সংকট মোচনকারী শ্রীহনুমান- আজীবন ব্রহ্মচারী, ৭ জন চিরঞ্জীবীর একজন, প্রভু শ্রীরামচন্দ্রের পরম ভক্ত এবং রুদ্র তথা শিবের একদাশ অবতার। পবনপুত্র, কেশরী নন্দন, অঞ্জনীপুত্র, বজরংবলি এরকম হাজারো নামে তিনি আসীন হয়ে আছেন বিশ্বের কোটি কোটি সনাতন ধর্মাবলম্বীদের হৃদয়ে। কিন্তু প্রশ্ন হল তিনি ব্রহ্মচারী তথা সারাজীবন অবিবাহিত থাকার সত্ত্বেও কিভাবে মকরধ্বজ নামক এক পুত্রের জনক হয়েছিলেন তিনি? তবে কি তিনি গোপনে বিবাহ করেছিলেন? নাকি কোন অলৌকিক কারনে জন্ম নিয়েছিলেন তাঁর এই পুত্র? হনুমান ও তাঁর পুত্র মকরধ্বজের সেই পৌরাণিক কাহিনী নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন। তথ্যপূর্ণ মনে হলে কমেন্টে একবার জয় শ্রীহনুমান লিখে যাবেন।
হনুমান ও তাঁর পুত্র মকরধ্বজের এই কাহিনী জানা যায় কৃত্তিবাসী রামায়ণ থেকে। তাছাড়া থাইল্যান্ড ও কম্বোডিয়ায় প্রচলিত রামায়ণের সংস্করণেও হনুমান ও তাঁর পুত্রের কথা জানা যায়। তবে সেখানে হনুমানের পুত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে মাচ্ছানু বা মৎসানু নামক এক বানর সরীসৃপকে। তবে বাল্মিকী রামায়ণে শ্রী হনুমানকে ব্রহ্মচারী বা চিরকুমার হিসেবেই উল্লেখ করা হয়েছে। যাইহোক, এবার তাহলে আসল কাহিনীতে প্রবেশ করা যাক। রাম-রাবণের মহাযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে রাবণের প্রহারে অসুস্থ হন রাম-লক্ষণ সহ অসংখ্য বানর সেনা। সেসময় গন্ধমাদন পর্বত থেকে আনা জড়িবুটি সেবন করে সুস্থ হয়ে ওঠেন তাঁরা সবাই। এসময় রাবণ খবর পাঠান তাঁর পুত্র মহীরাবণের কাছে। দেবী পাতাল ভৈরবীর কপায় এই মহীরাবণ ছিলেন পাতালের রাজা এবং তাঁর পুত্রের নাম ছিল অহিরাবণ। তবে কোন কোন মতে তাঁরা ছিলেন আপন ভ্রাতা। যাইহোক মহীরাবণ বুদ্ধি করে পাতাল লোক থেকে সুড়ঙ্গ খনন করে পৌছে যান রাম-লক্ষণের শিবিরে। পাতাল দেবীর কৃপাধন্য ও অসাধারন মায়াশক্তিসম্পন্ন মহীরাবণ প্রথমেই নিজের বেশ পরিবর্তন করে ধারণ করেন রামের সহযোগী বিভীষণের রূপ। এরপর তিনি স্বাচ্ছন্দ্যে পৌছে যান রাম-লক্ষণের সন্নিকটে। তিনি বিভীষণের রূপ ধারণ করে রাম শিবিরে প্রবেশ করেছিলেন বিধায় দ্বারপাল বা রক্ষীগণও তাঁকে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করেননি। রাম-লক্ষণের নিকটে পৌছে তিনি তাঁর মায়া পাশ দ্বারা তাঁদের দুইজনকেই বেঁধে ফেলেন এবং তড়িৎ গতিতে নিয়ে আসেন পাতাল পুরীতে।
এদিকে মহীরাবণ রাম-লক্ষণকে অপরহরণ করে নিয়ে যাওয়ার পর রাম শিবিরে প্রবেশ করছিলেন বিভীষণ। তাঁকে দেখে আশ্চর্য হলেন দ্বাররক্ষীরা। তাঁরা জানালেন কিছুক্ষণ আগেই বিভীষণ তাঁদের সামনে দিয়েই শিবিরে প্রবেশ করেছেন। শুনে আশ্চর্য হলেন বিভীষণ। ইতিমধ্যেই সংবাদ এলো রাম-লক্ষণ শিবিরে অনুপস্থিত। সকল ঘটনা শুনে শ্রীহনুমান বুঝতে পারলেন কে বা কারা ছলনার আশ্রয় নিয়ে তাঁর প্রভু শ্রীরামচন্দ্র ও লক্ষণকে হরণ করেছেন। এসময় শিবিরের সন্নিকটে পাতালগামী একটি সুড়ঙ্গের সন্ধান পেলেন তিনি। আর সেখান থেকে তিনি বুঝতে পারলেন রাম-লক্ষণকে হরণ করে পাতালপুরীতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সুতারাং তিনিও আর দেরী না করে বেরিয়ে পড়লেন পাতালের উদ্দেশ্যে। দীর্ঘ পথ ভ্রমণ করে অবশেষে তিনি পৌছে গেলেন পাতাল রাজ্যে। সেখানে এক অন্ধকার প্রকোষ্ঠে পৌছে শ্রীহনুমান আবিষ্কার করলেন, বিশালাকৃতির এক পাতাল ভৈরবীর মূর্তির সামনে মায়াপাশে বাঁধা রয়েছেন দুই দশরথ নন্দন রাম-লক্ষণ। কিন্তু পাতাল ভৈরবীর মূর্তির সামনে রাম ও লক্ষণকে বেঁধে রাখার পিছনে কি কারণ থাকতে পারে এবং কিভাবেই বা তাদেরকে উদ্ধার করা যায় এই নিয়ে একটু আড়ালে বসে ভাবতে থাকলেন শ্রী হনুমান।
এমন সময় রাম লক্ষ্মণ কে এনে হাঁড়িকাঠের সামনে উপস্থিত করলেন রক্তবস্ত্র, রক্ততিলক ও রুদ্রাক্ষে ভূষিত রাক্ষস মহীরাবণ। মহীরাবণ বলল- “রাম লক্ষ্মণ! তোমাদের অসীম সৌভাগ্য যে মহামায়ার সেবায় নিয়োজিত হচ্ছ। এবার হাঁড়িকাঠে মাথা রেখে দেবীর উদ্দেশ্যে প্রণাম করে উৎসর্গ হওয়ার জন্য প্রস্তুত হও।”এসময় রাম-লক্ষ্মণ বললেন- “অবশ্যই! কিন্তু আমরা অযোধ্যার রাজপুত্র। আমাদের পিতা শক্তিশালী নৃপতি ছিলেন। তাই সকলেই আমাদের প্রণাম করতো কিন্তু আমরা কখনো কাউকে প্রণাম করিনি । কিভাবে প্রণাম করতে হয়- জানিও না।” মহীরাবণ কিছুটা বিরক্ত হয়ে “জয় মা ” ধ্বনি করে হাড়িকাঠে মাথা রেখে রাম-লক্ষণকে বোঝাতে লাগলেন কিভাবে হাড়িকাঠে মাথা দিয়ে প্রণাম করতে হয়। এমন সময় দেবী পাতাল ভৈরবীর মূর্তির আড়াল থেকে লাফ দিয়ে বেরিয়ে এলেন হনুমান। প্রথমেই তিনি মহীরাবণের গলা হাড়িকাঠের শিকে আটকে দিলেন এবং পরে তাঁর শিরোচ্ছেদ করে তাঁকে দেবীর উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করলেন। মুক্ত হলেন রাম লক্ষ্মণ। কিন্তু যুদ্ধ তখনও শেষ হয় নি। এবার মহীরাবণ ও তাঁর পুত্র অহিরাবণের পোষ্য রাক্ষসেরা এসে আক্রমণ করলেন রাম-লক্ষণ ও হনুমানকে। শুরু হল প্রবল যুদ্ধ। সেই ভয়ংকর যুদ্ধে রাক্ষস সেনাদের নিধন করলে লাগলেন তাঁরা তিন জন।
এসময় হনুমানের সাথে যুদ্ধ করতে এলেন বানর ও কুমিরের সংমিশ্রনে তৈরি এক যোদ্ধা। শ্রীহনুমান এত বিপুল শক্তির অধিকারী হয়েও কোনভাবেই যেন পেরে উঠছিলেন না সেই যোদ্ধার কাছে। প্রবল যুদ্ধে দুজনেরই রক্তপাত হল, শরীরে আঘাত লাগলো কিন্তু তাঁর পরেও দুজনই অপরাজিত। শেষমেশ ক্লান্ত হয়ে পড়লেন দুজনই। বীর হনুমান তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, “হে যুবক, কে তুমি? আমার সাথে যুদ্ধ করার শক্তি ও সাহস তুমি কিভাবে পেলে?” উত্তরে সেই যুবক উত্তর দিলেন, “আমি হনুমান পুত্র মকরধ্বজ। এবং মহীরাবণের বিশ্বস্ত সেনা। আমাকে পরাস্ত করা এত সহজ নয়। ” মকরধ্বজের উত্তর শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন হনুমান। বললেন, “হে যুবক, তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে। আমিই সেই পবন পুত্র হনুমান। আমি ব্রহ্মচারী এবং আমার কোন পুত্র নেই।” এবার একটু নমনীয় হলেন মকরধ্বজ। তিনি কোমল স্বরে বললেন, “হে পিতা। আমি যে আপনারই পুত্র তা আপনার জানার কথাই নয়। আমি নিজে আমার জন্ম কাহিনী আমার মাতার মুখে শ্রবণ করেছি। আপনি যখন লঙ্কাপুরীতে অগ্নিসংযোগ করে আপনার লেজের আগুন নেভাতে সাগরে এসেছিলেন, তখন আপনার শরীর থেকে এক বিন্দু ঘাম পতিত হয়েছিল জলে। এবং ঘটনাক্রমে সেই ঘামের ফোঁটাটি পান করেছিলেন এক মকরকন্যা তথা কুমীর কন্যা। অতপর আপনার সেই ঘামের মাধ্যমে তিনি গর্ভবতী হন এবং আমার জন্ম হয়। ”
হনুমান ও মকরধ্বজের এই আলাপচারিতার মধ্যেই ছুটে আসেন মহীরাবণের পুত্র অহিরাবণ। এরপর হনুমানের প্রহারে মস্তিষ্ক চূর্ণ হয়ে মৃত্যুবরণ করল অহিরাবণ। শেষ হল যুদ্ধ। কিন্তু হনুমান যেন একেবারে মুষড়ে পড়লেন। বললেন, “সমস্ত সংসার আমাকে ব্রহ্মচারী নামেই জানে। কিন্তু আমি যে এক পুত্র সন্তানের জনক তা জানাজানি হলে এই বিশ্ব সংসার আমাকে মিথ্যাবাদী নামে জানবে। ” এসময় শ্রীহনুমানের পাশে এসে তাঁর মাথায় হাত রাখলেন ভগবান শ্রী রামচন্দ্র। তিনি বললেন, “হে হনুমান। বৃথা রোদন করো না। যা কিছু ঘটে তার পেছনে কোন না কোন শুভ উদ্দেশ্য থাকে। তুমি স্বেচ্ছায় নারীসঙ্গ করো নি, সুতরাং এখানে তোমার বিন্দুমাত্র দোষ নেই। এখন যদি তুমি নিজেকে অপরাধী ভাবো তাহলে তোমার পুত্র মকরধ্বজ অত্যন্ত দুঃখী হবে। তুমি বরং পুত্রকে আলিঙ্গন করে স্নেহ এবং আশীর্বাদ প্রদান করো।” এসময় মকরধ্বজ এসে হনুমানের চরণে প্রণাম করতে উদ্যত হলে হনুমান বললেন, “হে পুত্র, আমাকে নয় আগে প্রভুকে প্রণাম করো।” মকরধ্বজ পিতার কথামত ভগবান শ্রীরামচন্দ্র ও লক্ষ্মণকে প্রণাম করে পিতা হনুমানকে প্রণাম করলেন। তাঁরা তিন জনই প্রাণ ভরে আশির্বাদ করলেন মকরধ্বজকে। এসময় শ্রীরামচন্দ্র বললেন, “হে হনুমান পুত্র মকরধ্বজ, আজকের প্রলয়ংকরী যুদ্ধে পাতালপুরী শাসক শূন্য হয়েছে। অনতিবিলম্বে এস্থানের শাসক নিযুক্ত না করা হলে অরাজকতা সৃষ্টি হবে। তাই আজ থেক বীর প্রতাপী হয়ে পাতাল পুরী শাসন করো। সদা ধর্ম পথে থাকো এবং পিতার আদর্শকে হৃদয়ে লালন করো।”
এই বলে হনুমান পুত্র মকরধ্বজকে পাতালপুরীর রাজা নিযুক্ত করে পুনরায় লঙ্কার যুদ্ধক্ষেত্রে ফিরে গেলেন রাম-লক্ষণ এবং তাঁদের পরম ভক্ত হনুমান।