You are currently viewing শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের জীবনী এবং মতুয়া ধর্মের ইতিহাস

শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুরের জীবনী এবং মতুয়া ধর্মের ইতিহাস

সময়টা উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের।  বৃটিশ নিয়ন্ত্রিত ভারতবর্ষে তখন অশিক্ষা, কুসংস্কার, অত্যাচার, ধর্মের নামে নিপীড়ন, ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রবল দাপট, বৈদিক বর্ণাশ্রম প্রথার অপব্যাখ্যা করে জাত-পাতের নামে নিষ্ঠুর ভেদাভেদ প্রভৃতি অন্ধকারে আচ্ছন্ন সমগ্র বঙ্গদেশ।  সেসময় নমঃশুদ্রকে আরও একটু তাছিল্য করে বলা হত চণ্ডাল বা চাঁড়াল।  এই চণ্ডালগণ ছিলেন সমাজের দলিত-পতিত শ্রমজীবী বা কৃষিজীবী মানুষ যাদেরকে উচ্চবর্ণের মানুষরা মনে করতেন অস্পৃশ্য বা অচ্ছুত।  এই অস্পৃশ্যদের স্পর্শ করলে স্নান করে শুদ্ধ হয়ে হত উচ্চবর্ণের মানুষদের, তাঁদের গৃহে আহার করলে হত অন্নপাপ, তাঁদের জন্য সামাজিক আচার অনুষ্ঠান, শিক্ষা, চিকিৎসা প্রভৃতির দ্বার ছিল বন্ধ।  তবে আশার কথা হল এই যে, পৃথিবীতে অত্যাচার-নিপীড়নের মাত্রা বাড়তে থাকলে তা রোধ করার উপায় গ্রহণ করেন স্বয়ং ঈশ্বর।  তিনি কখনো নিজে আবির্ভূত হয়ে অথবা কোন দিব্যপুরুষকে প্রেরণ করে নতুন পথের দিশা দান করেন পীড়িতদেরকে।  আর ঠিক একারণেই দলিত-পীড়িত মানুষের পতিত-পাবন হয়ে ধরাধামে জন্ম নিয়েছিলেন পূর্ণব্রহ্ম শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর।  হ্যাঁ, এতবড় মহামানবের জীবন কথা এত সহজে এবং এত স্বল্প সময়ে পরিবেশন করা কষ্টসাধ্য।  তবুও তার জীবনী, দর্শন, আদর্শ, উপদেশ এবং মতুয়া ধর্মের সারমর্ম তুলে ধরার জন্য আমাদের আজকের আয়োজন।  আশা করি সমাজের অবহেলিত শ্রেণীকে উদ্ধারহেতু জন্ম নেওয়া এই মহামানবের কথা শ্রবণ করে তৃপ্ত হবেন আপনারাও।

হরিচাঁদ ঠাকুরের জন্মঃ

ইংরেজী ১৮১২ খ্রিস্টাব্দ তথা বাংলা ১২১৮ সালের চৈত্র মাসের মধুকৃষ্ণা ত্রয়োদশীতে তৎকালীন পূর্ববঙ্গের ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার সফলাডাঙা গ্রামে জন্ম নিয়েছিলেন এক দিব্যশিশুঃ শিশুটির নাম হরিদাস বিশ্বাস।  এই হরিদাস বিশ্বাসই পরবর্তীকালে হয়ে উঠেছিলেন পূর্ণব্রহ্ম শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর।  যশোমন্ত বৈরাগী এবং অন্নপূর্ণা বৈরাগী নামের এক পরম বৈষ্ণব দম্পত্তির ৫ সন্তানের মধ্যে হরিচাঁদ ছিলেন ২য়।  পারিবারিক পদবী বিশ্বাস হলেও স্থানীয়ভাবে যশোমন্ত বৈরাগী নামে পরচিত ছিলেন হরিচাঁদ ঠাকুরের পিতা।  অন্যদিকে কয়েক পুরুষ আগে থেকে নিত্য সাধুসেবা, ঠাকুরপুজো, এবং বৈষ্ণবধর্মের আচার আচরণ পালন করার জন্য ঠাকুর উপাধি প্রাপ্ত হয়েছিলেন যশোমন্ত বৈরাগীর পরিবার।  তাই পরবর্তীকালে যশোমন্ত বৈরাগীর অধস্তনরা পরিচিত হয়েছিলেন ঠাকুর পদবী দ্বারা।

হরিচাঁদ ঠাকুরের ছোটবেলাঃ

তবে সমাজের নিম্নবর্ণের আরও ৫টা ছেলের মত হরিচাঁদ ঠাকুরের জীবন শুরু হয়েছিল বঞ্চনা দিয়ে।  স্থানীয় জমিদার কর্তৃক নিজেদের ভিটে-মাটি আত্মসাৎ করার ফলে ঠাকুর পরিবারকে আশ্রয় নিতে হয়েছিল বিভিন্ন স্থানে।  আর চণ্ডালদের জন্য যেহেতু শিক্ষার দ্বার ছিল বন্ধ, সেহেতু পাঠশালায় গিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা অর্জনের সুযোগ তিনি পান নি।  তাই বন্ধুদের সাথে দুষ্টুমি করে আর গোচারণ করে কেটে গিয়েছিল ছোট্ট হরিচাঁদের বাল্যকাল।  তবে শিশু হরিচাঁদ এতটাই দুষ্টু ছিলেন যে, তাঁদের বাড়িতে আগত বৈষ্ণদের  ঝোলা লুকিয়ে রাখা, তাঁদের জিনিসপত্র লুকিয়ে পুকুরে ফেলে দেওয়া ইত্যাদি রকমের দুষ্টুমিতে মেতে থাকতেন তিনি।  তবে তার শিশুকালেও লক্ষণীয় বিষয়টি ছিল এই যে, তার পিতা-মাতা তাঁদের বাড়িতে আগত বৈষ্ণবদের পদধূলি মাথায় নিতেন এবং ঐ সকল বৈষ্ণবদের পা ধোয়া জল পান করতেন।  তবে শিশু অবস্থাতেও হরিচাঁদ তা কখনো করেননি।  হরিচাঁদ গবেষকদের মতে, এভাবেই উচ্চবর্ণের মানুষ, ব্রাহ্মণ্যবাদ, জাত-পাত ও কুসংস্কারের প্রতি ক্ষোভ ও বিদ্রোহ বুকে নিয়ে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছিলেন হরিচাঁদ।

আরও পড়ুনঃ  পুরীর জগন্নাথ দেবের স্নানযাত্রা কি? || Snana Yatra of Jagannath Dev || 2022

সমাজ সংস্কারে হরিচাদঃ

যৌবনে পদার্পণ করার পর তার জ্ঞান ও মেধার দ্যুতি ছড়াতে থাকে দিকে দিকে।  আদিম কৃষিপদ্ধতির পরিবর্তে বিজ্ঞানসম্মত চাষাবাদ পদ্ধতির প্রবর্তন করা, অসুখ বিসুখে ওঝা বা ঝাড়ফুঁকের পরিবর্তে প্রাকৃতিক চিকিৎসার প্রবর্তন করা, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও মেধা দ্বারা আন্তঃকোন্দল মীমাংসা করা, নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে নেতৃত্ব দেওয়া প্রভৃতি রকমের সমাজ সেবামূলক কাজের মাধ্যমে নিম্নবর্ণের মানুষের মধ্যমণি হয়ে উঠলেন তিনি।  তবে তার মূল কাজটি ছিল তখনও বাকী।

হরিচাঁদ ঠাকুরের আত্মপ্রকাশঃ

এর কিছুকাল পরে দিকে দিকে রটে গেল একটাই কথাঃ হরিচাঁদ ঠাকুর অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী।  কিন্তু কেন? কারনটা হচ্ছে তার নির্দেশিত পন্থায় হরিনাম করে জটিল ও কঠিন রোগ থেকে সুস্থ হয়ে যাচ্ছেন মানুষ, নিঃসন্তান দম্পত্তি প্রাপ্ত হচ্ছেন সন্তানলাভের সুখ, এমনকি সেই হরিনামের গুণে জন্মান্ধ ব্যক্তিও ফিরে পাচ্ছেন দৃষ্টিশক্তি।  তবে কি হরিচাঁদ কোন ডাক্তার বা কবিরাজ ছিলেন? না, ছোটবেলায় পাঠশালার চৌকাঠ যিনি মাড়ানোর সুযোগ পান নি তার পক্ষে ডাক্তার হওয়া কোনভাবেই সম্ভব নয়।  তবে কি তিনি তুকতাক বা জাদুমন্ত্রের প্রয়োগ করতেন? না, তুকতাক বা কোন রকম কুসংস্কারে তিনি কখনোই বিশ্বাস করতেন না।  তবে কিভাবে এই অসাধ্য সাধন করেছিলেন তিনি?  এই প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে শুধুমাত্র হরিনাম।  ভক্তদের মধ্যে রব উঠল হরিচাঁদ স্বয়ং শ্রীচৈতন্য ও গৌতম বুদ্ধের অবতার।

আপনারা জানেন শ্রীচৈতন্যদেব ছিলেন বাংলার ভক্তি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ।  শুধুমাত্র হরিনাম তথা শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলার বুকে তিনি ঘটয়ে দিয়েছিলেন প্রেমের এক মহাপ্লাবন।  তার বিলানো হরিনামের অমৃতসুধা পান করে বুঁদ হয়ে থাকতেন ভক্তসকল।  কিন্তু শ্রীচৈতন্যদেবের রহস্যজনক অন্তর্ধানের পর সমাজের বুকে আবার ধীরে ধীরে মাথা চাড়া দিয়ে ঊঠেছিল ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রবল একনায়কতন্ত্র।  সমাজের খেটে খাওয়া মানুষগুলোর উপরে আবারও নেমে এসেছিল অস্পৃশ্যতা, জাতিভেদ, কুসংস্কার, উপেক্ষা এবং অবহেলা নামক দানবীয় খাঁড়া।  সেকারনে হরিনামের সেই অবরুদ্ধ ধারাটিকে মুক্ত করে পুনরায় আম জনতার মধ্যে সঞ্চালিত করার জন্য প্রয়োজন ছিল শ্রীচৈতন্যদেবের মতই একজন মহামানব।  আর সেকারনে দলিত-পতিত এবং অবহেলিত মানুষগুলোর কান্না, অপমান, এবং বঞ্চনার আর্তচিৎকারে আবির্ভূত হয়েছিলেন শ্রীশ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর।  তিনি সেই শক্তিমান অদ্বিতীয় পুরুষ যিনি বাংলার বুকে হরিনামের মৃতপ্রায় ধারাটির মধ্যে সঞ্চারিত করেছিলেন এক প্রবল বেগ।  স্থির জলরাশির মধ্যে তিনি যেন এনে দিয়েছিলেন মহাসমুদ্রের কল্লোল।

মতুয়া ধর্মের প্রবর্তনঃ

তাঁরই নেতৃত্বে বৃহত্তর ফরিদপুর অঞ্চলের হাজার হাজার শ্রমজীবি এবং নিম্নবর্গের মানুষরা অভূতপূর্ব ভাববাদী আন্দোলনের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন।  বলাই বাহুল্য, হরিচাদ ঠাকুর শুধুমাত্র নিম্নবর্ণের মানুষদের ঠাকুর নন, তৎকালীন সময়ে তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন  ছত্রিশটি জাতি।  এবং এই জাতিগুলোর মধ্যে ব্রাহ্মন, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র ছাড়াও অন্তর্ভূক্ত হয়েছিলেন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীগণও।  তাইতো বলা হয় সকল নমঃ মতুয়া, কিন্তু সকল মতুয়া নমঃ নয়। যাইহোক, এই অজস্র অগণিত অনুগামীদের কাছে হরিচাদ ঠাকুর হয়ে উঠেছিলেন শ্রীচৈতন্যদেবের অবতারস্বরূপ।  শ্রীচৈতন্যদেবের ভক্তরা যেমন ভাবে তন্ময় হয়ে নাম সংকীর্তনের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে প্রেম বিলিয়ে দিতেন, তেমনি শ্রীহরিচাদ ঠাকুরের অনুগামীরাও প্রবল ভাবোন্মাদ অবস্থায় হরিবোল ধ্বনির মাধ্যমে সারাধারণ মানুষের মধ্যে ঈশ্বর আরাধনার এক নতুন পথের সন্ধান দিয়েছিলেন।  ঠাকুরের অনুসারীগণ ডঙ্কা, শিঙা, শঙ্খ, কাসর ইত্যাদি রকমের বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে, ত্রিকোন লাল নিশান উড়িয়ে,  প্রবল গর্জন আর প্রচণ্ড নাচের মধ্য দিয়ে, হরিবোল ধ্বনিতে মেতে থাকতেন। তবে হরিচাঁদ ঠাকুরের এই সাধন পদ্ধতিকে স্বাভাবিকভাবে নেয় নি সেসময়কার উচ্চবর্ণের হিন্দুগণ।  তারা হরিচাঁদের অনুসারীদের প্রতি বিরক্ত হয়ে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ করে তাঁদের নাম দিয়েছিলেন মত্ত।

আরও পড়ুনঃ  ভূত চতুর্দশী কি? এর পিছনের পৌরাণিক কাহিনী জানেন কি? Bhoot Chaturdashi Celebration in Bengal

তবে সমাজের উচুশ্রেণীর মানুষদের এই বিদ্রুপকেও ইতিবাচক হিসেবে নিয়েছিলেন ঠাকুর।  তিনি তার প্রচারিত মতবাদের নাম দিয়েছিলেন মতুয়া ধর্ম।  এবং বলাই বাহুল্য মতুয়া শব্দটির উৎপত্তি হয়েছিল সেই বিদ্রূপাত্মক মত্ত শব্দ থেকে।  আগেই বলেছি, হরিচাঁদ ঠাকুরের অনুগামীরা তাকে শ্রীচৈতন্যদেব ও গৌতম বুদ্ধের অবতার মনে করে থাকেন।  অন্যদিকে, গবেষকদের মতে মতুয়া ধর্ম হচ্ছে, বৈষ্ণব ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্মের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এক সূক্ষ্ম সনাতন ধর্ম।  অর্থাৎ, বৈষ্ণব ধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্মের সাধন পদ্ধতির জটিলতাগুলোকে পরিহার করে সহজ-সরল এবং আড়ম্বরহীন পন্থায় ঈশ্বর সাধনই হচ্ছে মতুয়া ধর্ম।  তাই গবেষকরা অনেকেই মতুয়া ধর্মকে হিন্দু ধর্মের প্রকৃত ও যুগোপযোগী সংস্কার বলেও উল্লেখ করেছেন।  তবে হরিচাঁদ ঠাকুর কর্তৃক প্রচারিত মতুয়া বা সূক্ষ্ম সনাতন ধর্মে কোনো দেব-দেবীর স্থান নেই।  এখানে হরিনামই হচ্ছে সবকিছু।

মতুয়া ধর্মের কিছু প্রধান বৈশিষ্ট্যঃ

প্রথমত, জাগতিক কর্মকে ব্যাপক গুরুত্ব দিয়েছেন হরিচাঁদ।  তিনি বলেছেন, “গৃহীর কর্মই ধর্ম”।  আপনি যতবড় ভক্ত বা ধার্মিক বা ভক্ত হন না কেন, কর্ম না করলে জগত সংসারে টিকে থাকা সম্ভব নয়।  সুতারাং হরিনাম করতে করতে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিতে হবে কর্মে।  সেকারনে তিনি স্পষ্ট বলেছেন, “হাতে কাম মুখে নাম”।  তবে তিনি শুধু উপদেশ দিয়েই ক্ষ্যান্ত হননি, তিনি নিজেও কঠোর পরিশ্রম করে দেখিয়ে গিয়েছেন মানবব জীবনে কর্মের গুরুত্ব।  তিনি কখনো করেছেন তেলের ব্যবসা, কখনো মুদি মালামাল দিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বিক্রি করেছেন আবার কখনো পতিত জমিতে কৃষিকাজ করে বন্ধ্যা মাটির বুকে ফলিয়েছেন সোনার ফসল।  এই এসকল কর্ম আমাদেরকে এই শিক্ষা দেয় যে, মানুষের জীবনে আধ্যাত্মিকতা যতটা জরুরী, পার্থিব বাস্তবতাও ঠিক ততটাই জরুরী।

দ্বিতীয়ত, সংসার ধর্ম বা গার্হস্ত্য আশ্রমের উপরেও ব্যাপক গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন তিনি।  তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, সংসারই মানুষের জীবনের সুখ শান্তি উন্নতির মধ্যেই রয়েছে সমাজের রাষ্ট্রের যথার্থ উন্নতি।  তাই তাকে শ্রীচৈতন্যদেব এবং গৌতম বুদ্ধের অবতার বলা হলেও তিনি কিন্তু তাঁদের মত সন্ন্যাসধর্ম পালন করতে গিয়ে সংসার ত্যাগ করেননি।  তার মতে গৃহের জীবন যাপন করেও ঈশ্বরের আরাধনা করা সম্ভব।  তিনি নিজেও একজন সফল গৃহীর জীবন যাপন করেছিলেন।  ফরিদপুরের লোচন প্রামাণিকের কন্যা শান্তিবালা দেবীকে তিনি বিবাহ করেছিলেন এবং দাম্পত্য জীবনে গুরুচাঁদ ঠাকুর ও উমাচরণ ঠাকুর নামক দুই পুত্রের জনক হয়েছিলেন।

আরও পড়ুনঃ  দেবতাদের চেয়ে শক্তিশালী ১২ জন ভয়ংকর অসুর

তৃতীয়ত, তৎকালীন সমাজে নারীর প্রতি বৈষ্যম্য ছিল তুঙ্গে।  নারীদেরকে চার দেওায়লের মধ্যে আটকে রেখে পতিসেবা, সন্তান উৎপাদন ও সন্তান লালনপালনের যন্ত্র হিসেবে ব্যাবহার করাই ছিল সেযুগের বৈশিষ্ট্য।  কিন্তু হরিচাদ ঠাকুর অনুধাবন করেছিলেন একটি দেশের অর্ধেক জনসংখ্যাকে গৃহবন্দী করে রেখে সমাজের উন্নতি কখনোই সাধিত হতে পারে না।  তাই তিনি সমাজে নারীকে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তাঁদের যথাযোগ্য মর্যাদায়।  মতুয়া ধর্মে বিধান দিয়েছিলেন যে,  নারী পুরুষ একসাথে পুজো অর্জনা করবে,  নাম সংকীর্তণ করবে,। মহোৎসবে নারী পুরুষ একসঙ্গে ঈশ্বরের প্রেমে মাতোয়ারা হবে।  অর্থাৎ, নারীকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করে তিনি সমাজে নারী-পুরুষের মধ্যে এক অপূর্ব সমতা বিধান করেছিলেন।  একারনে হরিচাঁদ গবেষকগণ মতুয়া ধর্মকে হল সাম্যবাদী ধর্ম নামেও অভিহিত করেছেন।

কর্ম, সংসার ও নারীসংক্রান্ত বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করা ছাড়াও আরও বেশ কিছু নীতি অনুসরণ করার উপদেশ দিয়েছিলেন হরিচাদ ঠাকুর।  যেমনঃ

  1. সদা সত্য কথা বলা,
  2. পরস্ত্রীকে মাতৃজ্ঞান করা,
  3. পিতামাতাকে ভক্তি করা,
  4. জগৎকে প্রেমদান করা,
  5. জাতিভেদ না করা,
  6. কারও ধর্মনিন্দা না করা,
  7. বাহ্য অঙ্গ সাধুসাজ ত্যাগ করা,
  8. শ্রীহরিমন্দির প্রতিষ্ঠা করা,
  9. ষড়রিপু  থেকে সাবধান থাকা,
  10. দৈনিক প্রার্থনা করা এবং
  11. ঈশ্বরে আত্মদান করা।

ইত্যাদি বিষয়ে সমানভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন পতিত-পাবন ঠাকুর।

মতুয়া মহাসঙ্ঘ প্রতিষ্ঠাঃ

এছাড়াও জীবনের এক পর্যায়ে এসে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, সমাজের নির্ম্নবরগের মানুষদের আত্মশক্তি জাগরণের জন্য, জোর করে চাপিয়ে দেওয়া শত শতাব্দীর ধর্মীয় বিধি নিষেধের শৃংখল ছিন্ন করার জন্য,  অস্পৃশ্যতাকে নির্মুল করার জন্য, এবং ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য প্রয়োজন বিদ্যার্জন এবং সঙ্ঘবদ্ধতার।  আর তার এই দর্শন থেকেই মতুয়াদের নিয়ে তৈরি হয়েছে মতুয়া মহাসঙ্ঘ।  এই মতুয়া মহাসঙ্গের কর্মকাণ্ড ব্যাপক বিস্তৃত হলেও বস্তুত তা আসলে মতুয়া আন্দোলনের ধারক ও বাহক।  এতক্ষণে হয়ত অনেকের মনেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, মতুয়া ধর্ম কি সনাতন হিন্দু ধর্ম থেকে আলাদা কিছু? এটি নিয়ে যদি সত্যি আপনাদের আগ্রহ থাকে তাহলে আগামীতে এই বিষয়ের উপরে ভিডিয়ো নির্মাণ করার চেষ্টা করব আমরা।

মহাপ্রস্থানঃ

যাইহোক, এরকম এক বিশাল কর্মমুখর জীবন যাপনের পর অবশেষে থামলেন পূর্ণব্রহ্ম শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর।  নিজের অসমাপ্ত কাজের ভার পুত্র গুরুচাঁদের উপরে ন্যাস্ত করে ১৮৭৮ সালের ১৩ই মার্চ ভোরবেলা দিব্যধামে যাত্রা করেন তিনি।  মাত্র ৬৬ বছরের জীবনে তিনি অজস্র অবহেলিত মানুষকে দান করে গেছেন মুক্তির স্বাদ, শিখিয়ে গিয়েছেন সহজ-সরল পথে ঈশ্বরের সানিধ্য লাভের উপায় এবং রেখে গিয়েছেন প্রেমের বানী বিলানো মতুয়া ধর্ম।  এই মহামানবকে শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়ে প্রতিবছর তার তার জন্মতিথিতে বর্তমান বাংলাদেশের ওড়াকাঁন্দির ঠাকুরবাড়িতে অনুষ্ঠিত হয় তার জন্মোৎসব, মহাবারুনি পূণ্য স্নান ও মতুয়া মহামেলা।  দেশ বিদেশের কোটি কোটি ভক্ত ও পূণ্যার্থীর পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে এই মহাতীর্থ।

Rate this post

Leave a Reply