You are currently viewing দুর্গা পূজায় কুমারী পূজা কেন করা হয়?  Why Virgin Girls are Worshiped During Durga Puja?

দুর্গা পূজায় কুমারী পূজা কেন করা হয়? Why Virgin Girls are Worshiped During Durga Puja?

কুমারী পূজা, ১৯০১ সালে স্বামী বিবেকানন্দের হাত ধরে, বেলুড় মঠ থেকে শুরু হওয়া, বাঙ্গালী হিন্দুদের দুর্গাপুজোর এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। প্রতিবছর দুর্গাপুজোর মহাষ্টমী বা মহানবমী তিথিতে অনুষ্ঠিত হয় কুমারী পূজা। কিন্তু সনাতন ধর্মের বহু শাস্ত্রগ্রহ্নথে কুমারী পুজার নির্দেশনা থাকলেও মাত্র ১০০ বছর আগে শুরু হয়েছে এই পুজোর সংস্কৃতি। আপনাদের অনুরোধের প্রেক্ষিতে আজ আমাদেরও আলোচনার বিষয় এই কুমারী পূজা।

ছোট বেলা থেকেই রামায়ন ও মহাভারতে আমরা অনেক বড় বড় যজ্ঞের কথা শুনে এসেছি। এই দুর্গোৎসবের একটি বড় অঙ্গ হচ্ছে কুমারী পূজা। কুমারী পূজা নিয়ে আমাদের মধ্যে যেন কৌতূহলের কমতি নেই। ভারত ও বাংলাদেশের রামকৃষ্ণ মিশনসহ বেশ কিছু ঐতিহ্যবাহী মন্দিরে অষ্টমীর মহাতিথিতে এই কুমারী পূজা হয়ে থাকে। তবে মতান্তরে মহানবমী তিথিতেও কুমারী পূজা অনুষ্ঠিত হতে পারে। হিন্দু শাস্ত্রমতে নারীকে সন্মান ও শ্রদ্ধার আসনে বসাতে এবং দেবীর কুমারী রুপের অর্চনা করতেই এই পূজার বিধান দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও“নিজেদের পশুত্বকে সংযত রেখে নারীকে সন্মান জানানোই”- কুমারী পূজার মূল লক্ষ্য।

বৃহদ্ধর্মপুরাণ-এ রামের জন্য ব্রহ্মার দুর্গাপূজার বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। তখন শরৎকাল, দক্ষিণায়ণ। দেবতাদের নিদ্রার সময়। তাই, ব্রহ্মা স্তব করে দেবীকে জাগরিত করলেন। দেবী তখন কুমারীর বেশে এসে ব্রহ্মাকে বললেন, বিল্ববৃক্ষমূলে দুর্গার বোধন করতে। দেবতারা মর্ত্যে এসে দেখলেন, এক দুর্গম স্থানে একটি বেলগাছের শাখায় সবুজ পাতার রাশির মধ্যে ঘুমিয়ে রয়েছে একটি তপ্তকাঞ্চন বর্ণা বালিকা। ব্রহ্মা বুঝলেন, এই বালিকাই জগজ্জননী দুর্গা। তিনি বোধন- স্তবে তাঁকে জাগরিত করলেন। ব্রহ্মার স্তবে জাগরিতা দেবী বালিকামূর্তি ত্যাগ করে চণ্ডিকামূর্তি ধারন করলেন।

অন্যমতে কুমারী পূজার উদ্ভব হয় কোলাসুরকে বধ করার মধ্য দিয়ে থেকে। কোলাসুর এক সময় স্বর্গ-মর্ত্য অধিকার করায় বিপন্ন দেবগণ মহাকালীর শরণাপন্ন হন। সে সকল দেবগণের আবেদনে সাড়া দিযে় দেবী পুনর্জন্মে কুমারীরূপে কোলাসুরকে বধ করেন। এরপর থেকেই মর্ত্যে কুমারী পূজার প্রচলন শুরু হয়।

আরও পড়ুনঃ  মহালয়া - মহিষাসুরমর্দিনির বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র || জানুন তাঁর জীবনের করুণ ইতিহাস || Birendra Krishna

কেউ কেউ বলে থাকেন, সেকালে মুনিঋষিরা কুমারীপুজোর মাধ্যমে প্রকৃতিকে পুজো করতেন। প্রকৃতি মানে নারী। সেই প্রকৃতিরই আর এক রূপ কুমারীদের মধ্যে দেখতে পেতেন তাঁরা। তাঁরা বিশ্বাস করতেন মানুষের মধ্যেই রয়েছে ঈশ্বরের অযুত প্রভাব। কারণ মানুষ চৈতন্যযুক্ত। আর যাঁদের সৎ মন কলুষতামুক্ত, তাঁদের মধ্যে আবার ঈশ্বরের প্রকাশ বেশি। কুমারীদের মধ্যে এই গুণগুলি থাকে মনে করেই তাদের বেছে নেওয়া হয় এই পুজোর দেবী হিসেবে।

তন্ত্রসার মতে, “১ থেকে ১৬ বছর পর্যন্ত বালিকারা কুমারী পূজার উপযুক্ত; তবে তাদের অবশ্যই ঋতুমতি হওয়া চলবে না।” মেরুতন্ত্রে বলা আছে, “সর্বকামনা সিদ্ধির জন্য ব্রাহ্মণ কন্যা, যশোলাভের জন্য ক্ষত্রিয় কন্যা, ধনলাভের জন্য বৈশ্য কন্যা ও পুত্র লাভের জন্য শূদ্রকূল জাত কন্যা কুমারী পূজার জন্য যোগ্য।” গুণ ও কর্ম অনুসারেই এই জাতি বা বর্ণ নির্ধারিত হয়। সেইজন্যই প্রচলিত শাস্ত্র অনুসারে, বিভিন্ন মিশন ও মন্দিরগুলোতে সর্ব মঙ্গলের জন্য ব্রাহ্মণ কন্যাকেই দেবী জ্ঞানে পূজা করা হয়। সকল নারীর মধ্যই বিরাজিত রয়েছে দেবীশক্তি। তবে কুমারী রূপেই মা দুর্গা বিশেষভাবে প্রকটিত হয়েছিলেন। তাই, কুমারী রূপে নারীকে দেবীজ্ঞানে সন্মান জানানোর একটি বাস্তব উদাহরন হচ্ছে “কুমারী পূজা”। ঈশ্বরের ভাব অনন্ত, তাই যে কোনও ভাব অবলম্বন করে ঈশ্বরকে আরাধনা করা যায়। সেজন্য পূজারীরা কুমারী মাতৃরূপে ঈশ্বরকে আরাধনা করেন। কুমারী পূজা মাতৃরূপে ইশ্বরেরই একটি আরাধনা।

মনু সংহিতায় বলা হয়েছে,

যেখানে নারীরা পূজিত হন সেখানে দেবতার প্রসন্ন। যেখানে নারীরা সম্মান পান না, সেখানে সব কাজই নিষ্ফল।

আবার মহাদেব যোগিনী শাস্ত্রে বলেছেন,

শতকোটি জিহ্বায় কুমারী পূজার ফল ব্যক্ত করতে পারব না।

কুমারীরা শুদ্ধতার প্রতীক হওয়ায় মাতৃরূপে ঈশ্বরের আরাধনার জন্য কুমারীকন্যাকে নির্বাচন করা হয়। সাধারণত অষ্টমী বা নবমীতে কুমারী পূজা করা হয়।

দেবী পুরাণে কুমারী পুজোর সুষ্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। শাস্ত্র অনুসারে সাধারণত এক বছর থেকে ১৬ বছরের অজাতপুষ্প সুলক্ষণা কুমারীকে পুজোর উল্লেখ রয়েছে। ব্রাহ্মণ অবিবাহিত কন্যা অথবা অন্য গোত্রের অবিবাহিত কন্যাকেও পুজো করার বিধান রয়েছে। শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, শুদ্ধাত্মা কুমারীতে ভগবতীর প্রকাশ। কুমারী পুজোর মাধ্যমে নারী জাতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়। ১৯০১ সালে স্বামী বিবেকানন্দ কলকাতার বেলুড় মাঠে নয় কুমারীকে পুজো করেন। তখন থেকে প্রতি বছর দুর্গাপুজোর অষ্টমী তিথিতে বেলুড় মঠে মাহা ধুমধাম করে এই পুজোর প্রথা চলে আসছে। এছাড়াও কালীপূজা, জগদ্ধাত্রীপূজা এবং অন্নপূর্ণা পূজা উপলক্ষে এবং কামাখ্যাদি শক্তিক্ষেত্রেও কুমারী পূজার প্রচলন রয়েছে।

আরও পড়ুনঃ  গাভীকে মাতা বলা হয় কেন? গোমাতা রক্ষার প্রয়োজনীয়তা কি? Why Cows are Called Gowmata?

মাদুরাইয়ের মীনাক্ষী দেবী মন্দিরে ও কন্যাকুমারীতেও মহা ধুমধামের সঙ্গে কুমারী পুজো হয়। কথিত আছে, কুমারীপুজো ছাড়া হোম-যজ্ঞ করেও দুর্গাপুজোর সম্পূর্ণ ফল পাওয়া যায় না। কুমারীপুজোর আগে সাধক কুমারীকে নতুন বস্ত্র, ফুলের মালা ও মুকুটে সাজান। পায়ে আলতা, কপালে সিঁদুর ও তিলক সৌন্দর্যে রাঙিয়ে তোলেন।

যোগিনীতন্য, কুলার্ণবতন্য, দেবীপুরাণ, স্তোত্র, কবচ, সহস্রনাম, তন্যসার, প্রাণতোষিণী, পুরোহিতদর্পণ প্রভৃতি ধর্মীয় গ্রন্থে কুমারী পূজার পদ্ধতি এবং মাহাত্ম্য বিশদভাবে বর্ণিত হযে়ছে। বর্ণনানুসারে কুমারী পূজায় কোন জাতি, ধর্ম বা বর্ণভেদ নেই। দেবীজ্ঞানে যে-কোন কুমারীই পূজনীয়। তবে সাধারণত ব্রাহ্মণ কুমারী কন্যার পূজাই সর্বত্র প্রচলিত। বয়সের ক্রমানুসারে পূজাকালে এই সকল কুমারীদের বিভিন্ন নামে অভিহিত

হিন্দুশাস্ত্রে এসব নাম জগত মাতার স্বরূপের এক একটি গুণ প্রকাশ করে। প্রায় সর্বজাতীয় কুমারী কন্যাকেই কুমারীরূপে পূজা করা যেতে পারে। তবে কুমারী পূজার জন্য সাধারণত ৫ থেকে ৭ বছরের কুমারীকন্যাকে মনোনীত করা হয়।

আরও পড়ুনঃ  পঞ্চকেদার সৃষ্টি হওয়ার পেছনের পৌরাণিক কাহিনী || Mythology Behind the Creation of Panch Kedar ||

কুমারী পূজার দার্শনিক তত্ত্ব হলো নারীতে পরমার্থ দর্শন ও পরমার্থ অর্জন। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যে ত্রিশক্তির বলে প্রতিনিয়ত সৃষ্টি, স্থিতি ও লয় ক্রিয়া সাধিত হচ্ছে, সেই ত্রিবিধ শক্তিই বীজাকারে কুমারীতে নিহিত। কুমারী প্রকৃতি বা নারী জাতির প্রতীক ও বীজাবস্থা। তাই কুমারী বা নারীতে দেবীভাব আরোপ করে তার সাধনা করা হয়। এ সাধনপদ্ধতিতে সাধকের নিকট বিশ্বজননী কুমারী নারীমূর্তির রূপ ধারণ করে; তাই তার নিকট নারী ভোগ্যা নয়, পূজ্যা। পৌরাণিক কল্পকাহিনিতে বর্ণিত আছে, এ ভাবনায় ভাবিত হওয়ার মাধ্যমে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব নিজের স্ত্রীকে ষোড়শীজ্ঞানে পূজা করেছিলেন।

5/5 - (1 vote)

Leave a Reply