You are currently viewing দেবতাদের চেয়ে শক্তিশালী ১২ জন ভয়ংকর অসুর

দেবতাদের চেয়ে শক্তিশালী ১২ জন ভয়ংকর অসুর

সনাতন শাস্ত্রমতে স্বর্গের দেবতাগণ অসীম ক্ষমতার অধিকারী। তাঁরা অমর, অবিনশ্বর, অজেয়। কিন্তু নিয়তির আয়োজনে কখনো কখনো দিতির পুত্র অসুর ও দৈত্য, দানুর পুত্র দানব ও ব্রহ্মাসৃষ্ট রাক্ষসগণ হয়ে ওঠেন দেবতাদের চেয়ে বেশী শক্তিশালী। আর এই শক্তিশালী অসুরদের কারণেই যুগে যুগে সংঘটিত হয়েছে দেবাসুরের সংগ্রাম। শক্তিশালী অসুরগণ প্রাইয়শই স্বর্গরাজ্য আক্রমণ করে বিতাড়িত করেছেন দেবতাগণকে। এমনকি কোন কোন সময় এঁদেরকে পরাজিত করতে নাজেহাল হতে হয়েছে স্বয়ং ত্রিদেবকেও। সনাতন এক্সপ্রেসের আজকের আয়োজনে আমরা এমন ১২ জন অসুরের কাহিনী আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চলেছি যারা ছিলেন দেবতাদের চেয়েও অধিক শক্তিশালী। এবং তাঁদের এই শক্তির প্রভাবে তাঁরা পরাজিত করেছিলেন দেবতাদেরকে, স্থাপন করেছিলেন ত্রাসের রাজত্ব এবং সৃষ্টিতে ডেকে এনেছিলেন প্রলয়ের কালো থাবা। তবে এই ১২ জন অসুর অসীম শক্তিশালী হওয়ার সত্ত্বেও কি কারনে এবং কিভাবে তাঁদের পতন ঘটেছিল তা আপনাদেরকে জানানোর উদ্দেশ্যেই আমাদের আজকের আয়োজন।

বজ্রাঙ্গ ও তারকাসুর

বজ্রাঙ্গ ও তারকাসুর নামক দুই মহাবলশালী অসুরের কাহিনী বর্ণিত হয়েছে মৎস্য পুরাণে। আপনারা জানেন অদিতির পুত্র দেবতাদের হাতে বারংবার পরাজিত ও নিহত হয়েছেন দিতির পুত্রগণ তথা দৈত্য বা অসুরেরা। তাই একদা দিতি তাঁর দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে স্বামী কশ্যপ মুনির সমীপে প্রার্থনা করেন, “হে প্রভু, আমি এক মহাবীর্যবান পুত্রের জননী হতে চাই। সেই পুত্র যেন হয় অজেয় বীর ও দেবতাদের অবধ্য। এবং আমার সেই পুত্র যেন আমার অন্যান্য সন্তানদের হত্যার প্রতিশোধ নিতে পারে। উত্তরে কশ্যপ মুনি তাঁর স্ত্রী দিতিকে বললেন, “হে প্রিয়তমা, তুমি ১০ বৎসরকাল অরণ্যে নির্বাসিত অবস্থায় তপস্যা করো। তোমার সেই তপঃপ্রভাবে এক মহাবলশালী পুত্রের জন্ম হবে। সেই পুত্রের সকল অঙ্গ হবে বজ্রসারময়। তাই বজ্রাদি তথা কোন অস্ত্রশস্ত্রের দ্বারাও সে বিনষ্ট হবে না।”

স্বামীর পরামর্শ মত ১০ বছর ধরে কঠিন তপস্যা করলেন দৈত্যমাতা দিতি। ফলে তাঁর তপস্যার ফলস্বরূপ জন্ম হল বজ্রাঙ্গ নামক এক দুর্জেয় পুত্রের। বজ্রাঙ্গ প্রাপ্তবয়স্ক হলে দৈত্যমাতা দিতি তাকে আদেশ করলেন, “হে পুত্র, স্বর্গের রাজা দেবরাজ ইন্দ্র আমার বহু সন্তানকে হত্যা করেছে। এবার তুমি তাঁর প্রতিশোধ নাও।” সুতারাং মাতৃ আদেশে বজ্রাঙ্গ চললেন দেবরাজ ইন্দ্রের সাথে যুদ্ধ করতে। স্বর্গভূমিতে এক তুমুল যুদ্ধ শুরু হল দেবতাগণ ও ব্জ্রাঙ্গের মধ্যে। কিন্তু দেবগণের নিক্ষেপিত সকল প্রকার অস্ত্রশস্ত্রই বজ্রাঙ্গের শক্তির কাছে খড়কুটোর মত উড়ে গেল। অবশেষে দেবরাজ ইন্দ্র পরাজিত হলেন বজ্রাঙ্গের হাতে। যুদ্ধ শেষে পাশ দ্বারা দেবরাজকে বন্দী করে মাতা দিতির কাছে নিয়ে এলেন বজ্রাঙ্গ। তবে প্রপিতামহ ব্রহ্মা ও পিতা কশ্যপের অনুরোধে ইন্দ্রদেবকে হত্যা না করে মুক্ত করে দিলেন তিনি।  বিনিময়ে বজ্রাঙ্গ প্রপিতামহ ব্রহ্মার কাছ থেকে ধর্মে ও তপস্যায় মতি থাকার বর প্রার্থনা করে নেন। তাছাড়া ব্রহ্মাও তাকে উপহার স্বরূপ বজ্রঙ্গী নামের এক অপরূপা সুন্দরী নারী সৃষ্টি করে বজ্রাঙ্গের স্ত্রী হিসেবে দান করলেন।

এ ঘটনার পর বজ্রাঙ্গ তাঁর স্ত্রী বজ্রঙ্গীকে নিয়ে গহীন অরণ্যে তপস্যায় লীন হয়ে গেলেন। তবে দেবরাজ ইন্দ্র বজ্রাঙ্গ কর্তৃক পরাজিত ও অপমানিত হওয়াকে কোনভাবেই মেনে নিতে পারেননি। তাই বজ্রাঙ্গের প্রতি অনিষ্ট করার অপকৌশলে লিপ্ত হলেন তিনি। তিনি বানর, মেষ ও সাপের রূপ ধরে বজ্রাঙ্গ ও তাঁর স্ত্রীর তপস্যায় বিঘ্ন ঘটানোর চেষ্টা করলেন, শৃগালের রূপ ধারণ করে আশ্রমকে অপবিত্র করলেন, মুষলধারে বৃষ্টিপাতের আয়োজন করে আশ্রমকে জলে ভাসিয়ে দিলেন, এমনকি বজ্রপাত ঘটিয়েও তাঁদের তপস্যা বিঘ্নিত করার জোর প্রচেষ্টা চালালেন। ইন্দ্রদেবের এহেন উৎপাতে অতিষ্ট হয়ে উঠলেন বজ্রাঙ্গ ও তাঁর সহধর্মিনী। তাই এবার আবারও বজ্রাঙ্গ তপস্যার মাধ্যমে আহবান করলেন প্রপিতামহ ব্রহ্মাকে। ব্রহ্মার দর্শন পাওয়ামাত্র তিনি ইন্দ্রদেবের দুষ্কর্মের কথা বর্ণনা করলেন তাকে। সেই সাথে তিনি ব্রহ্মার কাছে প্রার্থনা করলেন, “হে প্রপিতামহ আমাকে এমন এক পুত্র দান করুন যে স্বর্গরাজ্যকে জয় করতে সক্ষম হবে। তাছাড়া সে যেন যে দীর্ঘকাল দেবতাদের নানাভাবে উৎপীড়ন করে তাদের অহংকারের শাস্তি দিতেও সক্ষম হয়”  ব্রহ্মাও বজ্রাঙ্গের মুখে ইন্দ্রদেবের অপকর্মের কথা শুনে অসন্তুষ্ট হলেন এবং বজ্রাঙ্গকে এক স্বর্গজয়ী পুত্রের বর দিয়ে অদৃশ্য হলেন।

বজ্রাঙ্গ অসুর
বজ্রাঙ্গ অসুর

এর কিছুকাল পরে বজ্রাঙ্গের ঔরসে এবং বজ্রঙ্গীর গর্ভে জন্ম হল তারকাসুর নামক এক ভয়ংকর অসুরের। তাঁর জন্মের সাথে সাথে প্রকম্পিত হয়ে উঠল সসাগরা পৃথিবী, প্রবল বেগে বায়ু বইতে লাগল, এবং সমুদ্রের জল স্ফীত হয়ে উঠল। দৈত্যকুলে তখন মহানন্দের জোয়ার। আর দেবকুলের দেবতাদের মুখে দেখা দিল দুশ্চিন্তার বলিরেখা।

ছোট বয়স থেকেই তারকাসুর শুরু করলেন প্রজাপতি ব্রহ্মার কঠোর তপস্যা। কখনো অনাহারে, কখনো অর্ধাহারে, কখনো গাছের পাতা বা জল খেয়ে এবং কখনো নিজের শরীরের মাংস অগ্নিতে আহুতি দিয়ে তপস্যা চালিয়ে যেতে লাগলেন তারকাসুর। তাঁর তপস্যার প্রভাবে উত্তপ্ত হয়ে উঠল সমগ্র ত্রিভূবন। অবশেষে তারকাসুরের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর সামনে প্রকট হলেন প্রজাপতি ব্রহ্মা।  তিনি তারকাসুরকে বলে উঠলেন, “হে তাত, তোমার এই কঠোর তপস্যায় আমি অত্যাধিক সন্তুষ্ট হয়েছি। এবার বল কি অভিপ্রায়ে তোমার এই নজিরবিহীন তপস্যা?” তারকাসুর বলে উঠলেন, “হে পদ্মযোনি ব্রহ্মদেব, আপনি আমাকে এমন বর দিন যাতে কোন প্রকার অস্ত্র বা মহাস্ত্রের আঘাতে অথবা কোন প্রাণির হাতে যেন আমার মৃত্যু না হয়।” কিন্তু ব্রহ্মা বললেন, “হে তাত, তোমার প্রার্থিত বর আমার সাধ্যাতীত। কারন তাতে সৃষ্টির নিয়ম লঙ্ঘিত হবে। তুমি বরং অন্য কোন বর চাও।” ব্রহ্মার কথায় কিঞ্চিত চিন্তিত হলেন তারকাসুর। তারকাসুর চিন্তা করলেন, ভগবান শিব দক্ষযজ্ঞে দেবী সতীকে হারিয়ে মহাজাগতিক ধ্যানে মগ্ন হয়ে আছেন। অন্য কোন নারীকে তিনি কখনোই তাঁর মনে স্থান দেবেন না। সুতারাং সুদুরতম ভবিষ্যতেও তাঁর কোন সন্তান জন্ম নেবে না। তাই তারকাসুর তাঁর কূটবুদ্ধি প্রয়োগ করে ব্রহ্মাকে বললেন, “হে ব্রহ্মদেব, তাহলে আপনি আমাকে এই বর দিন যে, একমাত্র ভগবান শিবের পুত্র ব্যাতীত আমাকে কেউই বধ করতে পারবে না।” ব্রহ্মা বললেন, “তথাস্তু, দেবাদিদেব মহাদেবের পুত্র ব্যাতীত কেউই তোমাকে বধ করতে পারবে না।” এই বলে অন্তর্হিত হলেন পদ্মযোনি ব্রহ্মা।

তারকাসুর
তারকাসুর

এবার শুরু হল তারকাসুরের তাণ্ডব। কারন তাকে বধ করার মত কারও জন্মই হয়নি এই ত্রিভূবনে। তাই জম্ভ, কুজম্ভ, মহিষ, কুঞ্জওর, মেমস, কালা নেমি, নিমি, মথন, জম্ভক, শুম্ভ প্রভৃতি দৈত্য রথী মহারথীদের নিয়ে স্বর্গরাজ্য আক্রমণ করে বসলেন তারকাসুর। তাঁদের ভয়ংকর সব সমরাস্ত্রের ঝনঝনানিতে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত হল চারিদিকে। পক্ষান্তরে দেবতারাও সাধ্যমত চেষ্টা করলেন এই বিশাল অসুর বাহিনীকে নিরস্ত করতে। কিন্তু দেবতাদের সকল প্রচেষ্টা বিফল হল অসুরদের বিরুদ্ধে। এমনকি ব্রহ্মার বরের প্রভাবে স্বয়ং নারায়ণও দেবতাদের সাহায্যে এগিয়ে আসতে পারলেন না। ফলে শোচনীয় পরাজয় বরণ করতে হল দেবতাদেরকে। পরাজিত দেবগণ হারালেন তাঁদের প্রিয় স্বর্গরাজ্য,এরপর ছন্নছাড়া অবস্থায় ঘুরে বেড়াতে লাগলেন ত্রিলোকের পথে প্রান্তরে। তাঁদের হারানো স্বর্গরাজ্য ফিরে পাওয়ার এখন একটাই উপায়। আর সেটি হচ্ছে ভগবান শিবের পুত্র। কিন্তু প্রথমত ভগবান শিব মহাজাগতিক ধ্যানে মগ্ন, দ্বিতীয়ত তিনি অন্য কোন নারীর পাণিগ্রহণ করবেন না। দেবতাদের এই মহাসংকটের মধ্যে সংবাদ এলো দেবী দক্ষায়নী সতী গিরিরাজ হিমালয় ও মেনকার ঘরে পুনরায় জন্ম নিয়েছেন পার্বতী রূপে। এবং দেবী পার্বতীও দীর্ঘদিন যাবত ভগবান শিবকে পতিরূপে প্রাপ্ত করার জন্য তপস্যা করছেন।

অবশেষে দেবতাদের পরিকল্পনায় কামদেব মদনের সাহায্যে ধ্যান ভঙ্গ করা হল শিবের। ধ্যান ভঙ্গের পর শিব জানতে পারলেন তাঁর প্রিয়তমা স্ত্রী দেবী সতী পুনরায় জন্ম নিয়েছেন এবং তাকে পতিরূপে প্রাপ্ত করার জন্য তিনি উদগ্রীব হয়ে আছেন। এভাবে পুনরায় মিলন ঘটল হর-পার্বতী দম্পতির। আর তারকাসুরকে বধ করার উদ্দেশ্যে জন্ম নিলেন তাঁদের পুত্র কার্ত্তিকেয়। অবশেষে রণভূমিতে দেখা হল শিবপুত্র কার্ত্তিকেয় ও দানবেন্দ্র তারকাসুরের। তুমুল যুদ্ধের পর দেবসেনাপতি কার্ত্তিকেয়র হাতে নিহত হলেন তারকাসুর।

মধু ও কৈটভ

মধু ও কৈটভ নামক দুই মহাশক্তিশালী অসুরের কাহিনী বর্ণীত হয়েছে মার্কণ্ডেয় পুরাণে। প্রলয়কালে সমগ্র বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড কারণ সমুদ্রে পরিণত হলে শ্রীবিষ্ণু তাঁর অনন্ত নাগের উপরে শয়নরত অবস্থায় ছিলেন। এবং তাকে নিদ্রিত রেখেছিলেন যোগনিদ্রারূপিনী মহামায়া। এসময় শ্রীবিষ্ণুর নাভিপদ্ম থেকে জন্ম নিয়েছিলেন পদ্মযোনি ব্রহ্মা। তবে সমস্যা শুরু হল দুই অসুরের আকস্মিক আবির্ভাবের ফলে। যোগনিদ্রায় রত শ্রীবিষ্ণুর কর্ণমল থেকে জন্ম নিয়েছিলেন এই দুই দূর্বধ্য অসুর। তাঁদের নাম মধু এবং কৈটভ। জন্মের পরেই তারা দেখতে পেলেন শ্রীবিষ্ণুর নাভিপদ্মে স্থিত পদ্মযোনি ব্রহ্মাকে। এসময় এই দুই অসুর বিভিন্নভাবে ব্রহ্মাদেবকে উত্যক্ত করতে শুরু করলেন, এবং এক পর্যায়ে তারা ব্রহ্মাকে বধ করতেও উদ্যত হন। ভীত ব্রহ্মা বিষ্ণুকে জাগরিত করার অনেক চেষ্টা করলেন বটে। কিন্তু যোগনিদ্রায় রত বিষ্ণুদেবকে তিনি কোনভাবেই জাগরিত করতে পারলেন না। অবশেষে ব্রহ্মা শুরু করলেন যোগনিদ্রারূপিনী মহামায়ার স্তব। আর ব্রহ্মার সেই স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে দেবী মহামায়া নিজেকে বিষ্ণুর শরীর প্রত্যাহার করে প্রকট হলেন তাঁর সামনে। দেবী মহামায়া ব্রহ্মার স্তবের কারণ বুঝতে পারলেন এবং সেইসাথে শ্রীবিষ্ণুরও যোগনিদ্রা ভঙ্গ হল। শ্রীবিষ্ণু দেখতে পেলেন তারই কর্ণমল থেকে উদ্ভূত দুই অসুর ব্রহ্মাকে হত্যা করতে উদ্যত। তাই অনতিবিলম্বে তিনি অসুরদেরকে তাঁর নিজের সাথে যুদ্ধ করার আহবান করলেন। তবে স্বয়ং বিষ্ণুদেবের শরীর থেকে উদ্ভূত অসুরগণকে পরাজিত বা বধ করা স্বয়ং বিষ্ণুর পক্ষেও ছিল সাধ্যাতীত। প্রায় ৫ হাজার বছর ধরে ভগবান শ্রীবিষ্ণু যুদ্ধ করলেন এই মহাশক্তিশালী দুই অসুরের সাথে। কিন্তু কোন পক্ষই কোন পক্ষকে পরাজিত করতে পারলেন না।

মধু ও কৈটভ
মধু ও কৈটভ

তবে স্বয়ং বিষ্ণুদেব তাদেরকে পরাজিত করতে না পারায় অহংকার মাথাচাড়া দিয়ে ঊঠল অসুরদ্বয়ের মধ্যে। তারা বলে উঠলেন, “হে বিষ্ণু, তোমার রণদক্ষতায় আমরা অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়েছি। আমাদের মত সর্বশক্তিশালী যোদ্ধাদের সাথে তুমি বীরত্বের সাথে যে যুদ্ধ করেছ তা দেখে আমরা বিষ্মিত। বল হে বিষ্ণু, তুমি আমাদের কাছ থেকে কি বর চাও?” শ্রীবিষ্ণু বুঝতে পারলেন যেহেতু এই দুই অসুরের মধ্যে অহংকারের আবির্ভাব ঘটেছে, তাই এরা নিজেরাই এদেরকে বধ করার সুযোগ করে দিতে চায়। আর তাই তিনিও দেরী না করে বলে উঠলেন, “হে মধু-কৈটভ, তোমরা আমার হাতে বধ্য হও, আমাকে এই বর দান কর।” বিষ্ণুর চালাকী বুঝতে পারলেন মধু ও কৈটভ। তবে চালাকীতে তারাও কম যান না। তারা চারিদিকে তাকিয়ে দেখলেন শুধু জল আর জল। দৃষ্টিসীমার মধ্যে জল ব্যাতীত আর কিছুই নেই সেখানে। তাই তারাও শ্রীবিষ্ণুকে বললেন, “তাই হবে হে বিষ্ণু। তবে আমাদেরকে বধ করতে হবে এমন এক স্থানে যেখানে কোন জল থাকবে না।” অসুরগণ ভেবেছিলেন, যেহেতু চারিদিকে জল ছাড়া কোথাও কোন স্থলভাগ নেই তাই বিষ্ণুও তাদেরকে বধ করতে সক্ষম হবেন না। তবে শ্রীবিষ্ণুর হাত থেকে রেহাই পাননি তারা। তাঁদের কাছ থেকে বর পাওয়া মাত্র শ্রীবিষ্ণু নিজের শরীরকে বহুগুণে বর্ধিত করেন, এরপর নিজের উরুর উপরে দুই অসুরকে রেখে সুদর্শন চক্র দিয়ে বধ করেন তাদেরকে। আর মধু ও কৈটভের মেদ থেকেই জন্ম হয়েছিল মেদিনী বা পৃথিবীর।

আরও পড়ুনঃ  ঢেঁকি কেন নারদের বাহন ? নারদ কেন কলহসংগঠক স্বভাবের?

মহিষাসুর

একজন বাঙালী হিসেবে মহিষাসুরের কাহিনী জানেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় না। প্রতিবছর মহালয়ার দিনে প্রচারিত মহিষাসুরমর্দ্দিনি থেকে জানা যায় দেবী দুর্গা কর্তৃক মহিষাসুর বধের কাহিনী। মার্কণ্ডেয় পুরাণের দেবী মাহাত্ম্য, কালিকা পুরাণ, শ্রীশ্রীচণ্ডী প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে জানা যায়, একদা অসুরলোকের অধিপতি রম্ভ পরিকল্পনা করলেন স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল জয় করার জন্য। এই উদ্দেশ্যে তিনি মাতা দনুর পরামর্শে শুরু করলেন অগ্নিদেবের তপস্যা। দীর্ঘকাল ধরে চলতে লাগল রম্ভের সেই কঠিন তপস্যা। এদিকে দেবরাজ ইন্দ্র রম্ভের তপস্যার হীন উদ্দেশ্য বুঝতে পারলেন। তাই তিনি বহুভাবে বাধাগ্রস্থ করার চেষ্টা করলেন সেই তপস্যাকে। তবে দেবরাজ ইন্দ্রের কোন প্রচেষ্টাতেই রম্ভের তপস্যা ভঙ্গ হল না। বরং কিছুকাল পরে রম্ভের তপস্যায় সন্তুষ্ট হলেন অগ্নিদেব। তিনি রম্ভের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে তাকে বরদান করলেন, রম্ভের ঔরসে এমন এক মহা পরাক্রমশালী পুত্র জন্মগ্রহণ করবে যে তাঁর অসীম পরাক্রম দ্বারা স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল জয় করে ত্রিলোকের অধীশ্বর হবে।

এদিকে স্বর্গের এক অপ্সরা অভিশপ্ত হয়ে মহিষীরূপে বিচরণ করছিলেন। আর ত্রিলোক বিজয়ী পুত্র উৎপাদন করার উদ্দেশ্যে সেই মহিষীকেই বিবাহ করেছিলেন সদ্য বরপ্রাপ্ত রম্ভ। এর ফলে রম্ভের ঔরসে এবং মহিষী মাতার গর্ভে জন্ম নিয়েছিলেন মহাশক্তিশালী অসুর মহিষাসুর। জন্মসূত্রেই মহিষাসুর ছিলেন প্রবল বলশালী এবং মায়াবিদ্যায় পারদর্শী। তাছাড়া মহিষী মাতার গর্ভে জন্মগ্রহণ করার কারনে তিনি ইচ্ছেমত মহিষসহ অন্যান্য রূপ ধারণ করতে পারতেন।

মহিষাসুর
মহিষাসুর

তবে ত্রিলোক বিজয়ের বর প্রাপ্ত হয়ে জন্মগ্রহণ করার পরেও মহিষাসুর জন্মের পর পরই ত্রিলোক বিজয়ে ব্রতী হন নি। বরং নিজের শক্তি বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে তিনি শুরু করেছিলেন প্রজাপতি ব্রহ্মার কঠোর তপস্যা। স্বর্গের রাজা দেবরাজ ইন্দ্র এবারো চেষ্টা করেছিলেন মহিষাসুরের এই কঠোর তপস্যা ভঙ্গ করার জন্য। তবে হিংস্র জন্তু-জানোয়ার দিয়ে ভয় দেখিয়ে বা রুপসী অপ্সরাদের দ্বারা প্রলুব্ধ করেও কোন ফল হয়নি। অবশেষে মহিষাসুরের তপস্যার প্রভাবে তাকে বর প্রদান করতে আসতেই হল প্রজাপতি ব্রহ্মাকে। ব্রহ্মাকে সম্মুখে দেখতে পেয়ে মহিষাসুর তাঁর কাছে চেয়েছিলেন অমরত্বের বর। তবে ব্রহ্মা তাকে অমরত্বের বর না দিয়ে এই বর দিয়েছিলেন যে, “হে বৎস মহিষাসুর, আমি তোমাকে এই বর প্রদান করছি যে, কোন পুরুষের হাতে তোমার মৃত্যু হবে না।”

আর এই বরেই যারপরনাই সন্তুষ্ট হয়েছিলেন মহিষাসুর। তিনি ভেবেছিলেন কোন পুরুষই যখন তাঁর কোন ক্ষতি করতে পারবে না তাহলে নারী তো কোন ছার! কিন্তু তিনি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেননি যে তাঁর নিয়তিতে নারীই তাঁর মৃত্যুর কারণ হবে।

যাইহোক, এরপরের কাহিনী আপনাদের সকলেরই জানা। অগ্নিদেব ও ব্রহ্মার বরে বলীয়ান মহিষাসুর এবার হয়ে উঠলেন দাম্ভিক, অত্যাচারী এবং নিষ্ঠুর। তিনি স্বর্গরাজ্য আক্রমণ করে পরাজিত ও বিতাড়িত করলেন দেবতাদেরকে। স্বর্গরাজ্যে শুরু হল অসুরদের রাজত্ব। অন্যদিকে দেবগণ ভীত হয়ে ত্রিলোকের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপন করে বেড়াতে লাগলেন। আর যেহেতু ব্রহ্মার বরে কোন পুরুষ মহিষাসুরকে বধ করতে পারবেন না, সেহেতু ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের পক্ষেও সরাসরি যুদ্ধ করে তাকে পরাজিত বা বধ করা সম্ভব নয়। অবশেষে দেবতাদের সম্মিলিত তেজপুঞ্জ থেকে আবির্ভূতা হয়েছিলেন দেবী দুর্গা। দেবতাদের প্রদত্ত্ব অস্ত্রসস্ত্র দ্বারা রণসাজে সজ্জিতা হয়ে মহিষাসুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমেছিলেন তিনি। এরপর ১০ দিন ব্যাপী চলমান এক রক্তস্নাত যুদ্ধে মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন তিনি।

শুম্ভ-নিশুম্ভ ও রক্তবীজ

মার্কণ্ডেয় পুরাণের দেবী মাহাত্ম্য থেকে জানা যায় দুই ভীতি উৎপাদনকারী অসুরের নাম। এরা হচ্ছেন দুই অসুর ভ্রাতা শুম্ভ এবং নিশুম্ভ। শুম্ভ-নিশুম্ভ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে, যে কোন মূল্যে ত্রিলোক অধিকার করে তারা দুই ভ্রাতা রাজত্ব করবেন। আর তাই প্রজাপতি ব্রহ্মার তপস্যায় নিযুক্ত হয়েছিলেন তারা। তাঁদের কঠোর তপস্যায় কেটে গেল হাজারো শীত-বসন্ত। তারা কখনো এক পায়ের উপরে দাঁড়িয়ে, কখনো বৃক্ষ থেকে মাথা নিচের দিকে দিয়ে ঝুলে, কখনো লেলিহান অগ্নির মাঝখানে বসে আবার কখনো নিজেদের শরীরের মাংস কেটে যজ্ঞাগ্নিতে আহুতি দিয়ে চালিয়ে যেতে থাকলেন তপস্যা। অগত্যা তাঁদের এই তপস্যার ফল প্রদান করতে আসতেই হল প্রজাপতি ব্রহ্মাকে। তাঁর আগমনে উল্লাসিত হয়ে এই দুই অসুর ভ্রাতা দাবী করেছিলেন অমরত্বের বর। তবে ব্রহ্মা তাদেরকে সরাসরি অমরত্বের বর না দিয়ে এই বর দিয়েছলেন যে, কোন দেব, মানব, দানব কেউই তাদেরকে বধ করতে পারবে না। সুতারাং অমরত্ব এবং ব্রহ্মার দেওয়া বর এই দুইয়ের মধ্যে আর কোন তফাৎ রইল না বলা চলে।

শুম্ভ ও নিশুম্ভ অসুর
শুম্ভ ও নিশুম্ভ অসুর

এবার আসি রক্তবীজের কথায়। রক্তবীজ নামক এই ভয়ংকর অসুরের কাহিনী আপনারা অনেকেই জেনে থাকবেন। মহিষাসুরের পিতা রম্ভ এক মহিষের সাথে যুদ্ধে নিহত হন। কিন্তু যখন চিতার আগুনে রম্ভের শরীর দাহ করা হচ্ছিল, ঠিক তখনই সেই চিতাগ্নি থেকে উদ্ভব হয় এক ভয়ংকর অসুরের। তাঁর নাম রক্তবীজ। এই রক্তবীজও বহু বছর ধরে তপস্যা করেছিলেন প্রজাপতি ব্রহ্মার। আর তাঁর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা তাকে বর দিয়েছিলেন যে রক্তবীজের শরীরের এক ফোটা রক্ত যেখানে পতিত হবে সেখানে আরও বহু রক্তবীজের জন্ম হবে। তাই তাকে বধ করা বস্তুত অসম্ভব। পরবর্তীতে এই রক্তবীজ সেনাপতি হিসেবে যোগদান করেছিলেন শুম্ভ-নিশুম্ভের সাথে। সুতারাং বোঝাই যাচ্ছে শুম্ভ-নিশুম্ভ ও রক্তবীজ এই তিন জনই ছিলেন অবধ্য এবং স্বর্গের দেবতাদের চেয়েও শক্তিশালী।

যাইহোক, ব্রহ্মার বর প্রাপ্ত হওয়ার পর ত্রিলোকে তুমুল ধ্বংসযজ্ঞ শুরু করেছিলেন শুম্ভ এবং নিশুম্ভ। ত্রিলোক বিজয়ের বাসনায় তারা একে একে পাতাল লোক ও মর্ত্য লোক দখল করার পর আক্রমণ করলেন স্বর্গ লোকে। দেবতাদের সাথে প্রলয়ঙ্করী যুদ্ধ সংঘটিত হল অসুরদের। আর সেই যুদ্ধে খুব স্বাভাবিকভাবে পরাজয় বরন করতে হল দেবতাদেরকে। সেই সাথে আবারও স্বর্গরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হল অসুর রাজত্ব। এর আগে দেবতারা মহিষাসুরের কাছে পরাজিত হলে মহাদেবী দেবী দুর্গারূপে মহিষাসুর বধ এবং  স্বর্গরাজ্য উদ্ধার করেছিলেন। তাই এবারও রাজ্য হারিয়ে অসহায় দেবগণ হাজির হলেন কৈলাস পর্বতে মহাদেবীর কৃপা লাভের আশায়। দেবতাদের এই দুর্দশা দেখে দেবী পার্বতীও অত্যন্ত ব্যাথিতা হলেন। তিনি তাঁর শরীরের কোষ থেকে সৃষ্টি করলেন এক রণাঙ্গীনী দেবী মূর্তিকে যার নাম কৌশিকী।

এরপর দেবী কৌশিকি এক অতি সুন্দরী নারীমূর্তি ধারণ করে শুম্ভ-নিশুম্ভের সেনাপতি চণ্ড ও মুণ্ডের দৃষ্টিগোচর হলেন। চণ্ড ও মুণ্ড এই অপরূপ দেবীপ্রতিমার কথা বর্ণনা করলেন শুম্ভ-নিশুম্ভের কাছে। শুম্ভ নিশুম্ভ দেবীর রূপ-লাবণ্যের কথা শুনে দেবীকে বিবাহ করার ইচ্ছা পোষন করলেন এবং তাঁদের এক দূত মারফত দেবীর কাছে বিবাহের প্রস্তাব প্রেরণ করলেন। কিন্তু দেবী সেই দূতকে জ্ঞাত করালেন যে, যে ব্যক্তি আমাকে যুদ্ধে পরাজিত করতে পারবে শুধুমাত্র তাকেই আমি বিবাহ করব। একজন সামান্য নারীর মুখে এরকম অহংবোধসম্পন্ন কথা শুনে অতিশয় ক্রুদ্ধ হলেন শুম্ভ ও নিশুম্ভ। তারা ভাবলেন সামান্য নারীকে যুদ্ধে পরাস্ত করতে আমাদের একজন সেনাপতিই যথেষ্ঠ। তাই তারা দৈত্যসেনাপতি ধূম্রলোচনকে প্রেরণ করেছিলেন দেবীর সাথে যুদ্ধ করতে। কিন্তু ধূম্রলোচন রণাঙ্গণে এসে যার দেখা পেলেন তিনি কোন সাধারন সুন্দরী নন, বরং উগ্ররূপা মহা আগ্রাসী এক দেবীমূর্তি। এরপর দেবী কৌশিকী ও ধূম্রলোচনের মধ্যে শুরু হয় ভয়ংকর যুদ্ধ। তবে দেবীর উগ্রমূর্তির সামনে খুব বেশীক্ষণ টিকে থাকতে পারেননি ধূম্রলোচন। এক পর্যায়ে দেবীর প্রচণ্ড অস্ত্রাঘাতে পরাজিত ও নিহত হন ধূম্রলোচন।

দেবী কৌশিকী কর্তৃক ধূম্রলোচন সংহারের পর এবার শুম্ভ নিশুম্ভ রণভূমিতে প্রেরণ করলেন চণ্ড ও মুণ্ড নামক দুই ভয়ানক অসুরকে। বিপুল পরিমান অশ্ব, গজ, পদাতিক, রথী ও মহারথীদের নিয়ে যুদ্ধভূমিতে প্রবেশ করলেন চণ্ড ও মুণ্ড। এসময় দেবী কৌশিকী তাঁর শরীর থেকে সৃষ্টি করলেন কৃষ্ণবর্ণ এক ক্রুদ্ধ দেবী মূর্তিকে। ভীষনাদর্শনা এই দেবী রণভূমিতে প্রবেশ করেই তাঁর রণহুংকারে প্রকম্পিত করে তুললেন চারিদিক। এরপর অসুরবাহিনীর সৈন্য সামন্ত্যকে গলধঃকরন করতে লাগলেন তিনি। এক পর্যায়ে তিনি সম্মুখীন হন চণ্ড ও মুণ্ডের। দেবীর সাথে প্রলয়ঙ্করী যুদ্ধ সংঘঠিত হয় এই দুই অসুরের। তবে যুদ্ধের এক পর্যায়ে চণ্ড ও মুণ্ডের শিরোচ্ছেদ করে দেন উগ্ররূপা কৃষ্ণবর্ণা এই দেবী। চণ্ড ও মুণ্ড নামক এই দুই অসুরকে বধ করার জন্য দেবী কৌশিকী এই নবসৃষ্টা দেবীর নামকরণ করেছিলেন দেবী চামুণ্ডা। তবে দেবী চামুণ্ডা মতান্তরে দেবী কালিকা নামেও জগতে প্রসিদ্ধ। চণ্ড মুণ্ড বধের পর রণভূমিতে ছুটে এসেছিলেন অগণিত অসুর যোদ্ধারা। দেবী কৌশিকী তখন নিজের শরীর থেকে সপ্তমাতৃকা তথা দেবী  ব্রহ্মাণী, দেবী মাহেশ্বরী, দেবী কৌমারী, দেবী বৈষ্ণবী, দেবী বারাহী, দেবী নারসিংহী, এবং দেবী ঐন্দ্রীকে সৃষ্টি করলেন। এই দেবীগণ অগ্নিমূর্তি হয়ে অসুরদের রক্তে লাল করে দিলেন সমস্ত রণভূমি। প্রথমে ধূম্রলোচন এবং পরে চণ্ড-মুণ্ড সহ অসংখ্য অসুর যোদ্ধা নিহত হওয়ার পর এবার রণভূমিতে এলেন রক্তবীজ। শুরু হল দেবী কৌশিকীর সাথে রক্তবীজের যুদ্ধ। তবে দেবীর পক্ষে রক্তবীজকে পরাজিত করা সম্ভব হচ্ছিল না। কারণ দেবী কৌশিকী একবার তাকে বধ করলে তাঁর শরীরের রক্ত যেখানে যেখানে পতিত হয় সেখান থেকে আরও বিপুল পরিমান রক্তবীজের সৃষ্টি হতে থাকে। ফলে রক্তবীজের সংখ্যা বাড়তেই থাকে রণাঙ্গণে। একসময় দেবী কৌশিকী দেবী চামুণ্ডাকে পরামর্শ দিলেন, “হে দেবী, আমি এক একটি রক্তবীজাসুর বধ করার সাথে সাথে তুমি তাঁর রক্ত এমনভাবে পান করো যাতে একটি রক্তের ফোঁটাও মাটিতে না পড়ে।” এরপর সমস্ত রণভূমি জুড়ে মাতা চামুণ্ডা বিছিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর রক্তলোলুপ জিহ্বা। ফলে রক্তবীজের রক্ত আর মাটিতে পতিত হওয়ার সুযোগ পায় নি। আর এভাবে একটি একটি করে সমস্ত রক্তবীজকে বধ করেছিলেন দেবী চণ্ডী।

আরও পড়ুনঃ  পঞ্চতত্ত্ব কারা? শ্রীচৈতন্য, নিত্যানন্দ,অদ্বৈতাচার্য, গদাধর,ও শ্রীবাসের আসল পরিচয় || Pancha Tattva
রক্তবীজ অসুর
রক্তবীজ অসুর

তুমুল সংগ্রাম করে রক্তবীজকে বধ করার পর দেবীপক্ষ যখন শ্রান্ত এবং ক্লান্ত, ঠিক তখনই শুম্ভ তাঁর ভ্রাতা নিশুম্ভকে পাঠিয়েছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে। শুম্ভ জানতেন যেহেতু তারা দুই ভ্রাতা কোন দেব, মানব, বা দানব দ্বারা বধ্য নন, সেহতু নিশুম্ভকে যুদ্ধ করতে পাঠিয়ে কিছুটা আশ্বস্থ হয়েছিলেন তিনি। তবে তিনি কল্পনাও করতেও পারেননি যে, তারা দুই ভাই কোন দেবের হাতে বধ্য না হলেও দেবীর হাতে অবশ্যই বধ্য। তাই কিছুক্ষণ পরে দেবী দুর্গার সাথে প্রচণ্ড যুদ্ধে যখন নিশুম্ভ নিহত হলেন, তখন প্রমাদ গুনলেন শুম্ভ। ভাতৃবিয়োগের যন্ত্রণায় ক্লিষ্ট হয়ে শুম্ভ দেবীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “হে দেবী, তুমি গর্ব করো না, কারণ তুমি অন্যের সাহায্যে এই যুদ্ধে জয়লাভ করেছ।”

একথা শুনে দেবী বলেছিলেন, “এ জগতে একমাত্র আমিই ত আছি, আমা হইতে অপর দ্বিতীয় আর কে আছে? ওরে দুষ্ট! দেখ, আমার বিভূতিসমূহ আমাতেই প্রবেশ করিতেছে।”

একথা বলার পর দেবীর সমস্ত সহচরী শক্তিরা একে একে সবাই দেবীর দেহে প্রবেশ করলেন। এরপর শুরু হল শুম্ভের সাথে দেবী কৌশিকীর ভয়ানক যুদ্ধ। এবং যুদ্ধান্তে অসুর শুম্ভকে শূলে গ্রথিত করে বধ করেন দেবী মহামায়া। আর সমস্ত অসুরদের বধ করার মাধ্যমে স্বর্গরাজ্যে আবারও অধিকার প্রতিষ্ঠিত হল দেবতাদের।

বিত্রাসুর বা বৃত্তাসুর

অসুরদের মধ্যে যারা দেবতাদের চেয়েও শক্তিশালী হয়ে উঠেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন বিত্রাসুর। তবে এই অসুর কোন স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় জন্ম গ্রহণ করেন নি। কোন এক সময় দেবরাজ ইন্দ্রের প্রতি প্রচণ্ড অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা বা মতান্তরে ত্বষ্টা। এর ফলে এক মহাযজ্ঞের আয়োজন করে যেই যজ্ঞের হোমাগ্নি থেকে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন বিত্রাসুর নামক এক অতি পরাক্রমশালী অসুর।

জন্মের পর বিত্রাসুর বুঝতে পেরেছিলেন দেবরাজ ইন্দ্রকে পরাজিত করাই তাঁর জীবনে মুখ্য উদ্দেশ্য। তবে সে উদ্দেশ্য সফল করতে হলে বিপুল শক্তি অর্জন করতে হবে তাকে। সুতারাং তিনি তাঁর আরধ্য হিসেবে বেছে নিলেন দেবাদিদেব মহাদেবকে। এবং এরপর হাজার বছর ধরে মহাদেবের কঠোর তপস্যায় লীন হয়ে রইলেন তিনি।

অবশেষে তাঁর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়েছিলেন শিব। তিনি বিত্রাসুরের সম্মুখে উপস্থিত হয়ে তাঁর কাছে জানতে চাইলেন, “হে বিত্রাসুর, কি বর চাও তুমি?”। বিত্রাসুর মহাদেবের কাছে চেয়েছিলেন অমরত্বের বর। কিন্তু ভগবান শিব তাকে সরাসরি অমরত্বের বর প্রদান করেননি। বরং তিনি তাকে বর দিয়েছিলেন, “হে বিত্রাসুর, আমি আমি তোমাকে এই বর প্রদান করছি যে, কোন ধাতু অথবা কাঠের দ্বারা নির্মিত অস্ত্র-সস্ত্রে তোমার মৃত্যু হবে না।” মহাদেব কর্তৃক প্রদত্ত্ব এই বর বৃত্তাসুরের জন্য ছিল অমরত্বেরই সমান। কারন, দেবতা, দানব, মানব সকলের অস্ত্রই ধাতু অথবা কাষ্ঠ দ্বারা নির্মিত হয়।

তো মহাদবের কাছে থেকে বর প্রাপ্তির পর ত্রিভূবন দেখতে পেল বৃত্তাসুরের আসল চেহারা। তাঁর অমানবিক ও নিষ্ঠুর অত্যাচারে প্রকম্পিত হল ত্রিলোক। স্বর্গ মর্ত্ত্য ও পাতালে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠল চারিদিক থেকে। এরপর এক পর্যায়ে এই মহা পরাক্রমশালী বিত্রাসুর আক্রমন করে বসলেন স্বর্গরাজ্যেও। স্বর্গরাজ্যের দেবতারাও সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করলেন সেই দুর্দণ্ড প্রাতাপশালী অসুরকে। কিন্তু তাদের সকল প্রকার অস্ত্রশস্ত্র তৃণসম আঘাত হানতেও ব্যার্থ হল বিত্রাসুরের বিরুদ্ধে। রণাঙ্গনে নজিরবিহীন তাণ্ডবের দামামা বাজিয়ে বিজয়রথে অগ্রসর হলেন বিত্রাসুর। ফলশ্রুতিতে দেবগন হলেন পরাজিত এবং স্বর্গরাজ্য থেকে নিষ্কাশিত ও বিতাড়িত।

বিত্রাসুর
বিত্রাসুর

স্বর্গরাজ্যে দেব শাসনের অবসান ঘটলে দেবতারা বিভিন্ন ছদ্মবেশে আত্মগোপন করলেন ত্রিলোকের বিভিন্ন প্রান্তে। আর স্বর্গলোকে প্রতিষ্ঠিত হল অসুরদের রাজত্ব। এভাবে বহুকাল কেটে যাওয়ার পর দেবগণ নিরূপায় হয়ে দেবাদিদেব মহাদেবের শরণাপন্ন হলেন। রাজ্যহারা, স্বর্গহারা দেবতাদের আকুতিভরা স্তব শুনে চোখ খুললেন সমাধিমগ্ন শিব। দেবতারা আকুল হয়ে তাকে জানালেন তাদের দুর্দশার কথা, বিত্রাসুরের দুর্বৃত্তায়নের কথা। তারা মহাদেবের কাছে প্রার্থনা করলেন, “হে দেবাদিদেব, অনুগ্রহ করে এই মহাবলশালী অসুরকে বধ করুন, স্বর্গরাজ্য পুররূদ্ধার করুন এবং সৃষ্টির স্বাভাবিক ছন্দ ফিরিয়ে আনুন।”

দেবাদিদেব মহাদেব বললেন, “হে স্বর্গের দেবতাগন, বিত্রাসুর আমার তপস্যা করেই এই বিপুল শক্তির অধিকারী হয়েছে এবং আমার দেওয়া বরেই বলীয়ান হয়ে আজ এই অনাসৃষ্টি শুরু করেছে। কিন্তু আমি নিজেই যেহেতু তাকে জীবন রক্ষার বরদান দিয়েছি, তাই আমার পক্ষে তাকে বধ করা বা তাঁর বিনাশের পথ দেখানো অনুচিত হবে। সুতারাং আপনাদের উচিত হবে শ্রীনারায়ণের কাছ থেকে এই সংকট থেকে উত্তোরণের উপায় জিজ্ঞাসা করা। তার অনুগ্রহেই আপনাদের অভীষ্ট পূর্ণ হবে।”

ব্যাথিত দেবতারা এরা শরণ নিলেন বিশ্ব সংসারের প্রতিপালক ভগবান শ্রী হরি বিষ্ণুর।  ভগবান বিষ্ণু তখন দেবতাদেরকে আশ্বাস দিয়ে বললেন, “হে দেবগন, আপনারা ইতিমধ্যেই উপলব্ধি করেছেন যে, আপনাদের অধিকৃত বর্তমান অস্ত্রশস্ত্র দ্বারা বিত্রাসুরকে পরাজিত বা বধ করা অসম্ভব। কিন্তু তাই বলে সৃষ্টির বিনাশ সাধনকারী এবং পাপগ্রস্থ কোন অসুরই অবধ্য নয়। আপনারা পৃথিবীলোকে ধ্যানরত মহর্ষি দধীচির নিকট গমন করুন, তিনি পরোপকারী, জ্ঞানী এবং ত্যাগী। এবং একমাত্র তিনিই আপনাদেরকে এই সংকট থেকে উত্তোরন করতে পারেন। আপনারা যদি তাঁর অস্থি দিয়ে বজ্রাস্ত্র নির্মাণ করতে পারেন, তাহলে   সেই প্রচন্ড শব্দকারী বজ্র দ্বারা আঘাত করলে পরাজিত ও নিহত বিত্রাসুর।”

শ্রীনারায়নের পরামর্শে এবার যেন আশার দেখতে পেলেন দুর্দশাগ্রস্থ দেবতাগন। তবে দধিচী মুনির অস্থি দিয়ে বজ্র নির্মান করতে হলে আগে তাকে প্রাণত্যাগ করতে হবে।  দধীচি কেনই বা তাদের জন্য প্রাণত্যাগ করবেন এবং তারাও বা কিভাবে মুনিকে প্রাণত্যাগ করার আবদার করতে পারেন? এরকম নানাবিধ সংকোচ নিয়ে দেবতাগন হাজির হলেন মহর্ষি দধীচির পর্ণকুটিরে। এরপর সসংকোচে মহর্ষি দধিচীর কাছে খুলে বললেন বিত্রাসুরের তাণ্ডব ও তাঁদের দূরাবস্থার কথা। এবং বিত্রাসুরকে বধ করতে যে অস্থি নির্মিত বজ্রাস্ত্রের প্রয়োজন সেটিও দধিচীর কাছে প্রকাশ করলেন দেবতাগণ।

তবে দেবতাদের কথা শুনে দধিচী বিন্দুমাত্র বিচলিত হলেন না। বরং তাঁর অস্থি দিয়ে নির্মিত অস্ত্র দিয়ে মহাবিশ্বের কল্যান সাধন হবে জেনে আনন্দ প্রকাশ করলেন তিনি। তিনি দেবতাদেরকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলেন, “হে দেবগণ, আপনাদের সংকোচ অবাঞ্ছিত নয়। কিন্তু আমার এই নশ্বর দেহ তো একদিন নষ্ট হবেই। আমার সামান্য নশ্বর দেহের এই অস্থি দিয়ে যদি সৃষ্টির স্বাভাবিক ছন্দ ফিরে আসে, অত্যাচারী অসুরদের বিনাশ ঘটে, তাহলে এর চেয়ে সৌভাগ্য আর কি বা হতে পারে” একথা বলে মহর্ষি দধীচি যোগবলে তাঁর নশ্বর  দেহ ত্যাগ করে স্বর্গলোকের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করলেন। তাঁর মৃত্যুর পর তারই অস্থি দিয়ে নির্মান করা হল এক মহাশক্তিশালী বজ্রাস্ত্র।

এরপর দেবতাগণ আবারও অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত হয়ে যুদ্ধে আহবান করলেন বিত্রাসুর ও তাঁর বিশাল অসুর বাহিনীকে। দেবতা ও অসুরদের এই যুদ্ধ চলল বহুকাল যাবত। মায়াবী বিত্রাসুর তাঁর সমস্ত মায়াবী শক্তি ও বিপুল পরাক্রম নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লেন যুদ্ধের ময়দানে। তবে দধিচী মুনির অস্থি দ্বারা নির্মিত সেই প্রচণ্ড ক্ষমতাসম্পন্ন বজ্রের আঘাতে দেবতারা পরাজিত ও নিহত করলেন বিত্রাসুরকে। সৃষ্টি ফিরে পেল তাঁর স্বাভাবিক ছন্দ, অত্যাচারের নরককুম্ভ থেকে মুক্ত হল সমগ্র ত্রিলোক।

জলন্ধর বা শঙ্খচূড়

বিভিন্ন পুরাণে জলন্ধর বা শঙ্খচূড় এবং বৃন্দা বা তুলসী দেবীর প্রায় বেশ কিছু কাহিনী বর্ণিত আছে। তবে জলন্ধর অসুরের প্রচলিত কাহিনীটিই এখানে আপনাদের জন্য উপস্থাপন করা হল।

একদা দেবরাজ ইন্দ্র দেবাদিদেব মহাদেবের সাথে সাক্ষাৎ এর উদ্দেশ্যে দেবরাজ ইন্দ্র কৈলাসে যাত্রা করেছিলেন। কিন্তু পথিমধ্যে তিনি দেখতে পেলেন একজন পাগল সন্যাসী তথা অবধূত পথ আটকে শুয়ে আছেন। অহংকারী দেবরাজ ইন্দ্র তাঁকে গর্বের সাথে পথ ছেড়ে দিতে আদেশ করলেন। কিন্তু অবধূত দেবরাজ ইন্দ্রের কোন কথাই কানে তুললেন না। বরং ইন্দ্রদেবের আদেশ দিব্যি অগ্রাহ্য করে আগের মতই পথ আটকে শুয়ে রইলেন তিনি। এর ফলে ক্রোধের উদ্রেক ঘটল দেবরাজ ইন্দ্রের। তিনি তৎক্ষণাৎ তাঁর বজ্রাস্ত্রকে আহবান করে বজ্রাঘাত করলেন সেই অবধূতকে। আর ঠিক সেই সময় সেই অবধূত রূপান্তরিত হলেন দেবাদিদেব মহাদেবে। দেবরাজের ধৃষ্টতায় এবং প্রচণ্ড বজ্রাঘাতে তুমুল ক্রুদ্ধ হলেন ভগবান শিব। তিনি তাঁর তৃতীয় নয়ন উন্মীলন করে সেই নেত্রের অগ্নি নিক্ষেপ করলেন দেবরাজ ইন্দ্রের দিকে। এসময় দেবগুরু বৃহস্পতি ছুটে এসে মহাদেবের কাছে আকুতি জানালেন এবং ইন্দ্রদেবের প্রাণভিক্ষা চাইলেন। গুরু বৃহষ্পতির আকুতিতে সে যাত্রায় বেঁচে যান ইন্দ্রদেব। তবে মহাদেবের নেত্র থেকে উদ্ভূত সেই ক্রোধাগ্নি দিক পরিবর্তন করে পতিত হল সমুদ্রের বুকে। ফলে মহাদেবের সেই ক্রোধ থেকে জন্ম নিল এক অদ্ভূত শিশু। শিশুটি সৃষ্টি হওয়ার পরে এতটা করুণভাবে রোদন করছিল যে প্রজাপতি ব্রহ্মা শিশুটির কাছে যেতে বাধ্য হলেন। তিনি শিশুটিকে কোলে তুলে নিলেন এবং তাঁর নামকরণ করলেন জলন্ধর। তাছাড়া তিনি তাকে বর দিয়েছিলেন যে বালকটি পরিণত বয়সে প্রচণ্ড বলশালী হবে এবং ভগবান শিব ব্যাতীত আর কেউ তাকে বধ করতে পারবেন না। এরপর সমুদ্রদেব শিশুটিকে নিজের পুত্র হিসেবে লালন পালন করতে শুরু করলেন। ভগবান শিবের ক্রোধাগ্নি থেকে জন্ম হওয়ার কারনে শিশুটি ছিল প্রবল পরাক্রমশালী এবং তেজস্বী।

ভগবান শিভ ও জলন্ধর
ভগবান শিভ ও জলন্ধর

তো জলন্ধর যখন শৈশব পার করে যৌবনে পা দিলেন তখন অসুরগুরু শুক্রাচার্যকে তিনি বসিয়েছিলেন নিজের গুরুর আসনে। আর অসুরগুরু শুক্রাচার্যও দেবতাদের দীর্ঘদিনের ছলনার প্রতিশোধ নিতে তৈরি করা শুরু করেছিলেন জলন্ধরকে। জলন্ধরের শুধু একটাই দূর্বলতা ছিল যে, তিনি শুধুমাত্র মহাদেবের হাতে বধিত হবেন। তাই সেই দূর্বলতাকে চিরতরে মিটিয়ে দিতে শুক্রাচার্য জলন্ধরের বিবাহ দিয়েছিলেন অসুর কালনেমির কন্যা বৃন্দার সাথে। কারন বৃন্দা দেবী বরপ্রাপ্ত ছিলেন যে, যতদিন পর্যন্ত বৃন্দার সতীত্ব অটুট থাকবে ততদিন পর্যন্ত তাঁর স্বামীকে কেউই বধ করতে পারবে না। ফলে জলন্ধরকে সংহার করার ক্ষমতা আর কারো রইল না। এবার গুরু শুক্রাচার্যের আদেশে জলন্ধর আক্রমণ করলেন দেবতাদেরকে। প্রলয়ঙ্করী সেই যুদ্ধে দেবতাদের নিক্ষেপিত সকল প্রকার অস্ত্র-সস্ত্র ব্যার্থ করে বিজয়রথে অগ্রসর হলেন জলন্ধর। দেবতাগণ আবারও হলেন স্বর্গ থেকে বিতাড়িত, নিষ্কাষিত। অসহায় এই দেবতাগণ জানতেন একমাত্র মহাদেব শিবই জলন্ধরকে সংহার করতে সক্ষম। তাই তারা দেবাদিদেবকে অনুরোধ করলেন জলন্ধরের প্রকোপ থেকে দেবতাদেরকে রক্ষা করতে এবং স্বর্গরাজ্যে পুনরায় দেবতাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে। দেবতাদের আকুতিতে জলন্ধরের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হলেন মহাদেব। কিন্তু দীর্ঘকাল যুদ্ধের পরেও তাঁদের কেউ কাউকে পরাজিত করতে পারলেন না। তো এই যুদ্ধের পরিণতি দান করতে এবার এগিয়ে এলেন জগতের প্রতিপালক ভগবান শ্রী হরি নারায়ণ। তিনি বুঝতে পারলেন, জলন্ধরের স্ত্রী বৃন্দার সতীত্ব নাশ না করতে পারলে জলন্ধরকে পরাজিত করা অসম্ভব। তাই তিনি জলন্ধরের ছদ্মবেশে হাজির হলেন বৃন্দা দেবীর গৃহে। বৃন্দাও ভেবেছিলেন তাঁর পতি হয়ত যুদ্ধ জয় করে গৃহে ফিরে এসেছেন। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বৃন্দার সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করলেন ভগবান বিষ্ণু। ফলে বিনষ্ট হল বৃন্দার সতীত্ব এবং পতিব্রত। আর এই ঘটনার সাথে সাথে মহাদেবের নিক্ষেপিত ত্রিশূল দ্বারা বধিত হয়েছিলেন জলন্ধর। সুতারাং বুঝতেই পারছেন জলন্ধর এতটাই শক্তিশালী ছিলেন যে তাকে বধ করার জন্য স্বয়ং জগতের প্রতিপালককে সতীত্ব হরণের কলঙ্ক মাথা পেতে নিতে হয়েছিল।

আরও পড়ুনঃ  পূর্বজন্মে পরম বিষ্ণুভক্ত হয়েও কেন পরজন্মে রাবণ ও কুম্ভকর্ণ রূপে জন্মাতে হল?

রাবণ

সনাতন হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অন্তরে চিরকালীনভাবে গ্রথিত নামটি হচ্ছে শ্রীরামচন্দ্র। আর ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের নামের সাথে সাথে যে খল নামটি উচ্চারিত হয় সেটি হচ্ছে রাবণ। এই লঙ্কাধিপতি রাবণ ছিলেন দেবতাদের চেয়ে শক্তিশালী অসুর, দানব বা রাক্ষসদের মধ্যে অন্যতম একজন। রাক্ষস সুমালীর কন্যা রাক্ষসী কৈকেশী ও ঋষি বিশ্বঃশ্রবার সন্তান হওয়ার কারনে রাবণ ছিলেন অর্ধ রাক্ষস এবং অর্ধ ব্রাহ্মণ। তবে তিনি জন্মগতভাবে প্রাপ্ত হয়েছিলেন যুদ্ধংদেহী রাক্ষসকুলের স্বভাব। পাতাললোকে বসবাসরত অবস্থায় তিনি জানতে পারেন তারই বিমাতা দেববর্ণিনীর পুত্র কুবের বিপুল ঐশ্বর্য ও আরাম আয়েশ নিয়ে লঙ্কাপুরীতে বসবাস করছে। তাই উচ্চাভিলাষী রাবণ সংকল্প করলেন তিনিও বিপুল ঐশ্বর্য,বিত্ত, সম্মান, রাজত্ব ও পরাক্রম ভোগ করবেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি এগারো হাজার বছর ধরে তপস্যা করলেন প্রজাপতি ব্রহ্মার। তাঁর তপস্যার প্রভাবে উত্তপ্ত হয়ে উঠল ত্রিলোক, স্ফীত হয়ে উঠল সমুদ্রপৃষ্ঠ, প্রকম্পিত হয়ে উঠল দিক-বিদিক। তাঁর এমন কঠোর তপস্যায় সন্তুষ্ট হলেন পদ্মযোনি ব্রহ্মা। তিনি রাবণের সামনে প্রকট হয়ে বললেন, “হে দশানন, তোমার তপস্যায় আমি সন্তুষ্ট হয়েছি। বল বৎস, কি বর চাও তুমি?” অন্যান্য অসুরদের মত বুদ্ধিমান রাবণও ব্রহ্মার কাছে দাবী করেছিলেন অমরত্বের বর। কিন্তু ব্রহ্মা জানিয়েছিলেন, “জন্ম-মৃত্যুর চিরায়ত নিয়মের উল্লঙ্ঘন করে আমি তোমার এই চাওয়া পূর্ণ করতে পারবো না।”

ব্রহ্মার এই কথায় মনোক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন রাবণ, তবে বুদ্ধিমান রাবণ পুনরায় বর প্রার্থনা করেছিলেন যে, কোন দেবতা, দানব, অসুর, কিন্নর, গন্ধর্ব, বা যক্ষ যেন তাকে বধ করতে না পারে। রাবণের চাওয়া এই দ্বিতীয় প্রার্থনাটি মঞ্জুর করেছিলেন প্রজাপতি ব্রহ্মা। তবে রাবণ অহংকারের বশে বর চাওয়ার সময় মানব ও বানর এই দুইটি শ্রেণীর কথা উল্লেখ করেননি। কারণ তিনি ভেবেছিলেন যেখানে  কোন দেবতা, দানব, অসুর, কিন্নর, গন্ধর্ব, বা যক্ষ আমাকে পরাজিত বা বধ করতে পারবে না, সেখানে মানব বা বানর তো কোন ছার। আর এই কারণেই বানররাজ বালির হাতে তাকে একবার পরাজিত ও বন্দী হতে হয়েছিল।

রাবণ
রাবণ

যাইহোক, ব্রহ্মার কাছ থেকে এই বিরাট বরদান পাওয়ার পর অহংকারী রাবণ এবার হয়ে উঠলেন অত্যাচারী, নিষ্ঠুর এবং নির্ভীক। সর্বপ্রথমে তিনি লঙ্কা রাজ্য থেকে বিতাড়িত করেন তাঁর বিমাতা দেববর্ণিনী এবং বৈমাত্রেয় ভ্রাতা কুবেরকে। সেই সাথে কুবেরের অধিকৃত পুষ্পক বিমানটিও ছিনিয়ে নিয়েছিলন তিনি। এরপর একের পর এক যুদ্ধ এবং যুদ্ধ বিজয়ের উল্লাসে মশগুল হয়ে উঠেছিলেন রাবণ। নারীদের প্রতিও নূন্যতম সম্মান ছিল না তাঁর। বেদবতীকে অপমান করা কিংবা অপ্সরা রম্ভার সাথে বলপূর্বক শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করা রাবণের সেই হীন মানসিকতারই প্রমান। সেইসাথে ব্রাহ্মণদের যজ্ঞস্থল নষ্ট করা, রথী-মহারথী রাজাদেরকে যুদ্ধে পরাজিত করে বিনা কারনে তাদেরকে হত্যা করাসহ অসংখ্য হত্যা, লুণ্ঠন, পরস্ত্রী সম্ভোগ, অত্যাচার, নিষ্ঠুরতা প্রভৃতি কর্মের সাথে জড়িত ছিলেন রাবণ। এমনকি তাঁর পুত্র মেঘনাদের জন্মের সময় তিনি নবগ্রহকে পরাজিত ও বন্দী করেছিলেন। এসময় তিনি শনিদেবকে যুদ্ধে পরাজিত করে তাকে মারাত্মকভাবে আহত করেছিলেন। বলা হয় রাবণের এই যুদ্ধংদেহী মনোভাব থেকে বিরত রাখতে তাঁর স্ত্রী মন্দোদরী শতরঞ্জ নামক একটি খেলার উদ্ভাবন করেছিলেন যার বর্তমান নাম দাবা। তবে রাবণের অনাচার এরকম বহুগুণে বৃদ্ধি পেলেও  ব্রহ্মার দেওয়া বরের কারণে ত্রিদেব সহ স্বর্গরাজ্যের কোণ দেবতাই তাকে বিনাশ করতে সক্ষম ছিলেন না। আর তাই জগতের প্রতিপালপক ভগবান শ্রীবিষ্ণু এবার অবতার ধারণ করেছিলেন রাম রূপে। নিখুত পরিকল্পনায় শ্রীবিষ্ণু রচনা করেছিলেন রাবণ বধের নাটক। রাবণের পরস্ত্রীর প্রতি মোহকে কাজে লাগিয়ে টোপ ফেলেছিলেন তিনি। তবে আপাতদৃষ্টিতে রাবণ বুদ্ধিমান হলেও তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় মুর্খামি করেছিলেন সীতাহরণের এই টোপ গিলে। আর এই অপকর্মের দ্বারাই ষোল কলা পূর্ণ হয়ে যায় তাঁর। আর এরপরের রাম-রাবণের যুদ্ধের কাহিনী আপনাদের সকলেরই জানা। মাতা সীতাকে উদ্ধারের জন্য বিশাল বানর সেনা নিয়ে রাবণকে বধ করেছিলেন রামরূপী ভগবান  বিষ্ণু।

মেঘনাদ

এবার আসি রাবণের পুত্র মেঘনাদের কথায়। অসীম শক্তিশালী মেঘনাদ রাবণের মতই ছিলেন মহাপরাক্রমশালী এবং ত্রিদেব ব্যাতীত অন্য সকল দেবতা, মানব, দানব, যক্ষ, রাক্ষস, অসুর ও অন্যান্য সৃষ্টির মধ্যে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী। সনাতন ধর্মীয় পৌরাণিক ইতিহাসে তিনি এযাবতকালের একমাত্র অতিমহারথী হিসেবে পরিগণিত হন। এবং বীরত্বের শ্রেণীবিভাগে শুধুমাত্র মহামহারথীগণ তথা ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর ছাড়া অন্য সকলের চেয়ে তিনি শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা। তো মেঘনাদ যখন মাতৃগর্ভে, তখন তাঁর পিতা রাবণ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যেকোন মূল্যে তিনি তাঁর অনাগত সন্তানকে অজেয় এবং সর্বোচ্চ শক্তিশালী হিসেবে গড়ে তুলবেন। আপনারা অনেকেই জানেন মহাজ্ঞানী রাবণ ছিলেন চতুর্বেদ ও জ্যোতিষশাস্ত্রে অত্যন্ত সুপণ্ডিত। তাই মেঘনাদের জন্মের সময় তিনি নবগ্রহকে বন্দী করেছিলেন যাতে তাঁর পুত্রের জীবনে কোন গ্রহের কুপ্রভাব না পড়তে পারে। এসময় শনিদেবের সাথে ভয়ংকর যুদ্ধ হয়েছিল রাবণের এবং সেই যুদ্ধে শনিদেব রাবণের কাছে অত্যন্ত শোচনীয়ভাবে পরাজয় বরণ করেছিলেন।

যাইহোক মেঘনাদ তাঁর জন্মের পর বজ্রের ন্যায় শব্দ করেছিলেন বলে তাঁর নাম হয়েছিল মেঘনাদ। আবার অন্যমতে, তিনি মেঘের আড়ালে লুকিয়ে গম্ভীর নাদ সহকারে যুদ্ধ করতে পারতেন বিধায় তাঁর নাম হয়েছিল মেঘনাদ। দেবরাজ ইন্দ্রকে পরাজিত করার জন্য তাঁর নাম হয়েছিল ইন্দ্রজিৎ। এবং তাঁর মাতা মন্দোদরীকে দেওয়া ভগবান শিবের বরের কারনে তাঁর নাম হয়েছিল কানীন।

বাল্যকাল থেকেই পিতার আদেশে শক্তি অর্জনে ব্রতী হন মেঘনাদ। গুরু শুক্রাচার্যের দিকনির্দেশনায় তিনি মহামায়ার আরাধনা করে লাভ করেন অতুল্য মায়াবল, দুঃসাধ্য মহেশ্বর যজ্ঞ সম্পাদন করে পশুপতির কাছ থেকে লাভ করেন বিভিন্ন বর ও মায়াবিদ্যা। অন্যদিকে, তিনি অগ্নিষ্টোম, অশ্বমেধ, রাজসূয়, গোমেধ, বৈষ্ণব প্রভৃতি সপ্তযজ্ঞ সম্পন্ন করেন এবং কামচারী আকাশগামী স্যন্দন, তামসী মায়া, অক্ষয় তূণীর, শক্তিশেল ও শত্রুনাশক বহুবিধ অস্ত্রসস্ত্র লাভ করেন। ফলে বাল্যকাল থেকেই মেঘনাদ হয়ে ওঠেন দুর্ধর্ষ এক যোদ্ধা।

মেঘনাদ বা ইন্দ্রজিৎ
মেঘনাদ বা ইন্দ্রজিৎ

বিপুল শক্তি, অভেদ্য মায়াজাল ও অপ্রতিরোধ্য অস্ত্রসস্ত্র লাভ করার পর রাবণের মত তিনিও বহু যুদ্ধে জয়লাভ করেন। একদা  নাগরাজ শেষনাগকেও যুদ্ধে পরাজিত করেন মেঘনাদ। এরপর শেষনাগের কন্যা সুলোচনাকে বিবাহ করেছিলেন তিনি। মূলত এই অপমানের বদলা নিতেই নাগরাজ শেষনাগ লক্ষ্মণরূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।

একদা দিগবিজয় করার সময় পুত্র মেঘনাদকে নিয়ে স্বর্গরাজ্য আক্রমন করেন রাবণ। এসময় দেবরাজ ইন্দ্রের পুত্র জয়ন্তকে অস্ত্রাঘাতে সংজ্ঞাহীন করে দেন মেঘনাদ। এর ফলে ক্রুদ্ধ ইন্দ্রদেব বজ্রাস্ত্র নিক্ষেপ করে ভূপাতিত করে দেন দশানন রাবণকে। এসময় মেঘনাদ তাঁর মায়াবিদ্যা প্রয়োগ করে নিজে অদৃশ্য থেকে ইন্দ্রকে মায়াজালে আচ্ছন্ন করেন এবং শরজালে বন্দী করে ফেলেন। এরপর বন্দী ইন্দ্রদেবকে নিয়ে লংকায় ফিরে আসেন রাবণ ও মেঘনাদ। এর কিছুকাল পরে স্বয়ং প্রজাপতি ব্রহ্মা লংকায় আসেন ইন্দ্রদেবের মুক্তির দাবী নিয়ে। মেঘনাদ ইন্দ্রদেবের মুক্তির বিনিময়ে ব্রহ্মার কাছে প্রার্থনা করেন অমরত্বের বর। কিন্তু  ব্রহ্মা তাকে সরাসরি অমরত্বের বর না দিয়ে এই বর দিয়েছিলেন যে, মেঘনাদ যদি যুদ্ধের আগে নিকুম্ভিলা নামক যজ্ঞাগারে মাতা প্রত্যাঙ্গিরার পূজা করেন তাহলে যজ্ঞাগ্নি থেকে এক দিব্যরথ আবির্ভূত হবে এবং এই রথে উপবেশন করে মেঘনাদ যুদ্ধে গেলে তাকে পরাজিত করার ক্ষমতা কারও থাকবে না। এসময় ব্রহ্মা আরও বলেন, মেঘনাদকে শুধুমাত্র সেই শৌর্যশালী মানব বধ করতে পারবেন যিনি ১৪ বৎসর যাবত নিদ্রাহীন থাকবেন এবং ১৪ বৎসর যাবত নারীসঙ্গ থেকে বিরত থাকবেন। বনবাসের সময় নিদ্রাদেবীর কৃপায় লক্ষ্মণ ১৪ বৎসর যাবত নিদ্রা যাননি এবং তাঁর পত্নী উর্মিলা অযোধ্যায় অবস্থান করার কারণে তিনি এ সময়টাতে কোন নারীসঙ্গও করেননি। একারনেই পরবর্তীতে লক্ষ্মণ মেঘনাদকে বধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

যাইহোক, রামায়ণের যুদ্ধে মেঘনাদ রণাঙ্গনে যুদ্ধ করেছিলেন মাত্র তিনি দিন। কুম্ভকর্ণের মৃত্যুর পর পিতার আদেশে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রবেশ করেন মেঘনাদ। প্রথম দিনেই মেঘনাদ বিপুল পরিমান বানর সেনা সংহার করেন এবং রাম-লক্ষ্মণকে নাগ-পাশে বিদ্ধ করে সেদিনকার যুদ্ধে বিজয় প্রাপ্ত করেন। পরবর্তীতে শ্রীবিষ্ণুর বাহন গরুড়দেব রাম-লক্ষণকে নাগপাশ থেকে মুক্ত করেন।

দ্বিতীয় দিনের যুদ্ধেও প্রচণ্ড পরাক্রম প্রদর্শন করেন মেঘনাদ। তিনি অসংখ্য বাণর সেনা বধ করে লক্ষ্মণের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হন। এদিন লক্ষ্মণও দুর্দণ্ড প্রতাপে যুদ্ধ করছিলেন রাবণপুত্র মেঘনাদের সাথে। কিন্তু মেঘনাদ নিজের মায়াবল প্রয়োগ করে বারংবার বিহ্বল করে ফেলেন লক্ষ্মণকে। এবং এক পর্যায়ে তিনি মহাশক্তিশালী শক্তিশেল নিক্ষেপ করে অচেতন করে দেন শ্রীরামচন্দ্রের প্রাণের ভ্রাতা লক্ষ্মণকে। পরবর্তীতে শ্রীহনুমানের মাধ্যমে জড়িবুটি এনে সুস্থ করা হয় লক্ষ্মণকে।

যুদ্ধের তৃতীয় দিনে মেঘনাদ তাঁর চূড়ান্ত মায়াবিদ্যা প্রয়োগ করে মায়া সীতা সৃষ্টি করলেন, এবং সকলের সামনে তাকে বধও করলেন। এর ফলে মনোবল ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছিল রাম-লক্ষ্মনসহ সমস্ত বানর সেনাদের। এসময় লক্ষ্মণকে জীবিত দেখে মেঘনাদ চুপিসারে নিকুম্ভিলাতে ঢুকে পড়েছিলেন যজ্ঞ সম্পাদন করার জন্য।

কিন্তু বিভীষণ মেঘনাদের এই বর সম্পর্কে আগে থেকেই অবগত ছিলেন। তাই তিনিই লক্ষ্মণকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন নিকুম্ভিলার যজ্ঞভূমিতে। মেঘনাদের যজ্ঞ সম্পন্ন হওয়ার আগেই যুদ্ধংদেহী লক্ষ্মণ হাজির হন মেঘনাদের সামনে। ফলে যজ্ঞ অসমাপ্ত রেখেই লক্ষ্মণের সাথে যুদ্ধে অবতীর্ণ হতে হয়েছিল মেঘনাদকে। এবং যুদ্ধের এক পর্যায়ে ইন্দ্রদেব কর্তৃক প্রদত্ব অঞ্জলিকাস্ত্র প্রয়োগ করে মেঘনাদকে বধ করেছিলেন লক্ষ্মণ। আর এভাবেই জীবনাবসান ঘটেছিল এক অতিমহারথী যোদ্ধা মেঘনাদের।

Rate this post

Leave a Reply