You are currently viewing দীপাবলির পিছনের ১০ পৌরাণিক কাহিনী || 10 Mythological Stories of Diwali || Festival of Lights

দীপাবলির পিছনের ১০ পৌরাণিক কাহিনী || 10 Mythological Stories of Diwali || Festival of Lights

প্রতিবছর দুর্গাপুজোর আনন্দ উৎসব মিলিয়ে যাওয়ার আগেই দীপাবলি আসে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের দ্বারে। বিজয়ার ভাসানে ৫ দিনের আনন্দ বিদায়ে অবচেতনে হলেও যে বিয়োগবিধুর চেতনায় আবিষ্ট হয় মন, সেই মন দীপাবলিকে সামনে রেখেই আবার আনন্দের স্বপ্ন দেখে। দীপাবলিতে বাড়িঘর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে বাড়ির চারপাশে ছোট ছোট মাটির প্রদীপ জ্বেলে এবং আতশবাজি পুড়িয়ে উদযাপন করা হয় আলোর উৎসব। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করা হয় নানা রঙের আলোর ঝলকানিতে মুছে যাক সমস্ত অন্ধকারের কালিমা। কিন্তু আমরা যারা দীপাবলিতে নতুন পোশাক পরিধান করে, নানান আলোকসজ্জায় নিজেকে আলোকিত করে এবং আতশবাজি পুড়িয়ে হৈ-হুল্লোড় করি, তাঁরা কি জানি দীপাবলির মাহাত্ম্য। কেন পালন করা হয় দীপাবলি? কিভাবে আবির্ভাব ঘটে এই আলোর উৎসবের? আপনি জেনে অবাক হবেন, অন্তত ১০টি কারন রয়েছে দীপাবলিতে আলোক উৎসব উদযাপন করার। আজ সনাতন এক্সপ্রেসের দর্শকদের জন্য রইল দীপাবলি বা দিওয়ালীর ইতিহাস ও উৎপত্তি সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য।

 

হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলিরে

হেমন্তিকা করল গোপন আঁচল ঘিরে॥

ঘরে ঘরে ডাক পাঠালো–

“দীপালিকায় জ্বালাও আলো,

জ্বালাও আলো, আপন আলো, সাজাও আলোয় ধরিত্রীরে।’

সনাতন ধর্মে আলো অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারন আলো, পবিত্রতা, সদগুন, সৌভাগ্য, এবং পরাক্রমকে সূচিত করে। আলোর উপস্থিতি মানেই অন্ধকার ও অপশক্তির অনুপস্থিতি। তাই দীপাবলি পালন করা হয় অমাবস্যার নিকষ অন্ধকারাচ্ছন্নতা ভেদ করে অশুভ শক্তির সক্রিয়তাকে নিষ্ক্রিয় করতে। দীপাবলির প্রতিটি প্রদীপ আমাদের আভ্যন্তরীন কালিমাকে দূর করে তাঁর আলোক শিখা দিয়ে।  দীপাবলি শব্দটির অর্থ হচ্ছে প্রদীপের সমষ্টি। এটি মূলত ৫ দিন ব্যাপী চলমান সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একটি উৎসব। আশ্বিন মাসের কৃষ্ণ পক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতে ধতেরাস বা ধন ত্রয়োদশী তিথিতে কুবের পুজো করার মধ্য দিয়ে সূচনা হয় দীপাবলি উৎসবের। এরপর চতুর্দশীতে ভূত চতুর্দশী বা নরক চতুর্দশী উৎসব, অমাবস্যায় দীপাবলি, শ্যামাপুজো এবং লক্ষ্মীপুজো, শুক্ল প্রতিপদে গোবর্ধন পুজো এবং শুক্লা দ্বিতীয়াতে ভাইফোঁটা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শেষ হয় এই অনুষ্ঠান। বাংলায় এর নাম দীপাবলি হলেও সমগ্র ভারতবর্ষে দিওয়ালী, দ্বিপান্বিতা, দিপালিকা, সুখরাত্রি, সুখসুপ্তিকা, এবং যক্ষরাত্রি হিসেবেও অভিহিত করা হয়। মূলত অমঙ্গল ও অলক্ষ্মী তাড়িয়ে গৃহস্থের ঘরকে আলোকিত করার উদ্দেশ্যেই এই দীপালিকায় আলো জ্বালার অনুষ্ঠান।

আরও পড়ুনঃ  শিবলিঙ্গের মাথায় মাংস ও থুথু দিলেন ভক্ত, এরপর কি হল? Kannappa Naynar Story in Bengali

এবার আসুন জেনে নেওয়া যাক দীপাবলী উৎসব পালনের নেপথ্যে থাকা সেই কারনগুলো।

  • প্রথম কারনটি হচ্ছে, মহালয়ায় শ্রাদ্ধগ্রহণের জন্য যমলোক ছেড়ে যে পিতৃপুরুষগণ মর্ত্যে আগমন করেন, তাঁদের পথ প্রদর্শনার্থে উল্কা জ্বালানো হয় । এ কারণে এদিন আলোকসজ্জা ও বাজি পোড়ানো হয় । কেউ কেউ রাত্রিতে নিজগৃহে দরজা-জানালায় মোতবাতি জ্বালান আবার কেউ বা লম্বা বাঁশের মাথায় প্রদীপ জ্বেলে তৈরি করেন আকাশ প্রদীপ।
  • ২য় কারনটি হচ্ছে, ত্রেতা যুগে শ্রীরামচন্দ্র রাবণ বধ করে এবং চৌদ্দ বছরের বনবাস শেষে যেদিন অযোধ্যায় প্রত্যাবর্তন করেন সেইদিনটি পালিত হয় দীপাবলী হিসেবে। এদিন শ্রীরামের প্রত্যাবর্তনে সারা রাজ্য জুড়ে জ্বালানো হয় মাটির প্রদীপ। প্রজারা খুশীতে খুশিতে আত্মহারা হয়ে মেতে উঠেছিল শব্দবাজির আনন্দে। তাই ত্রেতা যুগে ঘটে যাওয়া শ্রীরামচন্দ্রের গৃহে প্রত্যাবর্তনকে স্মরণ করতেই আজও দীপাবলীর আলোকসজ্জা এবং শব্দবাজি করে আনন্দ উতসবে মেতে ওঠেন আপামর সনাতন ধর্মাবলম্বী।
  • ৩য় কারনটি হচ্ছে নরকাসুর। পুরাকালে নরকাসুর নামের এক ভয়ংকর অসুরকে নিধন করেছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। সেদিন ছিল আশ্বিন মাসের কৃষ্ণ পক্ষের চতুর্দশী তিথি। সেই জয়ের আনন্দে পরের দিন অর্থাৎ দ্বিপান্বিতা অমাবস্যায় শ্রীকৃষ্ণের ভক্তগণ মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে এবং শব্দবাজি করে আনন্দ করেছিলেন। পৌরাণিক সেই ভয়ংকর অসুরের অত্যাচার থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করার আনন্দে আজও তাই দীপাবলি দীপদান করা হয় সমগ্র ভারতবর্ষে।
  • ৪র্থ কারনটি হচ্ছে, এই দীপাবলির দিনেই মহাভারতের পঞ্চপাণ্ডবদের নির্বাসন শেষ হয়েছিল। বনবাস শেষে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যাওয়ার আনন্দে পঞ্চপাণ্ডবগণ এবং তাঁদের শুভাকাঙ্খীরা দীপের আলো জ্বেলেছিলেন তাঁদের চারপাশে। পাণ্ডবদের সেই আনন্দক্ষণকে স্মরণে রেখেও দীপাবলী উৎসব পালন করা হয় মর্ত্ত্যধামে।
  • ৫ম কারনটি হচ্ছে, এই কার্তিকী অমাবস্যায় পালিত হয় কালীপুজো, লক্ষ্মীপুজো এবং গণেশপুজো। অমাবস্যার এই নিকষ-কালো অন্ধকার দূর করে দেবী শ্রীলক্ষ্মীকে আমন্ত্রন জানানো এবং আলোর মাধ্যমে অন্ধকার তথা অলক্ষ্মীকে বিদায় জানানোর জন্যই বিপুল পরিমান দীপ জ্বেলে আলোক উৎসব করে থাকেন মর্ত্ত্যবাসী।
  • ৬ষ্ঠ কারনটি হচ্ছে, দীপান্বিতা অমাবস্যার দিনে বৃন্দাবনের ব্রজবালারা গোবর্ধন পর্বতকে পুজো করে সমগ্র বৃন্দাবনকে দীপমালায় সাজিয়েছিলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পদস্পর্শে যে বৃন্দাবন এমনিতেই সুন্দর, সেই বৃন্দাবনে যখন ব্রজগোপীরা দীপের মালা দিয়ে সাজিয়ে দিলেন তখন তা এক অপার্থিব দৃশ্যের অবতারনা করেছিল। ব্রজবালারা বৃন্দাবনের সেই সৌন্দর্যে মোহিত হয়ে নৃত্য-গীতে মেতে উঠেছিলেন সেদিন। সেদিনকার সেই বৃন্দাবনের রূপকে স্মরন করে আজও দীপাবলিতে দীপদানের বিধান।
  • ৭ম কারনটি হচ্ছে, দীপাবলির দিনটি হচ্ছে দেবী মহালক্ষ্মীর জন্মদিন। পুরাণ অনুসারে জানা যায়, অমৃতের সন্ধানে ক্ষীরোদ সাগর মন্থন করতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে দেবতা ও অসুরগন। দেবাসুরের সংগ্রামে শুরু হয় সমুদ্র মন্থন। এই সমুদ্র মন্থন থেকে উঠে এসেছিলেন দেবী শ্রীলক্ষ্মী। সেদিনটি ছিল কার্তিকি অমাবস্যা। দেবগন দেবীর আবির্ভাবকে স্বাগতম জানিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে তাঁকে বরন করেছিলেন। তাই দেবীর আবির্ভাবের তিথিকে স্মরণ করেও এই দীপাবলি পালন করা হয়। আবার কোন কোন মতে এই দীপাবলির দিনেই দেবী শ্রীলক্ষ্মীকে বলিরাজার বন্দীশালা থেকে উদ্ধার করেছিলেন ভগবান শ্রীবিষ্ণু।
  • ৮ম কারন সনাতন ধর্ম নয় জৈন ধর্ম। এই দীপাবলির দিনেই আধুনিক জৈন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মহাবীর নির্বাণ লাভ করেছিলেন। সেই আনন্দময় ক্ষণকে স্মরণ করে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের পাশাপাশি তারাও শামিল হয় দীপাবলির আলোক উৎসব উদযাপনে।
  • ৯ম কারনটি জড়িয়ে রয়েছে শিখ ধর্মের সাথে। সনাতন ধর্ম ও জৈন ধর্মের পাশাপাশি শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ এইদিনটিকে পালন করে “বন্দী ছোড় দিবস” নামে। এই দীপাবলির দিনে শিখদের ৬ষ্ঠ গুরু হরগোবিন্দ সিং সম্রাট জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জয় করে ৫২ জন হিন্দু রাজাকে বন্দীদশা থেকে মুক্তি দান করেছিলেন। তাছাড়া অমৃতসরের স্বর্ণ্মন্দিরের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপনও করা হয়েছিল দীপাবলির এই পূণ্য তিথিতে। তাই এদিনটিতে গুরুদুয়ারায় প্রদীপ প্রজ্ব্বলন করে উদযাপন করেন সমগ্র শিখ সম্প্রদায়ের মানুষগণ।
  • এবং ১০ কারনটি হচ্ছে রাজা বিক্রমাদিত্য তথা দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত। এ নামটি ভারতের ইতিহাসে একটি সমাদৃত নাম। শক দস্যুরাজকে তিনি পরাজিত করে পরিচিত হন শকারি নামে। এই জয়লাভ তাঁর রাজত্বকালে মহাসমারোহে পালিত হত আলো উৎসব তথা দীপাবলি উৎসব হিসাবে।
আরও পড়ুনঃ  পূর্ণিমা তালিকা ২০২৩ (১৪২৯-১৪৩০) || নিশিপালন ও উপবাসের তালিকা || ভারত ও বাংলাদেশ সময় অনুযায়ী ||

পরিশেষে বলা যায় ঈশ্বরীয় আবেশে ভরা এ দীপান্বিতা অমাবস্যা। এ নামের মধ্যেই রয়েছে ইতিহাস ও পুরাণের অভিবন্দনা। উচ্ছ্বাস নেই, আছে হৃদয় থেকে উৎসারিত অফুরন্ত আনন্দের প্রজ্বলিত আলোকমালা। শুভ দীপাবলি।

5/5 - (1 vote)

Leave a Reply