You are currently viewing সপ্তর্ষি কি এবং কারা? যুগ, মহাযুগ, মনন্ত্বর, কল্প ও পরযুগের সপ্তর্ষিবৃন্দ || Saptarshi- Seven Sages

সপ্তর্ষি কি এবং কারা? যুগ, মহাযুগ, মনন্ত্বর, কল্প ও পরযুগের সপ্তর্ষিবৃন্দ || Saptarshi- Seven Sages

সপ্তর্ষি কি এবং কারা?

মেঘমুক্ত রাতের আকাশ আমাদের সকলেরই অত্যন্ত প্রিয়। শুক্লপক্ষে উপভোগ্য হয়ে ওঠে চন্দ্রদেবের সোনার জ্যোতি। আর কৃষ্ণপক্ষে কোটি কোটি তারার মিটিমিটি আলো প্রশান্তি জাগায় আমাদের হৃদয়ে। যারা রাতের এই তারাগুলোকে খুব ভালোভাবে খেয়াল করেছেন তাঁরা হয়ত সাতটি উজ্জ্বল তারার একটি যোগসুত্র দেখে থাকবেন। এই তারাগুলোকে সরলরেখায় যোগ করলে একটি জিজ্ঞাসা চিহ্ন বা খড়গের আকৃতি পাওয়া যায়। আর এরাই হলেন সপ্তর্ষি। সপ্তর্ষিগণকে চৈত্র-বৈশাখ মাসের সন্ধ্যায় উত্তর আকাশে খুব উপরে দেখতে পাওয়া যায়। জ্যৈষ্ঠ- আষাঢ় -শ্রাবণে ক্রমেই পশ্চিমে সরে আসেন তাঁরা, ভাদ্র থেকে অগ্রহায়ণ মাস পর্যন্ত উত্তর -পূর্ব আকাশে তাদের আর দেখা পাওয়া যায় না৷আবার পৌষ মাসে সপ্তর্ষিগন উদিত হন উত্তর-পূর্ব আকাশে, তারপর যতই দিন যায় ততই পশ্চিম দিকে সরে যেতে থাকেন তাঁরা৷

তবে এই সাতটি তারার নক্ষত্রমণ্ডলটি শুধুই কি শুধুই মিটিমিটি জ্বলা তারকা? নাকি অন্যকিছু? জানলে অবাক হবেন, পুরাণে আলাদা আলাদা পরিচয়ে পরিচিত করা হয়েছে এই সাতটি নক্ষত্রকে। হ্যাঁ, এরা হচ্ছেন সাতজন ঋষি যারা বিশ্ব সংসারের ভারসম্য রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত।  আবার প্রত্যেক মনন্ত্বরের শেষে এই সপ্তর্ষিও পরিবর্তিত হয়। জানলে অবাক হবেন ১৪টি মনন্ত্বরে মোট সপ্তর্ষির সংখ্যা ৯৮ জন। আসুন জেনে নেওয়া যাক এই সপ্তর্ষিদের উৎপত্তি, কর্ম-দায়ীত্ব ও ভূমিকা সম্পর্কে।

বিষ্ণুপুরাণ বলছে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রচয়িতা প্রজাপতি ব্রহ্মার মন বা মনন থেকে উৎপন্ন সাতজন মহাজ্ঞানী ঋষিদের সমন্বয়ে গঠিত হয় সপ্তর্ষিবৃন্দ। তাঁরা সমগ্র বিশ্বসংসারের ভারসম্য রক্ষায় ভূমিকা পালন করেন এবং গতি প্রকৃতি পর্যবেক্ষণ করেন। এরা জাগতিক সমস্ত কামনা বাসনা এবং মৃত্যুরও উর্ধে। সাধারনভাবে অনেকেই বলে থাকেন এই সাতজন ঋষি বা সপ্তর্ষিগণ হচ্ছেন মহর্ষি জমদগ্নি, মহর্ষি কাশ্যপ, মহর্ষি অত্রি, মহর্ষি বশিষ্ঠ, মহর্ষি গৌতম, মহর্ষি বিশ্বমিত্র, ও মহর্ষি ভরদ্বাজ। তবে অবাক করার মত ব্যাপার হচ্ছে এই সাতজন মহর্ষি কেউই চিরস্থায়ী নন। অর্থাৎ, প্রত্যেক মনন্ত্বর শেষে এই সাতজন মহর্ষি তাঁদের উপর অর্পিত দায়িত্ব সমর্পণ করে পরম ব্রহ্ম বা ব্রহ্মময়ীয়ে লীন হয়ে যান। এরপর শুরু হয় নতুন এক মনন্ত্বর। এই পরবর্তী নতুন মনন্ত্বরে অন্য সাত জন মহর্ষি নতুন করে ভারসম্য রক্ষার দায়ীত্বপ্রাপ্ত হন।

আরও পড়ুনঃ  শ্রীকৃষ্ণের বাম পায়ের নূপুর বড় এবং ডান পায়ের নূপুর ছোট কেন?

এবার এই মনন্ত্বরের ধারনাটি একটু পরিষ্কার করা যাক। সনাতন শাস্ত্রমতে আমাদের চারটি যুগ বিদ্যমান।

  • প্রথম যুগের নাম সত্য যুগ, যার আয়ুষ্কাল বা সময়ের পরিধি ১৭,২৮,০০০ বছর।
  • দ্বিতীয় যুগের নাম ত্রেতা যুগ, যার আয়ুষ্কাল ১২,৯৬,০০০ বছর।
  • তৃতীয় যুগ হচ্ছে দ্বাপর যুগ, যার আয়ুষ্কাল ৮,৬৪,০০০ বছর।
  • এবং চতুর্থ ও আমরা যে যুগে বাস করছি তাঁর নাম কলিযুগ। কলিযুগ চার যুগের মধ্যে সর্বশেষ এবং এর আয়ুষ্কালও সর্বনিম্ন। অর্থাৎ মাত্র ৪,৩২,০০০ বছর।
  • এই সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলিযুগ মিলে গঠিত হয় এক একটি মহাযুগ। এবং এক মহাযুগের আয়ুষ্কাল  ৪৩,২০,০০০ বছর।
  • এরকম ৭১ টি মহাযুগ মিলে অর্থাৎ ৩০,৬৭,২০,০০০ বছর নিয়ে গঠিত হয় এক একটি মনন্ত্বর।
  • আবার ১৪টি মনন্ত্বর নিয়ে গঠিত হয় এক একটি কল্প।

মজার ব্যাপার হচ্ছে এক একটি কল্প হচ্ছে ব্রহ্মার একটি দিন বা রাতের সমান। একটি কল্পের শেষ হলে মহাদেবের নেতৃত্বে আসে প্রলয়। একটি কল্পরাত্র ব্যাপী চলে ধ্বংসযজ্ঞ। অর্থাৎ প্রজাপতি ব্রহ্মা সারদিন ব্যাপী যা গড়েন, দেবাদিদেব মহাদেব তা সারা রাত্রব্যাপী ধ্বংস করেন। এবং পরবর্তী কল্পে তথা পরের দিন ব্রহ্মা আবারও ব্রহ্মাণ্ড রচনায় নিয়োজিত হন। এ যেন শিশুসুলভ ভাঙা গড়ার খেলা।

যাইহোক, এই সুযোগে এক এক জন ব্রহ্মার আয়ুষ্কালও জেনে নেওয়া যাক। দুইটি কল্প মিলে তৈরি হয় ব্রহ্মার একটি রাত ও দিন তথা অহোরাত্র। এরকম ৩৬০ ব্রাহ্ম দিন-রাত বা অহোরাত্র মিলে তৈরী হয় এক ব্রাহ্ম বৎসর। শুনে আশ্চর্য হবেন ব্রহ্মার এক একটি বছর ৩,১১,০৪০ কোটি মানব বছর বা সৌর বছরের সমান। এক এক জন ব্রহ্মার জীবনকাল ১০০ ব্রাহ্ম-বৎসর, এবং এই ১০০ ব্রাহ্ম বছর মিলে গঠিত হয় একটি পরযুগ বলা হয়। একটি পরযুগ শেষ হওয়ার পর একজন ব্রহ্মা বিদায় নেন এবং নতুন একজন ব্রহ্মা পুনরায় ব্রহ্মাণ্ড সৃজনের দায়িত্ব নেন। এ এক অনন্ত চক্র যা বহুকাল থেকে চলমান এবং এই চলমান প্রক্রিয়ায় আজ পর্যন্ত হাজার হাজাড় ব্রহ্মার আগমন ও গমন ঘটেছে।

আরও পড়ুনঃ  বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্রের সংঘাত || রাজা কৌশিক হয়ে উঠলেন ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্র ||

যুগ, মহাযুগ, মনন্ত্বর, কল্প ও পরযুগের সপ্তর্ষিবৃন্দ

এবার প্রত্যেক মনন্ত্বরের সপ্তর্ষিদেরকে জেনে নেওয়ার পালা। আমরা আগেই বলেছি ১৪টি মনন্ত্বরের সমন্বয়ে গঠিত হয় এক একটি কল্প।

১ম মনন্ত্বরের নাম সয়ম্ভুব মনন্ত্বর। এই মনন্ত্বরের সপ্তর্ষিগণ হচ্ছেন-

মহর্ষি মারীচি, মহর্ষি আত্রি, মহর্ষি আঙ্গিরস, মহর্ষি পুলহ, মহর্ষি পুলস্ত্য, মহর্ষি ক্রতু ও মহর্ষি বশিষ্ঠ।

২য় মনন্ত্বরের নাম স্বরোচিষ মনন্ত্বর। এই মনন্ত্বরের সপ্তর্ষিগণ হচ্ছেন-

মহর্ষি উর্যা, মহর্ষি স্তম্ভ, মহর্ষি প্রাণ, মহর্ষি বাত, মহর্ষি পৃশ্ব, মহর্ষি নিরায়া ও মহর্ষি পরিবন।

৩য় মনন্ত্বরের নাম হচ্ছে উত্তম মনন্ত্বর। এই মনন্ত্বরের সপ্তর্ষিরা হলেন মহর্ষি বশিষ্ঠের সাত জন পুত্র। তাঁরা হলেন-

মহর্ষি কৌকুন্ডিহি, মহর্ষি কুরুন্ডি, মহর্ষি দলয়, মহর্ষি শঙ্খ, মহর্ষি প্রবাহিত, মহর্ষি মিত এবং মহর্ষি সম্মিত।

৪র্থ মনন্ত্বরের নাম হচ্ছে তমস মনন্ত্বর। এই মনন্ত্বরের সপ্তর্ষিগণ হচ্ছেন-

মহর্ষি জ্যোতির্ধামা, মহর্ষি পৃথু, মহর্ষি কাব্য, মহর্ষি চৈত্র, মহর্ষি অগ্নি, মহর্ষি বনক ও মহর্ষি পিবর।

৫ম মনন্ত্বরের নাম হচ্ছে রৈবত মনন্ত্বর। এই মনন্ত্বরের সপ্তর্ষিগণ হচ্ছেন-

মহর্ষি হিরণ্যরোম, মহর্ষি বেদশ্রী , মহর্ষি ঊর্ধ্ববাহু, মহর্ষি বেদবাহু, মহর্ষি সুধামা, মহর্ষি পরজন্য ও মহর্ষি মহামুনি।

৬ষ্ঠ মনন্ত্বরের নাম হচ্ছে চাক্ষুষ মনন্ত্বর। এই মনন্ত্বরের সপ্তর্ষিগণ হচ্ছেন-

মহর্ষি সুমেধা, মহর্ষি বিরাজ, মহর্ষি হবিষ্মান, মহর্ষি উত্তর, মহর্ষি মধু, মহর্ষি সহিষ্ণু, ও মহর্ষি অতিনাম।

৭ম বা বর্তমান মনন্ত্বরের নাম হচ্ছে বৈবস্বত মনন্ত্বর। আমরা এই বৈবস্বত মনন্ত্বরে বাস করছি। এবং এই মনন্ত্বরের সপ্তর্ষিগণ হচ্ছেন-

মহর্ষি জমদগ্নি, মহর্ষি কাশ্যপ, মহর্ষি অত্রি, মহর্ষি বশিষ্ঠ, মহর্ষি গৌতম, মহর্ষি বিশ্বমিত্র, ও মহর্ষি ভরদ্বাজ।

৮ম মনন্ত্বরের নাম হচ্ছে সার্বর্ণী মনন্ত্বর। এই মনন্ত্বরের সপ্তর্ষিগণ হচ্ছেন-

মহর্ষি দীপ্তিমান, মহর্ষি গালভ, মহর্ষি পরশুরাম, মহর্ষি কৃপ, দ্রৌনি বা অশ্বত্থামা, মহর্ষি ব্যাস ও মহর্ষি ঋষ্যশ্রীঙ্গ।

৯ম মনন্ত্বরের নাম হচ্ছে দক্ষ সাবর্ণী মনন্ত্বর। এই মনন্ত্বরের সপ্তর্ষিগণ হচ্ছেন-

আরও পড়ুনঃ  রহস্যময় কেদারনাথ মন্দির

মহর্ষি সর্বর্ণ, মহর্ষি দ্যুতিমান, মহর্ষি ভব্য, মহর্ষি বসু, মহর্ষি মেধাতিথি, মহর্ষি জ্যোতিষ্মান, এবং মহর্ষি সত্য।

১০ম মনন্ত্বরের নাম হচ্ছে ব্রহ্ম সার্বর্ণী মনন্ত্বর। এই মনন্ত্বরের সপ্তর্ষিগণ হচ্ছেন-

মহর্ষি হবিষ্মান, মহর্ষি সুকৃত, মহর্ষি সত্য, মহর্ষি তপমূর্তি, মহর্ষি নাভাগ, মহর্ষি অপ্রতিমৌজা ও মহর্ষি সত্যকেতু।

১১তম মনন্ত্বরের নাম হচ্ছে ধর্ম সার্বর্ণী মনন্ত্বর। এই মনন্ত্বরের সপ্তর্ষিগণ হচ্ছেন-

মহর্ষি নিস্বর, মহর্ষি অগ্নিতেজ, মহর্ষি বপুষ্মান, মহর্ষি ঘৃনি, মহর্ষি অরুণি, মহর্ষি হবিষ্মান ও মহর্ষি অনঘ।

১২তম মনন্ত্বরের নাম হচ্ছে রুদ্র- পুত্র সার্বর্ণী মনন্ত্বর। এই মনন্ত্বরের সপ্তর্ষিগণ হচ্ছেন-

মহর্ষি তপস্বী, মহর্ষি সুতপা, মহর্ষি তপোমূর্তি, মহর্ষি তপোদ্ধৃতি, মহর্ষি তপোরতি, মহর্ষি তপোধ্যুতি ও মহর্ষি তপোধন।

১৩ তম মনন্ত্বরের নাম হচ্ছে রুচি মনন্ত্বর। এই মনন্ত্বরের সপ্তর্ষিগণ হচ্ছেন-

মহর্ষি নির্মোহ, মহর্ষি তত্ত্বদর্শী, মহর্ষি নিষপ্রকম্প, মহর্ষি নিরুৎসুক, মহর্ষি ধৃতিমান, মহর্ষি অব্যয় ও মহর্ষি সুতপা।

১৪ তম মনন্ত্বরের নাম হচ্ছে ভৌম্য মনন্ত্বর। এই মনন্ত্বরের সপ্তর্ষিগণ হচ্ছেন-

মহর্ষি অগ্নিবাহু, মহর্ষি শুচি, মহর্ষি শুক্র, মহর্ষি মগধ, মহর্ষি অগ্নিধ্র, মহর্ষি যুক্ত ও মহর্ষি জিত।

এই ছিল ১৪ মনন্ত্বরের ৯৮ জন সপ্তর্ষিগণ। যারা অনাদিকাল থেকে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

5/5 - (1 vote)

Leave a Reply