চলছে নিকৃষ্টতম অন্ধকারের যুগ, কলিযুগ। আর তাই কথায় কথায় “ঘোর কলি”, “কলির সন্ধ্যা” ইত্যাদি শব্দ শুনতে হচ্ছে আমাদেরকে। অনেকের মতে খুব শীঘ্রই শেষ হবে কলিযুগ আর ধ্বংস হবে পৃথিবী। কেউ বলছেন চলতি বছরেই ঘটে যাবে কলিযুগের সমাপ্তি। কেউ তো আবার একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলছেন, কলিযুগের পরিত্রাতা কল্কি অবতার নাকি ইতিমধ্যে পৃথিবীতে এসে আবার চলেও গিয়েছেন। কেউ কেউ নাকি অশ্বত্থামাকে অজ্ঞাতবাস থেকে বেরিয়ে আসতে দেখেছেন কল্কি অবতারকে সাহায্য করার জন্য। তাহলে কি সত্যিই কলিযুগের অন্তিম সময় আসন্ন?
প্রিয় দর্শক, কলিযুগের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে ধর্মহীনতা। আর এ কারনে ধর্ম বা ধর্মশাস্ত্রের সাথে কার্যত কোন সম্পর্কই নেই আমাদের। ফলে কলিযুগ সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তথ্য, কুসংস্কার ও অপতথ্যের বিস্তার ঘটছে আমাদের সমাজে। তাই সনাতন এক্সপ্রেসের আজকের আয়োজনে আপনাদেরকে জানাবো কলিযুগ সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য।
আজকের ভিডিয়োতে থাকছে কল্কি অবতার, কলিযুগ, এবং অসুর কলি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য। আরও জানতে পারবেন ঠিক কবে এবং কিভাবে শুরু হয়েছিল কলিকাল, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, ব্যাসদেব, ও নারদমুনি কর্তৃক এবং বিভিন্ন পুরাণে কিভাবে কলিযুগ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে, এযুগের মোট ধাপ কতটি এবং প্রত্যেক ধাপে কি কি ঘটবে, কলিযুগের নারী-পুরুষ ও পারবারিক বন্ধন কেমন হবে, এযুগে প্রকৃতি কেমন হবে এবং কলিযুগ শেষে প্রলয়কালে কি কি ঘটবে। এবং সর্বশেষ, কলিযুগের পরে কিভাবে সত্যযুগের সূচনা হবে।
কলিযুগের সূচনা
তো চলুন শুরু করা যাক, কলিযুগ কিভাবে শুরু হল? এই প্রশ্ন দিয়ে। আপনারা হয়তো অনেকেই জানেন জরা নামক এক ব্যাধের ছোড়া তুচ্ছ এক বাণের দোহাই দিয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের এই মর্ত্যলোক ত্যাগ করে বৈকুণ্ঠে গমন করেছিলেন। আর ঠিক সেদিনটিই ছিল দ্বাপরযুগের সমাপ্তি ও কলিযুগের প্রারম্ভের সময়। তবে এগুলো কোন কল্পকাহিনী বা রূপকথা নয়। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, মহাভারত, ভাগবত পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ, ভবিষ্য পুরাণ, কল্কি পুরাণ, অগ্নি পুরাণ, এবং বিষ্ণু পুরাণ থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, শ্রীকৃষ্ণের দেহাবসান সম্পর্কে যেসকল তিথি-নক্ষত্রের উল্লেখ করা রয়েছে তা দিয়ে নির্বিঘ্নে সেদিনকার দিন তারিখ বা সময় নির্দিষ্ট করে বের করতে পেরেছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। অর্থাৎ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ ৩১০২ সালের ১৮ই ফেব্রুয়ারী, চৈত্রমাসের শুক্ল প্রতিপদ তিথিতে, আশ্বিনী বা রেবতী নক্ষত্রে এবং মধ্যরাত বা সুর্যোদয়ের সময় শুরু হয়েছিল কলিযুগ।
আপনারা জানেন কলিযুগের আয়ুষ্কাল ৪,৩২,০০০ বছর। সুতারাং হিসাব করলে দেখা যায়, কলিযুগের সূচনা হয়েছে মাত্র ৫,১২৭ বছর। তাহলে বুঝতেই পারছেন কলিযুগ শুরুই হয়েছে সবেমাত্র এবং আজ থেকে আরও প্রায় ৪,২৬,৮৭৩ সৌরবছর পরে শেষ হবে কলিযুগ। সুতারাং কলিযুগের অন্ত আসন্ন কিনা এ প্রশ্নের উত্তর আপনার আর অজানা থাকার কথা নয়।
অসুর কলি
এবার জেনে নেওয়া যাক, অসুর কলি সম্পর্কে। আপনারা জেনে আশ্চর্য হবেন, যে দুর্যোধনকে বধ করার পর দ্বাপর যুগ শান্ত হয়েছিল, সেই দুর্যোধন স্বয়ং ছিলেন অসুর কলির অবতার। মূলত দ্বাপর যুগকে সংকুচিত করে কলিযুগকে ত্বরান্বিত করার জন্যই তিনি জন্ম নিয়েছিলেন দুর্যোধনরূপে। যাইহোক, অভিমন্যুপুত্র পরীক্ষিতের রাজত্বকালে অসুর কলি আবারও ফিরে এলেন পৃথিবীতে। তবে মহাবীর পরীক্ষিতকে বাধ্য করে বা তার সাথে দ্বন্দ করে অসুর কলির পক্ষে পৃথিবীতে অবস্থান করা সম্ভব ছিল না। তাই তিনি মহারাজ পরীক্ষিতকে সমীহ করেই তার কাছে পৃথিবীতে অবস্থান করার অনুমতি চাইলেন। তবে কলিকে পৃথিবীতে থাকার অনুমতি দিলে তার পরিনাম যে ভয়ংকর হবে তা সহজেই অনুমান করতে পেরেছিলেন মহারাজ পরীক্ষিত। আবার বিধির বিধানকে অগ্রাহ্য করে অসুর কলিকে কলিযুগে তার কর্ম থেকে বিরত রাখাও তিনি সমীচীন মনে করেননি। সবশেষে মহারাজ পরীক্ষিত অসুর কলিকে ৫টি স্থানে বসবাস করার অনুমতি প্রদান করেন। আর সেই স্থানগুলো হচ্ছে সুরাপানের আড্ডায়, দ্যূতক্রীড়া বা জুয়ার আড্ডায়, বারাঙ্গনাদের পাড়ায়, কসাইখানায় এবং স্বর্ণ বা স্বর্ণনির্মিত বস্তুতে। অসুর কলি সর্বপ্রথমে ঢুকে পড়েছিলেন মহারাজ পরীক্ষিতের স্বর্ণনির্মিত মুকুটে। আর সেখানে থেকেই পরীক্ষিতের চিন্তাভাবনাকে প্রভাবিত করা শুরু করেন তিনি। এরপর কলির প্রভাবে বুদ্ধিভ্রষ্ট মহারাজ পরীক্ষিত শমিক মুনির গলায় শাপ ঝুলিয়ে দেন এবং শমিক মুনির পুত্র শৃঙ্গী ঋষির অভিশাপে তক্ষকের দংশনে প্রাণ হারান। যদিও অসুর কলি ৫টি স্থানে বসবাস করার অনুমতি পেয়েছিলেন, কিন্তু মহাবলি রাজা পরীক্ষিতের মৃত্যুর পর সমস্ত পৃথিবীকে ধীরে ধীরে নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন করতে শুরু করেন তিনি।
কলিযুগের ৩টি ধাপ
এবার জেনে নেওয়া যাক কলিযুগের তিনটি পর্যায় সম্পর্কে। বিভিন্ন পৌরাণিক শাস্ত্র বিশ্লেষণ করে জানা যায়, কলিযুগের প্রথম ৩৬,০০০ বছরকে বলা হয় কলির ভোর। পরবর্তী ৩,৬০,০০০ বছরকে বলা হয় ঘোর কলি এবং কলিযুগের শেষ ৩৬,০০০ বছরকে বলা হয় কলির সন্ধ্যা।
কলির ভোর
কলির ভোর অর্থাৎ কলিযুগের প্রথম ৩৬০০০ বছর সম্পর্কে বৃহদ্ধর্মপুরাণ সহ বেশ কিছু পৌরাণিক শাস্ত্র থেকে জানা যায়ঃ এ সময়টাতে কিছুটা হলেও ধর্মের অস্তিত্ব থাকবে। তবে এর পাশাপাশি মানুষ ধীরে ধীরে বেদাদি শাস্ত্র থেকে বিমুখ হতে শুরু করবে এবং কালক্রমে অগণিত ধর্ম, মত, ও পথের জন্ম হবে। তাছাড়া ঈশ্বরে অবিশ্বাস বৃদ্ধি পাবে এবং ঈশ্বরপ্রেরিত কিছু মহাপুরুষ পৃথিবীতে অবতীর্ণ হয়ে সাময়িকভাবে ধর্মকে প্রতিষ্ঠা করবে। এই ভবিষ্যদ্বাণী প্রমানিত হয়েছে বৌদ্ধ ধর্মের উত্থান এবং শ্রীচৈতন্যদেব ও আদিশংকারাচর্যের মত মহাপুরুষদের আবির্ভাবের মাধ্যমে। তবে কলিযুগের ১০,০০০ বছর অতিবাহিত হলে আর কোন মহামানব জন্ম নেবেন না।
কলিযুগের প্রথম ৫০০০ বছর অতিক্রান্ত হলে গঙ্গা ধীরে ধীরে জলশূন্য হতে শুরু করবে এবং এক পর্যায়ে দেবী গঙ্গা তার সম্পূর্ণ জলপ্রবাহ বন্ধ করে বৈকুণ্ঠে ফিরে যাবেন। এর পরবর্তী ৫০০০ বছর পরে কোন দেবদেবীই আর পৃথিবীতে অবতীর্ণ হবেন না বা অবস্থানও করবেন না। এবং এই কলির ভোরেই আস্তে আস্তে ফুটে উঠবে কলিযুগের ভীতিকর কিছু বৈশিষ্ট্যঃ
যেমনঃ
- মানুষের ধর্ম, সততা, ন্যাপরায়ণতা, সহনশীলতা ধীরে ধীরে হ্রাস পেতে শুরু করবে। সেইসাথে লোভ, ক্রোধ, এবং ঈর্ষার মতো নেতিবাচক গুণাবলী ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাবে।
- মানুষের জীবনকাল, শারীরিক শক্তি ও স্মৃতি হবে সংক্ষিপ্ত এবং মহামারী ও রোগব্যাধির প্রকোপ বাড়বে।
- ধন এবং ক্ষমতা হবে মানুষের গুণ ও সম্মানের একমাত্র মাপকাঠি।
- বিবাহ হবে শুধুমাত্র শারীরিক সুখ ভোগের উদ্দেশ্যে এবং তুচ্ছ থেকে তুচ্ছতর কারনে ঘটবে বিচ্ছেদ। সেইসাথে পারিবারিক বন্ধন বিলুপ্ত হবে ক্রমান্বয়ে।
- নারীরা নগ্নতা ও তাঁদের শারীরিক সৌন্দর্যকে নিজেদের পুজি বলে মনে করবে।
- ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালিত হবে প্রতারণার উপর ভিত্তি করে। এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও আস্তে আস্তে পরিণত হবে ব্যবসাক্ষেত্রে।
- শাস্ত্রীয় বিধি-বিধানের অপব্যাখ্যা করে মানুষ তার স্বার্থসিদ্ধি করবে। ঠিক যেমন বৈদিক বর্ণাশ্রম প্রথাকে জন্মগত জাতিভেদে রূপদান করা হয়েছে।
- প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন খরা, বন্যা, অতিবৃষ্টি, ভূমিকম্প, ঝড় এবং দুর্ভিক্ষ বাড়বে।
- মানবসৃষ্ট বিপর্যয় যেমন হানা-হানি, যুদ্ধ, ব্যাভিচার ইত্যাদি বাড়তে থাকবে।
- মানুষ ধর্মশাস্ত্র, ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং আধ্যাত্মিকতার প্রতি আগ্রহ হারাবে।
- অযোগ্য ব্যক্তিরা রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করবে এবং প্রজাদের উপরে অন্যায়, অত্যাচার ও নিপীড়ন পরিচালনা করবে।
ঘোর কলি
তো কলির ভোরের পরের ধাপ হচ্ছে ঘোর কলি। অর্থাৎ পরবর্তী ৩,৬০,০০০ বছর। আমাদের পৌরাণিক শাস্ত্রের ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারেঃ
- এসময় মানুষের মধ্যে ধর্মের বিন্দুমাত্র অবশিষ্ট থাকবে না। ফলে ধর্মের অবনতি চরম সীমায় পৌঁছাবে।
- সমস্ত নদী ও জলের উৎস শুকিয়ে যাবে এবং পিপাসার জলটুকুও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
- মাতা ধরিত্রী তার বুকে সকল প্রকার ফসল উৎপাদন বন্ধ করে দেবেন। ফলে মানুষের ক্ষুধানিবৃত্তির জন্য কোন কিছুই পাওয়া যাবে না। খাদ্যের অভাবে মানুষ কঙ্কালসার হয়ে পড়বে।
- পুত্র-কন্যা কর্তৃক মাতা-পিতা অথবা মাতা-পিতা কর্তৃক পুত্র-কন্যা বধিত হবে।
- রাহু অকালে সূর্যকে গ্রাস করবে।
এরকম হাজারো কলির লক্ষণ দেখা যাবে পৃথিবীতে।
ধারনা করা হয় কলিযুগের এই পর্যায়ে জন্ম নেবেন ভগবান বিষ্ণুর দশম অবতার কল্কিদেব। কল্কিপুরাণ থেকে জানা যায়, চৈত্র মাসের শুক্ল দ্বাদশীর পুণ্যতিথিতে উত্তর প্রদেশের সম্ভল গ্রামে জন্ম নেবেন কল্কিদেব। তার পিতা বিষ্ণুযশ ও মাতা সুমতির চতুর্থ সন্তান হিসেবে আবির্ভূত হবেন তিনি। তিনি সিংহলের রাজা বৃহদ্রথের কন্যা পদ্মাবতীর পাণিগ্রহণ করে সংসার জীবনে প্রবেশ করবেন। এবং এরপর তিনি মনোনিবেশ করবেন পৃথিবী থেকে অত্যাচারী-পাপী ও অধার্মিকদের বিনাশকার্যে। একার্যে তার সহযোগী হিসেবে থাকবেন পরশুরাম ও অশ্বত্থামা। তার বাহন হবে দেবদত্ত্ব নামক এক ঐশ্বরিক শ্বেত ঘোড়া যা জল, স্থল বা অন্তরীক্ষেও তীব্র গতিতে ধাবিত হতে পারবে। এবং তার অস্ত্র হবে প্রজ্জ্বলিত অগ্নির মত তরবারি এবং সুদর্শন চক্র। মাত্র তিন দিনেই তিনি বিনাশ করবেন কলি অসুর সহ কলির প্রভাবে প্রভাবিত সমস্ত অধার্মিকদের। সুতারাং কল্কি অবতার ইতিমধ্যেই আবির্ভূত হয়েছেন কিনা সেবিষয়ে আপনাদের আর কোন সংশয় রইল না।
কলির সন্ধ্যা
এবার আসি কলিযুগের শেষভাগের ঘটনা অর্থাৎ কলির সন্ধ্যা বা কলিযুগের শেষ ৩৬০০০ বছরের ঘটনায়। আপনারা অনেকেই জানেন মহাভারতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বারংবার বলেছেন নতুন সৃজনের জন্য সম্পূর্ণ বিধ্বংসের প্রয়োজন। আর তাই এই ৩৬০০০ বছরে শুরু হবে সম্পূর্ণ সৃষ্টির বিনাশ প্রক্রিয়া। এসময় এত তীব্র বৃষ্টিপাত ঘটবে যে, সমস্ত পৃথিবী জলমগ্ন হয়ে পড়বে। ফলে ধীরে ধীরে পৃথিবী থেকে মুছে যাবে স্থলজ সকল প্রাণের অস্ত্বিত্ব। এরপর পৃথিবীতে একসাথে উদিত হবে ১২টি সূর্য। এবং ১২টি সুর্যের তীব্র তেজে সমস্ত জল শুকিয়ে তো যাবেই সেইসাথে সকল প্রকার জলজ প্রাণীও অস্তিত্ব হারাবে পৃথিবীর বুক থেকে। আর এভাবেই শুরু হবে সত্যযুগ। আকাশ থেকে নিয়মিত বর্ষণ, ধরণীমাতার অনুগ্রহ এবং প্রাকৃতিক অনুকুলতায় পৃথিবী আবারও ভরে উঠবে পত্র,পুষ্প,বৃক্ষের আন্দোলনে। প্রাণের স্পন্দনে স্পন্দিত হবে ভূলোক। শুরু হবে সত্যযুগ এবং প্রতিষ্ঠিত হবে ধর্ম।