প্রবাদ বলে, যম-জামাই-ভাগনা তিন নয় আপনা। তাই পৃথিবীলোকে বসবাসরত বেশিরভাগ মানুষের কাছে এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম হচ্ছে যমরাজ। জীবের নশ্বর দেহ ত্যাগ করার পরেই সর্বপ্রথম পাপাত্মার সাথে সাক্ষাৎ ঘটে যমরাজের। তিনিই তাঁদের পাপ-পূন্যের বিচার করে স্বর্গে প্রেরণ করেন অথবা নিক্ষেপ করেন নরকের অন্ধকার গলিতে। একাধিক পুরাণ, মূর্তিকল্প ও ভারতীয় চিত্রকলায় যমরাজের যে চিত্র ফুটে উঠেছে তা দেখেই রক্ত হিম হওয়ার মত অবস্থা হয় সাধারন মানুষের। তবে যম সম্পর্কে এর চেয়ে বিস্তারিত তথ্য আর পাওয়া যায় না। কোন এক অজ্ঞাত কারনে অথবা হয়ত আতংকগ্রস্থ হয়ে যম সম্পর্কে আমরা চর্চা করতে ভুলে যাই। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে যম সম্পর্কে আমাদের সমস্ত ভাবনা সত্য নাও হতে পারে। তাই আজ যম সম্পর্কে যাবতীয় জানা অজানা তথ্য নিয়ে হাজির সনাতন এক্সপ্রেস। আজকের ভিডিওতে আমরা জানতে চেষ্টা করব যমরাজ আসলে কে? কিভাবে তিনি যমরাজা হিসেবে নির্বাচিত হলেন? মর্ত্ত্য থেকে মানুষের আত্মা সংগ্রহ করে তিনি করেন টা কি? আর এসব করতে তাঁকে মহিষের পীঠেই বা চড়তে হয় কেন? এছাড়াও যমের জন্ম, মৃত্যু এবং জীবনের নানা ঘটনা দিয়ে সাজানো হয়েছে আমাদের আজকের আয়োজন। তবে আমাদের আজকের পর্বটি সম্পূর্ণরূপে বেদ, পুরাণ, উপনিষদ, রামায়ণ এবং মহাভারতে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে নির্মিত, এখানে আমাদের কোন নিজস্ব মতামত নেই এবং সত্য মিথ্যা নির্ণয় করার সুযোগ নেই। তাই আশা করি, কমেন্ট বক্সে কোন মন্তব্য করার সময় এই বিষয়গুলো মাথায় রাখবেন।
যম শব্দটি উৎপন্ন হয়েছে যমজ শব্দটি থেকে। বিবস্বত অর্থাৎ সূর্যের দুজন যমজ পুত্র-কন্যার মধ্যে পুত্রকে বলা হয় যম এবং কন্যাটিকে বলা হয় যমী বা যমুনা।এই যম এবং যমুনাকে কেন্দ্র করেই আজকের ভাইফোঁটা অনুষ্ঠানে বোনেরা উচ্চারন করেন-
ভাইয়ের কপালে দিলাম ফোঁটা
যমের দুয়ারে পড়ল কাঁটা
যমুনা দেয় যমকে ফোঁটা,
আমি দিই আমার ভাইকে ফোঁটা॥
তবে যমুনা যমকে আদৌ ফোঁটা দিয়েছিলেন কিনা সে বিষয়ে বিস্তর সন্দেহ রয়েছে বেদজ্ঞদের। তাছাড়া যমী ও যমুনা আলাদা নারী কিনা এবং যম ও যমীর মধ্যে আদৌ ভাই-বোন সুলভ সম্পর্ক ছিল কিনা তা নিয়ে অজস্র মদভেদ প্রচলিত রয়েছে পণ্ডিতগনের মধ্যে। তাই যম যমুনা এবং যমীর দিকে না গিয়ে আপাতত যমরাজার দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক।
বেদ, পুরাণ, উপনিষদ, রামায়ণ ও মহাভারতে ব্যাপকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যমরাজকে। শাস্ত্রমতে সমস্ত জীবের ধর্ম-অধর্মের বিচারক হচ্ছেন যমরাজ। ঋকবেদে সূর্য ও সংজ্ঞার পুত্র হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে যমরাজকে। যম বা যমরাজা ছাড়াও বিভিন্ন প্রামাণ্য গ্রন্থে কালা, লোকপাল, কালপুরুষ, ধর্মরাজ ইত্যাদি নামে নামাঙ্কিত করা হয়েছে মৃত্যুদূত যমকে। তাঁর শরীরের রঙ কখনো ঝড়ের পূর্ববর্তী মেঘের মত, কখনো নীলাভ আবার কখনো লাল। পরনে উত্তপ্ত সোনার মতো পোশাক, এক হাতে গদা এবং অন্য হাতে দড়ির ফাস নিয়ে প্রকাণ্ড একটি মহিষের উপর আসীন হয়ে আছেন তিনি। আবার কোন কোন রূপে তিনি চার হাত বিশিষ্ট, জ্বলন্ত আগুনের মালা দ্বারা ঘেরা এবং লাল, হলুদ বা নীল পোশাক পরিহিত। এবং এইরূপে তাঁর হাতে দেখা যায় যমদণ্ড, ফাদ, গদা, তরবারি, ড্যাঙস, ডাণ্ডা ইত্যাদি।
যমরাজ নরক নামক পাপীদের গ্রহের অধিপতি। পুরাণমতে পৃথিবীলোক থেকে বহু যোজন নীচে নরক নামক গ্রহলোক অবস্থিত। পাপীদের আবাসস্থল হওয়ার কারনে এই নরকপুরীতে সর্বক্ষন শোনা যায় পীড়িত পাপাত্মাদের আর্তচিৎকার এবং নাকে আসে উৎকট পোড়া ও পচা গন্ধ। এই নরকপুরীর যমালয়ে সংযমনী নামক যমপুরীতে সস্ত্রীক বসবাস করেন যমরাজ। তবে যমের স্ত্রী বা স্ত্রীদের নাম নিয়ে দ্বিমত রয়েছে সনাতন শাস্ত্র গ্রন্থগুলিতে। সাধারনভাবে যমের স্ত্রী হিসেবে ধুমর্ণা, শ্যামলা, বিজয়া, উর্মিলা, হেমা, মালা, এবং সুশীলার নাম পাওয়া গেলেও, পণ্ডিতগণ ধুমর্ণাকে যমের প্রধান বা একমাত্র স্ত্রী হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন। এছাড়াও যমালয়ে যমের সভার প্রধান হিসাবরক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন চিত্রগুপ্ত। উল্লেখ্য, কোন একসময় যমালয়ে যমকে হিসেব নিকেশের কাজে সাহায্য করার জন্য ব্রহ্মার কাছে একজন সহকারী চেয়েছিলেন যমরাজ। এর ফলে ব্রহ্মার শরীর থেকে যমের সহকারী হিসেবে উৎপন্ন হয়েছিলেন এই চিত্রগুপ্ত। এছাড়াও যমের অধস্তন হিসেবে অসংখ্য যমদূতগন বসবাস করেন যমলোকে। এদের মধ্যে মহাচন্দ ও কালপুরুষের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
যাইহোক, পাপীদের পার্থিব লীলা শেষ হওয়ার পর মুহূর্তের মধ্যেই যমরাজ বা তাঁর যমদূতগণ পাপাত্মাটিকে যমসদনে নিয়ে যান। এরপর চিত্রগুপ্তের হিসাবের খাতা থেকে মৃত ব্যাক্তির পাপ-পূণ্যের হিসেব কষে শাস্তির মাত্রা নির্ধারন করা হয় তাঁদের জন্য। এবং নরকলোকে যমরাজার প্রদান করা দন্ডকে বাস্তবায়িত করতে ড্যাঙস পেটাও করে থাকেন যমদূতগণ। তাই পৃথিবী ব্যাপী মানুষের কাছে যমরাজ মহা ভয়ংকর এক মৃত্যুদেবতা। তিনি স্বয়ং মৃত্যু স্বরূপ, নীরবে, নিভৃতে এবং ধীরপায়ে তিনি হাজির হন মানুষের দ্বার প্রান্তে, আর এক নিমেষেই মায়ার বাধন ছিন্ন করে নিয়ে যান যমালয়ে। তাই তাঁকে ঠেকানোর ক্ষমতা কারও নেই, তিনি অনিবার্য। এই কারনেই লালন ফকির বলেছেন-
“দেখে শুনে হয় না রুচি
যমে তো কাউকে ছাড়বে না”
তবে বিভিন্ন বৈষ্ণবীয় গ্রন্থে যমরাজাকে সজ্জন, পরম বৈষ্ণব, মহাজন বা বিষ্ণুভক্ত হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ মতে “কৃষ্ণপ্রাণা যমুনাদেবীর ভ্রাতা যম ঠাকুর সংসারবদ্ধ জীবকে কৃষ্ণনাম করতে দেখলে আনন্দিত হন ” অর্থাৎ, কৃষ্ণভক্ত যমুনা দেবীর ভ্রাতাকে যমকে যমঠাকুর নামে অভিহিত করা হয়েছে এবং কৃষ্ণনামে তিনি সন্তুষ্ট হন।
যাইহোক, সনাতন শাস্ত্র গ্রন্থ অনুযায়ী যমরাজই হলেন সেই ব্যাক্তি যিনি এই পৃথিবীলোকে সর্বপ্রথম মৃত্যুবরণ করেছিলেন। এবং প্রথম পার্থিব নশ্বর হিসেবে যমরাজকে মৃত্যুর অধিপতি হিসেবে অভিষিক্ত হন তিনি।
এবার আসি যমরাজের বাহন মহিষটির ব্যাপারে। ঘন অন্ধকারের ন্যায় যমরাজের সাথে বাহন হিসেবে কালো কুচকুচে মহিষটির দাঁড়িয়ে থাকাটা মোটেও কাকতালীয় ব্যাপার নয়। আসলে মহিষ একটি ধীরগতির প্রাণি। আর মানুষের জন্মের সাথে সাথে এই ধীর গতির বাহনে চড়ে আস্তে আস্তে তাঁর দিকে অগ্রসর হন যমরাজ। অর্থাৎ, আপনার জন্মের সাথে সাথে যমরাজ তাঁর বাহন মহিষে চেপে আপনার দিকে রওনা করেছেন। যেদিন তিনি আপনার সন্নিকটে পৌছে যাবেন, সেটিই আপনার জীবনের শেষ দিন। এদিক দিয়ে দেখতে গেলে, মানুষের জীবনকাল যমরাজের মহিষটির আমাদের নিকট আসতে অতিক্রান্ত সময়কালের সমান। সোজা কথায়, জন্মের দিন থেকেই শুরু হয়ে যায় আমাদের মৃত্যুর কাউন্টডাউন । তাই আসুন আমরা আমাদের কর্মে আরও যত্নবান হই, কুকর্ম এবং অধর্ম পরিত্যাগ করে মহাপুরুষদের পদাঙ্ক অনুসরন করি।