You are currently viewing অশ্বমুণ্ডধারী হয়গ্রীব অবতার কে? || শ্রীবিষ্ণুর মাথা কা *টা গেল কেন? || পৌরাণিক কাহিনী ||

অশ্বমুণ্ডধারী হয়গ্রীব অবতার কে? || শ্রীবিষ্ণুর মাথা কা *টা গেল কেন? || পৌরাণিক কাহিনী ||

দেহটি মানুষের, তাঁর চারটি হাতে শঙ্খ, চক্র, বেদ ও বরাভয়, মানুষের মতই দুটি পাও রয়েছে তাঁর, কিন্তু মাথাটি অশ্ব বা ঘোড়ার। সৃষ্টির প্রয়োজনে ঈশ্বর বিভিন্ন সময়ে মৎস, কূর্ম, বরাহ প্রভৃতি প্রাণীর রূপ ধারণ করেছিলেন বৈকি, কিন্তু অশ্ব বা ঘোড়ার রূপ ধারণ করা এই দেবতা আসলে কে? কেনই বা এই অদ্ভূত অবতার ধারন করলেন তিনি? আর এই ঘোটকরূপী অবতারে কি কল্যান সাধিত হয়েছিল সমগ্র মানব জাতির জন্য? আশা করি আপনাদের সকলের মনেই এখন এই প্রশ্নগুলোই উকি দিচ্ছে। আপনাদের সেই জ্ঞান তৃষ্ণা নিবারণ করতেই সনাতন এক্সপ্রেসের আজকের আলোচ্য বিষয় হয়গ্রীব। আসুন জেনে নেওয়া যাক, হয়গ্রীব অবতারের উৎপত্তি, প্রয়োজনীয়তা ও কৃতকর্মের কাহিনীগুলো।

ভগবান বিষ্ণুর প্রচলিত দশাবতার বা ২৪ অবতারের বাইরেও সৃষ্টির প্রয়োজনে বিভিন্ন সময় তিনি ধারণ করেছেন নানা রকমের অবতার। হয়গ্রীব অবতার ভগবান শ্রীবিষ্ণুর ঠিক তেমনই এক অবতার। এখানে হয়গ্রীব শব্দটি গঠিত হয়েছে হয় এবং গ্রীবা শব্দযুগলের মাধ্যমে। হয় শব্দের অর্থ অশ্ব বা ঘোড়া এবং গ্রীবা শব্দ দ্বারা বোঝানো হয় গলা বা মুখ। সুতারাং অশ্বমুণ্ড ধারণ করার কারনেই যে তাঁর নাম হয়েছে হয়গ্রীব তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু কেন শ্রী নারায়ণকে এই অশ্বমুণ্ড ধারণ করতে হল? আসুন এই প্রসঙ্গে জেনে নেওয়া যাক ৩টি চমৎকার পৌরাণিক কাহিনী।

১ম কাহিনীতে বলা হচ্ছে, কল্পান্তকালে সমগ্র মনুষ্য জাতির কল্যানার্থে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা যখন বেদ সৃষ্টি করেছিলেন, তখন মধু ও কৈটভ নামের দুই ধুরন্ধর অসুর সেগুলো হরণ করে নিয়ে যান। অসুরদের এই অনাসৃষ্টিতে বিপাকে পরলেন প্রজাপতি ব্রহ্মা। কারন বেদ হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার পরম চক্ষু, তাছাড়া বেদ হচ্ছে মনুষ্যকুলের জীবন বিধান তথা মূল ধর্মগ্রন্থ। তাই সমগ্র সৃষ্টি যদি এভাবে বেদবঞ্চিত হয়, তাহলে সৃষ্টির উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। তাহলে এখন উপায় কি? মোহাবিষ্ট হয়ে পড়লেন ব্রহ্মা, এরপর তিনি আকুল চিত্তে স্মরণ করলেন যোগনিদ্রায় শয়নরত ভগবান শ্রীবিষ্ণুকে। নিদ্রা ভাঙল নারায়ণের, এরপর ব্রহ্মার কাছ থেকে জানতে পারলেন দুই অসুর দ্বারা বেদ গ্রন্থ চুরি করার ঘটনা। ঠিক তখনই বেদ্গ্রন্থকে উদ্ধার হেতু শ্রীনারায়ণ ধারণ করলেন হয়গ্রীব মূর্তি। এরপর সেই অসুরদ্বয়ের অবস্থান চিহ্নিত করে চলে যান রসাতলে। আপনারা অনেকেই জেনে থাকবেন, পাতালের মোট ৭ টি স্তর রয়েছে যেগুলোকে একসাথে সপ্তপাতলি বলা হয়ে থাকে, এদের মধ্যে প্রথম স্তর হচ্ছে অতল, এরপর একেকে বিতল, সুতল, তলাতল, মহাতল, রসাতল ও পাতাল। এই রসাতলে পৌছে শ্রীবিষ্ণুর হয়গ্রীবাবতার দুই অসুররের অবস্থান চিহ্নিত করেন এবং তাঁদের কাছ থেকে বেদ উদ্ধার করে পুনরায় তা প্রত্যার্পণ করেন সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার কাছে। সেযাত্রায় বিষ্ণুর কৃপায় রক্ষা পেল বেদ এবং তা দ্বারা সমগ্র সংসার এক অমৃততুল্য জ্ঞানের স্বাদ আহরণ করতে সামর্থ্য হল। এবং পরবর্তীতে বেদ হরণকারী দুই অসুর মধু ও কৈটভেরও প্রাণনাশ করেন ভগবান শ্রীবিষ্ণু।

আরও পড়ুনঃ  দেবী দুর্গা গজ, ঘোটক, নৌকা ও দোলায় যাতায়াত করেন কেন?

এবার আসি দ্বিতীয় কাহিনীতে। দেবীভাগবত পুরাণে বর্ণিত হয়েছে, একদা সূর্যপুত্র রেবন্ত উচ্চৈঃশ্রবা নামক স্বর্গীয় ঘোড়ায় চড়ে বৈকুণ্ঠে বেড়াতে এসেছিলেন। আপনারা অনেকেই জেনে থাকবেন, এই উচ্চৈঃশ্রবা ছিল সাতটি মস্তকধারী এবং উড়ন্ত দৈবঘোটক। সমুদ্রমন্থনের সময় দেবী শ্রীলক্ষীর সাথে উত্থিত হয়েছিল এই উচ্চৈঃশ্রবা নামক ঘোড়াটি। তাই দেবী লক্ষী ঘোড়াটিকে নিজের ভ্রাতার মত আদরযত্ন করতেন। তো সূর্যপুত্র রেবন্ত যখন উচ্চৈঃশ্রবাকে নিয়ে লক্ষ্মী-নারায়ণের আবাসস্থল বৈকুণ্ঠে পৌঁছালেন, তখন উচ্চৈঃশ্রবাকে দেখে দেবী শ্রীলক্ষ্মী অত্যন্ত উৎফুল্ল হলেন। আনন্দের আতিশয্যে তিনি বৈকুণ্ঠের অতিথি রেবন্ত বা তাঁর স্বামী স্বয়ং নারায়ণকেও ভুলে গেলেন। দিনরাত উচ্চৈঃশ্রবার সেবাযত্নে নিয়োজিত থাকতেন তিনি। এভাবে কিছুকাল পার হয়ে যাওয়ার পর  বিরক্ত হলেন স্বয়ং নারায়ণও। এক পর্যায়ে তিনি দেবী লক্ষ্মীকে অভিশাপ দিয়ে বসলেন, “মর্ত্যে ঘোড়া রূপে জন্ম গ্রহণ করো।” এতক্ষণে সম্বিৎ ফিরে পেলেন দেবী শ্রীলক্ষ্মী। উচ্চৈঃশ্রবাকে পেয়ে নারায়ণের উপর তিনি কতটা বঞ্চনা করেছেন তা এবার তিনি নিজেই উপলব্ধি করতে পারলেন। কিন্তু স্বয়ং নারায়ণের উভিশাপ তো বিফল হওয়ার নয়, তাই তিনি তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “হে প্রভু, আপনার প্রতি আমার উদাসীনতার কারনে আমাকে এহেন অভিশাপ দেওয়া আপনার পক্ষে মোটেও অসঙ্গত নয়। কিন্তু হে প্রভু, আপনাকে ছেড়ে আমি মর্ত্যধামে গিয়ে শান্তি পাবো না। তাই দয়া করে আমাকে পুনঃরায় বৈকুণ্ঠে ফিরে আসার উপায় বলুন।”

নারায়ণ বললেন, হে দেবী, মর্ত্যে গিয়ে যদি তুমি নারায়ণ-তুল্য পুত্র লাভ করতে পারো, তাহলেই এই শাপ থেকে তুমি মুক্ত হবে। এরপর বিষ্ণুশাপের প্রভাবে ঘোটকী রূপে মর্ত্যে জন্ম নিলেন দেবী শ্রীলক্ষ্মী। তিনি বুঝতে পারলেন, নারায়ণতুল্য পুত্র লাভ করতে হলে তাঁকে অবশ্যই নারায়ণকে পতি রূপে প্রাপ্ত করতে হবে। তাই দেবী লক্ষ্মী এবার শুরু করলেন দেবাদিদেব মহাদেবের তপস্যা। তপস্যায় মহাদেব সন্তুষ্ট হলে দেবী লক্ষ্মী শিবের কাছে বর প্রার্থনা করলেন নারায়ণকে নিজের পতি হিসেবে লাভ করার জন্য। এরপর মহাদেবের পরামর্শে শ্রীনারায়ণ হয়গ্রীব রূপ ধারণ করে ঘোটকীরূপী লক্ষ্মীদেবীকে বিবাহ করেন এবং তাঁর ঔরসে দেবী লক্ষ্মী নারায়ণ তুল্য পুত্র লাভ করে পুনরায় বৈকুণ্ঠে ফিরে আসেন।

আরও পড়ুনঃ  কেন ও কিভাবে রাখবেন গণেশের মুর্তি। বাড়িতে গণপতি থাকলে অবশ্যই দেখুন

ভগবান শ্রীবিষ্ণুর হয়গ্রীবাবতারের তৃতীয় ও শেষ কাহিনীটি আরও চিত্তাকর্ষক।  একদা বৈকুন্ঠে নারায়ণ শ্রীলক্ষীর দিকে তাকিয়ে মৃদু হাস্য করেছিলেন। কিন্তু দেবী লক্ষ্মী ভাবলেন নারায়ণের এই চাহনি দিয়ে তাঁকে উপহাস করছেন। তাই তিনি শ্রীবিষ্ণুকে অভিশাপ দিলেন তাঁর মস্তক শিরোচ্ছেদ হয়ে যাবে। এর কিছুকাল পরে মধু ও কৈটভের সাথে তুমুল যুদ্ধ করে তাঁদেরকে পরাজিত ও নিহত করেন বিষ্ণু। সেই ভয়ংকর যুদ্ধে শ্রীবিষ্ণু অসুরগণকে পরাজিত করেছিলেন বৈকি, তবে যুদ্ধের শেষে তিনিও অত্যাধিক ক্লান্ত হয়ে তাঁর ধণুকের ছিলার উপরে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লেন। এদিকে মহর্ষি কশ্যপ ও তাঁর স্ত্রী দনুর দানব পুত্র হয়গ্রীব ছিলেন আদ্যাশক্তি মহামায়ার ভক্ত। দেবীর প্রতি প্রবল ভক্তি নিয়ে একদা তিনি শুরু করলেন মহামায়ার কঠোর তপস্যা। দীর্ঘকাল ধরে চলা সেই তপস্যায় প্রীত হলেন মাতা মহামায়া। তিনি দানব হয়গ্রীবের সম্মুখে প্রকট হয়ে বললেন, “হে বৎস, তোমার তপস্যায় আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। বল পুত্র কি বর চাই তোমার?”

 নিজের আরাধ্যা দেবীকে সম্মুখে দেখে হয়গ্রীব বলে উঠলেন, হে মাত, যদি আপনি আমার তপস্যায় পরিতুষ্ট হয়ে থাকেন, তাহলে আমাকে এই বর প্রদান করুন যে, দেবতা, অসুর, মানুষ কারও হাতে আমার যেন মৃত্যু না হয়। কেউই যেন আমাকে যুদ্ধ-সংগ্রামে পরাজিত করতে না পারে। যোগের অষ্টাদশ সিদ্ধি যেন আমার করায়ত্ত হয়। ফলতঃ আমি যেন অমর হয়ে চিরদিন এই জগতে বিচরণ করতে পারি। দেবী বললেন, “হে পুত্র, জগতে কেউই অমর নয়। মনুষ্যযোনীতে জন্ম নিলেই মৃত্যুর স্বাদ অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। তাই সেই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে আমি তোমাকে এই অমরত্বের বর দিতে অক্ষম। তবে তোমার অন্য কোন প্রার্থনা থাকলে তা আমার কাছে উপস্থাপন করতে পারো।” দেবী আদ্যাশক্তি মহামায়ার কথায় হতাশ হলেন দানব হয়গ্রীব। এরপর অনেক ভেবে-চিন্তে তিনি দেবীর কাছে বর চাইলেন, “তাহলে হে দেবী, আমাকে এই বর প্রদান করুন যে, একমাত্র আমার মত অশ্বমুণ্ড ধারী হয়গ্রীব ব্যাতীত আমাকে যেন কেউ বধ করতে না পারে।” এবার তাঁর প্রার্থনা মঞ্জুর হল। দেবী তাঁর প্রার্থনা মঞ্জুর করে অন্তর্ধান করলেন তাঁর সামনে থেকে। আর অভিলাষিত বর পেয়ে পরমানন্দিত হয়ে দানব হয়গ্রীব ফিরে গেলেন নিজ গৃহে।

আরও পড়ুনঃ  সপ্তাহের কোন বারে কোন দেবদেবীর পুজা করলে সৌভাগ্য আসবে?

দেবীর বরে বলীয়ান হয়ে কিছুকাল পরে দানব হয়গ্রীব এবার তাঁর আসল চেহারা প্রকাশ্যে আনলেন। অতিশয় বলশালী এই দানব দেবতা, মানব, ও ঋষিকুলকে সীমাহীন পীড়া প্রদান করতে শুরু করলেন। কিন্তু তাঁকে পরাস্থ করার কোন শক্তি সমস্ত বিশ্বভূবনে অনুপস্থিত। ত্রিলোকে এমন কোন পুরুষ ছিল না যিনি তাঁকে নিগৃহীত করতে পারেন। কোন কোন মতে তিনিও মধু ও কৈটভের মত ব্রহ্মার নিকট থেকে বেদ গ্রন্থ চুরি করেছিলেন যাতে মনুষ্যকুল জ্ঞানের পবিত্র আলোক থেকে বঞ্চিত হয়। দানব হয়গ্রীবের এই অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে দেবকুল বরাবরের মত শরণাপন্ন হলেন পালনকর্তা শ্রীবিষ্ণুর কাছে। কিন্তু মধু কৈটভকে বধ করার ক্লান্তিতে শ্রীবিষ্ণু তখনও তাঁর ধণুকের ছিলার উপরে মাথা রেখে নিদ্রা মগ্ন। এখন উপায়? অগত্যা উপায়ান্তর না দেখে প্রজাপতি ব্রহ্মা দেবতাদের নির্দেশ দিলেন যে ধণুকের উপর মাথা রেখে নারায়ণ নিদ্রিত আছেন সেই ধণুকের ছিলা অর্থাৎ জ্যা কেটে ফেলতে। ব্রহ্মার পরামর্শে দেবতারা যখন সেই ধণুকের জ্যা কর্তন করলেন, তখন ছিলার আঘাতে ঘুমন্ত নারায়ণের মস্তক ছিন্ন হয়ে লবণ সাগরে পতিত হল। ফলিত হল দেবী লক্ষ্মীর অভিশাপ। কিন্তু এবার ঘাবড়ে গেলেন দেবতারা। তাঁদের আশার শেষ কেন্দ্রবিন্দুটুকুও শেষ হয়ে গেল নারায়ণের মস্তক কর্তণ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে। এবার কি উপায় হবে তাঁদের? কে তাঁদেরকে রক্ষা করবে বিপুল বলশালী দানব হয়গ্রীবের হাত থেকে? আকুল দেবগণ এবার শরণাপন্ন হলেন দেবী মহামায়ার। মহামায়া তাঁদেরকে পরামর্শ দিলেন নারায়ণের স্কন্ধে একটি অশ্বমুণ্ড স্থাপন করার জন্য। এরপর দেবতাগণ একটি ঘোড়ার মস্তক নারায়ণের কাঁধে স্থাপন করলে শ্রীবিষ্ণু ধারণ করেন হয়গ্রীবাবতার। এবং নেই রূপে তিনি পরাজিত ও বধ করেন দূরাচারী দানব হয়গ্রীবকে।

5/5 - (1 vote)

Leave a Reply