You are currently viewing ভাইফোঁটা বা ভ্রাতৃদ্বিতীয়া কি, কেন ও কিভাবে?

ভাইফোঁটা বা ভ্রাতৃদ্বিতীয়া কি, কেন ও কিভাবে?

ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা,
যমের দুয়ারে পড়লো কাঁটা

ভাইফোঁটা বাঙালির জীবনের অন্যতম বড় উৎসবমুখর আবেগঘন পার্বণ। ভাইফোঁটার শাস্ত্রীয় নাম ভ্রাতৃদ্বিতীয়া বা যমদ্বিতীয়া। সাধারণত কালীপূজার দুইদিন পরে কার্তিক মাসের শুক্লদ্বিতীয়া তিথিতে ভাইবোনের এ পবিত্র সম্পর্কের উৎসবটি অনুষ্ঠিত হয়। তবে বাংলাদেশের বরিশাল সহ দক্ষিণাঞ্চলীয় অনেক স্থানেই শুক্লপক্ষের প্রতিপদ তিথিতে ভাইফোঁটা অনুষ্ঠিত হয়।এ উৎসবটি বাংলা ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন নামে বর্ণাঢ্যভাবে পালিত হয়।পশ্চিম ভারতে এই উৎসব ভাইদুজ নামেও পরিচিত। সেখানে ভ্রাতৃদ্বিতীয়া পাঁচ-দিনব্যাপী দীপাবলি উৎসবের সমাপনী দিন হিসেবে পালিত হয়। আবার, মহারাষ্ট্র, গোয়া ও কর্ণাটকে ভাইফোঁটাকে বলে ভাইবিজ। নেপালে ও পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলে এই উৎসব পরিচিত ভাইটিকা নামে। নেপালিদের কাছে বিজয়াদশমীর পর এটিই সবচেয়ে বড় উৎসব।

সারাভারতে ভাইফোঁটার মতোই আরেকটি ভাইবোনের সৌভ্রাতৃত্বের দিন উদযাপিত হয় শ্রাবণীপূর্ণিমার দিনে, যার নাম রক্ষাবন্ধন উৎসব। রক্ষাবন্ধন সাধারণত উত্তর, পশ্চিম এবং দক্ষিণ ভারতেই পালিত হয়। বাঙালিরা সাধারণত ভাইবোনের পবিত্র এ উৎসবটি পালন করে কালীপূজার দুইদিন পরে ভাইফোঁটার দিনে। বঙ্গভঙ্গের পরে সকলকেই এক করার জন্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই প্রথম রক্ষাবন্ধন দিনটিকে ভাইবোনের গণ্ডি পেরিয়ে সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধের উৎসবে পরিনত করে তোলে। সে থেকেই রক্ষাবন্ধনের দিনটি বাঙালির জীবনের গুরুত্ববহ অচ্ছেদ্য হয়ে যায়।

ভাইফোঁটা এবং রক্ষাবন্ধন ভাই-বোনের সম্পর্কের এমন স্নিগ্ধ অমলিন উৎসব ভারতবর্ষ ছাড়া বোধহয় পৃথিবীর আর কোথাও হয় না। ছোটবেলা থেকে অশীতি বৃদ্ধকাল পর্যন্ত সকল বয়সের সবাই ভাইফোঁটার এই উৎসবে উদীপ্ত, উজ্জীবিত হয়। ভাইফোঁটার ছড়াটিও অনন্য অসাধারণ। জানিনা মহাকালের কোন পবিত্র ক্ষণে বাংলার কোন এক লোককবির হৃদয়ে প্রতিভাসিত হয়েছিলো সর্বজনীন ভাইফোঁটার ছড়াটি। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, যতকাল বাঙালী থাকবে ততকালই অমর হয়ে থাকবে এই ছড়াটি। তবে অঞ্চলভেদে বিভিন্ন পাঠান্তর আছে ছড়াটির।

“ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা,
যমের দুয়ারে পড়লো কাঁটা।
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা,
আমরা দেই আমার ভাইকে ফোঁটা।
আগ বাজে, শাখ বাজে, আরো বাজে কাড়া,
আজ হতে ভাই তুমি না যাইয়ো যমপাড়া।”

আরও পড়ুনঃ  শনিদেব কেন সবার বড় ঠাকুর , তাঁর সৃষ্টি কিভাবে হয়েছে?

বোনেরা যমের হাত থেকে ভাইকে রক্ষার শুভকামনার সাথে সাথেই ভাইকেও আমৃত্যু দায়িত্ব নিতে হয় বোনের আত্মশ্লাঘাবোধ এবং সম্ভ্রম রক্ষার। কিন্তু খুবই পরিতাপের বিষয় যে বর্তমানে আমরা কয়জন ভাইয়েরা আমাদের বোনদের সম্ভ্রম রক্ষা করতে পারছি? যখন আসুরিক শক্তিসম্পন্ন পিশাচেরা আমাদের মা-বোনেদের সম্ভ্রমহানি করতে আসে, তখন আমরা ভাইয়েরা কি তাদের সম্পূর্ণভাবে প্রতিরোধ করতে পারি? অধিকাংশ ক্ষেত্রেই করি না বা প্রতিরোধের প্রচেষ্টাও করি না। তাইতো আসুরিক শক্তি দিনেদিনে ক্রমবর্ধমান হয়ে সকলের গায়ের উপরে দুষিত নিঃশ্বাস ছাড়ছে।এর অভিঘাতের জীবন দুর্বিষহ অসহনীয় হয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশের অসংখ্য বোনেরা আজও প্রতিনিয়ত লাঞ্ছিত হচ্ছে, নির্যাতিত হচ্ছে। সেই বোনেদের হাতে কপালে ফোঁটা নেয়া ভাইয়েরা সব কোথায়? আশেপাশের প্রতিবেসের দিকে তাকালে মনে হয় ভাইয়েরা সবাই আমরা আত্মকেন্দ্রিক কালনিদ্রায় মগ্ন। জানিনা বোনদের রক্ষার্থে ভাইদের কালনিদ্রা কবে ভাঙ্গবে?

বর্তমানে আমাদের যৌথ পারিবারিক ব্যবস্থা ভেঙে যাচ্ছে, পারিবারিক কাঠামোর মধ্যে অশান্তি ঝগড়াঝাটি চলে আসছে, ভাইবোনের মধ্যে স্বার্থের বিরোধে কোর্টকাছারি পর্যন্ত যেতে হচ্ছে। কিন্তু একবার আমরা ভেবে দেখেছি কি আমাদের ধর্মে বৈদিকযুগ এবং পৌরাণিক যুগ থেকেই ভাইবোনের সম্পর্কগুলো আজও আমাদের অনুসরণীয় হতে পারে।আমরা মহাভারতে শ্রীকৃষ্ণ, বড়ভাই বলরাম এবং আদরের ছোটবোন সুভদ্রা এ তিনভাইবোন আমাদের চোখের সামনে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সেই তিনভাইবোনের অনন্য সম্পর্কের দিকে দৃষ্টি রেখে আজও পুরীতে জগন্নাথ মন্দিরে শ্রীকৃষ্ণ, বলরাম এবং সুভদ্রা এ তিনভাইবোনকে একসাথে বসিয়ে সেখানে পূজা করা হয়। পুরীর রথযাত্রায় একটি বিষয় খুবই লক্ষ্যনীয়, রথযাত্রার সময়ে আগে বড়ভাই বলরামের রথ যায়, এরপরে ছোটবোন সুভদ্রার রথ এবং পরিশেষে যায় জগন্নাথদেবের রথ। আমাদের সংস্কৃতি অনুসারে জ্যেষ্ঠভাইকে আগে যেতে দিতে হয়। জ্যেষ্ঠকে অগ্রগামী করে,আদরের ছোটবোনের যাত্রা নির্বিঘ্ন করে, তবেই অবশেষে জগন্নাথদেবের রথ রাজপথে অগ্রসর হয়।আমাদের শাস্ত্রগ্রন্থে ভাই-বোনের পারস্পরিক সম্পর্কের বিষয়ে আমরা অনন্য দৃষ্টান্ত বেদ সহ রামায়ণে, মহাভারত এবং পুরাণের বিভিন্ন স্থানে পাই। কিন্তু শাস্ত্রগুলো পাঠ করলেও দুঃখজনকভাবে আমরা খুব একটা বিষয়গুলোর দিকে দৃষ্টি দিইনা। ভাই-বোনের পারস্পরিক সম্পর্ক রক্ষা করা অত্যন্ত জরুরি। এ বিষয়ে বেদেও সুনির্দিষ্টভাবে বলা আছে- ভাই যেন ভাইয়ের সাথে বিদ্বেষ না করে, বোন যেন বোনের সাথে বিদ্বেষ না করে। অর্থাৎ ভাইবোন সহ পরিবারের সকলে মিলে আমরা যেন সর্বদা ঐক্যবদ্ধভাবে থাকতে পারি।

আরও পড়ুনঃ  পিতৃপক্ষ ও দেবীপক্ষ কি? বিস্তারিত জানুন, সংশয় দূর করুন |

মা ভ্রাতা ভ্রাতরং দ্বিক্ষন্মা স্বসারমুতস্বসা।
সম্যঞ্চঃ সব্রতা ভূত্বা বাচং বদত ভদ্রয়া।।
(অথর্ববেদ: ৩.৬.৫.৩)

“ভাই ভাইকে বিদ্বেষ করবে না। বোন বোনকে বিদ্বেষ করবে না। তােমরা সকলে সম মতাবলম্বী ও সম কর্মাবলম্বী হয়ে মঙ্গলময় কথাবার্তা বলুক।”

ঐক্যবদ্ধতাতেই শক্তি, বিচ্ছিন্নতাতেই ধ্বংস ক্ষয় এবং বিপদ। ভাইবোনের সম্পর্কটি অছিদ্র হওয়া প্রয়োজন। এ সম্পর্কের মধ্যে যদি সামান্য একটি ছিদ্র হয়ে যায়, তবে সেই ছিদ্র দিয়েই কোন এক সময়ে কালসাপ চলে আসতে পারে। তাই ভাইবোনের অবিচ্ছেদ্য সম্পর্কের মধ্যে যেন কালসাপরূপ শত্রু এসে দংশন করতে না পারে; সে বিষয়ে আমাদের সজাগ থাকা প্রয়োজন।

কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

5/5 - (1 vote)

Leave a Reply