কথায় বলে হিন্দু ধর্মে ৩৩ কোটি দেবদেবী রয়েছেন। এটা যেমন ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের কাছে হাসির খোরাক, তেমনি শুনতেও বড্ড অদ্ভুত। তাহলে কি এটি একটি ভ্রান্ত ধারনা? আসলে এটুকুই যাচাই করে দেখার মত সময়ও আমাদের হয় না। আজ্ঞে হ্যা, এটি একটি ভ্রান্ত একটি ধারনা, তবে এর মধ্যে একটি ছোট্ট কিন্তু রয়েছে। আর তা হল সংস্কৃত কোটি শব্দটির অর্থ হল প্রকার। দশে চক্রে ভগবান যেমন ভুত হয়ে যান তেমনি মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত হুতে হতে ৩৩ প্রকার দেবদেবী বিকৃত হয়ে আজ ৩৩ কোটিতে পরিনত হয়েছেন। যাইহোক এই তেত্রিশ প্রকার দেবদেবী কে বা কারা তা নিয়ে অন্য কোন দিন আলোচোনা করা যাবে। আজ আপাতত আমরা আমাদের সনাতন দেবদেবীদের কে কোন বারে পুজিত হন এবং কিভাবে পুজিত হন তা আলোচোনা করতে যাচ্ছি। হিন্দু পূরাণ অনুসারে সপ্তাহের প্রতিটি দিন ঈশ্বরের বিভিন্ন রুপ তথা দেবদেবীকে উৎসর্গ করা হয়েছে। এছাড়াও, প্রতিদিন ঈশ্বরের উপাসনা এবং তাদের সন্তুষ্ট করার জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা আচার ও পদ্ধতি। আমরা অনেকেই দেবতার পুজা তো সম্পাদন করি, কিন্তু আমাদের প্রদানকৃত অর্ঘ্য এবং অঞ্জলী দেবতারা গ্রহন করছেন তো? জানি এ সংশয় আপনার মধ্যেও রয়েছে। তাই আসুন দর্শক জেনে নিই প্রধান কিছু দেবদেবীর পুজার জন্য নির্দিষ্ট বার ও সংশ্লিষ্ট দেবদেবীর পুজায় পালনীয় আচার ও অনুষ্ঠান সম্পর্কে। এ আয়োজনে আমাদের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত থাকার অনুরোধ রইল।
রবিবার নাম থেকেই বোঝা যায় এই দিনটি ভগবান সুর্যের প্রতি উৎসর্গিত। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী, ভগবান সূর্য একটি মহান গুরুত্ব বহন করে। ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে, ভগবান সূর্য পৃথিবীতে জীবন, স্বাস্থ্য এবং সমৃদ্ধি দান করেন। এছাড়াও, প্রচলিত বিশ্বাস মতে, সূর্য তাঁর ভক্তদের সুস্বাস্থ্য ও ইতিবাচকতা প্রদান করেন এবং চর্মরোগ নিরাময় করেন। রবিবার ভগবান সূর্যকে পূজা করার আগে প্রথমে আপনার দেহ এবং আপনার চারপাশের জায়গাটি ভালভাবে পরিষ্কার করা প্রয়োজন। ঘর পরিষ্কার করার পরে, খুব সকালে স্নান করতে হবে এবং গায়ত্রী মন্ত্র জপ করার সময় অর্ঘ্য তথা জল উৎসর্গ প্রদান করতে হবে। ‘ওঁ ভূর্ভুবস্ব তৎসবিতুর্বরেণ্যং ভর্গোদেবস্য ধীমহি ধীয়ো য়ো নঃ প্রচোদয়াৎ’ এটিই হচ্ছে সুর্যের পুজায় ব্যাবহৃত গায়ত্রী মন্ত্র। ভগবান সূর্যের উপাসনা করার সময়, কুমকুম ও চন্দন কাঠের মিশ্রন টীকা আকারে ভক্তের কপালে লাগাতে হবে। সুর্যদেবকে সন্তুষ্ট করতে এই দিনে অনেকেই উপবাস করে থাকেন। সুর্যপুজার নিয়মের একটা অংশ হিসেবে, আপনি কেবলমাত্র দিনে একবারই খেতে পারেন, তবে তা অবশ্যই সূর্যাস্তের আগে হতে হবে। এসময় বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে যে আপনার গ্রহনকৃত খাবারে কোনভাবেই রসুন, পেঁয়াজ এবং লবণ থাকে না। প্রচলিত বিশ্বাস মতে লাল রঙ ভগবান সূর্যের সাথে সংযুক্ত তাই সূর্যের উপাসনা করার সময় লাল পোশাক পরিধান করা শ্রেয় । এছাড়াও, অঞ্চলভেদে ভগবান সূর্যকে লাল রঙের ফুলও অর্পন করতে দেখা যায় এই দিনে।
সোমেশ্বর মহাদেবকে উতসর্গকৃত দিনটি হল সোমবার। এদেশে বাবা তারকেশ্বরের বহুল প্রচলিত ব্রতটি ১৬ টি সোমবার ব্যাপী ভক্তগন পালন করে থাকেন মহাসমারোহে। সোমবারের দিনটি ভগবান শিব-কে উৎসর্গ করা হয়ে থাকে। এই দিন ভক্তরা শিবের মন্দিরে যান এবং তাঁর উপাসনা করেন। ভগবান শিব এবং দেবী পার্বতী মিলে মহাবিশ্বের সৃষ্টির প্রতিনিধিত্ব করেন। ভগবানকে সন্তুষ্ট করতে ভক্তরা প্রায়ই সোমবার উপবাস পালন করে থাকেন। ভক্তদের বিশ্বাস, শিব তাঁর ভক্তদের অনন্ত শান্তি, দীর্ঘজীবন এবং স্বাস্থ্যের আশীর্বাদ করেন। সপ্তাহের এইদিনে ভগবান শিবের উপাসনা করার জন্য খুব সকালে স্নান সেরে পরিষ্কার সাদা বা হালকা রঙের পোশাক পরুন। গঙ্গাজল এবং ঠান্ডা কাঁচা দুধ দিয়ে শিবলিঙ্গকে স্নান করান। ‘ওঁ নমঃ শিবায়ে’ জপ করার সময় শিবলিঙ্গে চন্দন কাঠের পেস্ট, সাদা ফুল এবং বেল পাতা দিন। বলা হয় শিব সাদা বর্ণ পছন্দ করেন তাই, আপনি এই দিনে সাদা রঙের পোশাক পরতে পারেন। তবে কালো রঙের পোশাক পরবেন না কারণ বিশ্বাস করা হয় যে, ভোলেনাথ কালো রঙ পছন্দ করেন না।
৩) মঙ্গলবার দিনটি হনুমানের প্রতি উৎসর্গিত। দিনটির নামকরণ করা হয়েছে মঙ্গল গ্রহের নামে। হিন্দু পুরাণে, হনুমানকে শিবের অবতার বলে মনে করা হয়। ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে, হনুমান প্রত্যেকের জীবন থেকে বাধা ও ভয় দূর করেন। তাই, ভক্তরা এই দিনে হনুমানের উপাসনা করেন এবং উপবাসও করেন। সপ্তাহের প্রতি মঙ্গলবারে খুব সকালে স্নান করে পরিষ্কার পোশাক পরতে হবে। ভগবান সূর্যকে অর্ঘ্য অর্পণ করুন এবং হনুমান চালিশা জপ করুন। হনুমান চালিশা জপ করার সময় লাল ফুল প্রদান করুন এবং প্রদীপ জ্বালান। আপনি হনুমানকে সিঁদুরও দিতে পারেন। এছাড়াও, লাল এবং কমলা রঙের ফুলও দিতে পারেন শ্রী হনুমানকে। লাল রঙ ভগবান হনুমানের সাথে সম্পর্কিত বলে মনে করা হয়। সুতরাং, লাল রঙের পোশাক পরা এবং লাল রঙের ফুল- ফল দেওয়া আপনার জন্য উপকারি হতে পারে।
৪) বুধবারের দিনটি বুদ্ধি, শিক্ষা ও শিল্পী দেবতা গণেশকে উৎসর্গ করা হয়। তিনি তাঁর ভক্তদের জীবন থেকে নেতিবাচকতা এবং প্রতিবন্ধকতা দূর করেন। কোনও শুভ কাজ শুরুর আগে তাই প্রায়ই গণেশের পূজা করা হয়ে থাকে। এছাড়াও তিনি সিদ্ধিদাতা, বিঘ্নহর্তা ও সর্বাগ্রে পূজ্য। গণেশের পূজায়, দূর্ব ঘাস, হলুদ এবং সাদা ফুল, কলা এবং মিষ্টি দিতে পারেন। তবে, নৈবেদ্যগুলি একটি পরিষ্কার কলার পাতায় রাখবেন। পুজার সময় ‘ওঁ গণেশায় নমঃ’ জপ করলে তা বিশেষ ফলদায়ক। এছাড়াও সিঁদুর ও মোদক অর্পণ করেও ভগবান গণেশকে সন্তুষ্ট করতে পারেন। ভগবান গণেশ সবুজ এবং হলুদ বর্ণ খুব পছন্দ করেন। অতএব, আপনি এই দিনে সবুজ রঙের পোশাক পরার কথা ভাবতে পারেন।
৫) বৃহস্পতিবার গুরুবার নামেও পরিচিত এবং ভগবান বিষ্ণু এবং গুরু বৃহস্পতির প্রতি উৎসর্গ করা হয়। এছাড়া অনেকেই এই দিনে সাঁই বাবাকে পূজা করেন এবং সাঁই মন্দিরে যান। ভক্তরা এদিন দেবী শ্রীলক্ষীকেও আবাহন করে ভক্তি ও অর্ঘ্য সহকারে তার আরাধনা করে থাকে। বিশ্বাস করা হয় যে, এই দিনে ভগবান বিষ্ণুর উপাসনা করলে বৈবাহিক জীবনে সুখ আসে এবং পরিবারের মধ্যকার সমস্যাগুলির সমাধান হয়। ভগবান বিষ্ণু ও বৃহস্পতিকে সন্তুষ্ট করতে আপনি কলা গাছের নীচে একটি প্রদীপ জ্বালিয়ে কলাগাছের কাণ্ডে কুমকুম লাগাতে পারেন। এছাড়াও দেব-দেবীদের কাছে ঘি, দুধ, হলুদ ফুল এবং গুড় অর্পণ করলে বিশেষ ফল প্রাপ্ত হতে পারবেন। এদিন শ্রীমদ্ভাগবত গীতা পাঠ করাও আপনার পক্ষে অত্যন্ত উপকারি হতে পারে। এছাড়াও ‘ওঁ জয় জগদীশ হরে’ মন্ত্রটি জপ করার জন্য বৃহস্পতিবার দিনটি সর্বোত্তম। যেহেতু ভগবান বিষ্ণু এবং বৃহস্পতিকে প্রায়শই হলুদ রঙের পোশাক পরে থাকতে দেখা যায়, তাই আপনিও এই একই পোশাক পরতে পারেন।
৬) শুক্রবার দিনটিকে শুক্রাচার্যকে উৎসর্গ করা হয়ে থাকে। এছাড়াও এদিন মাতা সন্তোষীর ব্রত পালিত হয়ে থাকে সমগ্র বাংলার ঘরে ঘরে। ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে, এই দিনে উপবাস করলে এবং দেবী সন্তোষীর উপাসনা করলে জীবনে সমৃদ্ধি, সম্পদ, ইতিবাচকতা এবং তৃপ্তি আসতে পারে। এদিন ভক্তদের সকালে খুব সকালে উঠে স্নান করা উচিত এবং সাদা ফুল ও নৈবেদ্য উৎসর্গ করে দেবদেবীদের পূজা করা উচিত। গুড়, ছোলা, ঘি এবং দুধজাতীয় পণ্য দিতে পারেন। এদিন লবণ, রসুন এবং পেঁয়াজ ছাড়া প্রস্তুত খাবার খেতে হবে এবং সূর্যাস্তের পরে খাবার খাওয়া উচিত। তবে মনে রাখবেন, এদিন টক জাতীয় খাবার খাওয়া এবং উতসর্গ করা দুইই নিষিদ্ধ। আপনি এই দিনে সাদা এবং হালকা রঙের পোশাক পরতে পারেন।
৭) শনিবার এইদিনটি ভগবান শনি-কে উৎসর্গ করা হয়। বলা হয় যে, কারুর কর্মের উপর নির্ভর করে ভগবান শনি তাকে পুরস্কৃত করেন বা শাস্তি দেন। সাধারণত যারা জ্যোতিষশাস্ত্রে বিশ্বাসী তারা এই দিনটিকে মহাসমারোহে পালন করে থাকেন। কথিত আছে যে, এই দিনে শনিদেবের পূজা করলে সুখ, সম্পদ ও শান্তির আকারে ভগবান শনি-এর কাছ থেকে সৌভাগ্য ও আশীর্বাদ আসতে পারে। ভগবান শনি বা বড় ঠাকুরকে সন্তুষ্ট করতে এবং যে কোনও ধরনের বাধা এড়াতে এই দিনটি পালন করা হয়। ভগবান শনির উপাসনা করতে আপনি পিপল এবং শামি গাছের নীচে একটি প্রদীপ জ্বালাতে পারেন। এছাড়াও, এদিন দরিদ্রদের দান করলে তা আপনার জন্য বিশেষ ফলদায়ক হয়ে পারে। আপনি এইদিনে শনিদেবকে কালো সরিষা, পঞ্চফল, পঞ্চফুল, সিন্নি, পঞ্চামৃত এবং নীলকন্ঠ ফুল দিতে পারেন। এছাড়াও, আপনি পূজা সম্পন্ন করার পরে শনি আরতি করতে পারেন। ভগবান শনি কালো রঙ পছন্দ করেন তাই, এই দিনে কালো রঙের পোশাক পরা আপনার পক্ষে সহায়ক হতে পারে।