You are currently viewing ভয়ংকর ২৮ প্রকার নরক এবং তাদের বীভৎস শাস্তি || 28 Narakas and Punishments ||
২৮ প্রকার নরক

ভয়ংকর ২৮ প্রকার নরক এবং তাদের বীভৎস শাস্তি || 28 Narakas and Punishments ||

এ পৃথিবী আমাদের ক্ষণিকের আবাসস্থল। আমরা যেখান থেকে এসেছি এবং যেভাবে নিঃস্ব অবস্থায় এসেছি ঠিক সেই নিঃস্ব অবস্থায় সেখানেই ফিরে যেতে হবে। আর এটাই পৃথিবীর নিষ্ঠুরতম সত্য। আসলে এ পৃথিবীটা আমাদের জন্য এক বিরাট পরীক্ষা কেন্দ্র। এই ক্ষুদ্র জীবনে আপনি যদি ধর্মের বিধান অনুসরণ করেন, সৎভাবে জীবন যাপন করেন, দয়া-ক্ষমা প্রদর্শন করেন, এবং নিরহংকারী হয়ে জীবন অতিবাহিত করেন তাহলে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে স্বর্গের অনাবিল সুখ। আর যদি আপনি এর ঠিক বিপরীত দিকে গমন করেন, অর্থাৎ, ধর্মের অবমাননা, নিষিদ্ধ বা খারাপ কাজ ও চিন্তা, অত্যাচার, অহংকার, নিপীড়ন প্রভৃতি কাজে লিপ্ত থাকেন, তাহলে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে অসীম যন্ত্রনাময় নরকবাস। অগ্নিপুরাণ, দেবী ভাগবত পুরাণ, গরুড় পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ, শতপথ ব্রাহ্মণ, মনুস্মৃতি প্রভৃতি গ্রন্থে প্রায় ৮৬ প্রকার নরকের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তবে প্রচলতিভাবে যে ২৮ প্রকার নরকের কথা বলা হয়, সেই ২৮ প্রকার নরক নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন। এ আয়োজনে আপনাদের জন্য থাকছে ২৮টি আতঙ্কজনক নরকের নাম এবং কোন পাপের কারণে কোন নরকে ক্লেশ ও পীড়া সহ্য করতে হয় সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য।

আলোচ্যসূচী

জেনে নিন ২৮টি নরকের বর্ণনা

ভগবদ্গীতায় (৩/২৭) উল্লেখ করা হয়েছে-
প্রকৃতে ক্রীয়মাণানি গুণৈঃ কর্মাণি সর্বশঃ। 
অহংকার বিমূঢ়াত্মা কর্তাহমিতি মন্যতে।।
“প্রকৃতিতে সবকিছুই সম্পাদিত হয় গুণ এবং কর্ম অনুসারে, কিন্তু অহংকারের দ্বারা বিমোহিত হয়ে জীব নিজেকে কর্তা বলে অভিমান করে।” মূর্খ মানুষ মনে করে যে, সে কোনো আইনের অধীন নয়। সে মনে করে, ভগবান বা কোনো নিয়ন্তা নেই এবং সে তার খেয়ালখুশি মতো যা ইচ্ছা তাই করতে পারে। এভাবে সে বিভিন্ন পাপকর্মে লিপ্ত হয় এবং তার ফলে প্রকৃতির নিয়মে তাকে জন্ম-জন্মান্তরে বিভিন্ন নারকীয় পরিবেশে  দন্ডস্বরূপ যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। তার এ যন্ত্রণা ভোগের মূল কারণ, সে মুর্খতাবশত নিজেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন বলে মনে করে, যদিও সে সর্বদাই জড়াপ্রকৃতির কঠোর নিয়মের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এসমস্ত নিয়ম কার্য করে প্রকৃতির গুণের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এবং তাই প্রত্যেকে তিনিটি গুণের বিভিন্ন প্রকার প্রভাবের অধীনে কর্ম করে। তার কর্ম অনুসারে সে এজীবনে অথবা পরবর্তী জীবনে বিভিন্ন প্রকার ফল ভোগ করে। ধার্মিকেরা নাস্তিকদের থেকে ভিন্নভাবে আচরণ করে, তাই তারা যে কর্মফল ভোগ করে তা-ও ভিন্ন।

গুণ ও কর্ম অনুসারে স্বর্গ ও নরক ভোগ

যারা সত্ত্বগুণে কর্ম করে, তারা ধার্মিক এবং সুখী হয়, যারা রজোগুণে কর্ম করে, তারা সুখ ও দুঃখ দুই-ই ভোগ করে, আর যারা তমোগুণের দ্বারা প্রভাবিত, তারা সর্বদাই দুঃখী এবং তারা পশুর মতো জীবনযাপন করে। বিভিন্ন মাত্রায় বিভিন্ন গুণের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার ফলে জীবের গতির তারতম্য হয়।
পূর্ণকর্মের ফলে যেমন স্বর্গভোগ হয়, তেমনি পাপকর্মের ফলে নরকভোগ হয়। তমোগুণের প্রভাবে মানুষ পাপকর্মে লিপ্ত হয় এবং তাদের অজ্ঞানের মাত্রা অনুসারে তাদের নারকীয় জীবনের বিভিন্ন স্তর প্রাপ্ত হয়। কেউ যদি প্রমাদবশত তামসিক আচরণ করে, তাহলে তাকে অল্প কষ্ট ভোগ করতে হয়। কেউ যদি জ্ঞানবশত পাপকর্ম করে, তাহলে তাকে আরো বেশি নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। আর যারা নাস্তিকতাবশত পাপকর্ম করে, তাদের সবচেয়ে বেশি নরকযন্ত্রণা ভোগ করতে হয়। অনাদিকাল ধরে জীব সহস্র নরকগতি প্রাপ্ত হয়।

কর্মের সাক্ষী কে?

চেতনার বিবর্তনক্রমে জীবাত্মা মনুষ্যদেহ লাভ করে। ভগবান মানুষকে ভালোমন্দ বিচারবোদ দান করে থাকেন। মানুষ তার স্বতন্ত্র ইচ্ছাক্রমে কর্মক্ষেত্রে সদাচার বা কদাচার করতে থাকে। মানুষের সমস্ত কর্মের সাক্ষী চৌদ্দ জনের নাম মহাভারতে আদি পর্বে উল্লেখ রয়েছে। যথা- (১) সূর্য, (২) চন্দ্র, (৩) বায়ু, (৪) অগ্নি, (৫) আকাশ, (৬) পৃথিবী, (৭) জল, (৮) দিবা, (৯) নিশা, (১০) ঊষা, (১১) সন্ধ্যা, (১২) ধর্ম, (১৩) কাল এবং পরমাত্মা।
সারা বিশ্বে সবাইকে ফাঁকি দিয়ে আমরা অনেক কিছু পাপ কর্ম করতে পারি, কিন্তু এসকল দেবতাদের কাউকে ফাঁকি দেওয়া যায় না। আবার, আমাদের বহু সৎ কর্মের হিসাব এই বিশ্বে কেউ না রাখলেও তাঁরা সাক্ষী থাকেন। এমনকি সমস্ত দেবতাকেও যদি কখনো সম্ভব হয়ে থাকে, কোনোকিছু তাদের আড়ালে থাকার বা করার মতো, তবুও কাল কিংবা সর্বোপরি পরমাত্মাকে আড়াল করে কোনোকিছু করা সম্ভব নয়।

তিন প্রকার পাপ

সনাতন শাস্ত্রগ্রন্থ অনুসারে তিন প্রকার পাপের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
  • শারীরিক পাপঃ জীবহিংসা, চুরি, পরস্ত্রী সঙ্গ ইত্যাদি।
  • বাচিক পাপঃ অসৎ প্রলাপ, নিষ্ঠুর বাক্য প্রয়োগ, পরদোষ কীর্তন, মিথ্যা ভাষণ ইত্যাদি।
  • মানসিক পাপঃ পরের দ্রব্যে লোভ, পরের অনিষ্ট চিন্তা, বেদবাক্যে অশ্রদ্ধা ইত্যাদি।
এই ত্রিবিধ পাপ সযত্নে এড়িয়ে চললে মানুষ ইহলোকে ও পরলোকে সুখী হতে পারে। শ্রীভীষ্মদেব যুধিষ্ঠির মহারজকে এই নির্দেশ দিয়েছিলেন। (মহাভারত অনুশাসন পর্ব ১৩ অধ্যায়)

নরকের অবস্থান কোথায়?

জনৈক স্বনামধন্য বাঙালি সাহিত্যিক বলেছেন-
“কোথায় স্বর্গ? কোথায় নরক? কে বলে তা বহুদূর?
মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক, মানুষেতে সুরাসুর।”
এ কবিতাংশের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য বুঝতে না পেরে অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিরা মনে করে যে, মৃত্যুর পর মানুষের স্বর্গে বা নরকে গমনের ধারণাটি ভ্রান্ত। কিন্তু, কবি এখানে বলেননি যে, পরকাল বা স্বর্গ-নরক বলে কোনো স্থান নেই। প্রকৃতপক্ষে, তিনি স্বর্গ নরক সম্বন্ধে এখানে কেবল আংশিক ধারণা দিয়েছেন। বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে বৈদিক শাস্ত্রে। শ্রীমদ্ভাগবতে (৩.১০.৮) বলা হয়েছে, ব্রহ্মান্ডের অভ্যন্তরস্থ গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণুর নাভিপদ্মজাত ব্রহ্মা পদ্মকর্ণিকাতে প্রবেশ করে একে প্রথমে উর্ধ্বলোক, মধ্যলোক (ভূলোক) এবং অধঃলোক- তিনটি স্তরে, তারপর চৌদ্দটি স্তরে ভাগ করেন; যাকে বলা হয় চতুর্দশ ভুবন-দ্বিসপ্তধা।
উল্লেখ্য যে, একটি স্তরে এক বা একাধিক গ্রহলোক বিদ্যমান। এই চতুর্দশ ভুবনের মধ্যে পৃথিবীসহ উপরে রয়েছে সাতটি লোক- ভূ, ভূব, স্বর্গ, মহ, জন, তপ ও সত্য বা ব্রহ্মলোক এবং পৃথিবীর নিচে রয়েছে সাতটি লোক- অতল, বিতল, সুতল, তলাতল, মহাতল, রসাতল ও পাতাল। অর্থাৎ, পৃথিবীর অবস্থার স্বর্গ ও নরক গৃহের মাঝামাঝি। তাই, এখানে স্বর্গ ও নরক উভয় গ্রহলোকের প্রভাবই বিদ্যমান এবং কলিপূর্ব যুগত্রয়ে দৈব ও আসুরিক গুণ পৃথকভাবে পৃথক ব্যক্তির মধ্যে অবস্থান করলেও, বিশেষত এই কলিযুগে একই মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক, মানুষেতে সুরাসুর।
ত্রিলোকের অন্তরালে অবস্থিত। দক্ষিণদিকে ভূমন্ডলের অধঃভাগে এবং গর্ভোদক সমুদ্রের উপরিভাগে নরক গ্রহের অবস্থান। এ প্রসঙ্গে শ্রীল প্রভুপাদ বলেন, “পাতাল লোকের নিচে নরক; আর ব্রহ্মান্ডের তলদেশে গর্ভোদক সমুদ্র। তাই নরক গ্রহের অবস্থানটি হচ্ছে পাতাললোক ও গর্ভোদক সমুদ্রের মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত।”
পাপাচারী মানুষ যখন স্থুল দেহ ত্যাগ করে, তখন যমদূতেরা তার সূক্ষ্ম দেহকে পাশবদ্ধ করে যমপুরীতে নিয়ে যায়। পৃথিবী থেকে যমপুরী অর্থাৎ নরক গ্রহের দূরত্ব ৮৬ হাজার যোজন বা ৭ লক্ষ ৯২ হাজার মাইল। অর্থাৎ ১১ লক্ষ ৮৮ হাজার কিলোমিটার। মহাভারতে বলা হয়েছে, ষড়শীতি-সহস্রযোজন-বিস্তীর্ণ মার্গ। মাত্র কয়েক মুহূর্তের মধ্যে অতি দ্রুতগতি যমদূতেরা পাপাত্মাকে সেই স্থানে নিয়ে যায়। নরকের যম পুরীর নাম হচ্ছে সংযমনী। শ্রীসূর্যদেবের পুত্র ধর্মরাজ যম নরকের অধিপতি।

আমরা স্বর্গ-নরক দেখি না কেন?

ব্রহ্মান্ডে অসংখ্য গ্রহলোক আছে, যেগুলো আমরা কেউই দেখতে পাই না। কারণ, সেগুলো অনেক দূরবর্তী হওয়ায় আমাদের দৃষ্টিসীমার অতীত। তেমনি স্বর্গ-নরকও সুদূরবর্তী। তাছাড়া, পৃথিবীতে অধিকাংশ মানুষই তার পূর্বজীবনের স্মৃতি মনে রাখতে পারে না। তাই পূর্বজীবনে কেউ স্বর্গে অথবা নরকে থাকলেও তা তার বিস্মৃত। আবার, এ জীবনে যেহেতু এখনো মৃত্যুবরণ করেনি, তাই স্বর্গ-নরক দেখেনি। তাই- যা দেখিনা দুই নয়নে, বিশ্বাস করি না গুরুর বচনে-এরূপ মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিরাই স্বর্গ-নরক, পরকাল, আত্মা বা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে না, যদিও তারা অদেখা অনেককিছুই বিশ্বাস করে; যেমন পরমাণু, ভাইরাস, মন ইত্যাদি। এদের বলা হয় নাস্তিক। তবে, তাদের হতাশ হবার কিছু নেই; কেননা, মৃত্যুর পর অচিরেই নরকের দর্শন পাবেন। একইভাবে, পুণ্যাত্মারাও মৃত্যুর পরই স্বর্গের দর্শন পাবেন।

সনাতন শাস্ত্রে উল্লেখিত (ভাগবত পুরাণ) ২৮ প্রকার নরক

শতসহস্র নরককুন্ড বা শাস্তিবিভাগ রয়েছে। শ্রীকৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেবের পুত্র শ্রীল শুকদেব গোস্বামী শ্রীপরীক্ষিৎ মহারাজের কাছে মাত্র ২৮ টি নরকের বর্ণনা করেছেন, যা শ্রীমদ্ভাগবতে (৫/২৬/৫-৩৬) বর্ণিত হয়েছে। যাতনা শরীর নামক এক প্রকার শরীর ধারণ করে পাপাত্মারা সেখানে বহু সহস্র বৎসর অবধিও নরক যাতনা ভোগ করে। যাতনা শরীরটির বৈশিষ্ট্য হলো বহু রকমের নিপীড়ণ করা হলেও শরীর ত্যাগ হবে না। কেবল যাতনাই পেতে থাকবে।

কোন পাপে কোন নরক-কীরূপ শাস্তি?

 মানুষ কিছু পাপ-পুণ্যের ফল এ পৃথিবীতে ভোগ করে এবং কিছু ফল ও অন্যান্য ঊর্ধ্ব-অধঃলোকগুলোতে অথবা স্বর্গ-নরকে গিয়ে ভোগ করে। পৃথিবীতে কোন ধরনের ব্যক্তি কী ধরনের পাপাচার করলে নরকের কোন কুন্ডে কীভাবে শাস্তি ভোগ করে, তা শুকদেব গোস্বামী বর্ণনা করেছেন।

১. তামিস্রঃ

যে ব্যক্তি অপরের ধন, স্ত্রী ও পুত্র অপহরণ করে, অত্যন্ত ভয়ঙ্কর যমদূতেরা তাকে কালপাশে বেঁধে বলপূর্বক তামিস্র নরকে নিক্ষেপ করেন। এই তামিস্র নরক ঘোর অন্ধকারে আচ্ছন্ন; সেখানে যমদূতেরা পাপীকে ভীষণভাবে প্রহার, তাড়ন এবং তর্জন করে থাকেন। এখানে নিক্ষেপিত পাপাত্মাকে সর্বক্ষণ অনশনে রাখা হয় এবং পিপাসার জলটুকুও পান করতে দেওয়া হয় না। আর এরকমভাবে ক্রুদ্ধ যমদূতদের দ্বারা ক্রমাগতভাবে নির্যাতিত হয়ে বারংবার মূর্ছিত হয়ে পড়ে পাপাত্মা।

আরও পড়ুনঃ  শিবরাত্রি কি, কেন ও কিভাবে করবেন? জানুন শিবরাত্রির ব্রতকথা ও মাহাত্ম্য || Shivratri Mahatmya
তামিস্র
তামিস্র

২. অন্ধতামিস্রঃ

আমাদের সমাজে এমন অনেক ব্যক্তি আছেন যারা অন্যের স্ত্রী-পুত্র উপভোগ করেন এবং সেই দুর্বল স্বামীকে লাঞ্চিত করে তার প্রতি অবিচার করে থাকেন। সনাতন শাস্ত্রমতে, এ প্রকার পাপাত্মাদেরকে অন্ধতামিস্র নরকে নিক্ষেপ করে থাকেন যমদূতেরা। কোন বৃক্ষকে ভূপতিত করার পূর্বে যেমন তার নিচের অংশ কর্তন করা হয়, ঠিক তেমনি এই প্রকার পাপীদের নিম্নাংশ কর্তন করে অন্ধতামিশ্র নরকে নিক্ষেপ করা হয়ে থাকে। এখানে যমদূতেরা পাপাত্মাকে এত কঠোর যন্ত্রণা দেন যে তার বুদ্ধি ও দৃষ্টি শক্তি দুইই নষ্ট হয়ে যায়।

অন্ধতামিস্র
অন্ধতামিস্র

৩. রৌরবঃ

যে ব্যক্তি তার জড় দেহটিকে তার স্বরূপ বলে মনে করে এবং তার নিজের এবং আত্মীয়-স্বজনদের ভরণ-পোষণের জন্য দিনের পর দিন অপর প্রাণীর প্রতি হিংসা করে, সেই ব্যক্তি প্রাণী হিংসাজনিত পাপের ফলে রৌরব নরকে নিক্ষিপ্ত হয়। অর্থাৎ, এই পার্থিব জীবনে যে হিংসা-পরায়ণ ব্যক্তি অন্য প্রাণীদেরকে যন্ত্রণা দেয়, মৃত্যুর পর সেই সকল প্রাণি রুরু তথা রৌরব রূপে তাকেও পীড়া দেয়। উল্লেখ্য, এই রৌরব নামক প্রাণীদেরকে পৃথিবীতে দেখা যায় না, তারা সর্পের চেয়েও হিংস্র এবং বিষাক্ত।

রৌরব
রৌরব

৪. মহারৌরবঃ

পার্থিব জীবনে যে হিংসা-পরায়ণ ব্যক্তি নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য অন্য প্রাণীদেরকে যন্ত্রণা দেয় এবং তার প্রতি অবিচার করে, মৃত্যুর পর সেই ব্যক্তিকে নিক্ষেপ করা হয় মহারৌরব নরকে। রৌরব নরকের মত এখানেও রুরু নামক প্রাণীরা হিংসা-পরায়ণ ব্যক্তিকে সীমাহীন পীড়া ও যন্ত্রনা প্রদান করে। তবে রৌরব ও মহারৌরব নরকের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে, মহারৌরবের রুরুরা হিংসা-পরায়ণ ব্যক্তির মাংস ভক্ষন করে এবং তারা রৌরবের রুরুদের চেয়ে আরও বেশী হিংস্র ও বিষাক্ত হয়ে থাকে।

মহারৌরব
মহারৌরব

৫. কুম্ভীপাকঃ

২৮ প্রকার নরকের মধ্যে অন্যতম ভয়ংকর নরক হচ্ছে কুম্ভীপাক। বলা হচ্ছে, যে সমস্ত নিষ্ঠুর মানুষ তাদের দেহ ধারণের জন্য এবং জিহ্বার তৃপ্তি সাধনের জন্য নিরীহ পশু-পক্ষীকে হত্যা করে রন্ধন করে, সেই প্রকার ব্যক্তিরা নর-মাংসভোজী রাক্ষসদেরও ঘৃণিত। আর তাই সেই ব্যক্তির মৃত্যুর পর যমদূতেরা তাকে এই নরকে নিক্ষেপ করে ফুটন্ত তেলে ছেড়ে দেন। আর এভাবে যমদূতেরা পাপাত্মাকে ফুটন্ত তেলের মধ্যে তত বৎসর যাবত ঝলসাতে থাকেন যতবছর না সেই সকল প্রাণীর শরীরে পুনারায় লোম জন্মায়।

কুম্ভীপাক
কুম্ভীপাক

৬. কালসূত্রঃ

কোন ব্যক্তি ব্রহ্মঘাতী হলে তাকে কালসূত্র নামক নরকে নিক্ষেপ করা হয়। কালসূত্র নামক নরকটি তামা দ্বারা নির্মিত এবং এর পরিধি ৮০,০০০ মাইল। এর নীচ থেকে অগ্নি দ্বারা এবং উপর থেকে প্রখর সূর্যের তাপ দ্বারা সেই তাম্রময় ভূমি অত্যন্ত উত্তপ্ত হয়। সেখানে প্রতিনিয়ত ব্রহ্মঘাতীকে অন্তরে এবং বাইরে দগ্ধ করা হয়। অন্তরে সে ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় দগ্ধ হয় এবং বাইরে সে প্রখর সূর্যকিরণ ও তপ্ত তাম্রে দগ্ধ হতে থাকে। তাই সে কখনও শয়ন করে, কখনও উপবেশন করে, কখনও উঠে দাঁড়ায় এবং কখনও ইতস্তত ছুটাছুটি করে। এইভাবে একটি পশুর শরীরে যত লোম রয়েছে, তত হাজার বছর ধরে তাকে যন্ত্রণা ভোগ করতে হয়।

আরও পড়ুনঃ  সহজভাবে ও শুদ্ধভাবে গীতা পাঠ করার নিয়ম / উপায় || গীতার ১৮ টি নাম মাহাত্ম্য || গীতাপাঠের ফল।
কালসূত্র
কালসূত্র

৭. অসিপত্রবনঃ

যে ব্যক্তি স্বীয় ধর্ম তথা বেদমার্গ থেকে ভ্রষ্ট হয়ে নাস্তিকতা বা বৈধর্ম অবলম্বন করে, যমদূতেরা তাকে অসিপত্রবন নামক নরকে নিক্ষেপ করে থাকেন। অসিপত্রবন নরকটি তরবারির মত ধারালো পাতাযুক্ত তাল গাছ দ্বারা পরিবেষ্টিত। আর এখানে আগত পাপাত্মাদেরকে তুমুলভাবে বেত্রাঘাত করা হয় যমদূতগণ কর্তৃক। তাঁদের প্রহারের যন্ত্রণায় পাপাত্মা যখন ইতস্ততভাবে এদিকে ওদিকে ধাবিত হয়, তখন উভয় পার্শ্বের অসিতুল্য তালপত্রের ধারে তার সর্বাঙ্গ ক্ষত-বিক্ষত হয়। হাজার বছর ধরে চলতে থাকে তাঁর প্রতি যমদূতগণের এই অত্যাচার। আর এটাই সনাতন শাস্ত্র অনুসারে স্বধর্ম ত্যাগ করার ফল।

অসিপত্রবন
অসিপত্রবন

৮. শূকরমুখঃ

পৃথিবীলোকে যে রাজা বা রাজপুরুষ দণ্ডদানের অযোগ্য ব্যক্তিকে দণ্ড প্রদান করেন, নির্দোষ ব্যক্তিকে দোষের দণ্ড প্রদান করেন, কিংবা অদণ্ডনীয় ব্রাক্ষণকে শরীরদণ্ড প্রদান করেন, সেই পাপীকে রাজাকে যমদূতেরা শূকরমুখ নরকে নিক্ষেপ করে থাকেন। সেখানে অত্যন্ত বলশালী যমদূতেরা তাকে ইক্ষুদণ্ডের মতো নিষ্পেষণ করে থেতলে বা নিঙরে নির্যাতন করে থাকেন। পাপাত্মা তখন আর্তস্বরে রোদন করতে থাকে এবং নির্দোষ ব্যক্তি দণ্ডিত হলে যেমন মোহগ্রস্ত হয়ে মূর্ছাপ্রাপ্ত হয়, সেও সেইভাবে মূর্ছিত হয়।

শূকরমুখ
শূকরমুখ

৯. অন্ধকূপঃ

ভগবানের আয়োজনে ছারপোকা, মশা, মাছি, উকুন ইত্যাদি নিম্নস্তরের প্রাণীরা মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীদের রক্ত পান করে থাকে। এই প্রকার নগণ্য প্রাণীদের কোন ধারণা নেই যে, তাদের দংশনের ফলে মানুষের কষ্ট হয়। কিন্তু মানুষের চেতনা উন্নত, তাই তারা জানেন মৃত্যু কত বেদনাদায়ক। আর তাই বিবেক সমন্বিত মানুষ যদি বিবেকহীন তুচ্ছ প্রাণীদের হত্যা করে অথবা যন্ত্রণা দেয়, তাহলে তারা নিশ্চয়ই পাপ কর্ম সাধন করে। এই পাপের শাস্তি হিসেবে পাপাত্মাকে অন্ধকূপ নামক অন্ধকারাচ্ছন্ন নরকে নিক্ষেপ করে দণ্ডদান করা হয়ে থাকে। এবং পাপাত্মা যে-সমস্ত পশু, পক্ষী, সরীসৃপ, মশক, উকুন, কীট, মাছি ইত্যাদি প্রাণীদের যন্ত্রণা দিয়েছিল, সেখানে তাদের দ্বারাই সে আক্রান্ত হয়ে থাকে। তারা তাকে সর্বদিক থেকে আক্রমণ করে এবং এর ফলে পাপাত্মার নিদ্রা-সুখ একেবারেই নষ্ট হয়ে যায়। যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে সে কোথাও বিশ্রাম করতে না পেরে অন্ধকারে নিরন্তর ছোটাছুটি করতে থাকে। আর এভাবে অন্ধকূপে পাপাত্মা একটি নিম্নস্তরের প্রাণীর মতো যন্ত্রণা ভোগ করে।

অন্ধকূপ
অন্ধকূপ

১০. কৃমিভোজনঃ

যে ব্যক্তি কোন খাদ্যদ্রব্য প্রাপ্ত হলে অতিথি, বালক বা বৃদ্ধদেরকে না দিয়ে নিজেই ভোজন করে, যে ব্যক্তি পঞ্চবিধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করে না, যে ব্যক্তি নিজের পিতা, ব্রাহ্মণ বা দেবতাদের ঘৃণার চোখে দেখে সেই  সকল ব্যাক্তি কাকতুল্য বলে বর্ণিত হয়। তার মৃত্যুর পর তাকে কৃমিভোজন নামক একটি নিকৃষ্ট নরকে নিক্ষেপ করা হয়। সেই নরকের বিস্তার ১,০০,০০০ যোজন এবং তা কৃমিতে পরিপূর্ণ। সেখানে সেই কৃমিকুণ্ডে সেও একটি কৃমিরূপ প্রাপ্ত হয়, এরপর সে নিজে অন্য কৃমিদের ভক্ষন করে এবং অন্য কৃমিরাও তাকে ভক্ষন করতে থাকে। এভাবে ১,০০,০০০ বছর ধরে কৃমিরূপে কৃমিকুণ্ডে বসবাস করতে থাকে পাপাত্মাগণ।

কৃমিভোজন
কৃমিভোজন

১১. সন্দংশঃ

সনাতন শাস্ত্রানুসারে চুরি করা মহা পাপ। আর তাই কোন ব্যক্তি যদি অপর কোন ব্যক্তির ধন-রত্ন চুরি করেন অথবা বল প্রয়োগের দ্বারা অন্যের ধনরাশি অপহরণ করে, তাহলে তাকে সন্দংশ নামক নরকে নিক্ষেপ করা হয়। সেখানে যমদূতেরা লৌহময় অগ্নিপিণ্ড এবং উতপ্ত সাঁড়াশির দ্বারা তার ত্বক ছিন্নভিন্ন করে নাড়িভুঁড়ি বের করে আনে। এছাড়াও পাপাত্মার শরীর টুকরো টুকরো করে কেটে তাকে ভয়াবহ যন্ত্রনা প্রদান করা হয়ে থাকে এখানে।

সন্দংশ
সন্দংশ

১২. তপ্তসূর্মিঃ

যে সকল পুরুষ অগম্যা স্ত্রীলোকের সাথে বিবাহবহির্ভূত যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেন, এবং যেসকল স্ত্রীগণ অগম্য পুরুষের সাথে বিবাহবহির্ভূত যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেন, সেই সকল নরনারীকে তপ্তসূর্মি নামক নরকে নিক্ষেপ করা হয়ে থাকে। সেখানে যমদূতেরা তাদেরকে তীক্ষ্ণ চাবুক দিয়ে নিরন্তর প্রহার করেন এবং একই সাথে পুরুষকে উতপ্ত লৌহময় স্ত্রীমূর্তির সাথে ও স্ত্রীদেরকে লৌহনির্মিত উত্তপ্ত পুরুষ-মূর্তির সাথে আলিঙ্গন করতে বাধ্য করে থাকেন। আর সনাতন শাস্ত্রমতে এটিই অবৈধ যৌন সঙ্গের দণ্ড।

তপ্তসূর্মি
তপ্তসূর্মি

১৩. বজ্রকণ্টক-শাল্মলীঃ

যে ব্যক্তি কামান্ধ হয়ে জন্তু-জানোয়ারদের মাধ্যমে তাঁর কাম নিবৃত্ত করে, অথবা যে ব্যক্তি মাত্রাতিরিক্তভাবে যৌনকর্ম করে, মৃত্যুর পর তাকে বজ্রকণ্টক-শাল্মলী নামক নরকে নিক্ষেপ করা হয়। সেই নরকে একটি শাল্মলী বৃক্ষ রয়েছে, যার কাঁটা বজ্রের মতো তীক্ষ্ণ ও ভয়াবহ। এখানে যমদূতেরা পাপাত্মাকে শাল্মলী বৃক্ষের উপর চড়িয়ে অনাবরতভাবে টানতে থাকে এবং তার ফলে সেই কাঁটার আঘাতে পাপাত্মার সারা শরীর ছিন্নভিন্ন হতে থাকে।

বজ্রকণ্টক-শাল্মলী
বজ্রকণ্টক-শাল্মলী

১৪. বৈতরণীঃ

যে সমস্ত রাজন্য বা রাজপুরুষ দায়িত্বশীল পরিবারে জন্মগ্রহণ করা সত্বেও ধর্মনীতির অবহেলা করে এবং তার ফলে অধঃপতিত হয়, তারা মৃত্যুর পর বৈতরণী নামক নরকের নদীতে পতিত হয়। নরক বেষ্টনকারী পরিখাসদৃশ এই নদীটি ভয়ঙ্কর জলচর প্রাণীতে পরিপূর্ণ। তাছাড়া এই নদীটি মল, পস্রাব, ঘাম, রক্ত, পুঁজ, চুল, হাড়, অস্থিমজ্জা, নখ, মাংস, মেদ ইত্যাদিতে পরিপূর্ণ। পাপী ব্যক্তি যখন এই বৈতরণী নদীতে নিক্ষিপ্ত হয়, তখন সেখানকার হিংস্র জলজন্তুরা তার শরীরের মাংস খুবলে খুবলে খেতে শুরু করে। আর যন্ত্রনায় ক্লিষ্ট হয়ে ডুবন্ত পাপাত্মাও বৈতরণীর সেই নোরা জল পান করতে থাকে।

বৈতরণী
বৈতরণী

১৫. পূয়োদঃ

পূয়োদ নামক নিকৃষ্ট নরকে সেই সকল ব্যাক্তি নিক্ষিপ্ত হন যারা নিম্ন বর্গীয় মহিলা যৌনকর্মীর তথা বেশ্যা মহিলার যৌন সঙ্গি হিসেবে জীবন যাপন করেন। এরা পরিচ্ছন্নতা বজায় না রেখে পশুর ন্যায় জীবনযাপন করে এবং সভ্য আচরণ করতে ব্যর্থ হয়। তাই মৃত্যুর পর তাঁদেরকে নিক্ষেপ করা হয় পূয়োদ তথা পুঁজ, মূত্র, শ্লেষ্মা, লালা ইত্যাদি ঘৃণিত বস্তুতে পূর্ণ একটি সমুদ্রে। তাঁদের ইহকালে কৃত ঘৃণিত যৌনাচারের শাস্তি হিসেবে সেখানে তারা এই সমস্ত অতি ঘৃণিত পদার্থ ভক্ষণ ও পান করতে বাধ্য হয়।

পূয়োদ
পূয়োদ

১৬. প্রাণরোধঃ

যে সকল মনুষ্য কুকুর, গর্ধভ ইত্যাদি পশু সহযোগে আত্ম বিনোদনের জন্য জঙ্গলে পশু শিকারের খেলায় মত্ত হয় তাদেরকে প্রাণরোধ নামক এক নিকৃষ্ট নরকে নিক্ষেপ করা হয়। অনর্থক মৃগয়ায় গিয়ে পশু হত্যা করার শাস্তি হিসেবে, প্রাণরোধ নরকের যমদূতগণ পাপাত্মাকে কেন্দ্র করে তীরন্দাজীতে মেতে ওঠেন। অর্থাৎ, পাপাত্মাকে লক্ষ্য বানিয়ে নিষ্ঠুর যমদূতগণ তাঁর উপরে নিরন্তর বাণবর্ষন করতে থাকে। এবং বহু বছর ধরে চলতে থাকে এই শাস্তি।

প্রাণরোধ
প্রাণরোধ

১৭. বিশসনঃ

যে ব্যক্তি নিজের পদের তুলনায় অধিক প্রতিপত্তি লাভ করে, ইহলোকে ধন এবং প্রতিষ্ঠার গর্বে গর্বিত হয়, এবং দম্ভ প্রকাশ করার জন্য অথবা তাঁর সামাজিক অবস্থা জাহির করার জন্য যজ্ঞে নিরীহ পশুদেরকে বলি দেয়, তাকে মৃত্যুর পর বিশসন নামক নরকে নিক্ষেপ করা হয়। সেখানে যমদূতেরা এই প্রকার পাপাত্মাকে বহুকাল ধরে কষাঘাত করতে থাকে এবং তাঁদের নির্মম কশাঘাতে ক্লিষ্ট হয়ে পাপীর মৃত্যু হয়।

আরও পড়ুনঃ  জামাই ষষ্ঠী কি? জামাইয়ের সাথে দেবী ষষ্ঠীর কি সম্পর্ক? Jamai Shashthi Vrat Katha || ব্রতকথা ||
বিশসন
বিশসন

১৮. লালাভক্ষঃ

যে ব্যক্তি তাঁর সবর্ণা পত্নীকে বশে রাখার জন্য অথবা নিজের যৌন আকাঙ্খার উপরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নিজ পত্নীকে নিজের বীর্য্যরস পান করতে বাধ্য করেন অথবা সুরা পান করতে বাধ্য করেন, তিনি তাঁর মৃত্যুর পর লালাভক্ষ নামক এক নরক নদীতে নিক্ষিপ্ত হন। লালাভক্ষ নদীটি বীর্যরসে পরিপূর্ণ। আর তাই সেখানে নিক্ষেপিত পাপাত্মাকে নিরন্তর এই অভক্ষ ভক্ষণ ও পান করানো হয়ে থাকে।

লালাভক্ষ
লালাভক্ষ

১৯. সারমেয়াদনঃ

ইহলোকে যে সমস্ত ব্যক্তি দস্যুবৃত্তি করে পরগৃহে অগ্নিসংযোগ করে, বিষ প্রদান করে হত্যা করে, অথবা যে সমস্ত রাজা বা রাজপুরুষ আয়কর আদায়ের নামে অথবা অন্যান্য উপায়ে বণিক সম্প্রদায়কে লুণ্ঠন করে, মৃত্যুর পর সেই সমস্ত পাপাত্মাদেরকে সারমেয়াদন নামক নরকে নিক্ষেপ করা হয়। এই নরকে বিচরণ করে সাতশো কুড়িটি বজ্রের মতো দন্ত বিশিষ্ট কুকুর। আর যমদূতের নির্দেশে সেই অতি হিংস্র কুকুরগুলি পাপাত্মাকে তাঁদের তীক্ষ্ণ দন্ত দ্বারা ছেদন করে এবং এরপর অত্যন্ত তৃপ্তির সঙ্গে সেই সমস্ত পাপীদেরকে ভক্ষণ করে।

সারমেয়াদন
সারমেয়াদন

২০. অবীচিমৎঃ

কোন ব্যক্তি যদি ইহলোকে সাক্ষ্য প্রদান করার সময়, ক্রয়-বিক্রয় করার সময় এবং দান করার সময় কোন প্রকার মিথ্যা কথা বলে, তাহলে পরকালে তাকে অবীচিমৎ নামক ভয়ংকর নরকে প্রেরণ করা হয়। এখানে যমদূতেরা তাকে শত যোজন উন্নত পর্বত শিখর থেকে মাথা নীচের দিকে করে নিক্ষেপ করতে থাকে। তবে এই নরকে কোণ জল না থাকার সত্ত্বেও এর পাথর দ্বারা নির্মিত পৃষ্ঠস্থল জলের মতো প্রতীয়মান হয়। এই কারনেই এই নরককে অবীচিমৎ বা জলহীন বলা হয়। এখানে সেই পাপীদেরকে বার বার পাহাড়ের উপর থেকে নিক্ষেপ করা হলেও এবং তাদের দেহ তিল তিল করে বিদীর্ণ হলেও, তাদের মৃত্যু হয় না। এবং বহুকাল যাবত তারা নিরন্তর সেই যন্ত্রণা ভোগ করতে থাকে।

অবীচিমৎ
অবীচিমৎ

২১. অয়ঃপানঃ

অয়ঃপান নামক নরকটি সুরা পানকারী নারী-পুরুষদের জন্য সংরক্ষিত। যে সকল স্ত্রী-পুরুষ আমোদ-প্রমোদে রত হয়ে সুরাপান করে, অথবা যারা ব্রতপরায়ণ হয়েও প্রমাদবশত সোমরস পান করে, যমদূতেরা তাদেরকে অয়ঃপান নামক নরকে নিক্ষেপ করে থাকে। অয়ঃপান নরকে যমদূতেরা তাদের পা দিয়ে পাপীদের বক্ষঃস্থল চেপে ধরেন এবং তাদের মুখে অত্যন্ত উত্তপ্ত তরল লোহা ঢেলে দেন। আর এটাই সনাতন শাস্ত্র অনুসারে সুরাপানের শাস্তি।

অয়ঃপান
অয়ঃপান

২২. ক্ষারকর্দমঃ

যে ব্যক্তি নিজে অধম হওয়া সত্ত্বেও নিজের বিষয় সম্পত্তি নিয়ে আত্মঅহংকার করে, নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে প্রচার করে এবং অহংকারের বশবর্তী হয়ে তাঁর থেকেও জন্মে, তপস্যায়, বিদ্যায়, আচারে, বর্ণে অথবা আশ্রমে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে যথাযথভাবে সম্মান প্রদর্শন করে না, সে জীবিত অবস্থাতেই মৃতস্বরূপ। এবং এরূপ পাপকার্যের শাস্তি হিসেবে ঐ ব্যক্তিকে তাঁর মৃত্যুর পর ক্ষারকর্দম নামক নরকে নিক্ষেপ করা হয়। সেখানে সে যমদূতদের দ্বারা প্রচণ্ডভাবে নির্যাতিত হয় এবং একই সাথে ক্ষার ও কর্দমের মধ্যে অতি নৃসংশভাবে হাবুডুবু খেতে থাকে।

ক্ষারকর্দম
ক্ষারকর্দম

২৩. রক্ষোগণ-ভোজনঃ

এই পৃথিবীতে বসবাসকালীন সময়ে যে সকল নর-নারীগণ তাঁদের পরকালে পূণ্য সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেবদেবীর উদ্দেশ্যে নরবলি দান করেন এবং বলিদানকৃত মানুষের মাংস ভক্ষণ করে থাকেন তারা মৃত্যুর পর রক্ষোগণ-ভোজন নামক নরকে বন্দী হন। এই নরকে আগমনের পর পাপী ব্যক্তি যাঁদেরকে বলি দিয়েছিলেন সেই সকল নরগণ রাক্ষসরূপে তাঁদের সামনে আসেন। বিকট দর্শন এবং নিষ্ঠুর সেই রাক্ষসগণ ধারালো অস্ত্র দিয়ে পাপাত্মাকে বলিদান করে এবং তাঁর সমস্ত শরীর অস্ত্র দিয়ে খণ্ড খণ্ড করে কেটে ফেলে। এরপর সেই উন্মত্ত রাক্ষসগণ প্রবল আনন্দে নৃত্য-গীত করতে করতে তাঁর শরীরের রক্ত পান করে এবং মাংস ভক্ষন করে।

রক্ষোগণ-ভোজন
রক্ষোগণ-ভোজন

২৪. শূলপ্রোতঃ

যে সমস্ত মানুষ জীবন রক্ষার্থে আগত পশু-পাখীদের আশ্রয় দান করার ভান করে তাদেরকে শূল অথবা সূত্রের দ্বারা বিদ্ধ করে এবং তারপর ক্রীড়নকের মতো ক্রীড়া করে প্রবল যন্ত্রণা দেয়, অথবা যারা পশুপাখিকে গৃহে পালন করে যন্ত্রনা দিয়ে মারে, তারা মৃত্যুর পর শূলপ্রোত নামক নরকে নীত হয়। এখানে তাদের শরীর তীক্ষ্ণ শূল দ্বারা বিদ্ধ করা হয়। তাছাড়া তারা ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় পীড়িত হয় এবং চতুর্দিক থেকে বক, শকুন প্রভৃতি তীক্ষ্ণ-চঞ্চু পক্ষী এসে তাদের দেহ ছিন্নভিন্ন করতে থাকে। এবং এইভাবে যন্ত্রণায় অস্থির হয়ে তখন তারা তাদের পূর্বকৃত পাপকর্মের কথা স্মরণ করতে থাকে।

শূলপ্রোত
শূলপ্রোত

২৫. দণ্ডশূকঃ

যারা ইহলোকে সর্পের মতো ক্রোধপরায়ণ হয়ে অন্য প্রাণীদেরকে যন্ত্রণা দেয়, তাঁদের জন্য পরকালে রয়েছে দণ্ডশূক নামক নরকের ব্যাবস্থা। এই নিকৃষ্ট ও ভয়ংকর নরকে বিচরণ করে থাকে পঞ্চ বা সপ্ত ফণাবিশিষ্ট বিষাক্ত সাপেরা। বিষাক্ত হওয়ার পাশাপাশি এই সাপেরা বিকট দর্শণ, নিষ্ঠুর ও নৃশংস। তারা এখানে আগত পাপাত্মাদেরকে তুমুল যন্ত্রণা দিয়ে বিষিয়ে তোলে, এবং এরপর তারা পাপাত্মাদেরকে মূষিক বা ইঁদুরের মতো গলধঃকরন করে।

দণ্ডশূক
দণ্ডশূক

২৬. অবতনিরোধনঃ

ইহলোকে অনেক ব্যক্তিই আছেন যারা অন্য প্রাণীদেরকে অন্ধকার কূপে, গোলায়, ফাটলে বা পাহাড়ের গুহায় রুদ্ধ করে কষ্ট দেয়। এই ঘৃণিত পাপকর্মের জন্য সেই সকল ব্যক্তির মৃত্যুর পর তাদেরকে অবতনিরোধন নামক নরকে নিক্ষেপ করা হয়। সেখানে অন্ধকার কূপে বিষাক্ত ধোঁয়া ও বিকট দুর্গন্ধ দ্বারা শ্বাসরোধ করে পাপীকে  কঠোর যন্ত্রণা দেওয়া হয়।

অবতনিরোধন
অবতনিরোধন

২৭. পর্যাবর্তনঃ

যে গৃহপতি তাঁর গৃহে অতিথি আগত দেখলে ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠে, পাপকুটিল ক্রুর দৃষ্টি দ্বারা অতিথিকে ভস্মীভূত করতে উদ্যত হয়, এবং আগত অতিথির সাথে দূর্ব্যাবহার করে, তাকে পর্যাবর্তন নামক নরকে নিক্ষেপ করা হয়, যেখানে বজ্রের মতো কঠিন চক্ষুবিশিষ্ট শকুন, বক, কাক ইত্যাদি তীক্ষ্ণ চঞ্চু সমন্বিত পক্ষীরা সেই পাপী ব্যক্তির চক্ষু সহসা বলপূর্বক উৎপাটন করে ফেলে। আর এভাবে তীব্র যন্ত্রনায় পাপের ফল ভোগ করতে থাকে পাপাত্মা।

পর্যাবর্তন
পর্যাবর্তন

২৮. সূচীমুখঃ

কিছু ব্যক্তি ইহলোকে তার ধনের গর্বে গর্বিত থাকে এবং কাউকে তাঁর নিজের সমকক্ষ মনে করে না। অহঙ্কারে বক্রদৃষ্টি হয়ে সে সব সময় শঙ্কিত থাকে যে, অন্যেরা তার ধন অপহরণ করে নেবে। এমনকি সে তার গুরুজনদেরও সন্দেহ করতে ছাড়ে না। এইভাবে ধন হারানোর ভয়ে তার হৃদয় ও বদন শুষ্ক হয়ে যায় এবং তার ফলে তাঁর চেহারা হয়ে ওঠে পিশাচের মতো। সে কখনই সুখ পায় না এবং দুশ্চিন্তাহীন জীবন বলতে যে কি বোঝায়, তা সে জানতে পারে না। ধন উপার্জন, বর্ধন ও রক্ষণের জন্য যেহেতু তাকে পাপকর্ম করতে হয়, তার ফলে তাকে সূচীমুখ নামক নরকে নিক্ষেপ করা হয়, সেখানে যমদূতেরা তার সর্বাঙ্গে তাঁতীর মতো সূত্র বয়ন করে।

সূচীমুখ
সূচীমুখ

প্রিয় দর্শক, এতক্ষণে আপনারা নিশ্চই বুঝতে পারছেন, আমাদের কৃত পাপকর্মগুলোর জন্য পরকালে আমাদের জন্য কি কঠিন কঠিন শাস্তি অপেক্ষা করছে। তাই আসুন সময় থাকতে আমরা কৃষ্ণনাম জপ করি এবং মহান ঈশ্বরের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী হই।

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে

হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।

Image Source:

3/5 - (2 votes)

Leave a Reply