শৈশব থেকেই উদ্ভব শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে থাকতেন; তার রথ চালানো থেকে শুরু করে অনেক সেবা করতেন। কিন্তু তিনি কখনোই ভগবানের কাছ থেকে কোনো সাহায্য বা বর প্রার্থনা করেননি। যখন ভগবান তাঁর শ্রীকৃষ্ণ অবতার লীলার প্রায় শেষ পর্যায়ে পৌছেছেন, তখন একদিন তিনি উদ্ভবকে বললেন,
“প্রিয় উদ্ভব, আমার এ অবতারে কত মানুষকে আমি সাহায্য করেছি, বর দিয়েছি। কিন্তু তুমি আমার কাছে কখনো কিছু চাও না। তুমি এখনই আমার কাছে কিছু প্রার্থনা করো; তোমাকেও কিছু কৃপা করার আনন্দ লাভের মাধ্যমে এ অবতারে আমার লীলা সমাপ্ত করতে চাই।”
যদিও উদ্ভব ভগবানের কাছে কিছু চাইতেন না, কিন্তু তিনি শৈশব থেকেই ভগবানের লীলা অত্যন্ত কাছ থেকে দেখতেন; ভগবানের শিক্ষা আর তাঁর কাজের মধ্যে কিছু আপাত অসামঞ্জস্য তাকে বিহ্বল করত, যার ব্যখ্যা জানতে তিনি সবসময় উদগ্রীব থাকতেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি আমাদের জীবনযাপনের একটা পথ দেখিয়েছেন, কিন্তু আপনি নিজে চলেছেন অন্যভাবে।
আপনার মহাভারত লীলায় আমি আপনার অনেক লীলার কিছুমাত্র বুঝিনি। আমি আপনার কর্ম এবং তাঁর উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানতে অত্যন্ত উদগ্রীব, কৃপাপূর্বক আপনি আমার অভিলাষ পূর্ণ করবেন কি?” শ্রীকৃষ্ণ বললেন, “মহাভারতে যা আমি অর্জুনকে বলেছিলাম তা ভগবত-গীতা নামে খ্যাত, আজ আমি তোমাকে যা বলব তা উদ্ভব গীতা নামে খ্যাত হবে। নিঃসংকোচে জিজ্ঞেস করো।” উদ্ভব বললেন, “প্রথমে আমায় বলুন, প্রকৃত বন্ধু কে?”
শ্রীকৃষ্ণ বললেন, “প্রকৃত বন্ধু সেই, যে বন্ধুর বিপদে সাহায্যের আহ্বানের অপেক্ষা না করেই বন্ধুর সাহায্যে চলে আসে।” উদ্ভব বললেন, “আপনি তো পান্ডবদের প্রিয় বন্ধু ছিলেন, তারা আপনাকে আপাদবান্ধব (সব বিপদের পরিত্রাতা) বলে বিশ্বাস করত। আপনি তো শুধু বর্তমান নয়, ভবিষ্যৎও জানেন; আপনি সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী; আপনি কি তাদের সাথে প্রকৃত বন্ধুর মতো আচরণ করলেন?
আপনি কেন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে পাশা খেলা থেকে বিরত রাখলেন না? আর যখন তা করলেন না, তবে কেন ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের পক্ষে ভাগ্যকে পরিচালিত করলেন না যাতে অন্তত ধর্মের জয় হতো। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির ধন-সম্পদ, রাজ্য ও নিজেকে হারানোর পর আপনি তো পাশা খেলা বন্ধ করতে পারতেন। পাশা খেলার দন্ড থেকে আপনি তাঁকে রক্ষা করতে পারতেন। আপনি তাও করেননি।
দুর্যোধন যখন প্রস্তাব করেছিল যে, পান্ডবদের সব সৌভাগ্যের উৎস দ্রৌপদীকে পাশার বাজী রাখলে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের সব হারানো সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়া হবে, আপনি তো তখন আপনার ঐশ্বরিক ক্ষমতা ব্যবহার করে পাশার গুটিকে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের পক্ষে চালিত করতে পারতেন। বরং আপনি তখন এলেন, যখন দ্রৌপদী তার সম্ভ্রম প্রায় হারিয়ে ফেলেছেন। আর আপনি দাবি করেন যে, আপনি বস্ত্র দিয়ে তার সম্ভ্রম রক্ষা করেছেন?
সভায় এতগুলো মানুষের মধ্যে একজন স্ত্রীলোকের চুল ধরে টেনে হিঁচড়ে এনে তার পরনের বস্ত্র প্রায় খুলে ফেলার পর তার কোনো সম্মান আর বাকি ছিল কি? আপনি তার কী রক্ষা করলেন? চরম বিপদের সময় আপনি সবাইকে রক্ষা করেন বলে আপনার নাম আপাদবান্ধব। বিপদের সময়ই যদি আপনি সাহায্য না করলেন,তাহলে এ সাহায্যের অর্থ কী? এই কি ধর্ম?” প্রশ্নগুলো করতে করতে উদ্ধবও অঝোর নয়নে কান্না করছিলেন। আসলে এ প্রশ্ন শুধু উদ্ধবের একার নয়; যারা মহাভারত পড়েছে, তাদের অনেকের মনেই এ একই প্রশ্নের উদয় হয়, উদ্ভব অনেক আগেই ভগবানকে জিজ্ঞেস করেছেন।
ভগবান হেসে বললেন, প্রিয় উদ্ধব, এ পৃথিবীর নিয়ম হলো শুধু তারাই জেতে যাদের বিবেক (ভালো-মন্দ পার্থক্যের বিচারবোধ) আছে। যুধিষ্ঠিরের বিবেক কাজ করেনি যখন দুর্যোধনের বিবেক কাজ করেছিল, তাই দুর্যোধনের জয় হয়েছিল।” শ্রীকৃষ্ণের কথায় উদ্ধব আরো দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়ল। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলতে লাগলেন,
“দুর্যোধনের অনেক সম্পদ ছিল, কিন্তু সে পাশা খেলতে জানতো না, তাই সে মামা শকুনিকে তার জায়গায় খেলতে বলেছিল। এটা বিবেক। ঠিক একইভাবে যুধিষ্ঠির মহারাজও আমাকে তার হয়ে খেলতে বলতে পারতো, যেহেতু আমিও সম্পর্কে তার পিসতুত ভাই। কে জিততো, খেলাটা যদি আমার আর শকুনি মামার মধ্যে হতো? তোমার কী মনে হয় উদ্ধব? আমি কী করে যুধিষ্ঠিরকে ক্ষমা করি, যখন সে আমাকেই ভুলে গিয়েছিল?”
“বিবেকবর্জিত অবস্থায় সে আরো একটা বড় ভুল করে বসল; সে প্রার্থনা করল, আমি যেন পাশার ওই সভাতে না যাই, আর তার এ প্রতারণার শিকার হয়ে বাধ্য হয়ে পাশা খেলার পরিণতির কথা না জানি। সে প্রার্থনা দিয়ে পাশার ওই সভার বাইরে আমাকে বেঁধে ফেলল, আমি তো বাইরে অপেক্ষা করছিলাম, আর প্রত্যাশা করছিলাম কেউ অন্তত আমাকে ভেতরে আসার প্রার্থনা করুক।
যখন ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেবও হেরে গেল, তখন তারা দুর্যোধনকে অভিসম্পাত, আর নিজেদের ভাগ্যকে দোষারোপ করায় ব্যস্ত ছিল; আমাকে কেউ স্মরণ করেনি। দুর্যোধনের আদেশে দুঃশাসন যখন দ্রৌপদীর চুল ধরে টেনে হিঁচড়ে সভায় নিয়ে এলো, দ্রৌপদী তখনও আমাকে স্মরণ করেনি; তার নিজের সামান্য ক্ষমতার ওপর নির্ভর করে প্রতিবাদ করছিল মাত্র; একবারও আমাকে স্মরণ করেনি। দুঃশাসন যখন তার বস্ত্র হরণ করতে শুরু করল, তখন তার কিছুটা শুভবুদ্ধির উদয় হলো, নিজের শক্তির ওপর আস্থা হারিয়ে তখন চিৎকার করতে শুরু করল- হে হরি অভয়ম্, হে কৃষ্ণ অভয়ম্। তখন আমি তাকে সাহায্য করার সুযোগ পেলাম, আমাকে ডাকা মাত্রই আমি ছুটে গিয়েছি। এখন তুমিই বল, আমার দোষটা কোথায়?”
উদ্ধব বললেন, “অসাধারণ ব্যাখ্যা প্রভু, আমি সন্তুষ্ট। আমি কি আপনাকে আরেকটা প্রশ্ন করতে পারি?” শ্রীকৃষ্ণ অনুমতি দিলে উদ্ধব জিজ্ঞেস করলেন, “প্রভু, তাহলে আপনি কি শুধু ডাকলেই আপনার ভক্তের সাহায্যে আসেন, নিজে থেকে ধর্ম রক্ষার জন্য আসেন না?”
শ্রীকৃষ্ণ হেসে বললেন, “উদ্ধব, পৃথিবীতে সবার জীবন চালিত তাদের কর্মফলের ওপর। আমি এতে কোনো হস্তক্ষেপ করি না, আমি তোমার অত্যন্ত কাছ থেকে সবকিছুর সাক্ষী হই মাত্র। এটাই ঈশ্বরের ধর্ম।”
উদ্ধব বললেন, “ও, তাহলে আপনি আমাদের খুব কাছে থেকে আমাদের পাপকর্ম করতে দেখতে থাকবেন; আমারা যখন পাপের পর পাপ করতে থাকব, আপনি তখনো দেখতে থাকবেন। আপনি কি চান আমারা একের পর এক পাপ করতেই থাকি, ভুল করতে থাকি, আর তার ফলে শাস্তি পেতে থাকি?”
শ্রীকৃষ্ণ বললেন, “উদ্ধব, তোমার প্রশ্নের গভীরতা অনুধাবন করো। তুমি যখন বুঝতে পারছ আমি তোমার খুব কাছে তোমার সব কর্মের সাক্ষী হই, কী করে তুমি খারাপ বা অনৈতিক কাজ করো? তুমি ভবো, আমার অজ্ঞাতেই তুমি অনেক কিছু করতে পারো, আর ঠিক তখনি তুমি বিপদে পড়। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের অজ্ঞতা ছিল এই যে, তিনি ভেবেছিলেন তিনি আমার অজ্ঞাতে পাশা খেলবেন। যদি তিনি সত্যি এটা অনুধাবন করতেন যে, আমি সবসময় সবার সঙ্গে তাদের কর্মের সাক্ষী থাকি, তাহলে কি পাশার ওই সভা ভিন্নভাবে শেষ হতো না?”
উদ্ধব বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন, ভক্তিতে আপ্লুত হলেন। তিনি বললেন, “কী সুগভীর দর্শন! কী সুমহান সত্য! আমরা যখন এটা জানি যে, কোনোকিছুই ভগবান ছাড়া চলে না, তখন আমরা কীভাবে সাক্ষী হিসেবে তাঁর উপস্থিতি অনুধাবন করতে পারিনা? এ চরম সত্য ভুলে গিয়ে আমরা কীভাবে কর্ম করি? ভগবদ্গীতা জুড়ে এই শিক্ষাই তো ভগবান অর্জুনকে দিয়েছেন। তিনি অর্জুনের রথের সারতি তথা তার পথনির্দেশক হয়েছেন, নিজে যুদ্ধ করেননি।”
চলুন, আমরা সবাই আমদের ভেতরে বাইরে সর্বাবস্থায় সেই চিরন্তন সাক্ষীকে অনুধাবন করি তথা কৃষ্ণভাবনামৃতে নিমজ্জিত হই। আমাদের ভেতরে সেই মহান সত্ত্বার উপস্থিতি আবিষ্কার করি, যিনি প্রেমময় কৃপাময় পরমচৈতন্য।