবাহের পর কন্যা যেমন পিতার গোত্র থেকে স্বামীর গোত্র প্রাপ্ত হয়, তেমনি কেউ যখন কৃষ্ণ ভক্ত হন, তখন তিনি অচ্যুত গোত্রভুক্ত হন।
‘বৈষ্ণবাচার্য মাধ্ব’ গ্রন্থের একাদশ অধ্যায়ে শ্রীসুন্দরানন্দ বিদ্যাবিনোদ বর্ণনা করেছেন- “প্রাচীন বৃদ্ধ মনু সংহিতায় লিখিত আছে, পুরাকালে সন্ন্যাস প্রবর্তক দশজন আচার্য উদ্ভূত হয়েছিলেন। তাঁরা সকলেই অচ্যুত গোত্রীয়। কশ্যপ সন্তান পদ্মপাদ গোবর্ধন মঠে এবং ভার্গব গোত্রীয় ত্রোটক জ্যোতির্মঠে প্রতিষ্ঠিত হন। শঙ্করপ্রবর্তিত সন্ন্যাসে সকলেরই চ্যুত- গোত্রাভিমান প্রবল। কিন্তু বিষ্ণুস্বামী সম্প্রদায় সেই প্রকার চ্যুতকুল বা ব্রাহ্মণকুলকেই ব্রহ্ম-সন্ন্যাসের যোগ্য বলে মনে করেন না। স্থুল শরীর চ্যুত-গোত্র হইতে উৎপন্ন হয় সত্য, কিন্তু যজ্ঞ দীক্ষাক্রমে ত্রিজগণ সকলেই অচ্যুত গোত্রীয়।”
উপরোল্লেখিত ভাগবতের শ্লোকে স্পষ্টভাবেই বৈষ্ণবগণের গোত্র যে অচ্যুত তা ব্যক্ত করা হয়েছে। মহাপ্রভুর একান্ত পার্ষদ জগদানন্দ পন্ডিত, শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তীপাদ, শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুর, শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ ও সুন্দরানন্দ বিদ্যাবিনোদের সিদ্ধান্ত হতে অচ্যুতগোত্রই যে বৈষ্ণবের গোত্র তা প্রতিপাদিত হয়, যা দৈহিক পরিচয়ের উর্ধ্বে সরাসরি ভগবানের সাথে সম্পৃক্ত।
—হরেকৃষ্ণ—
(অক্ষয় লীলামাধব দাস)