You are currently viewing জামাই ষষ্ঠী কি? জামাইয়ের সাথে দেবী ষষ্ঠীর কি সম্পর্ক? Jamai Shashthi Vrat Katha ||  ব্রতকথা ||

জামাই ষষ্ঠী কি? জামাইয়ের সাথে দেবী ষষ্ঠীর কি সম্পর্ক? Jamai Shashthi Vrat Katha || ব্রতকথা ||

জামাই ষষ্ঠী কি? জামাইয়ের সাথে মা ষষ্ঠীর কি সম্পর্ক? দেবী ষষ্ঠীর জন্মকথা, ব্রতকথা।

মিষ্টির হাঁড়ি হাতে নিয়ে ফিনফিনে সাদা মসলিনের পাঞ্জাবি আর মালকোচা মারা ধুতি পরে জামাই বাবাজি নামলেন শ্বশুর বাড়ির পথে। সঙ্গে রয়েছেন লজ্জাবতীর লতার মত নুইয়ে থাকা নববধুটিও। পরনে তাঁর টুকটুকে লাল রঙের শাড়ী আর মাথায় লম্বা ঘোমটা।

মেয়ে জামাই এলো দোরে

শঙ্খ ধ্বনি বাজল ঘরে

পড়শিরা সব এলো দলে

নতুন জামাই দেখবে বলে।

পঞ্চব্যঞ্জনে সাজনো হল জামাইয়ের পাত। আম-কাঁঠাল, ইলিশের পেটি কিংবা কচি পাঠাঁর মাংস সহযোগে বিরাট এক ভুরিভোজ ৷ শ্বাশুড়িদের হাতপাখায় জামাইকে হাওয়া দেওয়া আর শান্তি জলের ছিটে। এ হল আবহমান বাঙালী হিন্দু সমাজের জামাই ষষ্ঠীর চিরায়াত চিত্র। কিন্তু, কী এই জামাই ষষ্ঠী? বাড়ির জামাইয়ের সাথে দেবী ষষ্ঠীর সম্পর্কটা কি? কিভাবে আবির্ভাব হল এই জামাই ষষ্ঠীর? বেদ, পুরাণ বা অন্যান্য সনাতন ধর্মীয় গ্রন্থে কি এই প্রথার উল্লেখ রয়েছে? বঙ্গ সংস্কৃতির সঙ্গেই বা কীভাবে জড়িয়ে গেল এই জামাই ষষ্ঠী? তাছাড়া কি কারণে  নবদ্বীপে নিমাই এর বিগ্রহ কে কেন্দ্র করে আজও আয়োজন করা হয় জামাই ষষ্ঠীর? এসকল প্রশ্নের উত্তর নিয়ে হাজির সনাতন এক্সপ্রেস। আজ আপনার জন্য থাকছে শহুরে আধুনিকতার নামে হারিয়ে যেতে বসা বাঙালীর এক মধুময় উৎসবের আদ্যোপান্ত। আশা করি শেষ পর্যন্ত আমাদের সাথেই থাকবেন।

সুজলা, সুফলা ভারতবর্ষের প্রতিটি ঋতুই নব নব রূপ রস, গন্ধ ধারন করে নানা উপাচারে সাজিয়ে উপহার দেয় আমাদেরকে। শীতকালে বাহারী সবজি, বর্ষার নদী-খালে অজস্র মাছ এবং গ্রীষ্মে কাচা পাকা সুস্বাদু ফলের পসরা নিয়ে আসে প্রকৃতি। তাই গ্রীষ্মকে বেছে নেওয়া হয়েছে জামাই আদরের মৌসুম হিসেবে।

জ্যৈষ্ঠ মাসে অরণ্য ষষ্ঠী,ষাট ষাট ষাট

শ্রাবণ মাসে লোটন ষষ্ঠী,ষাট ষাট ষাট

ভাদ্র মাসে মন্থন ষষ্ঠী,ষাট ষাট ষাট

আশ্বিন মাসে দুর্গা ষষ্ঠী,ষাট ষাট ষাট

অঘ্রাণ মাসে মূলা ষষ্ঠী,ষাট ষাট ষাট

পৌষ মাসে পাটাই ষষ্ঠী, ষাট ষাট ষাট

মাঘ মাসে শীতল ষষ্ঠী,ষাট ষাট ষাট

চৈত্র মাসে অশোক ষষ্ঠী,ষাট ষাট ষাট

বারো মাসে তেরো ষষ্ঠী ষাট ষাট ষাট

এই বারো মাসের তেরো ষষ্ঠীর মধ্যে জৈষ্ঠ্য মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিকেই বলা হয় জামাই ষষ্ঠী। তবে একে অরণ্য ষষ্ঠী, শুক্লা ষষ্ঠী ইত্যাদি নামেও ডাকা হয়ে থাকে। এদিন খুব ঘটা করে দেবী ষষ্ঠীর পুজো করেন শাশুড়িরা ৷ অন্যান্য ষষ্ঠীর মতো এই ব্রততেও উল্লেখযোগ্য হল পুজোর ডালি। কাঁঠালপাতার উপর থরে থরে সাজানো করমচা ফল-সহ পাঁচ, সাত বা নয় রকমের ফল, ১০৮ গাছা দূর্বা এবং আরও হরেক রকমের উপাচারে সাজানো হয় জামাইষষ্ঠীর পুজোর ডালি। ষষ্ঠীপুজো উপলক্ষ্যে শ্বাশুড়িরা ভোরবেলা স্নান করে ঘটে জল ভরে আনেন এবং ঘটের ওপর স্থাপন করেন আম্রপল্লব। সঙ্গে থাকে একটি তালপাতার পাখা। একটি সুতো হলুদে রাঙিয়ে তাতে ফুল, বেলপাতা দিয়ে গিট বেঁধে সাজিয়ে রাখা হয় জামাই বাবাজির কবজিতে বাঁধার জন্য। এর পর শুরু হয় মা ষষ্ঠীর পুজো।  তার আগে সকালে ওই পুজোর ডালি নিয়েই পুজো দিয়ে আসতে হয় মা ষষ্ঠীর থানে। ব্রতকথা পাঠের পরে সবাইকে বাতাস দিয়ে, হাতে ষষ্ঠীর সুতো বেঁধে তবেই উপবাস ভঙ্গ করেন বাড়ির গৃহিণী।

আরও পড়ুনঃ  পণ্ডিত চাণক্যের ৬৫টি জীবন বদলে দেওয়া বাণী - চাণক্য নীতি

তারপর নেমন্তন্ন করে নিয়ে আসা জামাইকে বসানো হয় আসনে। কপালে দইয়ের ফোঁটা, মাথায় ধান-দূর্বা এবং হাতের কবজিতে তেল-হলুদে চোবানো সুতো বেঁধে সম্পন্ন হয় আশীর্বাদ প্রদান ও দীর্ঘজীবনের কামনা। এরপর আসে আশীর্বাদী বস্ত্রাদি প্রদান, ফল-মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন ইত্যাদি ৷এর পাশাপাশি চলে জামাইবাবুর সঙ্গে শ্যালক-শ্যালিকার রঙ্গ রসিকতা। তবে অঞ্চল ভেদে আচার অনুষ্ঠানের ভিন্নতাও লক্ষ্য করা যায় জামাই ষষ্ঠীর উৎসবকে কেন্দ্র করে।

কিন্তু যে ষষ্ঠীদেবীকে  কেন্দ্র করে এত আয়োজন, তিনি কিন্তু বৈদিক দেবী নন। বরং বাংলার মানুষের হৃদমাঝারে অবস্থান করা এক লৌকিক দেবী হচ্ছেন এই মা ষষ্ঠী। প্রচলিত বিশ্বাস মতে, তাঁর কৃপায় বন্ধ্যা মায়ের কোল জুড়ে আসে সন্তান, সংসারে আসে সমৃদ্ধি, এবং চাষাবাদে আসে সুফল। দেবী ষষ্ঠীর পুজো নিবেদন করা হয় মূর্তিতে, ছবিতে বা ঘটে। মুর্তিকল্পে তিনি তাঁর বাহন বিড়ালের পিঠে আসীন, কোলে সন্তান এবং হাতে বরাভয়।   সাধারনত ষষ্ঠীর থানেই বা ষষ্ঠীতলাতেই পূজিতা হয়ে থাকেন এই লৌকিক দেবী। জেনে রাখা ভালো মধ্যযুগ হচ্ছে মঙ্গলকাব্যের রচনাকাল। সেই সময় থেকেই বাংলায় এই রীতির প্রচলন হয়েছে বলে মনে করেন পণ্ডিতগণ। শ্বশুরবাড়িতে মেয়ের দিনগুলো যাতে মসৃণ হয়, সেই ভাবনা থেকেই জামাইষষ্ঠী বা জামাইবরণ। পাশাপাশি শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে জামাইয়ের সম্পর্ককে সুদৃঢ় করার ইচ্ছে লুকিয়ে আছে এই লৌকিকতার পিছনে। সেইসঙ্গে কন্যা যাতে নিঃসন্তান না হয়, সেই প্রার্থনাও করা হয় মা ষষ্ঠীর কাছে।

তাই সবদিক দিয়ে দেখতে গেলে দেবী ষষ্ঠী উর্বরতার দেবী, সন্তান কামনা, শ্বশুড়বাড়ির সাথে সাথে জামাইয়ের সম্পর্কের উন্নয়ন, এবং শাশুড়ি কন্যা এবং জমাইয়ের মধ্যে অটুট বন্ধন তৈরি করতেই এই লোকাচারের উদ্ভব। আর যেহেতু জৈষ্ঠ্য মাস মধুময় রসালো ফলের মাস তাই এই মাসের শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিকেই বেছে নেওয়া হয়েছে জামাই ষষ্ঠীর তিথি হিসেবে।

এবার জেনে  নেওয়া যাক নবদ্বীপের নিমাইয়ের বিগ্রহকে কেন্দ্র করে জামাই ষষ্ঠীর আয়োজন করা হয় কেন?

শুনতে অবাক লাগলেও জ্যৈষ্ঠমাসের শুক্লপক্ষে মহাপ্রভু মন্দিরে পালিত হয় জামাই ষষ্ঠী। তবে সেদিন তিনি আর শ্রীকৃষ্ণের অবতার বা মহাপ্রভু নন, বরং সেদিন নিমাই তাঁদের জামাই। আপনারা অনেকেই হয়ত জানেন না, নবদ্বীপের এই মন্দিরের সেবায়েতরা বংশপরম্পায় বিষ্ণুপ্রিয়ার ভাইদের উত্তরপুরুষ। তাই প্রায় সাড়ে তিনশো বছর ধরে এই তিথিতে শ্রীচৈতন্যদেবের বিগ্রহকে তাঁরা জামাই হিসেবে আপ্যায়ন করে আসছেন। স্থানীয় প্রবীণারা মহাপ্রভুকে ষাটের বাতাস দেন। হাতে পরিয়ে দেন সুতো। বিগ্রহের পরনে নতুন পোশাকের সঙ্গে থাকে রাজসিক ভোগের আয়োজন। রুপোর রেকাবিতে মৌসুমি ফল, রুপোর বাটিতে ক্ষীর, রুপোর গ্লাসে জল দিয়ে ঘুম ভাঙানো হয় মহাপ্রভুর। তার পর থাকে চিঁড়ে, মুড়কি, দই, আম, কাঁঠাল ও মিষ্টির ফলাহার। মধ্যাহ্নভোজে নানা তরকারি, ডাল, ভাজা, থোড়, বেগুন পাতুরি, ছানার ডালনা, ধোকার ডালনা, লাউ, চালকুমড়ো এবং পোস্ত দিয়ে রাঁধা যায় এমন সব রকমের নিরামিষ পদ। দিবানিদ্রার পরে বিকেলে নিমাইয়ের উত্থানভোগে থাকে ছানা আর মিষ্টি। রাতে শয়ানের আগে গাওয়া ঘিয়ের লুচির সঙ্গে মালপোয়া আর রাবড়ি। সবার শেষে সুগন্ধি দেওয়া খিলি পান। তবে এই মন্দিরের জামাইষষ্ঠী-ভোগের বিশেষত্ব হল আমক্ষীর। গাছপাকা আমের রস ক্ষীরের সঙ্গে পাক দিয়ে তৈরি হয় এই পদ।

আরও পড়ুনঃ  পুত্রের যৌবন কেড়ে নিয়ে উপভোগ করলেন পিতা, পুত্র হলেন অকাল বৃদ্ধ। যযাতি, দেবযানী, ও শর্মিষ্ঠার প্রেম।

 

এবার আসুন জেনে নেওয়া যাক, এই জামাই ষষ্ঠী প্রথার উদ্ভব কিভাবে হল?

তবে এটা জানতে হলে আমাদেরকে ফিরে যেতে হবে সনাতন সমাজের সেঁকেলে আমলে। যেখানে মেয়ে মানেই ‘অন্তঃপুরবাসিনী’। সে যুগে ভারতবর্ষ তথা দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে একটা প্রচলিত সংস্কার ছিল। সেই সংস্কার অনুযায়ী কন্যা যতদিন না পুত্রবতী হয় ততদিন কন্যার পিতা-মাতা কন্যাগৃহে পদার্পণ করবেন না ৷ এর ফলে সন্তানধারণে সমস্যা বা সন্তান মৃত্যুর ফলে কন্যার পিতামাতাকে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করতে হত বিবাহিত কন্যার বাড়ি যাওয়ার জন্য । আবার একা একা বাড়ি থেকে বাড়ির বউ বেড়িয়ে বাপের বাড়ি যাবে এটাও একেবারে অসম্ভব ছিল সেকালে। পক্ষান্তরে কেউ মনে করেন, দূরে দূরে বিয়ে হওয়ার কারণে অথবা পরিবহন ব্যাবস্থার অপ্রতুলতার কারনে মেয়েরা একা বাবার বাড়িতে আসতে পারত না। তাই ষষ্ঠী পুজোর ছলে জামাই বরণ ও মেয়েকে দেখার সাধ মিটত বাবা-মায়ের। তৃতীয় একটি মত হল, জামাইকে পরিবারের ছেলের সমান মর্যাদা দানের জন্যই তথা তাঁর হাতে তেল-হলুদে চোবানো সুতোর গিঁট বেঁধে একাত্মীকরণ করার জন্যই উদ্ভব হয়েছিল জামাই ষষ্ঠীর।

 

জামাই ষষ্ঠী বা অরণ্য ষষ্ঠীর ব্রতকথাঃ

জামাই ষষ্ঠী বা অরণ্য ষষ্ঠীর ব্রতকথা অনুসারে যে কাহিনীটি প্রচলিত, সেখান থেকে জানা যায় এক পরিবারে ছিল দুটি গৃহবধু ৷ তাঁদের মধ্যে ছোট বউটি ছিল খুবই লোভী এবং একাসেড়ে ৷ বাড়িতে মাছ বা অন্যান্য ভাল খাবার রান্না হলেই ছোটবউ লুকিয়ে সেগুলো ভক্ষণ করত এবং শাশুড়ির কাছে অভিযোগ করত ‘সব খাবার কালো বিড়ালে খেয়ে নিয়েছে ’৷এভাবে চলতে লাগল বেশ কিছুকাল। এদিকে মথ্যা অভিযোগে বিড়ালটিও বিরক্ত হয়ে উঠল এক পর্যায়ে। তাই স্বয়ং মা ষষ্ঠীর বাহন বিড়াল চলল মা ষষ্ঠীর কাছে ৷তারপর মা ষষ্ঠীর কাছে এই মিথ্যা অভিযোগের প্রতীকার চাইল বিড়ালটি৷ অভিযোগ শুনে মা ষষ্ঠী এর একটি বিহিত ব্যাবস্থা করার আশ্বাস দিলেন বিড়ালটিকে৷ এরপর সেই ছোট বউ-এর একটি করে সন্তান হয় আর মা ষষ্ঠী তার প্রাণ হরণ করেন ৷ এইভাবে ছোট বউয়ের সাত পুত্র ও এক কন্যাকে হরণ করে নেন বিড়ালবাহিনী মা ষষ্ঠী৷ ফলে ছোট বউ এর কপালে জুটল লঞ্ছনা আর তিরষ্কার। এক পর্যায়ে স্বামী, শাশুড়ি ও অন্যান্যরা মিলে তাকে অলক্ষণা অপবাদ দিয়ে তাড়িয়ে দিলেন বাড়ি থকে।

অগত্যা মনের দুঃখে ছোট বউ চলে গেলেন বনে। একাকী একটি ঝোপের মধ্যে বসে উচ্চস্বরে কাঁদতে থাকেন তিনি ৷ তাঁর কান্না শুনে ছুটে এলেন এক বৃদ্ধা। জানতে চাইলেন তাঁর কান্নার কারন। ছোট বউ বৃদ্ধাটিকে তাঁর এই করুণ পরিনতির কথা সবিস্তারে বর্ণনা করলেন। সব শুনে বৃদ্ধা বললেন, “তোমার নিজের অপকর্ম একটি নিরীহ বিড়ালের কাঁধে চাপানোর ফলেই আজ তোমার এই অবস্থা।” এবার চকিত হয়ে উঠলেন ছোট বউ, বিড়ালের কথা তো সে নিজে ছাড়া আর কেউ জানে না। তাহলে কে এই বৃদ্ধা? তিনি বৃদ্ধার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই বৃদ্ধার বেশ ছেড়ে বেরিয়ে এলেন স্বয়ং মা ষষ্ঠী। ছোট বউ তৎক্ষণাৎ তাঁর ভুল বুঝতে পেরে লুটিয়ে পড়লেন দেবীর পদতলে। করুণাময়ী দেবীও তাঁকে ক্ষমা করে ফিরিয়ে দিলেন সাত পুত্র ও এক কন্যাকে। ছোট বউ তাঁর ৮ সন্তানকে নিয়ে বুক ফুলিয়ে ফিরে এলেন গৃহে আর চারিদিকে প্রচারিত হল মা ষষ্ঠীর এই ব্রতকথা।

আরও পড়ুনঃ  কামরূপ কামাখ্যাঃ যোনি পূজা, তন্ত্র-মন্ত্র, ইতিহাস ও পুরাণ || The Untold Mysteries of Kamrup Kamakhya

ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে মা ষষ্ঠীর আখ্যান

তবে মা ষষ্ঠীকে লৌকিক দেবী হিসেবে আখ্যায়িত করা হলেও পুরাণেও তাঁর অস্তিত্ব বিদ্যমান। তাই এবার ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ মতে মা ষষ্ঠীর আখ্যানটি জেনে নেওয়ার পালা। স্বায়ম্ভুব মনুর পুত্র প্রিয়ব্রত সমগ্র পৃথিবীর রাজা হলেও তাঁর রাজকাজে একেবারেই মন নেই। বিবাহ করে সংসার ধর্ম পয়ালন করার পরিবর্তে সারাক্ষণ জপে-তপে ও ধ্যানে-জ্ঞানে মগ্ন থাকতেন প্রিয়ব্রত। প্রিয়ব্রতের এই বৈরাগ্য দশা দেখে পরমপিতা ব্রহ্মা স্বয়ং প্রিয়ব্রতর কাছে এসে বললেন, হে প্রিয়ব্রত, তোমার বৈরাগ্য হয়েছে, ভালো কথা। কিন্তু হে পুত্র, সৃষ্টিকে অগ্রসর করতে অবিলম্বে সংসার করারও প্রয়োজন। ব্রহ্মার এমন সস্নেহ ভর্ৎসনায় প্রিয়ব্রত লজ্জিত হলেন। এবং, অবিলম্বেই ব্রহ্মাবাক্য শিরোধার্য করে মালিনী নামের এক সুলক্ষণা কন্যাকে বিবাহ করে ফেললেন তিনি।

এরপর দিনের আসে দিন যায় কিন্তু রানি মালিনী কিছুতেই আর সন্তানবতী হন না। বছরের পর বছর সন্তানের পিতা ডাক শুনতে পেলেন না তিনি। অবশেষে অনেক বছর পর অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে মালিনী প্রসব করলেন একটি পুত্রসন্তান। পুত্রটি সর্বগুণলক্ষণযুক্ত, কিন্তু প্রাণহীন। ফলে, রাজপুরীতে যেখানে আনন্দের বানে ভেসে যাওয়ার কথা, সেখানে তা ডুবে গেল শোকের সাগরে। অন্তঃপুরে কান্নার রোল উঠল সমস্বরে। রানি বার বার মূর্ছা যেতে লাগলেন এবং প্রিয়ব্রতও শোকে একেবারে মুহ্যমান হয়ে গেলেন।

যে সন্তান আজ রাজপ্রাসাদে খেলে বেড়াবে তাঁকে নিয়ে চিতায় তুললেন প্রিয়ব্রত। কিন্তু বারংবার চেষ্টা করেও তাঁর চিতায় আগুন দিতে পারলেন না তিনি। অবশেষে তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন পুত্রের চিতায় তিনি নিজেও পুড়বেন। তাই আপন তরবারি কোষমুক্ত করে নিজেকে হত্যা করতে উদ্যত হলেন প্রিয়ব্রত। কিন্তু সেই মুহূর্তেই, শাদা অথচ নানাবিধ রত্নখচিত রথে এক দেবীকে আকাশ থেকে নেমে আসতে দেখে হতভম্ব হয়ে থমকে দাড়ালেন প্রিয়ব্রত। সাদা চাঁপাফুলের মতো দেবীর গায়ের রঙ, পরনে ক্ষৌমবস্ত্র, অঙ্গে ফুলমালার সজ্জা, মুখে প্রসন্নময়ীর হাসি। দেবীকে একেবারে সামনে দেখে প্রিয়ব্রত বুকের সন্তান মাটিতে নামিয়ে করজোড়ে বন্দনা করে বললেন, হে দেবী, আপনি কে?

দেবী বললেন “ প্রকৃতির ষষ্ঠ অংশ থেকে আমার জন্ম। তাই সকলেই আমাকে ‘ষষ্ঠী’ বলে ডাকে। আমি পুত্রহীনকে পুত্র দান করি, প্রিয়হীনকে প্রিয়বস্তু দান করি, দরিদ্রকে ধন দান করি এবং ক্রিয়াহীনকে শুভকর্মের দিশা প্রদর্শন করি।” এই বলে দেবী প্রিয়ব্রতের মৃতপুত্রকে কোলে নিয়ে প্রাণ ফিরিয়ে দিলেন তাঁর।  তারপর শিশুটিকে কোলে নিয়েই রথে চেপে স্বর্গের দিকে উড়াল দিলেন দেবী। আচম্বিতে এমন অদ্ভুত ব্যাপার দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন প্রিয়ব্রত। তারপর হুঁশ ফিরতেই কাকুতিমিনতি করে এবং দেবীর স্তব করে পুত্রকে ফিরিয়ে দেওয়ার আবেদন করলেন দেবীর কাছে। দেবী তপখন তুষ্ট হয়ে স্থির হলেন। বললেন, হে প্রিয়ব্রত, তুমি স্বয়ম্ভুব মনুর পুত্র, তুমি যদি ধরায় আমার পুজোর প্রচলন করো তাহলে তোমার সন্তান তোমায় ফিরিয়ে দেব। আমার বরে তোমার পুত্র হয়ে উঠবে সকল বিষয়ে গুণবান। পৃথিবীতে ‘সুব্রত’ নামে বিখ্যাত হবে তোমার সন্তান। প্রিয়ব্রত আনন্দের সঙ্গে কথা দিলেন যে, তিনি অবিলম্বেই দেবীর পূজাবিস্তারের ব্যবস্থা করবেন। তাঁর এই সংকল্পে সন্তুষ্ট হয়ে পুত্র অর্পণ করে সানন্দে স্বর্গে ফিরে গেলেন দেবী ষষ্ঠী। আর এভাবেই ধীরে ধীরে সমগ্র ধরাধামে ষষ্ঠী পুজোর প্রসার ঘটল প্রিয়ব্রতের চেষ্টায়।

একবার ভাবুন তো, যে জামাই ষষ্ঠীকে এতদিন আমরা শুধু ভুরিভোজের মহোৎসব হিসেবে জেনে এসেছি, তা পিছনের এত ঘটনা কি আমরা জানতাম?

5/5 - (1 vote)

Leave a Reply