You are currently viewing বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্রের সংঘাত || রাজা কৌশিক হয়ে উঠলেন ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্র ||

বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্রের সংঘাত || রাজা কৌশিক হয়ে উঠলেন ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্র ||

Om Bhur Bhuva Swaha Tat Savitur Varenyam,

Bhargo Devasya Dhimahi Dhiyo Yonah Prachodayat ||

জানেন কি এই প্রসিদ্ধ গায়ত্রী মন্ত্রের দ্রষ্টা কে? হ্যাঁ, তিনি মহর্ষি বিশ্বামিত্র। তবে তিনি শুধুমাত্র বেদদ্রষ্টা একজন ঋষিই নন, রাম কর্তৃক তাড়কাকে বধ করানো, মাতা অহল্যাকে গৌতম মুনির শাপ থেকে মুক্ত করানো, রাম-সীতা সহ চার দশরথ নন্দনের সাথে মিথিলার রাজা জনক ও তার ভ্রাতার চার পুত্রীর বিবাহ সম্পাদন, রাজ হরিশ্চন্দ্রকে পরীক্ষা করে পুনঃরায় তার অধিকার ফিরিয়ে দেওয়া, রাজা ত্রিশঙ্কুকে সশরীরে স্বর্গারোহণের চেষ্টা করানো, অপ্সরা মেনকা ও তার মিলনে শকুন্তলার জন্ম, অপ্সরা রম্ভাকে অভিশাপ দিয়ে দীর্ঘকাল পাথরে পরিনত করা এসকল ঘটনার নায়ক মহর্ষি বিশ্বামিত্র। তবে সবচেয়ে আশ্চর্যজনক ব্যাপারটি হচ্ছে ঋষি বিশ্বামিত্র তার জীবনের শুরুতে ব্রাহ্মণই ছিলেন না। তিনি ছিলেন ক্ষত্রিয় বংশোদ্ভূত রাজা কৌশিক। তবে মহর্ষি বশিষ্ঠের সাথে বিরোধ ও সংঘাতের জেরে পালটে যায় তার জীবন। অহংকারী, ধনবান ও একগুয়ে রাজা কৌশিক থেকে তিনি হয়ে ওঠেন ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্র। আজ সনাতন এক্সপ্রেসের দর্শকদের জন্য রইল বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্রের সেই সংঘাত ও সংগ্রামের কাহিনী।

প্রাচীন কান্যকুব্জ নগরের রাজা মহামতি গাধির পুত্র ছিলেন মহারাজ কৌশিক। রাজা কৌশিক পরবর্তিতে তার এই ক্ষত্রিয় নাম পরিত্যাগ করে পরিচিত হয়েছিলেন মহর্ষি বিশ্বামিত্র নামে। যাইহোক, শত্রুদমনে তৎপর, অমিততেজস্বী এবং পরাক্রমশালী রাজা ছিলেন বিশ্বামিত্র। রাজা হিসেবে তিনি ছিলেন ধর্মাত্মা, এবং প্রজাহিতৈষী। তবে এর বাইরে ক্রোধ ও অহংকারের মত বদগুণও বিদ্যমান ছিল এই মহাপ্রতাপশালী রাজার মধ্যে। সুদীর্ঘকাল রাজকর্তব্য পালন করে এবং রাজ্যপাট সামলিয়ে একদা তিনি বীরদর্পে বেরিয়ে পড়লেন পৃথিবী পরিক্রমাইয়। সঙ্গে তাঁর মহাবিক্রমশালী সেনাদল হাতী, ঘোড়া, রথ আর আর বাদ্যবাহকের দল।

একবার বহু দেশ ঘুরে, নানা পর্বত, নদী, অরণ্য, নগর পার হয়ে ফুলে-ফলে, তরুলতায় পরিপূর্ণ এক শান্ত, সুনিবিড় তপোবনে এসে উপস্থিত হলেন রাজা বিশ্বামিত্র। সেখানে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে তৃণভোজী পশুর দল। তপস্যায় মগ্ন মহাত্মা মুনিরা কেউ দুশ্চর ব্রতপরায়ণ, কেউ বহিরিন্দ্রিয় দমন করে শুধু জল, বায়ু আর গাছের শুকনো পাতা গ্রহণ করে জীবন ধারণ করছেন। তপশ্চর্যার এক উৎকৃষ্ট স্থান মহর্ষি বশিষ্ঠের এই আশ্রম । ব্রহ্মার মানসপুত্র, অরুন্ধুতীর পতি এবং ইক্ষাকুকুলের পুরোহিত ঋষি বশিষ্ঠ তার আশ্রমে রাজা বিশ্বামিত্রের আগমনে অত্যন্ত উৎফুল্ল হলেন। তিনি যথাবিধি অভ্যর্থনা জানালেন রাজা বিশ্বামিত্রকে। পারস্পরিক কুশল প্রশ্নে অভিনন্দিত করলেন দুজন দুজনকে। কথার শেষে মুনিশ্রেষ্ঠ বশিষ্ঠ সৈন্যদল সহ রাজা বিশ্বামিত্রকে অতিথিরূপে আপ্যায়নের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। বিশ্বপরিক্রমা করে ক্ষুধা-পিপাসায় পরিশ্রান্ত বিশ্বামিত্রও রাজি হলেন ঋষি বশিষ্ঠের আশ্রমে আতিথেয়তা গ্রহণ করতে। তবে এখানে কোন রাজকীয় আপ্যায়ন আশা করেননি রাজা তিনি।

কিন্তু এ কি? কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের সামনে চলে এলো প্রচুর পরিমাণে উৎকৃষ্ট ও সুস্বাদু চর্ব্য-চষ্য-লেহ্য খাদ্যসম্ভার। আর সেই সাথে বস্ত্র, অলঙ্কার, মালা, কুসুম, চন্দন, বিচিত্র পালঙ্ক আর বসার আসন দ্বারা ভূষিত হয়ে উঠল মহর্ষি বশিষ্ঠের অতিথিশালা। রাজা বিশ্বামিত্র ও তার অগণিত যোদ্ধা ও পার্ষদগণ পরম তৃপ্তি সহকারে ভোজন করে তৃপ্তির ঢেকুর তুললেন। আর সেই সাথে রাজকীয় বস্ত্র, মালা-চন্দনে ভূষিত হয়ে বিশ্রাম নিলেন অভিজাত খাট পালঙ্ক ও আসনে। ক্ষুধা তৃষ্ণা ও ক্লান্তি দূর হতেই রাজা বিশ্বামিত্রের মনে তখন শুধু একটাই প্রশ্ন। একজন দরিদ্র বনবাসী ঋষি মুহূর্তের মধ্যে যে আপ্যায়নের ব্যাবস্থা করলেন তা কোন রাজা মহারাজার পক্ষেও করা সম্ভব নয়। তাই তিনি মহর্ষি বিশ্বামিত্রের কাছে জানতে চাইলেন এর রহস্য কি। বশিষ্ঠ জানালেন ইন্দ্রের কামধেনুর কন্যা শবলা বা নন্দিনী তার আশ্রমে দয়া করে অবস্থান করছেন। তার কাছে যা চাওয়া হয় তাই পাওয়া যায়। এই নন্দিনীর সাহায্যেই তিনি এই বিপুল সংখ্যক অতিথিকে যথাযথ সৎকারের ব্যাবস্থা করেছেন।

আরও পড়ুনঃ  পৌরাণিক ৭জন অমর চিরঞ্জীবী যারা আজও বেঁচে আছেন।

এমন কাম্য বস্তু দানকারী গাভীর কথা শুনে লোভে চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল রাজা বিশ্বামিত্রের। কারন এমন দুর্লভ রত্ন শুধুমাত্র রাজা মহারাজাদের অধিকারে থাকা উচিত। এ গাভী যে রাজার আয়ত্তে থাকবে, তাঁর ঐশ্বর্যের অভাব থাকবে না কখনও। একজন বনবাসী ঋষির এ দিয়ে কাজ কি? রাজা বিশ্বামিত্রের অন্তরে জেগে ওঠা এই ক্ষত্রিয়সুলভ অধিকারের বাসনা থেকে কামধেনু শবলাকে বশিষ্ঠের কাছে চেয়ে বসলেন তিনি। বিনিময়ে তিনি বশিষ্ঠকে দান করবেন বিপুল ঐশ্বর্য, রাশিরাশি ধন-রত্ন, স্বর্ণময় কণ্ঠহার, অলঙ্কারে ভূষিত চোদ্দ হাজার গজশ্রেষ্ঠ, উত্তমগুণযুক্ত এগার হাজার ঘোড়া, নানা রঙের অল্পবয়স্ক এক কোটি গাভী । তবে বশিষ্ঠ কিছুতেই সম্মত হলেন না এ প্রস্তাবে। স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, শতসহস্র কেন, শতকোটি ধেনু বা ধনরাশির বিনিময়েও শবলাকে তিনি দেবেন না। এই শবলা তাঁর প্রাত্যহিক দিন যাপনের নিত্যসঙ্গী। আশ্রমের যাগ-যজ্ঞ, জপ-হোম সব কিছুতেই শবলা যোগান দেয় প্রয়োজনীয় উপকরণ। আশ্রমের ভূতযজ্ঞে অন্যান্য প্রাণিদের উদ্দেশ্যে খাদ্যের ব্যবস্থাও করে সে। তাই তাকে কিছুতেই রাজার হাতে তুলে দিতে পারলেন না বশিষ্ঠ।

ফলে যা হওয়ার তাই হল। এতক্ষণের যত প্রীতিভাবনা, পারস্পরিক কুশল চিন্তা — সবই যেন এক লহমায় হারিয়ে গেল। বিশ্বামিত্রের ক্ষত্রিয়সুলভ বাসনার উদগ্র বহিঃপ্রকাশে দ্বন্দ্ব আর বিদ্বেষের আবহ ঘনিয়ে এল ক্রমশ। বিশ্বামিত্র জোর করে হরণ করে নিতে চাইলেন কামধেনুটিকে। যে গাভীর দেওয়া খাদ্য-পানীয়ে কিছুক্ষণ আগেই উদরপূর্তি করেছেন তারা, তাকেই এখন নিষ্ঠুরভাবে টানতে টানতে নিয়ে চলল রাজভৃত্যের দল। শবলা শোকে দুঃখে কাতর হয়ে অসহায় ভাবে বশিষ্ঠের জানতে চাইল, কেন এভাবে রাজার সৈন্যরা তাকে নিয়ে চলেছে? কেনই বা তিনি বাধা দিচ্ছেন না রাজার এ কাজে?  বশিষ্ঠ বললেন, “ক্ষাত্রতেজে উন্মত্ত এই রাজা জোর করে তোমাকে হরণ করে নিয়ে যাচ্ছেন। কারণ, তপস্যারত শান্তিপ্রিয় ব্রাহ্মণের চেয়ে সসাগরা পৃথিবীর অধিপতি ক্ষত্রিয় রাজার বাহুবল অনেক বেশি।” শবলা বশিষ্ঠকে সবিনয়ে জানাল, “বিশ্বামিত্র ক্ষত্রিয় বীর, মহাতেজস্বী, পরাক্রমশালী রাজা। তাঁর ক্ষমতা অনেক। কিন্তু আপনি ব্রহ্মতেজে বলীয়ান। সে তেজ যে কোন ক্ষাত্রশক্তির চাইতে অনেক বেশি। আপনি এই দুর্বিনীত, বলশালী রাজার বল আর দর্প দুইই বিনাশ করুন।”

শবলার এই কথায় স্বীয় তেজঃশক্তিতে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠলেন বশিষ্ঠ। বিশ্বামিত্রকে দমন করার জন্য শত্রুসংহারক সৈন্যদল সৃষ্টির আদেশ দিলেন শবলাকে। মুহূর্তেই শবলার হাম্বারবে সৃষ্টি হল অগণিত সৈন্য। শান্ত, সমাহিত তপোভূমি তখন পরিণত হল রণভূমিতে। সবলার সৃষ্ট সৈন্যদলের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হল মহারাজ বিশ্বামিত্রের সৈন্যদল। কিন্তু কি আশ্চর্য, সবলার সৃষ্ট সেই দৈব সৈন্যদের সামনে খড়কুটোর মত উড়ে গেল বিশ্বামিত্রের সকল সৈন্য। সেই সাথে রাজার শতপুত্রও নিহত হলেন সেই যুদ্ধে।বাকী রইলেন শুধুমাত্র রাজা বিশ্বামিত্র। তবে এবার তিনি যেন ভগ্নদন্ত সর্প, রাহুগ্রস্ত সূর্য। তাঁর সমস্ত শক্তি, দম্ভ, অহমিকা আজ চূর্ণ ও ভস্মীভূত হল। শত পুত্র, সৈন্য সব কিছু হারিয়ে হীনবল রাজা উপলব্ধি করলেন ব্রহ্মশক্তি ও ক্ষাত্রশক্তির পার্থক্য। তাই রাজ্যভার ত্যাগ করে এবং ক্ষত্রিয়ের রাজবেশ ছেড়ে চললেন হিমালয়ের কোলে, নির্জন অরণ্যদেশে। দেবাদিদেব মহাদেবের কঠোর তপস্যায় মগ্ন হলেন সেখানে। কিছুকাল পরে মহাদেব বিশ্বামিত্রের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে বর প্রদানে উপস্থিত হলেন। এসময় বিশ্বামিত্র মহাদেবের নিকট থেকে মন্ত্রসহ সাঙ্গোপাঙ্গ ধনুর্বেদ সম্পূর্ণ আয়ত্ত করে নেন।

কিন্তু রাজা বিশ্বামিত্র রাজসুখ ও রাজবেশ ত্যাগ করলেও তখনও তিনি ক্ষত্রিয় বলের মোহ ত্যাগ করতে পারেননি। আর তাই মহাদেবের কাছ থেকে বর প্রাপ্তির পরক্ষণেই তিনি আবারো মহর্ষি বশিষ্ঠের তপোবনে আক্রমণ করে বশিষ্ঠের উপরে শরবর্ষণ করতে শুরু করলেন। কিন্তু এবারও বশিষ্ঠের ব্রহ্মদণ্ডের সামনে তার সকল অস্ত্র পরাভূত হল। রাগে অপমানে বিশ্বামিত্র এবার অপেক্ষা করতে লাগলেন প্রতিশোধ নেওয়ার সঠিক সময়ের জন্য। এসময় তিনি খেয়াল করলেন মহর্ষি বশিষ্ঠ সরস্বতী নদীর তীরে বসে তপস্যায় মগ্ন থাকেন। তাই এবার তিনি সরস্বতী নদীকে আদেশ করলেন বিশ্বামিত্রকে একাকী তার কাছে নিয়ে আসার জন্য। বিশ্বামিত্রের ক্রোধ ও হুংকারে ভীত হয়ে সরস্বতী নদী তার আদেশ পালনের জন্য নদীর যে পাড়ে বসে বশিষ্ঠ তপস্যা করছিলেন সেই পাড় ভেঙে বশিষ্ঠকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলেন বিশ্বামিত্রের কাছে। কিন্তু বশিষ্ঠকে দেখামাত্র যখনই বিশ্বামিত্র তাকে হত্যা করতে উদ্যত হল তখনই সরস্বতী তাকে আবারও ভাসিয়ে নিয়ে তার তপস্থানে দিয়ে গেলেন। সরস্বতী নদী ভেবেছিলেন এভাবে তিনি বিশ্বামিত্রের আদেশ পালন করবেন আবার মহর্ষি বশিষ্ঠের কোন ক্ষতিও হতে দেবেন না। কিন্তু বিশ্বামিত্র সরস্বতী নদীর এই চালাকি বুঝতে পারেন এবং অভিশাপের মাধ্যমে সরস্বতী নদীকে জলের পরিবর্তে রক্ত দ্বারা পূর্ণ করে দেন। পরবর্তীতে বশিষ্ঠের মাধ্যমে দেবাদিদেব মহাদেব আবারও সরস্বতী নদীতে সুমিষ্ট নির্মল জলের প্রবাহ পুনঃস্থাপন করেন।

আরও পড়ুনঃ  অভিশপ্ত মন্দিরে রাত নামলেই পাথরে জাগে প্রাণ, মানুষ হয়ে যায় পাথর

এর কিছুকাল পরে বশিষ্ঠের জ্যেষ্ঠ্য পুত্র শক্তি এবং রাজা কল্মাষপাদ এক বিবাদে জড়িয়ে পড়েন। বিবাদের এক পর্যায়ে শক্তি কল্মাষপাদ রাজাকে রাক্ষস হয়ে যাওয়ার অভিশাপ দেন। বিশ্বামিত্র শক্তি এবং রাজা কল্মাষপাদ এর দ্বন্দ্বের ফলে প্রতিশোধ নেওয়ার এক নতুন উপায় খুজে পেলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ কিংকর নামক এক রাক্ষসকে রাজা কল্মাষপাদ এর শরীরে প্রবেশ করিয়ে দেন। এর ফলে রাজা কল্মাষপাদ রাক্ষস গুণ প্রাপ্ত হয়ে শক্তি সহ বশিষ্ঠের শতপুত্রকে ভক্ষণ করেন। এ খবর শুনে শোকে কাতর হলেন বশিষ্ঠ। তিনি যোগবলে জানতে পারলেন বিশ্বামিত্র এই অঘটন ঘটানোর মূল নায়ক। তবে তিনি চাইলেই তার ব্রহ্মবল দিয়ে তাকে শাস্তি দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা  না করে এবার দেহত্যাগ করার ইচ্ছা পোষন করলেন। কারন শতপুত্র নাশের পর সংসারে আর তার কোন আসক্তি নেই।  এমন সময় তিনি পিছন থেকে সুমধুর স্বরে বেদ পাঠ শুনতে পেলেন।

পিছনে ফিরে তিনি দেখতে পেলেন শক্তির স্ত্রী তথা তার পুত্রবধু অদৃশ্যন্তীকে। অদৃশ্যন্তী বললেন “ হে ভগবান, আপনি যার বেদ পাঠ শুনে পিছনে তাকিয়েছেন সে আমি নই, আমার গর্ভস্থ আপনার পৌত্রই বেদ পাঠ করছে।”  নিজের বংশধরের কথা শুনে দেহত্যাগের ইচ্ছা ত্যাগ করলেন বশিষ্ঠ। বললেন, “মা গো, আমি ভেবেছিলাম আমার সমস্ত দায়ীত্ব কর্ত্যব্য শেষ হয়েছে কিন্তু না। আমার বংশধরকে জ্ঞান ও সঠিক পথের দিশা দেখানোও আমার কর্তব্য”। ঠিক সেই সময় মহর্ষি বশিষ্ঠ ও তার পুত্রবধুকে লক্ষ্য করে ছুটে এলেন রাক্ষস কল্মাষপাদ। তখন বশিষ্ঠ নিজ হাতে তার মাথায় জল ছিটিয়ে দিয়ে পুনঃরায় তাকে মানুষ রূপে ফিরিয়ে আনলেন। সেইসাথে তার শতপুত্রের হত্যাকারী কল্মাষপাদকে ক্ষমাও করে দিলেন। পরবর্তীতে অদৃশ্যন্তীর গর্ভ থেকে জন্ম নিলেন মহামুনি পরাশর। তিনিও যখন তার পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তৎপর হলেন, তখনও মহর্ষি বশিষ্ঠ তাকে বিশ্বামিত্রকে ক্ষমা করে দেওয়ার শিক্ষা দেন। কারন ক্ষমা ব্রহ্মাণের সবচেয়ে বড় অস্ত্র।

একদা ইক্ষ্বাকু বংশীয় রাজা ত্রিশঙ্কু চেয়েছিলেন সশরীরের স্বর্গে যেতে। তাই তিনি তার কুলপুরোহিত বশিষ্ঠের কাছে এই ইচ্ছা ব্যাক্ত করলেন। কিন্তু মহর্ষি বশিষ্ঠ কিছুতেই রাজার এই প্রস্তাবে রাজি হলেন না। এমনকি বশিষ্ঠের পুত্ররাও রাজার এই ইচ্ছার জন্য নিন্দা জ্ঞাপন করেন। গুরু ও গুরুপুত্রদের দ্বারা অপমানিত ও তিরষ্কৃত হয়ে রাজা ত্রিশঙ্কু চললেন বশিষ্ঠের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিশ্বামিত্রের কাছে। বিশ্বামিত্রও তার প্রতিদ্বন্দ্বীর এই অপারগতার সুযোগ লুফে নিলেন। তার পৌরহিত্যে শুরু হল সশরীরে স্বর্গে যাওয়ার যজ্ঞ। কিন্তু গুরুর অবাধ্য হওয়ায় এবং গুরু কর্তৃক অভিশপ্ত হওয়ার কারনে স্বর্গদ্বার থেকে ফিরে আসতে হল রাজা ত্রিশঙ্কুকে।

আরও পড়ুনঃ  গুরু কে? গুরুজনদের চরন স্পর্শ করে প্রনাম করা হয় কেন?

এভাবে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যখন বার বার বশিষ্ঠের দ্বারা বিশ্বামিত্র পরাজিত ও অপমানিত হচ্ছিলেন, তখন তিনি চলে গেলেন পশ্চিমপ্রান্তে, পুষ্করতীর্থে। সেখানে দীর্ঘকাল তপস্যার পর একদিন দেখা পেলেন প্রজাপতি ব্রহ্মার। বললেন, “বিশ্বামিত্র তুমি এবার ঋষি হয়েছ।”কিন্তু তাতেও সন্তুষ্ট হলেন না বিশ্বামিত্র। তিনি চালিয়ে গেলেন তার কঠোর তপস্যা। কিন্তু এবার তার তপস্যায় বাধা হয়ে এলেন স্বর্গের অপ্সরা মেনকা। একদিন এই পুষ্করতীর্থে স্নানরতা মেনকার রূপের সম্মোহনী শক্তির কাছে পরাস্ত হলেন বিশ্বামিত্র। মেনকাকে নিয়ে আশ্রম বাস করলেন দশ বছর। তার ঔরসে মেনকার গর্ভে জন্ম হল শকুন্তলা নামক এক কন্যার। এরপর হঠাৎ যেন চেতনা ফিরে এল বিশ্বামিত্রের। তপস্যায় ব্রতী হওয়ার পরিবর্তে মেনকার সাথে কৃতকর্মের অনুশোচনায় দগ্ধ হলেন নিজেই। এরপর আবারও স্থান পরিত্যাগ করে চলে গেলেন উত্তর প্রান্তে। কৌশিকী নদীর তীরে বসলেন তপস্যায়। দীর্ঘকাল পরে আবারও এলেন ব্রহ্মা। বললেন, “বিশ্বামিত্র, তোমার তপস্যায় আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। এবার তুমি মহর্ষি হয়ে উঠেছ।”

কিন্তু, ব্রহ্মার বাক্য এবারও সন্তুষ্ট করল না বিশ্বামিত্রকে। কারন তাঁর লক্ষ্য ব্রহ্মর্ষি হয়ে ওঠা। কিন্তু সে লক্ষ্যে পৌঁছতে হলে হতে হবে জিতকাম, ইন্দ্রিয়জয়ী। সে অবস্থায় এখনও উত্তীর্ণ হননি তিনি। তাই তিনি আবার ডুবে গেলেন গভীর সাধনায়। তার সাধনার তেজে প্রকম্পিত হল দেবলোক। ইন্দ্র ভাবলেন তার সিংহাসন দখলের পরিকল্পনায় হয়ত মহর্ষি বিশ্বামিত্রের এই কঠিন সাধনা।  তাই তিনি তার ধ্যানভঙ্গ করার জন্য পাঠালেন আরেক অলোকসামান্য রূপসী অপ্সরা রম্ভাকে। অপ্সরার অনিন্দিত সেই রূপের লীলাচঞ্চল আর্তিতে বাধাগ্রস্থ হল বিশ্বামিত্রের সাধনা। কিন্তু এবার তার সন্দেহ হল এ নিশ্চয়ই ইন্দ্রের কাজ। তাই তিনি ক্রুদ্ধ হয়ে অভিশাপ দিয়ে পাথরের মূর্তিতে পরিনত করলেন রম্ভাকে।

কিন্তু রম্ভার প্রতি অভিশাপ আবারও নষ্ট করে দিল বিশ্বামিত্রের তপঃফল। বিশ্বামিত্র বুঝতে পারলেন এখনও তিনি ইন্দ্রিয়জয়ী হতে পারেন নি, তাই নিজের ক্রোধের কারনে অনুতপ্ত হলেন তিনি। মনে মনে স্থির করলেন, আর কখনো ক্রুদ্ধ হবেন না, অভিশাপ দেবেন না কাউকে। কঠোর প্রতিজ্ঞা করলেন, ব্রাহ্মণত্ব যতদিন না তিনি অর্জন করছেন, ততদিন তিনি রুদ্ধনিঃশ্বাসে একাসনে বসে মগ্ন থাকবেন সাধনায়। এরপর বজ্র নামক স্থানে অচল অটল পর্বতের মতো স্থির সাধক মগ্ন হয়ে রইলেন সাধনায়। কেটে গেল সহস্র বছর। দেবতারা এবার বুঝলেন, ঋষির প্রশান্তচিত্তে আর নেই কাম-ক্রোধের তাড়না। ষড়রিপু জয় করে তিনি আজ জিতেন্দ্রিয় পুরুষ। বহু প্রলোভনের পরীক্ষায় আজ উত্তীর্ণ তিনি।

অবশেষে সমস্ত দেবতাদের সঙ্গে নিয়ে আবারও তাকে দর্শন দিলেন ব্রহ্মা। ঋষি বিশ্বামিত্রকে বরণ করে নিলেন ব্রাহ্মণত্বে। ধন্য হলেন বিশ্বামিত্র। দীর্ঘ সাধনপথের উত্থান-পতন অতিক্রম করে আজ তিনি হলেন ব্রহ্মশক্তির অধিকারী। এত দিনে কেটে গেছে তাঁর দম্ভের, ক্রোধের, কামনার অন্ধাকার। ব্রহ্মবিদ্যার আলোয় আলোকিত আজ তাঁর সমগ্র হৃদয়। ব্রহ্মার কাছে তিনি প্রার্থনা করলেন, সমগ্র বেদবিদ্যা তার আয়ত্তে আসুক তাঁর, বশিষ্ঠও তাঁকে ক্ষমা করে ব্রাহ্মণ বলে স্বীকার করুন। ঋষি বশিষ্ঠ বরাবরই ক্ষমাশীল মহাপুরুষ। তিনি বিশ্বামিত্রের ব্রাহ্মণত্ব স্বীকার করে বুকে জড়িয়ে ধরলেন বিশ্বামিত্রকে। শত্রুতার ইতিহাস ভুলে মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হলেন দুই ব্রহ্মর্ষি। সৃষ্টি হল নতুন ইতিহাস।

5/5 - (1 vote)

Leave a Reply