You are currently viewing অসুরগুরু শুক্রাচার্য কিভাবে তাঁর প্রধান শত্রু দেবরাজ ইন্দ্রের কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন?

অসুরগুরু শুক্রাচার্য কিভাবে তাঁর প্রধান শত্রু দেবরাজ ইন্দ্রের কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন?

অসুরদের গুরু শুক্রাচার্য,  যিনি নামান্তরে দৈত্যগুরু বা দানবগুরু নামেও পরিচিত আমাদের কাছে। অন্যদিকে দেবতাদের রাজা এবং স্বর্গের অধিপতি হলেন দেবরাজ ইন্দ্র। অনাদিকাল থেকে এই দেবতা ও অসুরদের মধ্যে চলে আসছে দ্বন্দ্ব, সংঘাত, যুদ্ধ তথা দেবাসুরের সংগ্রাম। সুতারাং দেবতাদের রাজা ইন্দ্র এবং অসুরদের গুরু শুক্রাচার্যের মধ্যে ঘোর শত্রুতা থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তা সত্বেও কিভাবে দেবরাজ ইন্দ্র ও তাঁর পত্নী শচীদেবীর কন্যা জয়ন্তীকে বিবাহ করেছিলেন অসুরুগুরু শুক্রাচার্য? শুধু তাই নয়, সপ্তর্ষিদের অন্যতম ঋষি মহামুনি ভৃগুর পুত্র হয়েও কিভাবে অসুরদের গুরু হলেন তিনি? শ্রীনারায়ণের সাথে তাঁর শত্রুতার শুরুটা কিভাবে হয়েছিল? এবং ভগবান বিষ্ণু কিভাবে তাঁর একটি চোখ অন্ধ করে দিয়েছিলেন? এসকল ঘটনা জেনে নেওয়ার আহবান করে শুরু করছি সনাতন এক্সপ্রেসের আজকের পৌরাণিক পর্ব। আশা করি ভিডিওটি মনোযোগ সহকারে দর্শন ও শ্রবণ করবেন এবং আমাদেরকে উৎসাহিত করার জন্য কমেন্ট বক্সে একবার শ্রী হরি নারায়ণের নাম লিখে যাবেন।

অসুরগুরু শুক্রাচার্য জন্মেছিলেন মহামুনি ভৃগুর ঔরসে এবং কাব্যমাতা বা দিব্যমাতার গর্ভে। তাঁর পিতা ভৃগু মুনির ঘনিষ্ঠ মিত্র ছিলেন মহর্ষি অঙ্গিরা। তাই তিনি তাঁর নিজ পুত্র শুক্রাচার্যকে মিত্র অঙ্গিরার আশ্রমে পাঠিয়েছিলেন বিদ্যালাভ করার উদ্দেশ্যে। অঙ্গিরার আশ্রমে শুক্রাচার্যের সাথে বিদ্যা অর্জন করতেন স্বয়ং অঙ্গিরারর পুত্র বৃহস্পতি। তবে বিদ্যা, বুদ্ধি ও মেধায় শুক্রাচার্য ছিলেন অঙ্গিরা পুত্র বৃহস্পতি থেকে অনেক বেশী এগিয়ে। তাই কিছুকাল পরে শুক্রাচার্য কিছুটা পক্ষপাতিত্ব লক্ষ্য করলেন অঙ্গিরার আচরণে। তিনি খেয়াল করলেন গুরু অঙ্গিরা তাঁর পুত্রকে যতটা শেখাচ্ছেন তাকে ততটা শেখাচ্ছেন না। ফলে নতুন গুরুর সন্ধান করতে হল শুক্রাচার্যকে।

এর কিছুকাল পরে শুক্রাচার্য শিষ্যত্ব গ্রহণ করলেন গৌতম ঋষির। তাঁর থেকেই ধর্মশাস্ত্রের গভীর জ্ঞান অর্জন করেছিলেন তিনি। তাঁর জ্ঞানের পরিধি এতটাই বিস্তৃত ছিল যে সনাতন শস্ত্রের বহু গ্রন্থে তাকে সূক্ষ্মতত্ত্বদর্শী হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি তাঁর গুরুভ্রাতা বৃহষ্পতিও জ্ঞানের গভীরতার মাপে শুক্রাচার্যের ধারে কাছে পৌছাতে পারেননি। কিন্তু তা সত্বেও আবারও শুক্রাচার্যকে বঞ্চিত করে বৃহষ্পতিকে নিযুক্ত করা হল দেবতাদের গুরু হিসেবে। এ ঘটনায় ক্রুদ্ধ ও অপমানিত হয়ে শুক্রাচার্য সিদ্ধান্ত নিলেন বৃহষ্পতি যদি দেবতাদের গুরু পদে অভিসিক্ত হন তাহলে তিনিও অসুরদের গুরু নিযুক্ত হয়ে অসুরকুলকে রক্ষা করার ভার নেবেন। আর এভাবেই মহামুনি ভৃগুর পুত্র বনে গেলেন অসুরুদের গুরু শুক্রাচার্য।

আরও পড়ুনঃ  একাদশী কী? কিভাবে একাদশী আবির্ভাব হলো, একাদশী পালনের নিয়মাবলী, একাদশী মাহাত্ম্য

এবার আসি অসুরগুরু শুক্রাচার্য কিভাবে তাঁর প্রধান শত্রু দেবরাজ ইন্দ্রের কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন এবং নারায়ণের সাথে তাঁর শত্রুতার সূত্রপাত কিভাবে ঘটেছিল সেই ঘটনায়। আপনারা জানেন দেবাসুরের দন্দ্ব চিরকালের। কখনো দেবতাদের হাতে অসুরগণ পরাস্ত হতেন আবার কখনো অসুরগণ পরাজিত করতেন দেবতাদেরকে। তাই শুক্রাচার্য যখন অসুরদের গুরু নিযুক্ত হলেন তখন তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন দেবতাদের বিরুদ্ধে অসুরদের স্থায়ী জয়ের পথ অবশ্যই তাকে খুঁজে বের করতে হবে। তাঁর জন্য প্রয়োজন সঞ্জীবনী বিদ্যা। এই বিদ্যা প্রয়োগে মৃতদেহে প্রাণ সঞ্চার করা সম্ভব হবে। ফলে অসুরগণ এক প্রকার অমরত্বের স্বাদ পাবেন।

সুতারাং শুক্রাচার্য বেরিয়ে পড়লেন হিমালয়ের উদ্দেশ্যে। হিমশীতল পর্বতের চুড়ায় বসে রত হলেন দেবাদিদেব মহাদেবের কঠোর তপস্যায়। উদ্দেশ্য মহাদেবকে তপস্যায় সন্তুষ্ট করে তাঁর কাছ থেকে সঞ্জীবনী বিদ্যা আত্মস্থ করা। এভাবেই চলতে থাকল শত শত বছর। এক পর্যায়ে শুক্রাচার্যের এই তপস্যার বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন দেবরাজ ইন্দ্র। কারন অসুরদের কাছে সঞ্জীবনী বিদ্যা থাকলে তা দেবকুলের জন্য এক অশনি সংকেত। কোনভাবেই তাঁদেরকে যুদ্ধে পরাজিত করা সম্ভব হবে না দেবতাদের পক্ষে। আবার শুক্রাচার্যকে দেবরাজ ইন্দ্রের আজ্ঞাবহ অপ্সরাদের সম্পর্কেও খুব ভালোভাবেই জ্ঞাত। সুতারাং অপ্সরাদেরকে প্রেরণ করেও শুক্রাচার্যকে বিভ্রান্ত করা বা ধ্যান ভঙ্গ করা সম্ভব নয়।  তাই অনেক ভেবে দেবরাজ ইন্দ্র সিদ্ধান্ত নিলেন তারই কন্যা জয়ন্তীকে শুক্রাচার্যের ধ্যান ভঙ্গ করতে পাঠাবেন। দেবরাজ ইন্দ্র ও শচীদেবীর কন্যা জয়ন্তী পিতৃ আজ্ঞা পালনার্থে উপস্থিত হলেন শুক্রাচার্যের তপঃভূমিতে। কিন্তু বহু প্রচেষ্টায়ও তিনি তাঁর ধ্যান ভঙ্গ করতে পারলেন না। অবশেষে জয়ন্তী তাঁর কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত হয়ে সেখানেই অপেক্ষা করতে লাগলেন শুক্রাচার্যের তপস্যা সম্পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত।

এদিকে অসুরগুরু শুক্রাচার্য যখন সহস্র বছর ধরে মহাদেবের তপস্যায় লীন হয়ে আছেন, ঠিক তখনই অসুরদের উপরে আক্রমণ শুরু করলেন দেবগণ। অসুরগুরু শুক্রাচার্যের অনুপস্থিতিতে অসুররা তখন দিগভ্রান্ত ও অসহায় হয়ে পড়লেন। কোন ক্রমে তাঁরা নিজেদের প্রাণ বাঁচিয়ে উপস্থিত হলেন ভৃগুপত্নী তথা শুক্রাচার্যের মাতা কাব্যমাতার সামনে।  তাঁর কাছে বরাভয় ও আশ্রয় প্রার্থনা করলেন সমস্ত অসুরকুল। কাব্যমাতাও তাদেরকে আশ্বস্ত করলেন এবং অভয় প্রদান করলেন। এরপর তাঁর ঐশী ক্ষমতার দ্বারা তিনি সমস্ত দেবসেনাদেরকে স্থবির করে দিলেন। অর্থাৎ তাঁদের চলাচলের সমস্ত ক্ষমতা ছিনিয়ে নিলেন কাব্যমাতা।

আরও পড়ুনঃ  কি ঘটছে ভারতের রহস্যময় মন্দিরগুলিতে? || 10 Mysterious Temples of India || Part - 1 ||

দেবসেনাদের এ পরিস্থিতি দেখে দেবগণ এবার শরানাপন্ন হলেন ভগবান শ্রীহরি বিষ্ণুর। অনুরোধ করলেন অসুরদের মায়াজাল থেকে দেবতাদেরকে মুক্ত করতে। ফলে উভয় সংকটে পড়লেন শ্রীহরি বিষ্ণু। একদিকে দেবতাদের নিরাপত্তা রক্ষা অন্যদিকে একজন নারীর উপর প্রহার করা। অবশেষে তিনি তাঁর সুদর্শন চক্র দিয়ে কাব্যমাতার শিরোচ্ছেদ করে দেন। ফলে স্থবিরতা থেকে মুক্ত হলেন দেবগণ। ঘটনার পরম্পরায় ঋষি ভৃগু যখন গৃহে ফিরলেন তখন তাঁর পত্নীর নিথর দেহ দেখে ক্রোধে অন্ধ হয়ে গেলেন তিনি। এরপর তিনি বিষ্ণুকে অভিশাপ দিয়েছিলেন নারী হত্যা করার জন্য তাকে অবতাররূপে বারবার মর্ত্ত্যে ফিরে আসতে হবে এবং সেখানেও তাকে নারী হত্যা করতে হবে। মূলত শ্রীবিষ্ণুর অবতার-তত্ত্বের সূত্রপাত হয়েছিল এই ঘটনা থেকে। এবং রাম অবতারে তাড়কা রাক্ষসী বধ, শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক পুতনা রাক্ষসীকে বধ এবং পরশুরাম কর্তৃক আপন মাতাকে বধ করা সেই অভিশাপেরই ফল। তবে পরে অবশ্য ভৃগু তাঁর কমণ্ডলু থেকে মন্ত্রপূত জল ছিটিয়ে কাব্যমাতাকে পুনরায় জীবন দান করেছিলেন।

অন্যদিকে কিছুকাল পরে শুক্রাচার্যের তপস্যায় সন্তুষ্ট হলেন মহাদেব। তিনি শুক্রাচার্যের সামনে প্রকট হয়ে তাঁর ঈপ্সিত বর তথা সঞ্জীবনী বিদ্যা দান করলেন। ঠিক সেই সময় ইন্দ্র কন্যা জয়ন্তী শুক্রাচার্যের কাছে এসে তাঁর কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং তাকে স্ত্রীরূপে স্বীকার করার অনুরোধ করেন। শুক্রাচার্যও জয়ন্তীকে ক্ষমা করে তাকে নিজের ধর্মপত্নীরূপে স্বীকার করে নেন। এরপর হিমালয় থেকে ফিরে শুক্রাচার্য যখন নারায়ণ কর্তৃক নিজ মাতার শিরোচ্ছেদ করার ঘটনা জানতে পারেন, তখন থেকেই শুরু হয় নারায়ণের সাথে তাঁর শত্রুতা।

এবার আসি নারায়ণ কিভাবে শুক্রাচার্যের একটি চোখ অন্ধ করে দিয়েছিলেন সেই প্রসঙ্গে। দৈত্যরাজ বলির কথা আপনারা অনেকেই শুনে থাকবেন। একবার এই বলিরাজা অসুরগুরু শুক্রাচার্যের পরামর্শে ১০০টি অশ্বমেধ যজ্ঞ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সেই যজ্ঞে আগত ব্রাহ্মণদের দু হাত উজাড় করে দান করতে লাগলেন বলিরাজা। এমন সময় ব্রাহ্মণ পরিচয়ে সেই যজ্ঞে হাজির হলেন শ্রীবিষ্ণুর বামন অবতার। তিনি বলিরাজার কাছে তিনটি পা রাখার দাবী করেছিলেন। কিন্তু পাশে থাকা শুক্রাচার্য যোগবলে বামন অবতারের প্রকৃত পরিচয় জানতে পারলেন এবং বলিরাজাকে দান করতে নিষেধ করে বললেন- “শ্রীবিষ্ণু দেবতাদের স্বার্থে বামন রূপে তোমাকে ছলনা করছেন। বামনদেব তোমার সর্বস্ব হরণ করবেন, তাঁকে দান করার ক্ষমতা তোমার নেই।”

আরও পড়ুনঃ  কালভৈরব কে? তাঁর জন্মরহস্য কি? Kala Bhairava According to Hinduism, Buddhism and Jainism.

কিন্তু বলিরাজা গুরুর কথায় কর্ণপাত না করে বামনদেবকে তিন পাদ ভূমি দান করার জন্য সংকল্প করতে উদ্যত হলেন। শুক্রাচার্য বলিরাজাকে থামাতে না পেরে শেষমেষ সুক্ষ্ম দেহ ধারণ করে বলিরাজার কমণ্ডলুতে ঢুকে পড়লেন যাতে ঐ কমণ্ডলুর জল দিয়ে বলিরাজা বামনদেবকে দান করার সংকল্প করতে না পারেন। অতঃপর বলিরাজা যখন দানের সংকল্প করার জন্য কমণ্ডলু থেকে জল ঢালতে গেলেন তখন কমণ্ডলুর ভিতরে শুক্রের অবস্থানের কারনে জল পড়া বন্ধ হয়ে যায়। ভগবান বিষ্ণু বুঝতে পারলেন এটা শুক্রাচার্যের কারসাজি। তাই তিনিও একটি দূর্বাঘাস দিয়ে কমণ্ডলুর মধ্যে একটি খোঁচা দিলেন। ফলে একটি চোখ অন্ধ হয়ে যায় অসুর গুরু শুক্রাচার্যের। এরপর সেই কমণ্ডলু থেকে জল নিয়ে সংকল্প করলেন বলিরাজা। এবং এর পরের ঘটনা আপনাদের সকলেরই জানা।

5/5 - (1 vote)

Leave a Reply