You are currently viewing ভূত চতুর্দশী কি? এর পিছনের পৌরাণিক কাহিনী জানেন কি? Bhoot Chaturdashi Celebration in Bengal

ভূত চতুর্দশী কি? এর পিছনের পৌরাণিক কাহিনী জানেন কি? Bhoot Chaturdashi Celebration in Bengal

দেবীপক্ষের শুরু থেকেই শুরু হয় উৎসব-পার্বণের মৌসুম। পাঁচদিনের পুজো পেয়ে কৈলাসে শিবের কাছে  ফিরে যান উমা। ধনদেবী লক্ষ্মীও পাঁচালি শুনে মর্ত্য ছাড়েন। এরপর কুবেরের পুজো সম্পন্ন করে বাঙালী যখন দ্বীপান্বিতা অমাবস্যায় শক্তির আরাধনায় উদ্যত,  ঠিক তখনই দরজায় কড়া নাড়ে ভূত চতুর্দশী। শুধু তাই নয়, সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে চৌর চতুর্দশী, নরক চতুর্দশী, যম চতুর্দশী, রূপ চতুর্দশী বা রূপ চৌদাস নামেও পরিচিত এই দিনটি। পশ্চিমা হ্যালোইন পার্টির মত বাঙালীর হ্যালোইন হচ্ছ এই ভূত চতুর্দশী। তবে জানেন কি, ভূত চতুর্দশী আসলে কি? কেন পালন করা হয় এই ভূত চতুর্দশী? কেন এদিন ১৪ শাক খাওয়া এবং ১৪টি প্রদীপ জ্বালানোর বিধান? কেন এইদিন দেবী চামুণ্ডার পুজো করা হয়? এদিনে কেন মৃত পূর্বপুরুষের অশরিরী আত্মা নেমে আসে পৃথিবীতে? শ্রীরামচন্দ্র, দৈত্যরাজ বলি, ধর্মরাজ যম বা নরকাসুরের সাথে এর কি সম্পর্ক? আসুন কয়েকটি পৌরাণিক কাহিনীর আলোকে জেনে নেওয়া যাক ভূত চতুর্দশীর মাহাত্ম্য।

ভূত চতুর্দশী ও দৈত্যরাজ বলি

আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশী তিথিতে অর্থাৎ ধনত্রয়োদশীর পরেরদিন এবং দ্বীপান্বিতা অমাবস্যার কালীপুজোর আগের দিন বাংলার ঘরে ঘরে পালিত হয় ভূত চতুর্দশী। ভূত চতুর্দশী প্রসঙ্গে প্রথমেই যে ঘটনাটি সামনে আসে সেটি হল ভক্ত প্রহ্লাদের পৌত্র দৈত্যরাজ বলির কাহিনী। পুরাকালে দৈত্যরাজ বলি যখন স্বর্গরাজ্য দখল করে দেবতাদের বিতাড়িত করেছিলেন তখন চিন্তিত দেবগন শরানপন্ন হয়েছিলেন ভগবান শ্রীবিষ্ণুর। তখন অত্যাচারী বলিকে দমন করতে  ভগবান শ্রীহরি বামন অবতার রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন বলিরাজার সামনে। দাবী করেছিলেন তিনটি চরণ রাখার জায়গা। বলিরাজা তাঁকে তিনটি চরণ রাখার জায়গা দানে সম্মত হলে, তিনি তাঁর এক চরণ দ্বারা তিনি সমস্ত আকাশ ব্যাপ্ত করেন এবং দ্বিতীয় চরণ দ্বারা আবৃত্ত করলেন সমগ্র পৃথিবী। এরপর তাঁর শরীর থেকে তৃতীয় একটি পা বের করে বলিরাজাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “আর এক চরণ রাখি কোথায়? তখন বলিরাজা তাঁর মাথা পেতে দিয়েছিলেন এই তৃতীয় চরণ রাখার জন্য। আর সেই চরণ দিয়েই বলিরাজাকে পাতালে প্রেরণ করেছিলেন বামন অবতার। তবে নিজের এমন দুর্গতি হবে জেনেও বলিরাজা তাঁর মাথা পেতে দিয়েছিলেন বলে শ্রীবিষ্ণু তাঁকে অমরত্বের বর দিয়েছিলেন। আর সেই সাথে বছরে একটি দিন তিনি তাঁকে ভূত, প্রেত, পিশাচ, ও অশরীরী আত্মাদের সাথে নিয়ে পৃথিবীতে উঠে আসারও অনুমতি দিয়েছিলেন। আর সেই দিনটিই হচ্ছে ভূত চতুর্দশী।

আরও পড়ুনঃ  শিবলিঙ্গ ও জ্যোতির্লিঙ্গের মধ্যে পার্থক্য কি? কিভাবে জ্যোতির্লিঙ্গের আবির্ভাব হল?

১৪ জন অশরীরী পূর্বপুরষের ঘরে ফেরা

তবে ভৌতিক ব্যাপারটা এখানেই শেষ নয়। পুরাণমতে এই দিনে স্বর্গ ও নরকের দ্বার সাময়িকভাবে খুলে দেওয়া হয় পরলোকগত আত্মাদের নিজগৃহে ফেরার জন্য। তাই পিতৃকুল ও মাতৃকুলের ১৪ জন অশরীরী পূর্বপুরুষ নেমে আসেন গৃহস্থের বাড়িতে। যেহেতু মৃত্যুর পর মানুষের দেহ ‘পঞ্চভূত’ অর্থাৎ প্রকৃতিতে বিলীন হয়ে যায়, তাই প্রকৃতির কোল থেকে সংগ্রহ করা ১৪টি শাক খেয়ে পূর্বতন ১৪ পুরুষের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধার্পণ করা হয় এই তিথিতে। তাছাড়া ১৪ শাক ধোয়ার পর বাড়ির প্রতিটি কোনে ছিটিয়ে দেওয়া হয় সেই জল। এই ১৪ শাক হচ্ছে ওল, কেঁউ, বেতো, সর্ষে, কালকাসুন্দে, নিম, জয়ন্তী, শাঞ্চে, হিলঞ্চ, পলতা, শৌলফ, গুলঞ্চ, ভাঁটপাতা এবং শুষনী ইত্যাদি। তবে অঞ্চল ও মতভেদে এই শাকগুলো ভিন্ন ভিন্নও হতে দেখা যায়। এই ১৪ শাক খাওয়ার পেছনে কিছু বৈজ্ঞানিক কারণও বিদ্যমান। ভূত চতুর্দশীর এই সময়টা মূলত ঋতু পরিবর্তনের সময়। তাই নানা রকমের রোগের প্রাদুর্ভাব ও বহু মানুষের জীবনহানি ঘটত এই সময়টাতে। সেকারনে আশ্বিন ও কার্ত্তিক মাসকে প্রাচীনকালে যমদষ্টা কালও বলা হত। এই রোগ-শোক থেকে মুক্তি পেতে এবং শীতের আগে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতেই এই ১৪ শাক ভক্ষণের বিধান। তাছাড়া এই ১৪টি শাক খাওয়ার পাশাপাশি এদিন সন্ধ্যায় জ্বালানো হয় ১৪টি প্রদীপ। মূলত মর্ত্ত্যের বুকে নেমে আসা ভূত, প্রেত, পিশাচ, ও অশরীরী আত্মাদের পথ দেখানোর উদ্দেশ্যেই এই দ্বীপদান করা হয়।

চামুণ্ডা পূজা

তবে বলিরাজার অশরীরী সাঙ্গোপাঙ্গ বা ১৪ পূর্বপুরুষের প্রেতাত্মা ছাড়াও আরও ভৌতিক ব্যাপার রয়েছে ভূত চতুর্দশীতে। এদিন মর্ত্যের বুকে পুজো নিতে আসেন মাতা কালিকা। তবে এদিন তিনি আসেন চামুণ্ডারূপে। এই ভয়ংকরী মুর্তিতে তিনি সাথে নিয়ে আসেন ১৪টি প্রেতাত্মা। যদিও মাতা চামুণ্ডা ভক্তবাড়ি থেকে অশুভ শক্তিকে বিতাড়িত করতে মর্ত্ত্যে আসেন, তবুও তাঁর ১৪টি অশরীরী প্রেতাত্মাকে পথ দেখানোর জন্য ১৪টি দ্বীপদান করা হয়। এছাড়াও পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু জেলায় এদিনটি পালিত হয় ভূত উৎসব হিসেব। যেখানে ভূত, প্রেত, পিশাচ ইত্যাদি থেকে বাঁচতে পাঠ করা হয় এই মন্ত্রটি- “শীতলঞ্চ সমাযুক্ত সকন্টক দলান্বিত। হরপাপ সপামার্গে ভ্রাম্যমাণঃ পুনঃ পুনঃ”।

আরও পড়ুনঃ  দ্রৌপদী ও পঞ্চপাণ্ডবের ফুলশয্যা ও দাম্পত্য জীবন কেমন ছিল? Family Life of Draupadi and Pandavas

যম চতুর্দশী

এবার আসি যম চতুর্দশীতে। একদা যমরাজ তাঁর নিজের দূতদের জিজ্ঞাসা করেন, “কোন জীবের প্রাণ হরণ করার সময় তোমাদের কি তাঁদের ওপর দয়া হয় না?” যমদূতেরা প্রথমে সংকোচ করলেও পরবর্তীতে যমরাজের সামনে একটি ঘটনা বর্ণনা করেন। ঘটনাটি হচ্ছে- হেম নামক রাজার স্ত্রী এক সুন্দর পুত্র জন্ম দেন। কিন্তু সেই পুত্র সন্তানের কোষ্ঠী বিচার করে জ্যোতিষীরা জানান, বিবাহের চার দিন পর সেই বালকের মৃত্যু হবে। এই ভবিষ্যদ্বাণী শোনার পর রাজা সেই বালককে যমুনা তীরের একটি গুহায় ব্রহ্মচারী হিসেবে লালন পালন করতে শুরু করেন। একদিন সেই যমুনা তীরে মহারাজা হংসের পুত্রী ঘোরাফেরা করছিলেন। রাজকুমার সেই রাজকুমারীকে দেখে মোহিত হয়ে যান এবং তাঁরা একে অপরের সম্মতিতে গন্ধর্ব বিবাহ করেন। এরপর নিয়তির অমোঘ নিয়মে তাঁদের বিবাহের ৪ দিন পর রাজকুমারের মৃত্যু হয়। স্বামীর মৃত্যুতে সদ্যবিধবা রাজকুমারীর আহাজারি দেখে হৃদয় কেঁপে ওঠে আমাদের। ওই রাজকুমারের প্রাণ হরণের সময় আমাদের চোখ থেকেও জল গড়িয়ে পড়ে। কোনভাবেই কান্না থামাতে পারছিলাম না আমারাও।” এরপর একজন যমদূত যমরাজকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘অকাল মৃত্যু থেকে বাঁচার কী কোনও উপায় নেই? উত্তরে যমরাজ বললেন, “ভূত চতুর্দশীতে দ্বীপদান করলে অকাল মৃত্যু থেকে রেহাই পাওয়া যায়।” তবে এই কাহিনীটি একটু অন্যভাবে উপস্থাপন করা হয়ছে ধনতেরাসের কাহিনীর সাথে।

তাই শাস্ত্রমতে, ভূত চতুর্দশীতে বাড়ির প্রবেশ দ্বারে সামান্য ধান রেখে তাঁর উপর তিলের তেলের প্রদীপ জ্বালিয়ে যমদ্বীপ দান করার বিধান। এছাড়াও ধর্মরাজ, মৃত্যু, অন্তক, বৈবস্বত, কাল, সর্বভূতক্ষয়, যম, উডুম্বর, দধ্ন, নীন, পরমেষ্ঠী, বৃকোদর, চিত্র ও চিত্রগুপ্ত, এযাবৎকালের এই ১৪ জন যমরাজের উদ্দেশ্যে তর্পণ করার রীতিও প্রচলিত আমাদের সমাজে। তাই পদ্মপুরাণে স্পষ্টভাবেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, যম চতুর্দশীতে গঙ্গাস্নান করলে মৃত্যুর পর আর নরক দেখতে হয়না।

নরক চতুর্দশী

আবার বিষ্ণুপুরাণ’ মতে, এই তিথিতেই দুর্ধর্ষ নরকাসুরকে বধের দ্বারা ধরিত্রীর পাপ লাঘব করেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। যে কারনে এই তিথিকে নরক চতুর্দশী নামেও ডাকা হয়। এছাড়াও পুরাণে এই ভূত চতুর্দশী তিথিটিকেই চিহ্নিত করা হয়েছে,  ১৪ বছরের বনবাস পালন করে শ্রীরামচন্দ্রের ঘরে ফেরার দিন হিসেবে। তবে এই চতুর্দশী তিথিকে ঘিরে সবচেয়ে চমকপ্রদ বিষয়টি সংঘটিত হয় বাংলাদেশের ফরিদপুরে। এদিন নাকি কিছু না কিছু চুরি করতেই হয়। সেই কারনে এই অঞ্চলে এর নাম হয়েছে চৌর চতুর্দশী।

আরও পড়ুনঃ  বৈষ্ণব কে? তুলসী মালা, তিলক, গেরুয়া ধারন করলেই কি বৈষ্ণব হওয়া যায়? Who is Vaishnava?

5/5 - (1 vote)

Leave a Reply