কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের ১৮ দিন যাবত লক্ষ লক্ষ যোদ্ধার ভোজন রন্ধন করা কিভাবে সম্ভব হয়েছিল? কোন রহস্যে যুদ্ধকালীন সময়ের কোনদিন যোদ্ধাদের ভোজন কখনো কম হয়নি আবার ভোজনের একটি দানাও অপচয় হয়নি? খেয়াল করে দেখবেন, আমাদের ছোট ছোট পরিবারের ভোজন প্রস্তুত করতে গিয়ে আমাদের মায়েরাও সবসময় সঠিকভাবে ভোজনের পরিমান অনুমান করতে পারেন না। তাই কখনো আমাদের রান্না করা খাবার নষ্ট হয় আবার কখনো বা উদ্বৃত্ব থেকে যায়। কিন্তু মহাভারতের যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে না কোনদিন সৈন্যদের ভোজনে কম পড়েছে, না কোনদিন ভোজন উদ্বৃত্ব থেকে গিয়েছে। অথচ এ যুদ্ধে প্রতিদিনই বধিত হয়েছিলেন বিপুল সংখ্যক সেনা। প্রতিদিন প্রাতে যুদ্ধে গিয়ে কতজন যোদ্ধা দিনান্তে ফিরে আসতে পারবেন এবং ভোজন গ্রহণ করবেন তা জানা অসম্ভব ছিল। তবে কিভাবে অনুমান করা হত এই বিশাল সংখ্যক যোদ্ধাদের ভোজনের পরিমান? আর কোন ব্যক্তিই বা এই গুরুদায়িত্ব মাথায় নিয়ে ভোজনের ব্যাবস্থা করেছিলেন? আবার পাণ্ডব পক্ষের ৭ অক্ষৌহিণী সেনা ও কৌরব পক্ষের ১১ অক্ষৌহিণী সেনা এঁরা একসাথে ভোজন গ্রহণ করতেন নাকি তাঁদের জন্য আলাদা আলাদা ভোজনের ব্যবস্থা ছিল? প্রিয় দর্শক, চলুন সবিস্তারে জেনে নেওয়া যাক, মহাভারতের এই গুরুত্বপূর্ণ কাহিনীটি।
মহাভারতের যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন ১৮ অক্ষৌহিণী সেনা। তো যেহেতু সে সময়কার হিসাব পদ্ধতিতে এখনকার মত দশমিক পদ্ধতি ছিল না তাই আগে জানতে হবে অক্ষৌহিণী শব্দ দ্বারা কি পরিমান সৈন্যকে বোঝানো হত।
মহাভারত থেকে জানা যায়, ২১,৮৭০ টি রথ, ২১,৮৭০ টি গজ, ৬৫,৬১০ টি অশ্ব এবং ১,০৯,৩৫০ জন পদাতিক সৈন্য মিলে গঠিত হয় এক অক্ষৌহিণী সেনা।
যদি প্রত্যেকটি রথ, গজ ও অশ্বে একজন মাত্র যোদ্ধাও আরোহণ করে যুদ্ধ করে থাকেন তাহলে প্রত্যেক অক্ষৌহিনীতে যোদ্ধা ছিলেন ২,১৮,৭০০ জন। এবং এই হিসবে ১৮ অক্ষৌহিণী দ্বারা প্রায় ৪০ লক্ষের কাছাকাছি সৈন্য সংখ্যা বোঝানো হয়ে থাকে। তবে চিন্তার বিষয় এই যে, এক একটি রথে একাধিক রথী থাকতে পারেন, একটি হাতির পিঠে একাধিক যোদ্ধা যুদ্ধ করে থাকতে পারেন, আবার এক একটি অশ্বের পিঠে একাধিক আরোহীও থাকতে পারেন। সে হিসেবে অনুমান করা যায় মহাভারতের যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী যোদ্ধার সংখ্যা ৪০ থেকে ৫০ লক্ষের মধ্যে থাকতে পারে।
যাইহোক, এই লক্ষ লক্ষ যোদ্ধার জন্য প্রতিদিন ভোজন সরবরাহ করার জন্য, মোট সৈন্য সংখ্যা সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। এবার আসি ভোজন প্রস্তুত করার কাহিনীতে।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ ছিল পৃথিবীর প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। কারন আর্যাবর্তের এমন কোন রাজ্য বা রাজা ছিলেন না যিনি এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেননি। আর যেহেতু সে সময়টাতে অধর্মের জয়জয়াকার চলছিল তাই কৌরবদের পক্ষেই বেশীরভাগ রাজারাই যোগদান করেছিলেন মিত্রশক্তি হিসবে। আবার রাজনৈতিক কারনে কোন রাজার পক্ষে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ না করাটাও ছিল অসম্ভব। সেকারনে অনিচ্ছার সত্ত্বেও অনেকে যোগ দিয়েছিলেন এই বিরাট যুদ্ধে। কিন্তু দক্ষিণ ভারতের উডুপির রাজা ছিলেন ভ্রাতাদের মধ্যে সংঘঠিত এই যুদ্ধের বিপক্ষে। তিনি জানতেন এই যুদ্ধে ধর্মের প্রতিষ্ঠা হবে বৈকি কিন্তু তার জন্য বিনাশের পরিমানও হবে ব্যাপক। বিপুল সংখ্যক সেনা জীবন হারাবেন এই যুদ্ধে, বহু স্ত্রী হবেন বিধবা এবং বহু সন্তান হবে পিতৃহারা। তাই তিনি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিলেন নিরপেক্ষভাবে।
তো যুদ্ধ শুরুর প্রারম্ভে উডুপির রাজা যখন হস্তিনাপুরে উপস্থিত হলেন তখন পাণ্ডব ও কৌরব উভয়পক্ষ চেষ্টা করেছিলেন তাকে নিজেদের পক্ষে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য। কিন্তু বুদ্ধিমান রাজা সর্বপ্রথমে হাজির হলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দরবারে। শ্রীকৃষ্ণকে তিনি যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করে কিছু কথা বলার আজ্ঞা চাইলেন। শ্রীকৃষ্ণ তাকে অনুমতি দিলে উডুপির রাজা বলা শুরু করলেন, “হে বাসুদেব, আপনি নিশ্চই জানেন কুরুক্ষেত্রের এই যুদ্ধে বিপুল সংখ্যক সেনা অংশগ্রহণ করবেন। কিন্তু প্রতিদিন যুদ্ধের পর রণক্লান্ত এই বিপুল পরিমান যোদ্ধাদের ভোজনের ব্যবস্থা কিভাবে হবে?” ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন, “হে উডুপিরাজ, আপনার প্রশ্নটি নিরর্থক নয়। যোদ্ধাদের ভোজনের বিষয়ে আপনার যদি কোন প্রস্তাব থাকে তাহলে তা আমাকে অবগত করাতে পারেন। ” উত্তরে উডুপির রাজা বললেন, “হে ভগবান, ভাই-ভাইদের মধ্যকার এই যুদ্ধে আমি অংশগ্রহণ করার পক্ষে নই। আমি চাইনা এই যুদ্ধে অংশ নিয়ে আমার সেনারাও বধিত হোক, তাঁদের স্ত্রীরা বিধবা হোক বা তাঁদের সন্তানেরা পিতৃহীন হোক। আবার এই যুদ্ধে অংশ না নিয়েও কোন উপায় নেই। তাই আমার ইচ্ছা, আমি নিরপেক্ষ থেকে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনাদের জন্য ভোজন প্রস্তুত করি। এতে আমার যুদ্ধে অংশগ্রহণ করাও হবে, আবার আমার সেনারা ও তাঁদের পরিবার অক্ষত থাকবে এবং যোদ্ধাদের ভোজনের মত একটা গুরুতর বিষয়েরও সমাধান হবে। ”
উডুপির রাজার বুদ্ধিমত্তা ও প্রস্তাব বিবেচনা করে সন্তুষ্ট হলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। তিনি বললেন, “হে রাজন, এই যুদ্ধে পাচকের দায়িত্ব সামলানোর জন্য ভীমসেন ছিলেন উপযুক্ত ব্যক্তি। তবে তিনি যেহেতু সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবেন, সেহেতু বাস্তবিকভাবেই একজন পাচকের প্রয়োজন বটে। আমি আপনার প্রস্তাব স্বীকার করছি। আপনি আপনার সৈন্যদেরকে যুদ্ধভূমির পরিবর্তে রন্ধনশালায় নিয়ে যান এবং কৌরবপক্ষ ও পাণ্ডবপক্ষ উভয় পক্ষের জন্য ভোজন প্রস্তুত করুন।”
তো কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের শুরুতেই জানা গেল এ যুদ্ধে ১৮ অক্ষৌহিণী সৈন্য অংশ নিতে যাচ্ছেন। সুতারাং যুদ্ধ শুরুর আগের দিন তিনি তার সহযোগীদের নিয়ে ১৮ অক্ষৌহিণী সেনার জন্য রন্ধন করলেন। তিনি এমনভাবে ভোজন রন্ধন করলেন যাতে ভোজনের পরিমান কম হয়ে রণক্লান্ত কোন যোদ্ধা অভুক্ত না থাকেন, আবার ভোজনের পরিমান বেশী হয়ে তা যেন অপচয় না হয়। কিন্তু প্রথম দিনে প্রকৃত যোদ্ধার সংখ্যা জানা থাকায় ভোজনের পরিমান তো অনুমান করা গেল। কিন্তু এর পরে কি হবে? যুদ্ধের এক একটি দিন অতিবাহিত হয় আর হাজার হাজার যোদ্ধা কমতে থাকে যুদ্ধের ময়দান থেকে। কিন্তু তবুও উড়ুপীরাজের প্রস্তুতকৃত ভোজনে না কোনদিন কম হয়েছিল না উদ্বৃত্ব হয়েছিল। ভাববার বিষয় এই যে, আজকের যুদ্ধে কি পরিমান সেনা বধিত হবেন তা না জেনেও কিভাবে উড়ুপীরাজ ভোজন প্রস্তুতের সিদ্ধান্ত নিতেন? তবে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে যুদ্ধের ব্যাস্ততায় এত বড় রহস্য কোনদিনই কারও চোখে পড়েনি।
যুদ্ধ শেষে যুধিষ্ঠির যখন রাজা হলেন, তখন তিনি একদিন উড়ুপীর রাজাকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলেন, “হে রাজন, আপনি যে আঠারো দিন যাবত যুদ্ধরত সেনাদের ভোজনের ব্যবস্থা করলেন অথচ কোনদিন ভোজনের পরিমান কম বা বেশী হল না। কোনদিন কি পরিমান সেনা বধিত হবে তা না জেনেই কিভাবে আপনি এত নিখুঁতভাবে ভোজনের পরিমান নির্দ্ধারণ করতেন?”
উডুপির রাজা বিনীতভাবে মৃদু হাস্য করে বললেন, “মহারাজ, যুদ্ধের শুরুতে এ প্রশ্ন আমার মাথাতেও ছিল। তাই আমি শরণ নিয়েছিলাম অন্তর্যামী ভগবান শ্রীকৃষ্ণের। যেহেতু কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সকল যোদ্ধার ভোজনের দায়িত্ব আমার ছিল, তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভোজনের দায়িত্বও ছিল আমার কাঁধে। তিনি খুব বেশী ভোজন গ্রহণ করতেন না। রাতের ভোজন হিসেবে তিনি আমাকে কিছু সেদ্ধ বাদাম প্রদান করার আজ্ঞা দিয়েছিলেন। তাই আমি একটি পাত্রে কিছু বাদাম তার সামনে রাখতাম। আমি জানতাম ভোজন প্রস্তুতের বিষয়ে তিনি কোন না কোন সংকেত আমাকে নিশ্চই প্রদান করবেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সেই পাত্র থেকে কিছু বাদাম নৈশাহার হিসবে ভক্ষন করে বাকিগুলো রেখে দিতেন। আর আমি গুনে দেখতাম তিনি কি পরিমান বাদাম গ্রহণ করেছেন। যদি তিনি ৫০টি বাদাম গ্রহণ করে থাকেন তাহলে তার পরের দিন আমি ৫০ হাজার সেনার খাবার কমিয়ে দিতাম। আর এভাবে একেবারে নিখুঁতভাবে ভোজনের পরিমান নির্দ্ধারণ করতে পারতাম আমি।”
উডুপির রাজার উত্তর শুনে বিষ্মিত হলেন মহারাজ যুধিষ্ঠির। তিনি বুঝতে পারলেন কুরুক্ষেত্রের এই যুদ্ধবিজয়ে আসলে পাণ্ডবদের কোন কৃতিত্বই নেই। ভগবান শ্রীকৃষ্ণই পালনকর্তা রূপে তাদেরকে বাচিয়ে রেখেছেন আর মহাকালরূপে বাকিদেরকে সংহার করেছেন। আর একারনেই তিনি আগে থেকেই জানতেন কোনদিন কি পরিমান সৈন্য বধিত হবেন এবং সবশেষে কারা যুদ্ধ জয় করবেন এবং বেঁচে থাকবেন।