You are currently viewing কালিদাস পণ্ডিতঃ দেবীর বরে গণ্ডমূর্খ থেকে মহাকবি

কালিদাস পণ্ডিতঃ দেবীর বরে গণ্ডমূর্খ থেকে মহাকবি

কবি কালিদাস কয় বাল্যকালের কথা

নয় হাজার তেতুল গাছে কয় হাজার পাতা?

বুঝতেই পারছেন, মহাকবি কালিদাসের হাজারো বুদ্ধিদীপ্ত ধাঁধার মধ্যে এটিও একটি। বস্তুত এসকল ধাঁধার উত্তর দিতে যেমন শাণিত বুদ্ধির প্রয়োজন হয়। তেমনি যিনি এই ধাঁধাগুলো সৃষ্টি করেছিলেন, তিনিও ছিলেন অতুল্য প্রতিভা ও অপরিমিত বিদ্যা-বুদ্ধির অধিকারী।  খুব ছোটবেলা থেকেই বাড়ির বয়োজ্যেষ্ঠ এবং দাদু ঠাকুমা শ্রেণীর মানুষের থেকে মহাকবি কালিদাসের ধাঁধার উত্তর বের করার চ্যালেঞ্জ আমাদের বাঙালী সমাজের সাথে জড়িয়ে গেছে ওতপ্রোতভাবে। তবে ধাঁধার মাধ্যমে আমাদের সাথে কালিদাস পণ্ডিতের পরিচয় হলেও, তিনি ছিলেন প্রাচীন ভারতের এবং সংস্কৃত ভাষার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কবি। কিন্তু যদি বলি বিদ্যা-বুদ্ধি তো দূরে থাক, কালিদাস ছিলেন একজন হদ্দ বোকা এবং গন্ডমূর্খ? তাহলে কেমন হবে আপনাদের অভিব্যাক্তি? পাগলের প্রলাপ মনে হলেও কথা কিন্তু সত্যি। তবে সেই হদ্দ বোকা এবং গণ্ডমূর্খই হয়ে উঠেছিলেন মহাকবি কালিদাস বা কালিদাস পণ্ডিত। আর দুজন দেবী মাতার অপার কৃপায় সম্ভব হয়েছিলে এই অসাধ্য সাধন। আজ সেই কাহিনীই বলতে এসেছি আপনাদের। আশা করি শেষ পর্যন্ত আমাদের সাথেই থাকবেন।

স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আক্ষেপ করে লিখেছিলেন,

আমি যদি জন্ম নিতেম কালিদাসের কালে,

দৈবে হতেম দশম রত্ন  নবরত্নের মালে,

কিন্তু যে কালে মহাকবি কালিদাসের জন্ম হয়েছিল, সেই কালের কোন হদিস কিন্তু আজও পাওয়া যায় নি। বাঘা বাঘা ইতিহাসবিদগণও তার জন্মের সময় সম্পর্কিত তথ্যের ব্যাপারে ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেননি।

হায় রে কবে কেটে গেছে কালিদাসের কাল!

পণ্ডিতেরা বিবাদ করে লয়ে তারিখ-সাল।

স্বয়ং কালিদাস পণ্ডিতই তার জন্ম সম্পর্কিত কোন তথ্য রেখে যাননি। একারণে অসংখ্য দেশি-বিদেশি গবেষক একেক রকমের দাবী করেছেন তার জন্মের সময়কাল সম্পর্কে। কোন কোন মতে তার জন্ম যীশুখ্রীস্টেরও  জন্মের অনেক আগে। আবার কোন কোন মতে কালিদাসের জন্ম হয়েছিল খ্রিস্টীয় চতুর্থ থেকে ষষ্ঠ শতকের মাঝামাঝি। কেননা, কালিদাস বিক্রমাদিত্য নামক এক গুপ্ত সম্রাটের সভাকবি ছিলেন। তবে এখানেও রয়েছে আরও একটি জটিল সমস্যা। সমস্যাটি হচ্ছে বিক্রমাদিত্য নাম দ্বারা আসলে সুনির্দিষ্ট কিছু বোঝার উপায় নেই। কারন ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাসে অন্তত ছয়জন রাজা বিক্রমাদিত্য উপাধি ধারণ করে রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন। তবে সর্বাধিক প্রচলিত মতটি হচ্ছে, গুপ্ত সাম্রাজ্যের সর্বাধিক খ্যাতিমান নৃপতি দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত বা বিক্রমাদিত্যের রাজসভার সভাকবি ছিলেন কবি কালিদাস। তাছাড়া কালিদাসের অনেক রচনায় চন্দ্রগুপ্তের রাজ্য, রাজধানী উজ্জয়িনী ও রাজসভার উল্লেখ পাওয়া যায়। আর এই রাজার রাজত্বকাল ছিল ৩৭৫ খ্রিস্টাব্দ থেকে ৪১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। তবে সবকিছুর পরেও কালিদাসের জন্ম সম্পর্কে বিস্তর মতভেদ রয়েছে গবেষকগণের মধ্যে। জন্মসালের মতো তার জন্মস্থান নিয়েও রয়েছে নানা বিতর্ক। কারও মতে মহাকবি কালিদাসের জন্মস্থান উজ্জয়িনী কারও মতে বিদিশা, কেউ বলেন বিদর্ভ, আবার কেউ বা বলেন কাশ্মীর।  সুতারাং এসব তর্কে না গিয়ে ধরে নেওয়া হয় মহাকবি কালীদাসের জন্ম হয়েছিল প্রাচীন যুগের ভারতবর্ষের কোন এক স্থানে।

আরও পড়ুনঃ  ঘরে বসে বৃন্দাবনের প্রেম মন্দির দর্শন || Amazing Prem Mandir of Vrindavan || Prem Temple ||

এবার আসি আসল কথায়। জন্মের পর পরই পিতা মাতাকে হারিয়ে অনাথ হয়ে যান মহাকবি কালিদাস।  সর্বহারা শিশু কালিদাসের লালন-পালনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন রাখাল গোত্রের কিছু লোকজন। এর ফলে লেখাপড়ার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হন কালিদাস, বেড়ে ওঠেন অশিক্ষিত গণ্ডমূর্খ হিসেবে। তার ওপর তিনি ছিলেন হদ্দ বোকা। তার ভালো কিছু বলতে ছিল তার গৌরবর্ণ ও সৌম্য চেহারাটুকু। তার এই রাজপুত্রতুল্য সৌন্দর্যের কারনে সুন্দরী রাজকন্যা বিদ্যাবতীর সাথে বিবাহ হয়েছিল কালীদাসের। তবে এই রাজকন্যা শুধু সুন্দরীই ছিলেন না, ছিলেন অত্যন্ত বিদুষী। কিন্তু বিবাহের পর কালিদাসের জীবনে বিশেষ কোন পরিবর্তন আসে নি, বরং তার শিক্ষিত পত্নীর কাছ থেকে জুটেছিল  তার মুর্খতা নিয়ে হাসি-তামাশা এবং উপহাস।

প্রসঙ্গত, একদিন কালিদাস কুঠার হাতে বনে গিয়েছিলেন রান্নার কাঠ সংগ্রহ করতে। গাছে উঠে, তিনি যে ডালটিতে বসে ছিলেন, সেটিই কাটতে শুরু করলেন। কালিদাসের এমন বোকামি দাঁড়িয়ে দেখছিলেন একজন পথিক, তিনি কালিদাসকে ওই ডালটি কাটতে নিষেধও করেছিলেন। কিন্তু বোকা কালিদাস পথিকের বক্তব্য বুঝতেই পারলেন না। ফলশ্রুতিতে কাটা ডাল সহ ভূমিতে পতিত হলেন তিনি। পাড়ায় পাড়ায় রটে গেল বোকা কালিদাসের এই নতুন বোকামির গল্প। এ সংবাদ থেকে বঞ্চিত হননি তার নিজের স্ত্রীও। ফলে এবারও স্ত্রীর তরফ থেকে জুটল অপমান আর ভর্ৎসনা। নিজের স্ত্রীর এমন আচরণে গভীরভাবে ব্যাথিত হয়েছিলেন কালিদাস। এর ফলে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণবিসর্জন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। আর এখান থেকেই বদলে গেল কালিদাসের জীবন।

কালিদাস যখন নদীতে ঝাঁপ দিলেন, তাঁকে উদ্ধার করলেন স্বয়ং মাতা কালিকা। কালিদাস বিনতি করে বললেন, “মাগো, আমাকে কেন বাঁচালে? আমি যে বোকা, নির্বোধ। আমি আমার স্ত্রীর কাছেই হাসি-তামাশা, উপহাসের পাত্র। আমার দ্বারা কি উপকার হবে এই বিশ্ব সংসারের?” উত্তরে দেবীমাতা বললেন, “আজ থেকে আর তুমি নির্বোধ বা মূর্খ নও কালিদাস, আমি তোমাকে আশির্বাদ করছি- তোমার বিদ্যা, জ্ঞান ও বুদ্ধি হবে পৃথিবী বিখ্যাত। তোমার রচিত সাহিত্য কর্ম যুগ যুগ ধরে বাঁচিয়ে রাখবে তোমাকে। একসময়ের মূর্খ কালিদাস এবার পরিচিত হবে কালিদাস পণ্ডিত নামে”। এই বলে অন্তর্হিত হলেন দেবী। সেই থেকে কালিদাস হলেন দেবী কালির দাস বাঁ কালিদাস। অনেক গবেষকগণের মতে কালিদাসের পূর্বনাম জানা যায় না, তবে দেবী কালিকার কাছ থেকে বিদ্যা-বুদ্ধি ও জ্ঞানের বরপ্রাপ্ত হওয়ার পরে তার নাম হয়েছিল কালিদাস।

আরও পড়ুনঃ  মহর্ষি দধিচীর প্রকৃত পরিচয় ও আত্মত্যাগের কাহিনী || বজ্রসম কঠিন অস্থি যার || Mahrshi Dadhichi Story||

তবে অন্যমতে, কালিদাসকে নদী থেকে উদ্ধার করে প্রাণ বাঁচিয়েছিলেন দেবী বাগ্বাদিনী সরস্বতী। তিনিই তাঁকে পুত্রস্নেহে কোলে তুলে নিয়ে অতুল্য জ্ঞান ও বুদ্ধির বর দিয়েছিলেন। তবে ঘটনা যেটাই হোক, প্রত্যেক মতেই এ কথা মানা হয় যে- কোন একটি অলৌকিক ঘটনার প্রেক্ষিতে গণ্ডমূর্খ কালিদাস হয়ে উঠেছিলেন মহাকবি কালিদাস। কালিদাসের এই অলৌকিক পরিবর্তন বিষয়ে শ্রীশ্রী-গুরুচাঁদ চরিত্র সুধার আদিগীতিতে বলা হচ্ছে-

মাগো তুমি কালী বেশে, কৃপা কর কালিদাসে,

শুনেছি মা প্রভুর শ্রীমুখে।

ছিল মূর্খ কালিদাস, গিয়েছিল তব পাশ,

জ্ঞান দান করিলে তাহাকে।।

তুমি মাগো হর জায়া, মহাদেবী মহামায়া,

তুমি মাগো সঙ্কট হারিণী।

তুমিই আদ্যা অনাদ্যা,  তুমি মাগো ভবারাধ্যা,

তুমি মাগো করুণা দায়িনী।।

তাই বলি ওহে মাতা, জানা আছে সেই কথা,

পার তুমি সকলি করিতে।

যাইহোক, দেবীর বরে কালিদাস হয়ে উঠেছিলেন মহা পণ্ডিত।  তার রচিত মহাকাব্য রঘুবংশম এবং কুমারসম্ভবম, নাটক বিক্রমোর্বশীয়ম’, মালবিকাগ্নিমিত্রম, এবং অভিজ্ঞানশকু্ন্তলম, গীতিকাব্য মেঘদূতম্, এবং ঋতুসংহারমা তাঁকে এনে দিয়েছিল অমরত্বের বর। সেই বরে আজও বেঁচে আছেন, দেবীর আশির্বাদপ্রাপ্ত মহাকবি কালিদাস। শুধু ভারতবর্ষই নয় ইংরেজি, জার্মানসহ বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে কালিদাসের অমর সৃষ্টিগুলো।

তবে এখানেই কিন্তু শেষ নয়। অতুল্য প্রতিভার অধিকারী কালিদাস খুব অল্পদিনেই যশ ও খ্যাতির একেবারে শীর্ষে আরোহন করলেন। আর সেখান থেকেই শুরু হল তার দম্ভ। এক সময় তিনি নিজেকে সবচেয়ে জ্ঞানী ও বিদ্বানদের মধ্যে সবার সেরা মনে করতে শুরু করলেন। এবং তার সেই অহংবোধের পাহাড় চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিয়েছিলেন একজন দেবী।  প্রচলিত উপকথা অনুযায়ী, কোন একদিন একা একা নগর পরিভ্রমণ করছিলেন মহাকবি কালিদাস। মাথার উপরের তপ্ত সূর্যের দাবদাহে খুব শীঘ্রই তৃষ্ণার্ত হলেন তিনি। নিদারুণ তৃষ্ণায় গ্রামের পর গ্রাম পার হয়েও জলের সন্ধান পেলেন না তিনি।অবশেষে তিনি একটি গ্রামের একপাশে একটি কূপ দেখতে পেয়ে কিছুটা আশ্বস্ত হলেন। কূপ থেকে যে নারীটি জল ভরছিলেন কালিদাস তার কাছে এগিয়ে গেলেন।  বললেন, “দেবী আমি খুব তৃষ্ণার্ত, আমাকে দয়া করে জল পান করান।” কালিদাসের কথা শুনে মহিলাটি বলে উঠলেন, “আমি অপরিচিত পরপুরুষকে জল পান করাতে পারব না, আগে আপনি নিজের পরিচয় দিন , তারপরে আমি জল দেবো”।

আরও পড়ুনঃ  পঞ্চকেদার সৃষ্টি হওয়ার পেছনের পৌরাণিক কাহিনী || Mythology Behind the Creation of Panch Kedar ||

ইতিমধ্যে কালিদাসের গর্ব এবং অহংবোধ জেগে উঠেছে। সামান্য অবলা নারীর কাছে কালিদাস পণ্ডিতের পরিচয় দেওয়ার কোন অর্থই হয় না।  তাই তিনি কৌশলে মহিলাটিকে বললেন, “আমার পরিচয়ের চেয়ে বেশী গুরুত্বপূর্ন হচ্ছে, আমি আপনার অতিথি এবং অতিথি নারায়ন”। মহিলাটি উত্তর দিলেন, “মহাশয়, পৃথিবীতে মাত্র দুইটি অতিথি আছে। একটি হচ্ছে অর্থ এবং অপরটি যৌবন। সেই হিসেবে আপনি অতিথি হতে পারেন না।” একজন অতি সাধারন গ্রাম্য নারীর এমন সুগভীর জ্ঞান কালিদাসের অহংবোধের খুঁটিটিকে আঘাত করলেও সম্পূর্ণ বিনষ্ট করতে পারে নি। তিনি বলে উঠলেন, “আমি যে সহনশীল, তৃষ্ণার কষ্ট সহ্য করে আছি বহুক্ষণ।”  মহিলাটিও তৎক্ষণাৎ বলে উঠলেন, “এই পৃথিবীতে দুজনই সহনশীল। একটি হচ্ছে এই পৃথিবী যা আমাদের বোঝা বহন করে এবং দ্বিতীয়টি হচ্ছে বৃক্ষ, যাকে পাথর ছুঁড়ে মারলে তাঁর বদলে সুমিষ্ট ফল নিক্ষেপ করে।”

কালিদাস বুঝতে পারলেন এই মহিলা সাধারন নারী নন। এরপর তিনি পরাজয় স্বীকার করে বললেন, “আমি কিছুই জানিনা, আমি বোকা। আমি আমার পরাজয় স্বীকার করছি”  মহিলাটি তখন আবারও বলে উঠলেন, “এই দুনিয়ায়  কেবল দুজন বোকা।একজন হচ্ছেন সেই রাজা যিনি যোগ্যতা ছাড়াই সমস্ত কিছু পরিচালনা করেন। এবং অন্যজন  হচ্ছেন সেই রাজার সভাসদ ও প্রজা যারা রাজাকে সন্তুষ্ট করতে ভুল জিনিসটির প্রশংসা করেন।” এবার প্রমাদ গুনলেন মহাকবি কালিদাস। লুটিয়ে পড়লেন সেই নারীর পদতলে। বললেন “হে দেবী, ঘাট হয়েছে। এবার আমার তৃষ্ণা নিবারন করুন।” উত্তর এল “তথাস্তু”। আবারও বিষ্ময়ে চোখ তুলে মহিলাটির দিকে তাকালেন কালিদাস। কিন্তু কোথায় সেই নারী, তিনি যাকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেন, তিনি স্বয়ং সর্ব জ্ঞান ও কলার জননী দেবী বাগ্বাদিনী সরস্বতী।

কালিদাসের বিষ্ময়ের ঘোর না কাটতেই দেবী বললেন, “হে কালিদাস, তোমার জ্ঞান, বুদ্ধি অতুলনীয়। কিন্তু জ্ঞানের সাথে অহংকারের বসবাস চলে না। তাইতো আমাকে নিজে আসতে হল তোমার অহংকারের দূর্গ ধ্বংস করতে।” সেই থেকে অহংকার বর্জন করলেন কালিদাস। হয়ে উঠলেন আরও মহান, আরও বিদ্বান, আরও অমর।

4.5/5 - (2 votes)

Leave a Reply