আমি বিদ্রোহী ভৃগু, ভগবান বুকে এঁকে দিই পদ-চিহ্ন। কাজী নজরুল ইসলামের রচিত বিদ্রোহী কবিতার এই চরণটি হয়ত অনেকেই পড়ে থাকবেন। এখানে ভৃগু নামক এমন একজনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে যিনি এতবড় সুঃসাহসী যে ভগবানের বুকেও পদচিহ্ন একে দেন। সোজা কথায় ভগবানের বুকে পদচিহ্ন একে দেওয়ার অর্থ হচ্ছে ভগবানের বুকে পদাঘাত করা বা লাথি মারা। কিন্তু কে এই দুঃসাহসী ভৃগু যিনি ভগবান বিষ্ণুর বক্ষে পদাঘাত করেছিলেন? ভগবানের বুকে পদাঘাত করা কি এতই সহজ? কি কারনেই বা এই অঘটন ঘটিয়েছিলেন তিনি? তাছাড়া ভৃগুর পদাঘাত সহ্য করে শ্রীভগবানই বা তাঁকে কি ধরণের শাস্তি দিয়েছিলেন বা কেমন প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নিয়েই আমাদের আজকের আয়োজন। আজ আমরা জানব মহর্ষি ভৃগু কেন জগৎপতি শ্রীবিষ্ণুর বুকে লাথি মেরেছিলেন সেই পৌরাণিক কাহিনীটি। আশা করি সনাতনের এই অমূল্য অমৃত আস্বাদন করবেন। তবে শুরু করার আগে কমেন্ট বক্সে একবার জয় শ্রীবিষ্ণু লেখার অনুরোধ রইল।
পদ্মপুরাণ অনুসারে জানা যায়, একদা সরস্বতী নদীর তীরে মহর্ষি কশ্যপের নেতৃত্বে একটি বিরাট বৈদিক যজ্ঞের আয়োজন করা হয়েছিল। পুষ্পিত নদীতীরে নানা রকম উপাচার দিয়ে এবং দূর দূরান্ত থেকে আগত মুনি ঋষিদের নিয়ে শুরু হল যজ্ঞ। বৈদিক মন্ত্রোশ্চারনে এক ঐশ্বরিক আবহ তৈরি হল চারিদিকে। ঘটনাক্রমে সেই যজ্ঞস্থলে হাজির হলেন দেবর্ষি নারদ। ভগবান বিষ্ণুর মহা ভক্ত দেবর্ষি নারদের আগমনে সমস্ত মুনি ঋষিরা উল্লাসিত হয়ে তাঁকে স্বাগত জানালেন এবং সাদরে আসন গ্রহণ করার অনুরোধ জানালেন। এক পর্যায়ে দেবর্ষি নারদ ও ঋষিদের মধ্যে শুরু হল শাস্ত্র আলোচনা। বেদাদি শাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা চলাকালীন সময়ে নারদ প্রশ্ন করলেন, “এই যে যজ্ঞানুষ্ঠানটি সম্পাদিত হচ্ছে এতে আসলে কে সন্তুষ্ট হবেন?” মহর্ষি নারদের এই প্রশ্নে হতভম্ব হলেন উপস্থিত জ্ঞানী গুণী সকল মুনি ঋষিগন। কারন তাঁরা বুঝতে পারলেন এই প্রশ্নের আড়ালে আরও একটি সুক্ষ্ম প্রশ্ন নিহিত রয়েছে। আর তা হল, ত্রিদেব তথা ব্রহ্মা বিষ্ণু ও মহেশ্বরের মধ্যে আসলে কে শ্রেষ্ঠ? স্বভাবিকভাবেই এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া মোটেও সহজ কাজ নয়। তাই বিজ্ঞ ঋষিগণ চললেন মহর্ষি ভৃগুর কাছে।
আপনারা হয়ত অনেকেই জেনে থাকবেন, এই ভৃগু ঋষি ছিলেন অত্যান্ত জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান। তিনি একাধারে সপ্তর্ষিদের একজন, জ্যোতিষ শাস্ত্রে অসামান্য জ্ঞানের অধিকারী, ভার্গব বংশের প্রতিষ্ঠাতা, প্রজাপতি ব্রহ্মার সন্তান এবং ভৃগু সংহিতা গ্রন্থের প্রণেতা। এসকল কারনে যজ্ঞরত ঋষিগণ মহর্ষি ভৃগুকে বেছে নিলেন তাঁদের প্রশ্নের উত্তর খোজার জন্য। সিদ্ধান্ত হল ভৃগু ঋষি সত্বগুণের আলোকে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ তা বিচার করবেন। তো ত্রিদেবের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য মহর্ষি ভৃগু প্রথমেই গেলেন তাঁর পিতা ব্রহ্মার কাছে। ভগবান ব্রহ্মা তখন ধ্যানস্থ অবস্থায় তাঁর চার মুখ দিয়ে চারটি বেদ পাঠ করে চলেছেন। এরপর ভৃগু ঋষি তাঁর পিতাকে কোন প্রকার সম্মান না দিয়ে তাঁর ধ্যান ভঙ্গ করলেন। ব্রহ্মা তাঁর মানসপুত্রের এমন আচরণ দেখে কিছুটা বিস্মিত হলেন। বললেন, “হে পুত্র, আমার নিকটে তোমার আগমনের অভিপ্রায় নিবেদন করো।” ভৃগু ঋষি বললেন, “হে পিতা, আমি একজন ঋষি, কিন্তু আপনার লোকে এসে আমি কোন সম্মান প্রাপ্ত হলাম না। এতে আমি অসন্মানিত বোধ করছি।” পুত্রের এমন স্পর্ধা দেখে ক্রুদ্ধ হলেন ব্রহ্মা। বললেন, “মূর্খ ভৃগু, আমার পুত্র হয়ে আমার আলয়ে এসে আমার কাছে সম্মান প্রাপ্তির কথা বলছ, আমি তোমাকে অভিশাপ দেব।” ভৃগু মুনি তৎক্ষণাৎ স্তব করে ক্রোধ শান্ত করলেন প্রজাপতি ব্রহ্মার। তিনি তাঁর পুত্র হওয়ার সুবাদে ক্ষমা প্রার্থনা করলেন ব্রহ্মার কাছে। প্রজাপতি ব্রহ্মাও তাঁকে নিজের পুত্র বিবেচনা করে তাঁকে অভিশাপ দেওয়া থেকে বিরত থাকলেন। তবে তাঁকে এই বলে সতর্ক করলেন যে, ভবিষ্যতে যদি এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে তাহলে তিনি তাঁকে অবশ্যই অভিশাপ দেবেন।
এরপর পিতার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মহর্ষি ভৃগু চললেন দেবাদিদেব মহাদেবকে পরীক্ষা করতে। তখন দূর্গম কৈলাস পর্বতের শিখরে তুষার বেষ্টিত হয়ে ধ্যানমগ্ন হয়ে আছেন দেবাদিদেব মহাদেব। আর বাইরে প্রহরায় ব্যাস্ত নন্দী মহারাজ। ভৃগু ঋষি নন্দী মহারাজকে বললেন তাঁর দেবাদিদেবের সাথে সাক্ষাতের অভিপ্রায়। কিন্তু আপত্তি করলেন নন্দী মহারাজ। তিনি বললেন, “শ্রীভোলানাথ এখন গভীর সমাধিতে লীন। এখন কোনভাবেই তাঁর ধ্যান ভঙ্গ করা উচিত হবে না।” নন্দী মহারাজের এমন প্রবল আপত্তির সত্বেও মহর্ষি ভৃগু নাছোড়বান্দা। তিনি শিবের সাথে সাক্ষাৎ করার জন্য বাদানুবাদে লিপ্ত হলেন নন্দীর সাথে এবং সবশেষে নন্দীর বাঁধা উপেক্ষা করে উপস্থিত হলেন ধ্যানরত মহাদেবের কাছে। পরিকল্পনা মোতাবেক, তিনি এবারও অনেক কর্কশভাবে ধ্যান ভঙ্গ করলেন শিবের। প্রকৃতিস্থ হয়ে শিব জিজ্ঞাসা করলেন, “হে মুনিবর, দয়া করে আপনার আগমনের হেতু আমাকে জ্ঞাত করুন।” উত্তরে আরও কর্কশভাবে ভৃগু ঋষি বললেন, “হে মহাদেব, আমি শুনেছি আপনার দরজা নাকি সকল মুনি ঋষিদের জন্য সার্বক্ষণিক খোলা। কিন্তু আজ আমি আপনার কাছে আসার সময় নন্দী মহারাজ কর্তৃক কি আমাকে বাঁধা দেওয়া হয় নি?” ঋষির এমন উত্তপ্ত বাক্য শুনে শিব তাঁকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু ভৃগু তাঁর পরিকল্পনা মাফিক মহাদেবের সাথে উচ্যবাচ্য করেই চললেন। এক পর্যায়ে ক্রোধের উদ্রেক হল দেবাদিদেবের। তিনি তাঁর ত্রিশূল হাতে নিয়ে উদ্যত হলেন ভৃগু ঋষিকে বধ করার জন্য। এমন সময় ঘটনাস্থলে ছুটে এলেন মাতা পার্বতী। তিনি অনুনয় করে থামালেন শিব ও তাঁর ত্রিশূলকে। রক্ষা পেলেন ভৃগু। শিবের ত্রিশূল থেকে নিস্তার পেয়ে ভৃগু এবার চললেন জগৎপতি শ্রীবিষ্ণুর কাছে।
বৈকুন্ঠে শ্রীবিষ্ণু তখন শেষনাগের উপর শয়ন করে যোগনিদ্রায় রত। আর তাঁর পাশে বসে তাঁর পদসেবা করছেন দেবী শ্রীলক্ষ্মী। এমন সময় সেখানে উপস্থিত হলেন মহর্ষি ভৃগু। ব্রহ্মা এবং শিবের মত তিনি এবারও শ্রীবিষ্ণুর সাথে তাঁর কর্কশ আচরণ শুরু করলেন। উদ্দেশ্য শ্রীবিষ্ণুকে উত্তেজিত করা। কিন্তু বহুক্ষণ চেষ্টা করেও তিনি শ্রীবিষ্ণুর মনোযোগ আকর্ষন করতে পারলেন না। শ্রীবিষ্ণু ভৃগুর আলাপচারিতায় নূন্যতম কর্ণপাত না করেই নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে রইলেন বরাবরের মত। ভৃগু মুনি তাঁর কর্কশ আচরণ দ্বারা এবং অপশব্দের প্রয়োগ করেও যখন বিষ্ণুর নিদ্রাভঙ্গ করতে পারলেন না তখন তিনি এক অঘটন ঘটিয়ে বসলেন। অঘটনটি হচ্ছে তিনি ঘুমন্ত শ্রীবিষ্ণুর বুকে প্রবলভাবে পদাঘাত করেন এবং তাঁর যোগনিদ্রা ভঙ্গ করার চেষ্টা করেন। শ্রীবিষ্ণুর বুকে লক্ষ্মীর আবাস। ভৃগু মুনি সেখানে সজোরে পদাঘাত করায় ঘুম ভাঙল শ্রীবিষ্ণুর। ভৃগু মুনি ভাবলেন, এবার হয়ত তাঁর আর রক্ষা নেই। কারন তিনি লক্ষ্মীপতির বক্ষে পদচিহ্ন একে দিয়েছেন। কিন্তু নিদ্রাভঙ্গ হওয়ার পরেও নারায়ণ নির্বিকার। তিনি ভৃগু মুনির পা ধরে কোমলভাবে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, “হে মুনিবর, আমার বক্ষে পদাঘাত করার ফলে আপনি যদি আপনার পায়ে পীড়া বা ব্যাথা অনুভব করে থাকেন তাহলে আমি দুঃখিত। ” উল্লেখ্য, ভৃগুমুনির পায়ে তাঁর একটি তৃতীয় নয়ন ছিল। এই নয়ন মূলত ক্রোধ, হিংসা, অহংকার ও অধর্মের প্রতীক। শ্রীবিষ্ণু মুনির পায়ে হাত বোলাতে বোলাতে সেই চক্ষুতে আলতো একটি চাপ প্রয়োগ করলেন। ফলে অহংকার নাশ হল ভৃগু মুনির। তিনি লুটিয়ে পড়লেন জগৎপতি শ্রীনারায়নের চরণতলে। বললেন, “হে প্রভু, আমাকে ক্ষমা করবেন, আমি সত্বগুনের আলোকে ত্রিদেবকে পরীক্ষা করতে গিয়ে আপনার প্রতি হয়ত একটু বেশীই অবিচার করেছি। কিন্তু তা সত্বেও আজ আমি সন্দেহাতীতভাবে বুঝতে পেরেছি ত্রিদেবের মধ্যে আসলে কে শ্রেষ্ঠ।” উত্তরে শ্রীবিষ্ণু ভৃগুকে বললেন, “হে মুনিবর, আমাকে পদাঘাত করার জন্য আপনার দুঃখী হওয়ার কারন নেই কারন আপনার এই কৃতকর্মের মধ্যে একটি মহান উদ্দেশ্য লুকিয়ে ছিল। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি আজ থেকে আমার বুকের যেখানে আপনি পদাঘাত করেছেন সেখানে আমি সারাজীবন আপনার পদচিহ্ন বহন করব। ” সেই থেকে শ্রীবিষ্ণুর বুকে ভৃগু মুনির পদচিহ্ন আঁকা রয়েছে। আপনারা অনেকেই হয়ত খেয়াল করে থাকবেন শ্রীকৃষ্ণ বা গোপালের বিগ্রহতে অনেক সময় একটি ছোট্ট পায়ের চিহ্ন দেখতে পাওয়া যায়, এটি আসলে সেই মহর্ষি ভৃগুরই পায়ের চিহ্ন।
তবে সবশেষে একটি কথা না বললেই নয়, আর তা হল পৌরাণিক কাহিনীগুলো লেখা হয়েছিল অনেকটা রূপকভাবে। যার আড়ালে লুকিয়ে আছে একটি অন্যরকম সত্য। পুরাণে ত্রিদেবের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব বিচার সংক্রান্ত অনেক কাহিনীই লক্ষ্য করা যায়। এর মধ্যে কোনটিতে ব্রহ্মাকে শ্রেষ্ঠ বলা হয়, কোনটিতে বিষ্ণুকে আবার কোনটিতে মহেশ্বরকে। তবে প্রকৃত বিচারে এই ত্রিদেব হচ্ছেন নির্গুণ পরম ব্রহ্মের সৃষ্টি, স্থিতি, লয় বা স্বতঃ রজঃ ও তম গুণের প্রকাশ। এবং সত্যিকার অর্থে তাঁরা এক ও অভিন্ন স্বত্বা।