You are currently viewing মহালয়া কি? পিতৃতর্পন কি? মহালয়াতে কেন পিতৃতর্পন করা হয়?  Mahalaya and Pitru Tarpan |

মহালয়া কি? পিতৃতর্পন কি? মহালয়াতে কেন পিতৃতর্পন করা হয়? Mahalaya and Pitru Tarpan |

মহালয়া কি? মহালয়াতে কেন পিতৃতর্পন করা হয়?

এসে গেল শারদীয় দুর্গাপুজো। ফুরফুরে মন, বাইরে আগমনী সুগন্ধ, আর সাতসকালে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র। মহালয়ার দিন মানেই সকাল থেকেই ভরে ওঠে ফেসবুকের নিউজফিড, হোয়্যাটসঅ্যাপে ঘন ঘন মেসেজ। এসকল মেসেজের বিষয়বস্তু “শারদীয় দুর্গাপুজোর শুভেচ্ছা”। সবাই নিশ্চিত মহালয়া মানেই দূর্গাপূজার দিন গোনা। কিন্তু শুনতে অবাক লাগলেও, মহালয়ার সঙ্গে দুর্গাপুজোর কোনও সরাসরি যোগ নেই। বরং মহালয়ার নেপথ্যে রয়েছে মহাভারতের কর্ণের জীবনের অনুষঙ্গ। একইসাথে পুর্বজদের তর্পনের বিষয়টা এখানে গুরুত্বপুর্ণ।  তো আমরা যারা মহালয়াকে এতদিন দুর্গাপুজোর সাথে সম্পৃক্ত বলে মনে করতাম তাদের জন্যই আজকের ভিডিও। আসুন জেনে নিই মহালয়া কি? কর্ণ ও মহালয়ার মধ্যে কি সম্পর্ক? পিতৃতর্পন কেন করা হয়? কেন মহালয়াতেই পিতৃতর্পন করা হয় এবং সর্বোপরী মহালয়া বৃত্তান্ত। আশা করছি এ আয়োজনে আমাদের সাথে শেষ পর্যন্ত থাকবেন।

 

মহালয়ার এই দিনটি দুর্গাপুজোর শুরু বলেই আজকের বাঙালি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে। কিন্তু সনাতন ধর্মানুযায়ী, এই ধারনার কোনও ভিত্তি নেই। সম্ভবত আকাশবাণী বীরেন্দ্রকৃষ্ণ-বাণীকুমারের গীতি-আলেখ্যটি এই দিনে চালানোর ফলেই এমন ধারণার সূত্রপাত। কিন্তু মনে রাখা দরকার, আকাশবাণীর অনুষ্ঠানটির নাম কিন্তু ‘মহালয়া’ নয়— ‘মহিষাসুরমর্দিনী’। অনুষ্ঠানটি এখন মহালয়ার দিন সম্প্রচারিত হলেও শুরুতে তা সম্প্রচারিত হতো ষষ্ঠীর ভোরে। এবার আসুন আসল আলোচনায় যাওয়া যাক।

ত্রেতা যুগে ভগবান শ্রীরামচন্দ্র অকালে দেবিকে আরাধনা করেছিলেন লঙ্কা জয় করে মাতা সীতাকে উদ্ধারের জন্য। কিন্তু মূল দূর্গা পূজা হলো বসন্তে , সেটাকে বলা হয় বাসন্তি পূজা । শ্রীরামচন্দ্র অকালে-অসময়ে পূজা করেছিলেন বলে এই শরতের পূজাকে দেবির অকাল-বোধন বলা হয় । সনাতন ধর্মে কোন শুভ কাজ করতে গেলে বা বিবাহ করতে গেলে প্র্রয়াত পুর্বজদের এবং সমগ্র জীব-জগতের জন্য তর্পণ করতে হয় । তর্পণ মানে খুশি করা । ভগবান শ্রীরাম লঙ্কা বিজয়ের আগে মহালয়া তিথিতে এমনটাই করেছিলেন । সেই অনুসারে এই মহালয়া তিথিতে যারা পিতৃ-মাতৃহীন তারা তাদের পূর্বপূরূষের স্মরন করে এবং পূর্বপূরুষের আত্নার শান্তি কামনা করে অঞ্জলি প্রদান করেন । সনাতন ধর্ম অনুসারে এই দিনে প্রয়াত আত্নাদেরকে মর্ত্ত্যে পাঠিয়ে দেয়া হয়, এই সকল প্রয়াত আত্নার যে সমাবেশ হয় তাকেই বলা হয় মহালয় ।এবং এই মহালয় থেকেই মহালয়া । পিতৃপক্ষের ও শেষদিন এটি ।

আরও পড়ুনঃ  কৃষ্ণ ও বিষ্ণুর মধ্যে কি পার্থক্য?

পিতৃপক্ষ পূর্বপূরুষের তর্পণাদির জন্য প্রশস্ত এক বিশেষ পক্ষ। এই পক্ষ পিত্রুপক্ষ, ষোলা শ্রাদ্ধ, কানাগাত, জিতিয়া, মহালয়া পক্ষ ও অপরপক্ষ নামেও পরিচিত। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, যেহেতু পিতৃপক্ষে প্রেতকর্ম বা শ্রাদ্ধ, তর্পণ ইত্যাদি মৃত্যু-সংক্রান্ত আচার-অনুষ্ঠান পালিত হয়, সেই হেতু এই পক্ষ শুভকার্যের জন্য প্রশস্ত নয়। দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে গণেশ উৎসবের পরবর্তী পূর্ণিমা তথা ভাদ্রপূর্ণিমা তিথিতে এই পক্ষ সূচিত হয় এবং সমাপ্ত হয় সর্বপিতৃ অমাবস্যা, মহালয়া অমাবস্যা বা মহালয়া দিবসে। উত্তর ভারত ও নেপালে ভাদ্রের পরিবর্তে আশ্বিন মাসের কৃষ্ণপক্ষকে পিতৃপক্ষ বলা হয়।

পুরাণ অনুযায়ী, জীবিত ব্যক্তির পূর্বের তিন পুরুষ পর্যন্ত পিতৃলোকে বাস করেন। এই লোক স্বর্গ ও মর্ত্যের মাঝামাঝি স্থানে অবস্থিত। পিতৃলোকের শাসক মৃত্যুদেবতা যম। তিনিই সদ্যমৃত ব্যক্তির আত্মাকে মর্ত্য থেকে পিতৃলোকে নিয়ে যান। পরবর্তী প্রজন্মের একজনের মৃত্যু হলে পূর্ববর্তী প্রজন্মের একজন পিতৃলোক ছেড়ে স্বর্গে গমন করেন এবং পরমাত্মায় লীন হন এবং এই প্রক্রিয়ায় তিনি শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের উর্ধ্বে উঠে যান। এই কারণে, কেবলমাত্র জীবিত ব্যক্তির পূর্ববর্তী তিন প্রজন্মেরই শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হয়ে থাকে; এবং এই শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যম একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সূর্য কন্যারাশিতে প্রবেশ করলে পিতৃপক্ষ সূচিত হয়। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, এই সময় পূর্বপুরুষগণ পিতৃলোক পরিত্যাগ করে তাঁদের উত্তরপুরুষদের গৃহে অবস্থান করেন। এর পর সূর্য বৃশ্চিক রাশিতে প্রবেশ করলে, তাঁরা পুনরায় পিতৃলোকে ফিরে যান। পিতৃগণের অবস্থানের প্রথম পক্ষে হিন্দুদের পিতৃপুরুষগণের উদ্দেশ্যে তর্পণাদি সম্পন্ন করতে হয়।

মহাভারত অনুযায়ী, প্রসিদ্ধ দাতা কর্ণের মৃত্যুর পর তাঁর আত্মা স্বর্গে গমন করলে, তাঁকে স্বর্ণ ও রত্ন খাদ্য হিসেবে প্রদান করা হয়। কর্ণ ইন্দ্রকে এর কারণ জিজ্ঞাসা করলে ইন্দ্র বলেন, কর্ণ সারা জীবন স্বর্ণই দান করেছেন, তিনি পিতৃগণের উদ্দেশ্যে কোনোদিন খাদ্য প্রদান করেননি। তাই স্বর্গে তাঁকে স্বর্ণই খাদ্য হিসেবে প্রদান করা হয়েছে। কর্ণ বলেন, তিনি যেহেতু তাঁর পিতৃগণের সম্পর্কে অবহিত ছিলেন না, তাই তিনি ষোলো দিনের জন্য মর্ত্যে গিয়ে পিতৃলোকের উদ্দেশ্যে অন্ন ও জল প্রদান করার অনুমতি প্রার্থনা করেন। এই পক্ষই পিতৃপক্ষ নামে পরিচিত হয়।

আরও পড়ুনঃ  মহর্ষি ভৃগু কেন বিষ্ণুর বুকে পদাঘাত করেছিলেন? Why Rishu Bhrigu Kicked on The Chest of Lord Vishnu?

এই কাহিনিতে কোনো কোনো পাঠান্তরে, ইন্দ্রের বদলে যমকেও দেখা যায়।মহালয়া পক্ষের পনেরোটি তিথির নাম হল প্রতিপদ, দ্বিতীয়া, তৃতীয়া, চতুর্থী, পঞ্চমী, ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী, দশমী, একাদশী, দ্বাদশী, ত্রয়োদশী, চতুর্দশী ও অমাবস্যা।

পিতৃপক্ষে পুত্র কর্তৃক শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হিন্দুধর্মে অবশ্য করণীয় একটি অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানের ফলেই মৃতের আত্মা স্বর্গে প্রবেশাধিকার পান। এই প্রসঙ্গে গরুড় পুরাণ গ্রন্থে বলা হয়েছে, “পুত্র বিনা মুক্তি নাই।” ধর্মগ্রন্থে গৃহস্থদের দেব, ভূত ও অতিথিদের সঙ্গে পিতৃতর্পণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মার্কণ্ডেয় পুরাণ গ্রন্থে বলা হয়েছে, পিতৃগণ শ্রাদ্ধে তুষ্ট হলে স্বাস্থ্য, ধন, জ্ঞান ও দীর্ঘায়ু এবং পরিশেষে উত্তরপুরুষকে স্বর্গ ও মোক্ষ প্রদান করেন।বাৎসরিক শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যাঁরা অপারগ, তাঁরা সর্বপিতৃ অমাবস্যা পালন করে পিতৃদায় থেকে মুক্ত হতে পারেন। এই অনুষ্ঠানে পূর্ববর্তী তিন পুরুষের উদ্দেশ্যে পিণ্ড ও জল প্রদান করা হয়, তাঁদের নাম উচ্চারণ করা হয় এবং গোত্রের পিতাকে স্মরণ করা হয়। পিতৃপুরুষের ঋণ হিন্দুধর্মে পিতৃমাতৃঋণ অথবা গুরুঋণের সমান গুরুত্বপূর্ণ। জীবিত ব্যক্তির পিতা বা পিতামহ যে তিথিতে মারা যান, পিতৃপক্ষের সেই তিথিতে তাঁর শ্রাদ্ধানুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। তবে এই নিয়মের কিছু ব্যতিক্রমও রয়েছে। পূর্ববর্তী বছরে মৃত ব্যক্তির শ্রাদ্ধ হয় চতুর্থী বা চৌথা ভরণী অথবা পঞ্চমী তথা ভরণী পঞ্চমী তিথিতে। সধবা নারীর মৃত্যু হলে, তাঁর শ্রাদ্ধ হয় নবমী তিথিতে। এক্ষেত্রে বিপত্নীক ব্যক্তি ব্রাহ্মণী নারীদের শ্রাদ্ধে নিমন্ত্রণ করেন। শিশু বা সন্ন্যাসীর শ্রাদ্ধ হয় চতুর্দশী তিথিতে। এছাড়াও অস্ত্রাঘাতে বা অপঘাতে মৃত ব্যক্তিদেরও শ্রাদ্ধ হয় এই চতুর্দশী তিথিতেই। সর্বপিতৃ অমাবস্যা দিবসে তিথির নিয়মের বাইরে সকল পূর্বপুরুষেরই শ্রাদ্ধ করা হয়। যাঁরা নির্দিষ্ট দিনে শ্রাদ্ধ করতে ভুলে যান, তাঁরা এই দিন শ্রাদ্ধ করতে পারেন। এই দিন গয়ায় শ্রাদ্ধ করলে তা বিশেষ ফলপ্রসূ হয়। উল্লেখ্য, গয়ায় সমগ্র পিতৃপক্ষ জুড়ে মেলা চলে। বাংলায় মহালয়ার দিন দুর্গাপূজার সূচনা হয়। লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, এই দিন দেবী দুর্গা মর্ত্যলোকে আবির্ভূতা হন। মহালয়ার দিন অতি প্রত্যুষে চণ্ডীপাঠ করার রীতি রয়েছে। এদিন পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠিত হয় দ্বিপ্রহরে নদী বা হ্রদের তীরে বা শ্রাদ্ধকর্তার গৃহে। অনেক পরিবার বারাণসী বা গয়ায় গিয়েও শ্রাদ্ধানুষ্ঠান করেন । মৃত ব্যক্তির পুত্র বা বহুপুত্রক হলে জ্যেষ্ঠ পুত্র অথবা পিতৃকুলের কোনো পুরুষ আত্মীয়ই শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের অধিকারী এবং শ্রাদ্ধ কেবলমাত্র পূর্ববর্তী তিন পুরুষেরই হয়ে থাকে। মাতার কুলে পুরুষ সদস্য না থাকলে সর্বপিতৃ অমাবস্যায় দৌহিত্র মাতামহের শ্রাদ্ধ করতে পারেন। কোনো কোনো বর্ণে কেবলমাত্র পূর্ববর্তী এক পুরুষের বা ৭ পুরুষের অথবা চৌদ্দ পুরুষের শ্রাদ্ধ করা হয়ে থাকে। পূর্বপুরুষকে যে খাদ্য উৎসর্গ করা হয়, তা সাধারণত রান্না করে রুপো বা তামার পাত্রে কলাপাতার উপর দেওয়া হয়। এই খাদ্যগুলি হল ক্ষীর, ভাত, ডাল, গুড় ও কুমড়ো। শ্রাদ্ধকর্তাকে স্নান করে শুদ্ধ হয়ে ধুতি পরে শ্রাদ্ধ করতে হয়। এসময় সিদ্ধ অন্ন ও ময়দা ঘি ও তিল দিয়ে মাখিয়ে পিণ্ডের আকারে উৎসর্গ করা হয়। একে পিণ্ডদান বলে। এরপর দুর্বাঘাস, শালগ্রাম শিলা বা স্বর্ণমূর্তিতে বিষ্ণু এবং যমের পূজা করা হয়। এরপর পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে খাদ্য প্রদান করা হয়। এই খাদ্য সাধারণত নির্জন স্থানে রেখে আসা হয়।কোনো কোনো পরিবারে পিতৃপক্ষে ভাগবত পুরাণ, ভগবদ্গীতা বা শ্রীশ্রীচণ্ডী পাঠ করা হয়। অনেকে পূর্বপুরুষের মঙ্গল কামনায় ব্রাহ্মণদের দানও করেন।

আরও পড়ুনঃ  রাত নামলেই ১১ শিব মন্দির থেকে ভেসে আসে নারী কণ্ঠের কান্না || 11 Shiva Temple, Abhaynagar, Jessore

5/5 - (1 vote)

This Post Has One Comment

Leave a Reply