You are currently viewing হিন্দু নারীদের মাসিক ধর্ম পালনের সময়  ধর্ম-কর্ম, আচার-ব্রত, পূজা-পার্বণ, ধর্মীয় স্থানে প্রবেশ বিধি

হিন্দু নারীদের মাসিক ধর্ম পালনের সময় ধর্ম-কর্ম, আচার-ব্রত, পূজা-পার্বণ, ধর্মীয় স্থানে প্রবেশ বিধি

রজঃস্বলা বা ঋতুমতি নারীকে নিয়ে জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। কারও মতে মাসিক রজস্রাব একটি স্বাভাবিক শরীরবৃত্তিয় প্রক্রিয়া তাই এসময় কোণ বাধা নিষেধের প্রয়োজন নেই। আবার কারও মতামত ঠিক এর উলটো। তবে বেশীরভাগ মানুষের মনে এই বিষয়টি নিয়ে নানাবিধ প্রশ্ন এবং সংশয়। তো আমরাও জানতে চাই রজঃস্বলা নারী সুচি নাকি অশুচি?

রজঃস্বলা অবস্থায় ধ্যান-জপাদি উচিত কি না?

ঋতুমতি অবস্থায় ঈশ্বর সাধনা নিষেধ কি না?

রজঃস্বলা অবস্থায় কোনো স্ত্রীলোক দীক্ষা গ্রহণ করতে পারেন কি না?

রজঃস্বলা দেহে ঈশ্বর সাধনা সঙ্গত কি না?

রজঃস্বলা নারীর পক্ষে ঠাকুর ঘর, দেবমন্দির প্রভৃতিতে প্রবেশ করা কিংবা দেববিগ্রহাদি স্পর্শ করা উচিত কি না?

রজঃস্বলা নারী নিজ গুরুদেবের পাদস্পর্শ করে প্রণাম করতে পারেন কি না?

এরকম বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর “অখণ্ড সংহিতা”র ৫ম খন্ড তথা অখণ্ডমণ্ডলেশ্বর শ্রীশ্রী স্বামী স্বরূপানন্দ পরমহংসদেবের উপদেশ ও বাণীর সংকলন হতে আজ আমরা জানব।

তো চলুন দর্শক, মেয়েদের ঋতুস্রাবের সময় ধর্ম-কর্ম, আচার-ব্রত, পূজা-পার্বণ, ধর্মীয় স্থানে প্রবেশ ইত্যাদি বিষয়ে কি বলেছেন এই মহাপুরুষ?

 

প্রশ্ন — আচ্ছা, রজঃস্বলা নারীকে অপবিত্র বলে মনে করা হয় কেন? প্রত্যহই তো আমরা স্ত্রীপুরুষ প্রত্যেকে মলমূত্র ত্যাগ করছি, কই সেজন্য তো আমাদিগকে অশুচি বলে মনে করা হয় না! মলমূত্র-স্রাবের মত রজঃস্রাবও একটা স্বাভাবিক ব্যাপার মাত্র।

স্বামী স্বরূপানন্দ বললেন — মলমূত্র ত্যাগ করলেও তোমাকে অশুচি মনে করা হয়, যতক্ষণ না তুমি শৌচক্রিয়া সমাপন করছ। বস্ত্র পরিবর্তন করা বা কোমর-জলি করা প্রভৃতি সম্পর্কে নানা অঞ্চলে নানা মত আছে, কিন্তু শৌচ না করা পর্যন্ত তুমি সকল অঞ্চলের লোকের মতানুসারেই অশুচি ও অস্পৃশ্য। তার মানসিক কারণ হচ্ছে, শৌচ না করা পর্যন্ত মলমূত্র-ত্যাগকারীর মন নিম্নাঙ্গে থাকে। রজঃস্বলা নারীকেও অপবিত্র মনে করার মানসিক কারণ উহাই। রজো নিঃস্রাবের দিবসত্রয় তার মন নিম্নাঙ্গেই থাকে। মন যখন নিম্নাঙ্গ-বিহারী, তখন সে অল্প হোক বা বেশী হোক পশুভাব পায়। আর যার পায় না তাকে সাধারণ মানব-মানবীর চেয়ে উঁচু থাকের লোক বলে জানতে হবে।

আরও পড়ুনঃ  সপ্তর্ষি কি এবং কারা? যুগ, মহাযুগ, মনন্ত্বর, কল্প ও পরযুগের সপ্তর্ষিবৃন্দ || Saptarshi- Seven Sages

প্রশ্ন — রজঃস্বলা অবস্থায় ধ্যান-জপাদি উচিত কি না?

স্বামী স্বরূপানন্দ উত্তর দিলেন — আমি তো মোটেই অনুচিত মনে করি না। আমার শিষ্যাদেরকে আমি ঋতুর তিন দিনও আত্মকার্য করতে উপদেশ দেই। ঐ তিন দিন দেহের উপর দিয়ে একটা বিপর্যয় যায় বলে দৈহিক বিশ্রাম দরকার। কিন্তু ভগবানকে ডাকতে বাধা থাকা অনুচিত।

প্রশ্ন — অনেক সাধকেরাই যে ঋতুমতি অবস্থায় সাধনা নিষেধ করেন! এ বিষয়ে আপনি কি বলবেন?

স্বামী স্বরূপানন্দ বললেন — সান্ধ্যোপাসনার অঙ্গীভূত আসন-মুদ্রাদির অভ্যাস করতে আমিও নিষেধ করি। তবে তার কারণ হচ্ছে, এই সময়ে দৈহিক বিশ্রামের প্রয়োজন খুব বেশি। কিন্তু ধ্যান ও নামজপে নিষেধ করি না। দেহ রুগ্ন হলে গুরুপাক পথ্য বর্জন করে সব ডাক্তারই লঘুপাক পথ্য দেন, এখানেও ব্যাপারটা তাই। তবে এখানে কথাটা হচ্ছে মানসিক পথ্যের। রজঃস্বলা অবস্থায় গুরুতর মানসিক পরিশ্রম করলে স্রাবের স্বাভাবিক গতি পরিবর্তিত হতে পারে, তাতে জরায়ুর বা মস্তিস্কের রক্তাধিক্য বা রক্তাল্পতা ঘটতে পারে। এজন্যই কঠোর কৃচ্ছ্রমূলক ধ্যানজপাদি এই সময়ে না করাই শ্রেয়। কিন্তু আমাদের সাধন বড় সহজ সাধন, দেহ-মনের উপর এমন কোনো উৎপীড়ন বা জবরদস্তি এই সাধনে নেই, যাতে রুগ্ন অবস্থাতেও তার কোনো প্রতিক্রিয়া হতে পারে। এজন্যই রজঃস্বলা অবস্থায় সাধন বন্ধ রাখতে আমি কখনো উপদেশ দিই না।

 

প্রশ্ন — রজঃস্বলা অবস্থায় কোনো স্ত্রীলোক দীক্ষা গ্রহণ করতে পারেন কি না?

স্বামী স্বরূপানন্দের উত্তর — সাধারণ অবস্থায় পারে না। কিন্তু এমন অসাধারণ অবস্থায় উদয় রমণীর হতে পারে, যে সময়ে দেহ রজঃস্বলা হলেও তাকে অপবিত্র মনে করা ভ্রম। তেমন স্ত্রীলোকের দীক্ষা সর্বসময়েই হতে পারে।

 

প্রশ্ন — সদগুরুকে তো সর্বশক্তিমান বলে মানা হয়। রজঃস্বলা নারীকে স্পর্শমাত্র বা দৃষ্টিমাত্র তিনি কি পবিত্র করে নিতে পারেন না? তখন কি তাকে দীক্ষা দেওয়া চলে না?

আরও পড়ুনঃ  জামাই ষষ্ঠী কি? জামাইয়ের সাথে দেবী ষষ্ঠীর কি সম্পর্ক? Jamai Shashthi Vrat Katha || ব্রতকথা ||

স্বামী স্বরূপানন্দ — নিঃসন্দেহে সদগুরুর বাক্য, দৃষ্টি বা স্পর্শ শিষ্যকে পবিত্র করে তোলে। কিন্তু রজঃস্বলা নারীকে দীক্ষাদান প্রচলিত সদাচারের বিরোধী। নিষ্প্রয়োজনে বা সামান্য প্রয়োজনে এই সদাচার লঙ্ঘন করা উচিত নয়।

 

প্রশ্ন — অপবিত্র দেহে কি ঈশ্বর সাধনা কি সঙ্গত?

স্বামী স্বরূপানন্দ উত্তর দিলেন — সাধারণতঃ দেহের পবিত্রতা বিধান করে নিয়েই পরমাত্ম-সাধনে বসা উচিত। কারণ, দেহকে শুচি করতে গেলেই মনও স্বভাবতই একটা শুচিতা প্রাপ্ত হয়, দেহের শুদ্ধি-বিধানের চেষ্টায় মনেরও শুদ্ধি-বিধান ঘটে। বিশেষ-বিশেষ নির্দিষ্ট সময় গুলিতে সাধন-ভজন করতে বসলে এই জন্যই নির্মল দেহ, বিধৌত বস্ত্র, পবিত্র আসন ও শুচি স্থানের প্রয়োজন। কিন্তু অহর্নিশ যে ভগবানকে ডাকবে, তার দৃষ্টি শুচি-অশুচির দিকে না গিয়ে নিরন্তর ভগবানেরই দিকে থাকা উচিত। ধ্যান-জপের নির্দিষ্ট সময় গুলিতে স্থানের, আসনের, বস্ত্রের ও দেহের শুদ্ধি রক্ষা করে অপর সকল সময়ে বাহ্য শুদ্ধির আড়ম্বরের দিকে উদাসীন থেকে নিজ সাধন করে যাওয়া কর্তব্য।

 

প্রশ্ন — রজঃস্বলা অবস্থাতে তো নির্দিষ্ট সময় গুলিতে দৈহিক শুচিতা রক্ষার চেষ্টা চলতে পারে?

স্বামী স্বরূপানন্দ বললেন — পারে, কিন্তু সাধারণের পক্ষে নয়। নিজ জরায়ুর উপরে ইচ্ছাশক্তির প্রয়োগ করে যেকোনো সময়ের জন্য রজঃস্রাবকে স্তব্ধ করে রাখার সামর্থ্য অনেক সাধিকারই থাকে। কিন্তু এ সামর্থ্যের প্রয়োগ মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। স্বভাবের পথে প্রত্যেক নারীর দেহে তিন-দিবস ব্যাপী যে বিপর্যয় আপনি আসে, তার উপরে ঔষধের বলেই হোক আর ইচ্ছার বলেই হোক, কোনো নির্যাতনই দেহের ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্যের পক্ষে মঙ্গলজনক নয়। রজঃস্বলা হয়েছে বলেই কোনো নারীর উচিত নয় নিজেকে অপরাধিনী মনে করা। মাঝে মাঝে নিদ্রাযোগে কিঞ্চিৎ শুক্র-ক্ষরণ হয়ে যাওয়া যেমন অধিকাংশ পুরুষের পক্ষে একটা স্বাভাবিক ব্যাপার মাত্র, তেমনি মাসে একবার করে ঋতুমতী হওয়াও রমণীমাত্রেরই পক্ষে একান্ত স্বাভাবিক। এজন্য নিজেকে অপরাধিনী বা হেয় মনে করাও যেমন ভুল, ঋতুস্রাবকে বন্ধ করে রাখবার চেষ্টাও তদ্রুপ ভুল।

আরও পড়ুনঃ  বদ্রীনাথ মন্দিরের ৫ অজানা তথ্য

 

প্রশ্ন — রজঃস্বলা নারীর পক্ষে ঠাকুর ঘর, দেবমন্দির প্রভৃতিতে প্রবেশ করা কিংবা দেববিগ্রহাদি স্পর্শ করা উচিত নাকি উচিত নয়?

স্বামী স্বরূপানন্দের উত্তর — প্রাণের আবেগের দিক দিয়ে দেখতে গেলে অনুচিত বলব না। কিন্তু সমগ্র দেশের সাধারণ সদাচারের বিধি উলঙ্ঘন করে এই অবস্থায় এরূপ না করাই সঙ্গত। দেবতা নিত্য-পবিত্র, তিনি কি কখনো অপবিত্র হন? কিন্তু যে বিগ্রহ একা আমারই পূজার জন্য নয়, যে বিগ্রহের মধ্যবর্ত্তিতায় আরো অনেক মানবাত্মা আধ্যাত্মিক সাধন করে জীবনকে সার্থক করতে চান, তার উপরে আমার একার দাবী খাটাতে যাওয়াটা কি সঙ্গত?

প্রশ্ন — বিগ্রহটি বা পূজার ঘরটি যদি ঐ রমণীর একার জন্য হয়?

স্বামী স্বরূপানন্দ উত্তর দিলেন— তাহলে কোনো বিধিও নেই, নিষেধও নেই। ভক্তের প্রাণ যখন যা চায়, তখন তাই করতে পারে। তথাপি, সদাচার সদাচারই। সদাচার লঙ্ঘন করা সঙ্গত নয়।

প্রশ্ন — রজঃস্বলা নারী কি নিজ গুরুদেবের পাদস্পর্শ করে প্রণাম করতে পারে না? তার যদি জ্ঞান থাকে যে, গুরুদেবই সর্বদেবদেব?

স্বামী স্বরূপানন্দ — তিনটি দিন বই ত নয়! আর্য-সদাচার লঙ্ঘন করা আমি নিষ্প্রয়োজন মনে করি।

প্রশ্ন — গুরুদেবের প্রতিমূর্তি স্পর্শ করলে?

স্বামী স্বরূপানন্দ — তাতে নিষেধ নেই, যদি এই প্রতিমূর্তি প্রতিষ্ঠিত বিগ্রহ না হয়ে থাকে।

 

5/5 - (1 vote)

Leave a Reply